শান্তা
মুখোপাধ্যায়
আমি রোহিঙ্গা নারী
টলোমলো পায়ের কপালে বুলেট
সোহাগ চিহ্ন আঁকে!
ছুট ছুট ছুট সাগর পাহাড়
ওখানে মৃত্যু ডাকে।
পেরিয়ে এসেছি আদিগন্ত জল
সামরিক বাহিনী,
কত শত প্রাণ লাশ হল তার
হিসাব রাখিনি।
জলে ভাসে লাশ, বারুদের
ত্রাস
আপাদমস্তক ঢাকে-
সফর মৃত্যু মুখর, কবর
কবরের খোঁজ রাখে।
শেখা হয় নি কাগজে কলমে
আমার মাতৃভাষা,
বারবার আমি মা হয়েছি
বুকে নিয়ে এই আশা-
আমার সন্তান সম্বল হবে
বাড়াবে গণের শক্তি,
মাটির জন্য লড়াই করবে
হোক না রক্তারক্তি!
বুলেট এসে এঁকেছে যখন
কপালে সোহাগ চিহ্ন
প্রিয় চোখদুটো খুবলে নিয়েছে
ধড় থেকে মাথা ছিন্ন...
পারিনি থাকতে ঘেরাটোপ ঘিরে
হৃদয় উপড়ে নেমেছি রাস্তায়
কত শত মুখ মিছিলে চলেছে
দিন যায় আর রাত যায়।
পথে যেতে যেতে ইজ্জতটুকু
ছড়িয়েছে শ্মশানের খই,
তারা গলে পড়ে চাঁদ খেয়েছে
আমি শুধু জেগে রই।
বারজাখ থেকে জেগে উঠে মুখ
আমার সঙ্গে চলেছে...
চিতার আগুনে হাতদুটো সেঁকে
মশালগুলো জ্বেলেছে।
টুঁ শব্দটি কোর না কো তবু
মৌনমিছিলে চল
শান্তিবিজয়ী রাষ্ট্রনায়িকার
ঘুম কাড়া যায়? বল?
মরিনি আজও মারী ও মড়কে
প্রবল মৃত্যু ঝঞ্ঝায়...
অনাহারী চাঁদ মৃত্যুর ফাঁদ
এড়িয়ে কিভাবে দিন যায়!
হিমজল ডাকে সাঁতরাতে তাকে
ঠিকানা অনির্দেশ,
বাঁচার তাগিদ মনে আনে জিদ
শক্তি অনিঃশেষ।
তবু কথা দিই,
তবু কথা দিই
পাই যদি আমি পা রাখার জমি,
একমুঠো ভাত নিরাপদ রাত
আজও কবিতা লিখতে পারি,
'দেশ' শব্দের
মানে ভুলে যাওয়া
আমি রোহিঙ্গা নারী।।
খুদা হাফেজ
অঘ্রাণের বিকেল অন্তিম শয্যায়
শয়ান।
হালকা কুয়াশার চাদর ঢেকে
দিচ্ছে সব।
ঠোঁটে চোখের কোনে বেদনার গাঢ়
ছায়া-
যে কোনও মুহূর্তে নেমে আসতে
পারে
টুপ্টাপ ছন্দে।
কবরের অন্ধকারে নেমে যাবার
আগে
কলিজার রক্তটুকু অঞ্জলি দেয়
আকাশকে।
নিরুচ্চার হয়ে ওঠে চরাচর-
শব্দহীনতা ঢেকে দেয় ব্যর্থতার
ডানা ঝাপটানি।
খুদা হাফেজ।
বঙ্গভাষা- কোকনদ
ছল ছল বয়ে চলে স্বচ্ছতোয়া নদী,
স্বেচ্ছা উপবাসে যথা ক্ষীণতনু
নারী।
পথিপার্শ্বে গাঢ় ছায়া - দীর্ঘ
মহীরূহ,
অপেক্ষমাণ উচ্চারিতে
"দাঁড়াও পথিকবর।"
পথিকের পরিক্রমা ও পথে নয়
আজি।
সেই শোকে বাতাস হাহাকারে বয়,
প্রতিদিন দিনমণি অস্তমিত হয়।
"রেখো মা
দাসেরে মনে", মনে রেখেছেন মাতা,
সন্তান ভুলেছে তাকে, পরিত্যক্ত
তরণী যথা।
বিস্মৃত আজ সেই অপ্রমেয় যৌবন,
বঙ্গভাষা ছেনে কেটে সৃষ্টির
ক্ষণ।
মেঘনাদে দিলা যিনি নরোত্তম
স্বর
কাব্যলক্ষ্মী দিলা যারে
সর্বোত্তম বর,
সুসজ্জিতা বঙ্গভাষা নবতনু লয়ে
স্বর্গীয় কাব্যভাবে পারিজাত
হয়ে
প্রস্ফুটিলা বঙ্গজনমনে -
অমলিন,
শতাব্দী পার করে সেই স্বর
ক্ষীণ!
হে ক্ষণজন্মা
শ্মশ্রূগুম্ফধারী
আর একবার বঙ্গভাষা রঙ্গমঞ্চে
অবতীর্ণ হও। ধরিয়া শানিত
তরবারি
মুক্ত কর ভাষামাঝে
পঙ্কক্লেদভার।
ঝাড়ি ধূলা বঙ্গসন্তান স্মৃতির
পুনঃপ্রতিষ্ঠা কর আপনার কৃতির।
অচর্চিত অবহেলা অবসিয়া এবে
বঙ্গভাষা কোকনদ আবার ফুটিবে।।
মনসিজ
রাত্রি মধ্যযামে উঠে বসি,
আলুলায়িত কুন্তল আমার ...
দু'চোখে গভীর
উৎকণ্ঠা...
ঘুমন্ত সন্তানদের দিই চুম্বন
চিহ্ন,
অপাঙ্গে দেখতে থাকি একা...
দেখি অপুষ্টিতে শীর্ণ
দেহ......
সর্বাঙ্গে বুলাই
কল্যাণহস্ত......
উচ্চারণ করি স্বস্তিবচন......
ওদের মঙ্গলকামনায়।
রাত্রি বয়ে চলে আগামীর দিকে।
হোক, রোগা ভোগা
ছেলেরা আমার
দিই সমুদ্র গভীর ভালোবাসা,
মনসিজ সন্তান আমার
দিগন্তে এনেছে মুক্তির ভাষা।
রাজবস্ত্র
রাজার কাপড় কোথায়
আজ
প্রশ্ন অবান্তর,
একাল গিয়ে সেকাল এল,
রাজা
অনন্তর
সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর
বস্ত্র
পরেন অঙ্গে,
লোকলস্কর ঢাল তলোয়ার
সবই
আছে সঙ্গে।
রাজার বস্ত্র সূক্ষ্ম অতি,
তাকে
চর্মচক্ষে
দর্শন করা কঠিন অতি
সাধারণের
পক্ষে।
তাই দেখা না গেলেও আছে ঠিকই
রাজার
অঙ্গশোভা,
রাজার কাপড় কোথায় বলা
কবিরা
সব বোবা।
রাজার কাপড় জরুরী নয়,
এটা
বোঝাই ভাল,
রাজার উঠোন হয় না বাঁকা
উঠোন
ভরা আলো।
রাজার কাপড় যে সব প্রজা
পায়
না দেখতে চোখে,
লজ্জা তারই, লজ্জা
তারই
সেই
লজ্জার ঝোঁকে
নিমীলিত নেত্রে থাকেন
সে
সব সাধারণ,
চক্ষু কর্ণ করলে বিবাদ
জিভকে
করেন বারণ।