শ্যামশ্রী
রায় কর্মকার
ভীষণ বৃষ্টি এলে
ভীষণ বৃষ্টি এলে হাতদুটি পেতে
জল বিঁধে যাওয়া আমি দহগহনের মতো
স্থির হয়ে থাকি
উত্তরের জলধারা দক্ষিণে গড়ায়
জুলাইয়ের ভিজে বুক খুলে মধু শুষে
নেয় কদমের গাছ
আমার চিবুক আর নদীর চিবুক
রূপালী মায়ার দাগে মিশে যায়
কুয়াশায়
ব্রিজে গা এলিয়ে দিয়ে একদল সোনাবতী পাট
স্নাত হরিণীর ঢঙে উচাটন মেখে
শুয়ে থাকে
নাভির কনক বেড়ে ছায়াপাড় শাড়ি
এই ওঠে,এই মৃদু খসে
যায়
মাঠে ঘাটে ঠাকুরের থানের উপরে
স্নান সেরে ফিরে আসা মায়ের চুলের মতো এলো মেঘ থেকে
টুপটাপ মোহ ঝরে ভিজে যায় কলমীর
বন
মনে হয় হাত গামছায় তার খোঁপা
বেঁধে রাখি
আমার পিঠের চালে জল কেঁপে ওঠে
ফুটে ওঠে চুমো খায় এঁকেবেঁকে নেমে আসে এখানে ওখানে
সারাদিন সারারাত কানের ভিতর এক
মধুর শব্দ বাজে
তোমার নামের মতো গোপন শব্দ বাজে
কাঁচাবাড়ি তিসিখেত পোটোপাড়াটির
এক মাটির কাঠাম হয়ে
আমি ভিজে যাই
নামের শব্দ শুনে ভ্রমে ভিজে যাই
একেবারে
চন্দন মেঘের ঘরে
একদিন
কয়েক পৃষ্ঠা অপূর্ব বিভাবরী লিখব
তোমার জন্য
গড়ে তুলব চন্দনমেঘচিহ্নিত একটি
ঘর
ঋতুমতী গাছগুলি তোমার চোখের দিকে
অপাঙ্গে তাকাবে
রূপসী নক্ষত্র তার আঙুল ডুবিয়ে
দেবে কাকচক্ষু জলে
তারপর?
তারপর বৃষ্টি নামবে
তোমার পায়ের দাগ ফুটে উঠবে
অনাবৃত জুনের ভিজে থাকা পিঠে
ল্যাম্পপোস্টের শরীর বেয়ে নেমে
আসবে অঝোর বিন্দু আলো
তোমাকে ভিজিয়ে দেবে আপাদমস্তক
তোমাকে দেখে
প্রাচীরের প্রশস্ত কাঁধে ঝুঁকে
পড়বে কদমফুল
রান্নাঘরের ওভেনে নীল হয়ে জ্বলে
উঠবে আমাদের নিভৃত আগুন
রুগ্ন গানপাগল চাঁদ দাঁড়িয়ে পড়বে
তেজপাতা গাছের পিছনে
আমাদের প্রণয়ের ভাষা লেখা থাকবে
হরিণীবৃন্দের নাভিকূপে
কয়েকটি শতাব্দী জুড়ে সুগন্ধ
ছড়াবে
ইছামতী
পড়ন্ত বিকেলে এসে নদীটির ধারে
দাঁড়াতেই
প্রত্যক্ষ করলাম অপরূপ
ক্ষীণতনু ইছামতী উঠে এল মেঘের
চাতালে
চাঁদের ওপারে গিয়ে উন্মোচিত করলো
তার যৌবন
জ্যোৎস্নায় জেগে উঠলো তার কুমারী
সাজের জল
সে জলে ডোবালে হাত পুড়ে যায়
হু হু করে ডাক দেয় চিত্রময় তরল
আগুন
নদীর খোঁপা খুলে ঝরে পড়ল গন্ধরাজ
আদিম মাঝির পিঠ ছুঁয়ে গেলো তার
এলো চুল
মাঝি নোঙর খুলে ভাসিয়ে দিল তার
নৌকা
বাদামি যুবকবৃন্দ অবিরাম মন্ত্র
পড়লো গুপ্তপুঁথি থেকে
নদী তার বিম্ববতী ঠোঁট ভীষণ শ্রাবণে রেখে দিতেই
আষাঢ়ের স্পৃহা কেঁপে উঠলো ,
কেঁপে উঠলো ছায়ার স্তব্ধতা
রক্তিম হয়ে উঠলো
মোহাতুর চাঁদ
তীরবর্তী গাছের কোটরে জমা হল
বিন্দু বিন্দু রূপকথা
কোথায় কী ঘটে যায়
আচমকা রোদ কেঁপে ওঠে
শিহরিত জল থেকে
কাদাগুল্মে মাখামাখি উঠে আসে
কঙ্কাল করোটি
ব্রহ্মদেশের মাটি আঙুলে আঁকড়ে
থাকা রোহিঙ্গা যুবক
রক্তমাখা বস্ত্র ধোয় গাঙুরের জলে
পূর্বপুরুষের ছায়া ছেঁড়া
চাঁদোয়ার মতো মাথার উপর
নড়বড়ে খুঁটি থেকে ঝুলে থাকে
পতনোন্মুখ
কুটিল ভ্রুকুটি ফুঁড়ে
ব্রহ্মাস্ত্র নেমে আসে বরাকের পাড়ে
অলীক নীলের নীচে মৃদু ঘর,
ধানি গোলা , জোয়ারের
ক্ষেত
কোথায় হারিয়ে যায়,বলতে পারি না
কেউ
ভিতরে শিকড় কাঁপে
নম্র ছায়ার বনে অঘটন পটিয়সী
মায়াবী আপেল
ভুলে যায় জ্ঞানবৃক্ষ হতে
আমরাও ভুলে যাই দেশের মানুষ নাকি
মানুষের দেশ
নীরবতা ভেদ করে ভেঙে পড়ে
মানবতাবাদ
প্রতিটি টুকরো থেকে ধোঁয়া ওঠে
স্বাক্ষর পাপের
মাতৃক্রোড়চ্যূত শিশু ন্যূব্জপিঠে
বয়ে চলে জিরো টলারেন্স
অবচেতনের থেকে লুটপাট হয়ে যায়
পরিবার শব্দটি
এবার আশ্বিনে
মেঘের ছায়ার নীচে ঠোঁট ডুবিয়ে
দিলো পাখিটা
কী আশ্চর্য তুঁত রঙ ওর ডানায়
মাছরাঙা পাখি দেখলেই
আমার চোখের ভিতরে তিরতির করে
মেঘের পালক
ঘুমের গায়ে জড়িয়ে আসে মহালয়ার
সুর
যা দেবী সর্বভূতেষু মন্ত্র বাজতে
থাকে দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামে
আকাশে ছড়িয়ে যায় অভিমানিনী
পার্বতীর নীলাভ কাজল
আশ্বিনের কোল আঁচলে লুকনো
প্রেমের গন্ধ আছে
বুকে ঢিপঢিপ ঢেউ, তোলপাড়, মৃদু ভাঙচুর
এই দ্যাখো না
কেমন কলকে ফুলের মতো রোদ এসে
ছুঁয়ে যাচ্ছে তোমার পিঠ
আশ্বিন এলেই তোমাকে এমন মায়াবী
মনে হয়
চোখের মণিতে জলনৌকা বায়
বুকের ভিতর ঘুঘু ডাকে ঘুরুর ঘুর
তোমার হাত ধরে হেঁটে যেতে ইচ্ছে
করে একলক্ষ বছর
কলকাতার ফুটপাথে, প্যাণ্ডেলে
প্যাণ্ডেলে, ঢাকের
আওয়াজে
ভীড়ের মধ্যে একলা হয়ে আমরা দুজন
নবমীর বিকেল শেষ হয়ে এলো
সূর্য এখন মায়ের টিপের মতো লাল
খালপাড়ে ওই মনখারাপ রঙের বাড়িটা
দ্যাখো
কেমন থম হয়ে বসে আছে
বাড়িটার বুক ঘেঁষে কতো কাশ ফুল
কেমন উলুকসুলুক মাথা দোলাচ্ছে
হাওয়ায়
ও বাড়ির জেঠিমা সন্ধ্যা হলে যখন
বাগানে বসে থাকেন
ওনার মাথার ওপর ঝিরঝির করে প্রাচীন আমলকি গাছের পাতাগুলো
বোধহয় ভাগ করে নিতে চায় পুরনো
দিনের স্মৃতি
পুজো এলে কাউকে এমন নিঝঝুম একা
থাকতে দিতে নেই
ছোটবেলায় কত লুকোচুরি খেলেছি
ওদের বাগানে
মনে পড়ে তোমার?
চলো না যাই দু'জনে
ঢাকের আওয়াজ শুনি ও বাড়ির
বারান্দায় বসে
ওনার হাতে তুলে দিই একটা ধানরঙা
ধাক্কাপাড় শাড়ি
ফেরার পথে এক আঁজলা শিউলি কুড়িয়ে
দেব তোমাকে
ভীষণ শিউলি ঝরে গলিটার মুখে
পায়ের তলায় থইথই করে সুগন্ধ
ভাবছি, এই পাড়াটার
নাম রাখব বনশিউলিপুর
আর ওই বাড়িটার নাম নীলাঞ্জন