রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৮

অদিতি চক্রবর্তী



অদিতি চক্রবর্তী

তাসের দেশ

তেমন করে বলতে পারো দিব্যি গিলে
আড়াল করা কথার পিছু পা পিছলে
কিন্তু,কেন,যদি,এসব ধাঁধার মাঝে
ছোঁয়াচ হয়ে লেগে আছো সকাল সাঁঝে
মর্জি মতো রাত লিখছো ললিত রাগে
পলাশ এরপরেও কি ফুটবে বাগে?
বুকের গোপন পলেস্তারায় নিকিয়ে মাটি
আমিও তো ভান করতে পারি তুলসী কাঠি
জলপ্রপাতে বাঁধ ভাঙা  কয়েক প্রহর
উপদ্রুত এলাকাজুড়ে জাগায় বাসর
হাঁটার পথে পলিমাটি গোলাপ ফোটায়
পিপাসা তার পাতকুয়োতে পদ্ম বোঁটায়
মাইলফলকে এতোলবেতোল সতেরো ক্রোশ
টেক্কা তাসের মেম আমি আর সাহেবের দোষ?





কবিতীর্থ জোড়াসাঁকো

মনে করো আবার তুমি জন্ম নিলে রবি ঠাকুর,
জন্মালে এই কলিকালে
কিন্তু তোমার সাবেকী সেই মাথার ব্যামো
নাচছে তেমন তাল বেতালে।
দেখছো তোমার বন্ধু স্বজন সবাই কেমন কাগজ ভুলে
একটু খানি সময় পেলেই মোবাইল স্ক্রিনে দশ আঙুলে
ডাইনে, বাঁয়ে,উপর,নীচে,একটু আগায়,একটু পিছে
ওমনি তোমার বায়না মতো তোমার হাতেও সেই যন্তর
তুমিও তাতে পুরতে চেয়ে তোমার যত ছুঃমন্তর,
এগিয়ে এলে।
কোন নামেতে লিখবে এখন?
তোমার গুণের বিবিধ বিষয়,
যদিও পাঁচটি সদস্য পদ এমনকিছুই সমস্যা নয়
পাঁচ নামে সেই পাঁচ বিষয়ের খুললে খেড়োর খাতা
ফেসবুকেই জন্ম নিলো সদ্যজাত লেখা।
গল্প,ছবি,কবিতা,গান ও নাচের লাইক পাতা।
চললোও তা। কেউ আসলো লাইক দিতে,
কেউ এলো লাই পাবার আশায়।
কেউবা মুফত গালিও দিলো
যত্নে লেখা গীতিকবিতায়।
বললো, ওসব ছন্দ বাজে।
অন্তমিলের রেওয়াজ নেই আর পুনরাধুনিক পত্রিকাতে।
লিখতে হলে লিখতে হবে সময়রাজার আক্কেল দাঁতে।
ছবির পাতায় প্রশংসাতে কেউ লিখলো ভুরি ভুরি
সাথে ছবিও সাটিয়ে দিলো, চা দিয়েছে যখন,
তার লাগবে মাটির খুরি।
গল্প পাতা? পড়লোনা তো কেউ।
তারই মাঝে,
একজন তো জানিয়ে গেলো,
ব্যস্ত থাকি নানান কাজে।
দু' লাইনে গল্প যদি লিখতে পারো,
তবেই যদি পড়তে পারি।
অণু এবং পরমাণু তে ছুটছে মর্ডাণ গল্পগাড়ি।
চোখ দুখানা সামলে আছি লাগিয়ে ঠুলি
নিজের গল্প ঢাক পেটাতেই পাঁজর খুলি!
এবার যখন নাচের পাতায় চোখ বুলোলে
চড়কগাছে চক্ষু পেলে
বেশতো সেদিন পঞ্চু তোমার নাটক থেকে
খানিক খাবলে দু'পিঠ সেঁকে
ভিডিও খানি আপলোডালো প্রথম পাতায়
এক সাগরের নোনতা মেখে গায়ে মাথায়
কুড়িয়েছিলে শতহাতের সাবাস ধ্বনি
আর এখানে পাড়ার ননি
শতডজন লাইক পেলো!
আর তোমাকে কে একজন হুক্কা হুয়া
কমেণ্টবক্সে জানিয়ে গেলো,
হাত ঘুরিয়ে মুড়ির মোয়া
মিলবেনা আর এক্কেবারেই
বরং হিপহপ, লকিং, ডিস্কো চলছে দেশে
ওসব রাবিশ আর টানেনা, সবটা একপেশে
করবেটা কি? ভাববে বসে?
থাকবে এমন মিডিয়াতেই পোঁ খানাকে আঁকড়ে ধরে?
পাওয়ার মধ্যে পাবে কেবল
রোজ দু'ডজন হাই, হ্যালোটা ভেতরঘরে।
মানলাম সব দলবাজিতে তুমি এখন গো-হেরুয়া
কাগজ কলম হাতে পেলে পূর্ণ হবে সব অসূয়া?
বেশতো তবে ইচ্ছেপূরণ আবার তোমার হলো
খাম আটকে কবিতা গেলো বেশ ক' কিলো
তাবড় তাবড় পত্রিকাতে। ডাকও পেলে
বিশেষ দিনে কবিতাপাঠের,
পত্রিকাটির প্রকাশকালে।
অতিথি যিনি, মনে হয়না তাকেও চিনি?
আরে ওই তো পাড়ার ভুতো!
একহাতে তার পুস্পস্তবক
আরেক হাতে পত্রিকা তো!
টুকরো লোহার নিলাম ডাকে,যমদূতের চেহারা।
কানাঘুষোয় শুনেছিলে নবম ক্লাসেই
টা টা ডাকে তারও ছিলো সাড়া।
ভুতোর লেখা কবিতাখানি বই এর প্রথম পাতাটিতে,
তোমার লেখা শেষ পাতাটির কোণার বেচারা!
আজকের এই অনুষ্ঠানের সিংহভাগের খাইখরচা ভুতোর অনুদানেই
প্রকাশক কি করবে বলো?
কাজেকাজেই, মানেমানেই
এমনভাবেই চলা ভালো।
ভাবছিলেতো সেরা কবির তকমা পাবে? আগের মতো?
এখন মেধা কিনছে মানুষ, ফানুস করে বুদ্ধি যতো।
সেরা হবার আসল লড়াই বিজ্ঞাপনে কার কতো দম
জন্ম নিলে আবার যখন মাথার ব্যামো
এবার তবে মেধার সাথে শিখতে হবে
চালাকির সব প্যাঁচপয়জার,রকমসকম।
হাওয়াতে কার পালের ওড়া
রঙ বদলে কে খচ্চর? কে ছোটালো টাট্টুঘোড়া?
কি বলছ হে রবি ঠাকুর?
এবার তোমার ঘটি ডুবলে পুকুরটুকুর জল পাবেনা?
কি যাতনা! আচ্ছা তবে ফুলের মালা গলায় নিয়ে
ওমনি খাঁড়াই দাঁড়িয়ে থাকো
কলিকালের রগড় দেখো দূর থেকে আর
সুযোগ মতো পুজো নিও কবিতীর্থ জোড়াসাঁকো।





নিজস্বী

শিশুর মতো সহজ আমি
বাদবাকী সব ঘোড়েল
কেউ দেয়না আমার মতো
তেলা মাথায় তেল।
মিটমিটে সব পাজীর দলে
একা আমিই ভালো
যদিও মন্দ লোকের কথায়
বিষম "ঘাগু মাল"ও।
দলাদলি চাইনা মোটে
থাকি তো পাঁচতারায়
পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙে
পাজীর পা- ঝাড়ায়।
আমায় যারা বোঝেনা তারা
বদমাইশ এর ঝাড়
বিপ্লব কি এমনি আসে
শুয়ে, বসে আমার?
ঘাড় নাড়াই হাওয়া বুঝে
সে কি আমার দোষ?
কাজ ফুরোলে মানুষ মারি
নইলে গড়ি পাপোষ
লোকদেখানো কাজ করিনা
লোকেই করে কাজ
নিজের ঢাক নিজে পেটাতে
বলোতো কোথায় লাজ?
একটুখানি নুনি শাকে
ছটাক ঘি দিই ভাতে
নিন্দুকেরা দেখে কেবল
মাংস নাচতে পাতে।
বড়াই আমার একটুও নেই
রঙ বোতলেই মুখ
কন্যাসমা মেয়ে দেখলেই
জড়িয়ে ধরতে সুখ।
জলের মতো বুঝতে পারি
সেয়ানা সব লোক
দক্ষিণাটি দিলেই বলি
তোদের ভালো হোক।
আবার কি বলবে আমায়
সুযোগসন্ধানী?
আম পাকিয়ে কাঁঠালসত্ব
আমি কেবল জানি।





মা

মা আমার মা,
আটপৌড়ে শাড়ির গিঁটে শক্ত গ্রানাইট বাস্তব।
কুঁচির পরতে পরতে জন্মান্তরের নীরবতা
সংসারের মঙ্গলঘট পাছে নড়বড়ে হয়!
দু'ঠোঁটের আগল অপরাহ্ণ সূর্যালোকে নিশ্চুপ যখন
ঠিক তখুনি আমাদের চার ভাইবোনের দাপুটে দখল খুবলে খেয়েছে
তোমার বিশ্রামের সময়টুকু।
' ' শ্বাসাঘাতে স্পষ্ট বুঝতে পারি সেদিনের সেতারের ছেঁড়া তারগুলিতে
তুমি কিভাবে বেহাগের সুরারোপ করেছিলে।
মাঝে মঝে মনে হয়নি এমনটাও না,
তালপাখার হাতখানিতে অনবরত যুগিয়ে চলেছিলে আমাদের বাঁচাবার কসরত।
কোল থেকে আঁচল অবধি অন্যকে সুখী করার পথ চলতে
তুলসী তলার মতো নতজানু জীবনভোর।
তিলে তিলে নিঃস্ব হয়ে  চলেছিলে  নির্বিবাদে অবিন্যস্ত চলনের মানানসই পদক্ষেপে
বুকভরা সুধামন্ত্র বিলিয়ে একা কেবল পুড়ে গেলে গনগনে উনুনের আঁচে।
বাবার রেখে যাওয়া শূন্য মাঠে ভরদুপুর মাথায় নিয়ে
তুমিই বেড়ে দিলে সানকি থালায় গরম ভাতের গন্ধ।
পলে পলে বুঝিয়ে দিয়েছো মা'র জাত ধর্ম থাকতে নেই।
চার চারটি অনাথ সন্তানের ভার তোমার হাতে সঁপে দিয়েই তো বাবা
বিধর্মী প্রমাণিত হয়ে চারটি গুলি বুকে নিয়ে চলে গেলেন গ্রহান্তরে।
তুমিও অজুহাত দাওনি মা, অন্য জঠরের জাতক পালনকথায়।
তোমার নিকোনো উঠানে আজ আনন্দডানা মেলে ধরলাম
আর সেইমাত্র তুমি চলে গেলে পারিজাত কাননের পৌষালি আঙ্গিনায়
মা, আমার মা,একী সুধারস তব!





জামাইবাবু

আমায় তুমি ডাকতে ছোট শালি বলে
এই তোসেদিনও মানে দশদিনের আগের রোববার
ফোন তুলতেই জানালে--ছোট শালি জায়গা রেখো।
খানিক চুপ দেখেই ফের ওপাশ থেকে, - আরে তোমার শেষ লেখা কবিতা
জায়গা রাখো দুর্দান্ত।
খানিক নকল রাগ দেখিয়েই জবাব করলাম, - শেষ কবিতা কেন হবে
জামাইবাবু? আমিতো রোজই লিখি
তুমি কিনা সবটা পড়ে উঠতে পারোনা! আজ লিখলাম -- ফুল না ফুটলে।
পড়বে কিন্তু। বলেছিলে -- পড়বো সময় পেলে।
সময় আর তোমায় দাক্ষিণ্য করেনি। তোমাকে না আমাকে? কি জানি!
আমার উনির কাছে শোনা তুমি নাকি তার দিদির গলায়, " আমার
মল্লিকাবনে" গানটি অবাক চোখে শুনেই
এক কথায় বিয়েতে রাজী হয়েছিলে।
একটি গানে ফুটেছিলো একটি বিয়ের ফুল।
তুমি আমার গান, কবিতা, আর সবটুকু ভালোর দখল নিয়েছিলে।
আমার কি দোষ বলো? আমি তোমায় মানুষ ভাবতে পারিনা?
'দোষে গুণে ভরা মানুষ -- নইলে সে ভগবান'
-ছোটোকাল থেকে এই শিক্ষেই পেয়েছি।
তাইতো ভগবান মানেই তুমি জামাইবাবু।
আমি শুধু কেন,তোমার বাতাসে যারা নিঃশ্বাস নিয়েছে
তারা সক্কলেই এই কথা বলবে।
আজ সকাল থেকে ঝলমলে রোদ উঠেছে জানো?
তোমার সেই সেদিনের কথাখানি মনে করাতে হয়তো!
ওই যে গো, তুমি একদিন আমাকে রাগাতেই বুঝি বলেছিলে,
- যেদিন আমি থাকবোনা, তুমি একটা আলোর গান গেয়ো।
ধরো সে গানে যদি আলো না থাকে,ধরে বেঁধে এনো।
তুমি আলোর দেশে পৌঁছে গেছো জামাইবাবু?
শুনতে পাচ্ছো? আমি গাইছি আলোর গান
সারা শরীর রোদ মেখে গান গাইছি তোমাকে শোনাতে,
--আমার পরাণ বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান, তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ,
নাইকো তান
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও।
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে

দাও...