সম্পাদকের
কলমে
সাহিত্যচর্চার
প্রচলিত মাধ্যমের বাইরে এই যে ইনটারনেট ভিত্তিক কাব্যসাহিত্যচর্চার এক বিস্তৃত
দিগন্তের উন্মোচন ঘটে গিয়েছে, অনেকেই এর কুফল নিয়ে যতটা বেশি চিন্তিত, এর সুফল
নিয়ে ততটা বেশি ভাবেন না। এ কথা ঠিকই যে ইনটারনেট ভিত্তিক সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে
সাহিত্যিক উৎকর্ষতার মান কখনোই বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। যদিও সেই ঠিক একই কথাও বলা
যেতে পারে সাহিত্যচর্চার চিরায়ত মাধ্যমের ক্ষেত্রেও। সেক্ষেত্রও বটতলার সাহিত্যের
ঐতিহ্য যথেষ্টই সুপ্রাচীন। মাধ্যম যাই হোক না কেন, সাহিত্যিক উৎকর্ষতার নিরিখেই
সাহিত্য কালোত্তীর্ণ হবে বা হবে না। সাহিত্যের এই কালোত্তীর্ণ হওয়া বা না হওয়া
মাধ্যমের উপর নির্ভর করে না। করে সাহিত্যিকের মেধা ও মননের উৎকর্ষতার উপর, তাঁর
শিল্পবোধের মুন্সীয়ানার উপর। সর্বপরি তাঁর জীবনবোধের গভীরতা ও শিল্পসত্ত্বার
উদ্বোধনের উপর। কোন মাধ্যমে তিনি সাহিত্যচর্চা করলেন সেটা গৌন বিষয়। অনেকেই এই বিষয়ে ততটা সচেতন নয়। আমাদের অধিকাংশেরই আজীবনের
ধারণা, ছাপাখানা ঘুরে দুই মলাটের ভিতর বন্দী না হলে সাহিত্যের উৎকর্ষতার প্রমাণ হয়
না। বস্তুত এমন ধারণা করার কোনই যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। বিশেষত আজকের
আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয় সাহিত্য বাজারের রীতিনীতিতেই। সারা বছর ধরে কত যে অপাঠ্য
বইয়ের প্রকাশ ঘটে তার হিসাবই বা কে রাখে। ফেল কড়ি মাখো তেলের এই যুগে পকেটের পয়সা
ঢাললেই যে কেউই যা খুশি লিখে এক আধটা বই ছাপিয়ে প্রকাশ করে ফেলতে পারে। সত্যি কথা
বলতে কি অধিকাংশ ছোট ও মাঝারি প্রকাশনাই লেখকের টাকায় বই ছাপিয়ে ব্যবসা করে থাকে।
একথা কে না জানে। আর সেখানেই প্রকাশকের লাভ। ক্ষতির দায় পুরোটাই লেখকের। ফলে বই
ছাপা হলেই যে তার সাহিত্যিক উৎকর্ষতা প্রমাণিত হবে বিষয়টা কিন্তু আদৌ তেমন নয়। তাই
এরই অনুসিদ্ধান্তে একথাও বলা যেতে পারে ছাপাখানার চৌকাঠ না পেরোলেই যে সাহিত্যিক উৎকর্ষতা
অপ্রমাণিত হবে, বলা যায় না সেই কথাও।
ইনটারনেট
ভিত্তিক সাহিত্যচর্চার মধ্যে দিয়ে ঘটে গিয়েছে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশের এক
যুগান্তকারী পরিবর্তন। ইনটারনেটর আসার আগে কেবলমাত্র ছাপাখানা ভিত্তিক
সাহিত্যচর্চার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ পরিসরে অনেক সুপ্ত প্রতিভাই বিকশিত হয়ে ওঠার সঠিক
পরিবেশ ও সুযোগ পায়নি। ইনটারনেট বিপ্লবের হাত ধরে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের এক অসীম
সম্ভাবনার দরজা খুলে গিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই সাহিত্যচর্চার সামগ্রিক পরিসরের উপর
এর সদর্থক প্রভাব পড়তে বাধ্য। যাঁর চিন্তিত হয়ে বলেন, ইনটারনেটের ফলে
সাহিত্যচর্চার দিগন্তে মধ্যমেধার বাড়বাড়ন্তই ঘটতে চলেছে, তাঁরা হয়তো খেয়াল করেন
না, সাহিত্যচর্চার চিরকালীন আবহমানতায় মধ্যমেধার বাড়বাড়ন্ত চিরকালই ছিল, থাকবে।
সমকালে কত জনপ্রিয় লেখক কালের হাত ধরে হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। এটাই তো
সাহিত্যের ইতিহাস। তাই সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যমেধার উপস্থিতিও এক শাশ্বত সত্য। তার
মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসেন যুগান্তকারী সব সাহিত্যিক, মহাকালের দিগন্তে যাঁদের শাশ্বত
উপস্থিতি আলো দিতে থকে নিরন্তর। ফলে ইনটারনেট ভিত্তিক সাহিত্যচর্চার দিগন্তেও যে
একই ঘটনা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে?
তাই
নেটভিত্তিক সাহিত্যচর্চার দিগন্তে নাকউঁচু স্বভাবের যাঁরা, তাঁরা যতই বিরুদ্ধ
সমালোচনায় বিদ্ধ করুন না কেন, সাহিত্যচর্চার এই নবদিগন্তের পরিসর দিনে দিনে
সাহিত্যচর্চার সামগ্রিক পরিসরকেই বিস্তৃততর ও সমুন্নত করে তুলবে। এই বিষয়ে সন্দেহ
নাই কোন। হ্যাঁ একথাও একই সাথে সত্য, অনেক বেশি করে অসাহিত্যের স্তুপও বোঝাই হচ্ছে
প্রতিদিন। কিন্তু সাহিত্যের প্রচলিত ঘরানার মানুষজন যত বেশি করে নতুন এই নেট
মাধ্যমকে আপন করে নিতে পারবেন, ততই সাহিত্যের পক্ষেও মঙ্গল। ভালো রসদ হাতের কাছে
পেতে থাকলে, পাঠকের রুচি ও সাহিত্যবোধও উন্নত হতে থাকবে দ্রুত। ফলে অসাহিত্যের
স্তুপকে তখন দুহাত দিয়ে সরানোও সহজ হয়ে উঠবে। এই সহজ সত্যটুকু যত বেশি মানুষ
তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারেন, ততই মঙ্গল সাহিত্যের পক্ষে।
তাই মধ্যমেধার বাড়বড়ন্তের বিরুদ্ধে সাহিত্যচর্চার দিগন্তকে
আরও বেশি করে উৎকর্ষতার পরিপুষ্টি দিতেই যে কোন মাধ্যমেরই সুসাহিত্যিকদের একজোট
হয়ে হাত মেলানোর প্রয়োজন রয়েছে। অর্থাৎ সেই নাকউঁচু মনোভাবের ঘেরাটোপে নিজেকে
বন্দী করে না রেখে সকলেরই উচিৎ, নতুন এই নেট মাধ্যমকে সাদরে বরণ করে নেওয়া। তাতে
করে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতার দিকটিও সুরক্ষিত থাকবে। পাঠকের রুচির উন্নতিতেও সহায়ক
হবে। সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যের মানও অনেক বেশি উন্নত হয়ে উঠবে। আর কবিতাউৎসবের
মধ্যে দিয়ে আমরা ঠিক এই লক্ষ্যকেই মাথায় রেখে এগিয়ে চলতে চাইছি। ঠিক সেই কারণেই
দুই বাংলার সকল কবিসাহিত্যিকদেরকেই আমাদের আন্তরিক আমন্ত্রণ, কবিতাউৎসবে যোগ
দেওয়ার জন্যে। ইনটারনেট ভিত্তিক সাহিত্যচর্চার এই নবজাতক মাধ্যমটিকে উৎকর্ষ করে
তোলার দায় ও দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলেরই। সাহিত্যচর্চা যে আর শুধুই ছাপাখানার
সীমাবদ্ধ পরিসরে পুষ্ট হয়ে উঠতে পারে না, তার সামনে যে আজ এক বিপুল সম্ভাবনার দরজা
খুলে গিয়েছে, পরিপুষ্ট করে তুলতে হবে সেই সম্ভাবনার বিস্তৃত দিগন্তকেই; বুঝতে হবে
সেইটি। নতুন এই বিস্তৃত দিগন্তের অসীম সম্ভাবনার কথা উপলব্ধির দরকার আছে আমাদের
সকলেরই। আর সেই দায় ও দায়িত্ব মাথায় নিয়েই মাসিক কবিতাউৎসবের আয়োজনে অন্যান্য
বারের মতোই আমাদের এবারে নিবেদনে দুই বাংলার কবিদের দুইশাতাধিক কবিতার বিপুল
সম্ভার।