রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৮

সম্পাদকের কলমে



সম্পাদকের কলমে

বুদ্ধদেব একটি ভালো কথা বলে গিয়েছিলেন মৃত্যুশয্যায়। "আত্মদীপ ভব"আপনাপন চেতনার আলোতে নিজের অন্তরের মানুষটি হয়ে ওঠার একটি পথ। রবিঠাকুর সেই পথেই আরও একটু পরিস্কার আলো ফেলে গেলেন। বললেন, "বৃহৎ আমি'" কথা। আমাদের দৈনন্দিন ক্ষুদ্র আমির মোহাবেশ থেকে নিজেকেই উদ্ধার করে বিশ্ব আমির মহাসভায় পূর্ণ আমি হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু দুঃখের কথা, আমরা অধিকাংশই সেই ক্ষুদ্র আমির ঘেরাটোপে আটকা পরে গিয়ে, নিজ নিজ অহং-এর কাছে বলি হয়ে নিজের পূর্ণ আমিতে পৌঁছাতেই পারি না। আর পারি না বলেই আমাদের "be who you are" হয়ে ওঠা হয় না সারাজীবন বেঁচে থেকেও। এইখানে বিবেকানন্দ সুন্দর একটি সহজ পথের সন্ধান দিয়ে গেলেন। 'জীবে প্রেম করে যেই জন', এই প্রেমের চর্চা ঠিক মতো করতে পারলেই ধীরে দীরে দিনে দিনে সেই পূর্ণ আমিতে পৌঁছানোর একটি পথ তৈরী হয়ে উঠতে পারে। বিবেকানন্দ নিজের জীবনেই সেটি পেরেছিলেন বলেই আমাদের সেই পথের সন্ধানটি দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হলো না। বুদ্ধদেব রবিঠাকুর বিবেকানন্দ কারুর কথাই আমরা নিজেদের জীবনে সত্য করে তুলতে পারলাম না। কিন্তু কেন পারলাম না? সেই কারণটি সুস্পষ্ট করে গেলেন শ্রীঅরবিন্দ। তিনি দেখলেন ডারউইনের তত্ব মতো মানুষ এখনো পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠতে পারে নি। বাঁদর গোত্র থেকে নিরন্তর অভিযোজনের প্রক্রিয়াটি আজও চলছে। আজকের মানুষ আগামীর অতিমানবের পূর্ববর্তী প্রজাতি মাত্র। তিনি এও দেখলেন, বিশ্বচেতনার নানার স্তর রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মতো আমরা জীবগোষ্ঠী একটির পর একটি চেতনার স্তরে প্রবেশ করি। এইভাবেই বাঁদরের চেতনার স্তর থেকে আজকের মানবিক চেতনার স্তরে আমাদের পৌঁছানো। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়। আরও উচ্চতর চেতনার কয়েকটি স্তর এখনো অধরা রয়ে গিয়েছে। ডারউইন তত্ব অনুযায়ী অভিযোজনের প্রক্রিয়ায় মানুষ হয়তো একদিন সেই সব উচ্চতর চেতনার স্তরে পৌঁছাবে একদিন। কিন্তু জীবনানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, "সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ"অভিযোজনের সেই ধারায় আরও বহু শতাব্দীর নিরন্তর প্রয়াসের মধ্যে দিয়েই মানুষ আরও মহত্তর মনুষত্বে পৌঁছাবে নিশ্চয়। কিন্তু সেই শুভ দিনের জন্যে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। ক্ষুদ্র আমির অহং সর্বস্ব সংকীর্ণ চেতনার বলয় থেকে মুক্তির যে অভীপ্সা, সেই অভীপ্সাকেই যতদূর সাধ্য ক্রমাগত সংক্রমিত করে যেতে হবে। করে যেতে হবে আমাদের কাজের মধ্যে দিয়ে। সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। আমাদের সৃজনশীলতার দিগন্তে সেই অভীপ্সাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে হবে। তবেই না আরও বেশি করে মানবাত্মার মধ্যে মুক্তির এই চেতনা সংক্রমিত হতে পারবে।

আমাদের সাহিত্যচর্চা আমাদের সংস্কৃতিচর্চা আসলে সেই মুক্তির অভীপ্সার দিগন্তেরই অভিমুখি। যে নিরন্তর অভিযোজনের মধ্যে দিয়ে আজকের মানুষের যাবতীয় অর্জন ও ব্যর্থতা, সেই অভিযোজনের মধ্যে দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাটিও নিরন্তর বহমান। এবং এইখানেই কবিতা ও কবিতাচর্চার প্রকৃত গুরুত্ব। কবিতা যে আদৌ ছন্দবিলাস নয়, নয় শব্দের কলাকৌশল, সেই সত্যটি আমরা বিস্মৃত হয়ে থাকি অধিকাংশ সময়েই। জীবনানন্দ যে বলেছিলেন, ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’- সেই কাজ তো থেমে থাকতে পারে না কখনো। যিনি কবিতা লিখছেন, যিনি কবিতা লিখবেন, তিনি তো সেই কাজটিকেই আরও নিপুণ ভাবে আরও সমৃদ্ধতর ভাবেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন। কারণ সেই যাওয়াটুকুই আসলে কবিতাচর্চা। কবিতাউৎসবের শুরু কিন্তু সেই বোধ থেকে। সেই চেতনা থেকেই। কবিতাউৎসবে আমরা সেই চর্চাটিরই উৎসব পালন করতে প্রয়াসী। আরও একটু সোজা কথায় কবিতার মধ্যে দিয়ে জীবনের উৎসব। কবিতার মধ্যে দিয়ে চেতনার উৎসব। কবিতার মধ্যে দিয়ে মানবাত্মার সেই মুক্তির উৎসব, যে মুক্তির দিশা দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের মনীষীরা।

এইটুকুই কবিতাউৎসব নিয়ে আমাদের প্রয়াস। এইটুকুই কবিতাউৎসব নিয়ে আমাদের অভীপ্সা। এইটুকুই কবিতাউৎসব নিয়ে আমাদের আনন্দ। আর সেই আনন্দে নয় নয় করে দুটি বছর সম্পূর্ণ করে ফেলল কবিতাউৎসব। ফাল্গুন ১৪২২ বিশিষ্ট সাহিত্যকর্মী ও নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, এই মাঘ সংকলনে তার দ্বিতীয় বর্ষ পূরণ হলো। মাসিক কবিতাউৎসবের এই নিরবচ্ছিন্ন ও নিয়মিত প্রকাশের পিছনে কবিতাউৎসবের সকল সদস্যের অবদান অনস্বীকার্য্য। আমরা প্রত্যেকের কাছেই তাই আন্তরিকভাবেই একান্ত কৃতজ্ঞ।

মাসিক কবিতাউৎসবের আরও একটি উল্লেখযোগ্য নিবেদন পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভ। পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভ একটি অনলাইন কবিতার আসর। যেখানে জুম ভিডিও প্ল্যাটফর্মে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবিরা প্রতি মাসের ১৬ ও ৩০ তারিখ সমবেত হন স্বরচিত কবিতা পাঠ, কবিতা আবৃত্তি ও সাহিত্য আলোচনায়। সমগ্র অনুষ্টানটি রেকর্ড করা হয় এবং ফেসবুকে অনলাইন লাইভ সম্প্রচারিত হয়। পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভের কর্ণধার ও সঞ্চালক কানাডা নিবাসী কবি মৌ মধুবন্তীর সৌজন্যে ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই লাইভ কবিতার আসরটি সম্প্রতি একটি বৎসর অতিক্রম করে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করলো। নতুন বর্ষে একটি নতুন সংযোজন, প্রতি পর্বে একজন কবির সাথে প্রশ্নোত্তর পর্ব। কবি মৌ মধুবন্তীর এই উদ্যোগের সার্বিক সাফল্য কামনা করে কবিতাউৎসব। পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভে অংশগ্রহণে আগ্রহী কবিরা সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন কবি মৌ মধুবন্তীর সাথে।


আমাদের দ্বিতীয় বর্ষের বর্ষশেষ এই সংখ্যায় থাকছে দুই বাংলার কবিতার এক বিশাল সম্ভার। এই পর্বে অংশ নিয়েছেন দুই বাংলার সাতচল্লিশ জন কবি। আমাদের এ মাসের অতিথি বিভাগে এই মাসের অতিথি বিশিষ্ট কবি দিশারী মুখোপাধ্যায়। কবিতাউৎসবের সাথে এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে কবির দৃষ্টিতে জীবন ও সাহিত্যের এক বিস্তৃত ও সুগভীর দিগন্তের সুস্পষ্ট ছবি। আমাদের আশা কবির চিন্তা চেতনার সাথে পরিচিত হয়ে কবিতাউৎসবের পাঠক মাত্রেই আনন্দিত হবেন। পাঠকের তৃপ্তিই কবিতাউৎসবের মোক্ষ।