শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সম্পাদকের কলমে



বাংলাসাহিত্যের সংকট

যে কোন সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা হলো ভাষা। ভাষাই সাহিত্যকে ধারণ করে এবং বহন করে। ভাষা ছাড়া সাহিত্যের কোন অস্তিত্বই সম্ভব নয়। ঠিক যেমন দেহ ছাড়া অসম্ভব প্রাণের অস্তিত্ব। সেইরকমই সাহিত্যে ভাষার গুরুত্ব। আমাদের বাংলাসাহিত্যও তেমনই বাংলাভাষার হাত ধরেই আজ এতটা পথ পেড়িয়ে এসেছে। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ভিতর দিয়েই বাংলাসাহিত্যেরও বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এমন কোন সময় ছিল না যখন বাংলাভাষার উদ্ভব হয় নি, অথচ বাংলাসাহিত্য ছিল। ঠিক তেমনি এমন কোনদিন আসবেও না, যখন বাংলাভাষার মৃত্যু হলেও বাংলাসাহিত্য টিকে থাকবে। সেটি অসম্ভব। অনেকে একথাও ভাবতে পারেন, ঠিক তেমনই বাংলাভাষার মৃত্যু হওয়াও একটি অসম্ভব বিষয়। আমাদের বাংলাভাষাও টিকে থাকবে চিরদিন। অবশ্যই বাংলা সাহিত্যপ্রেমী আমরা সকলেই চাই, বাংলাভাষা যেন চিরকাল বেঁচে থাকে। কিন্তু একথাও সত্য, ভাষার যে শুধু বিবর্তনই হয়, তাই নয়। ভাষার মৃত্যুও হয়। অনেক ভাষাই কালের প্রভাবে হারিয়ে যায় মানব সভ্যতা থেকে। আমরা যদিও ভাবতে পারি বাংলাভাষাতো আর হারিয়ে যাচ্ছে না। যাবেও না। প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা কখনোই হারিয়ে যেতে পারে না। এ নেহাতই কষ্টকল্পনা।

এখানে কয়েকটি কথা ভাবার আছে। এটা খুবই সত্য কথা প্রায় পঁচিশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে প্রায় পঞ্চম জনবহুল ভাষা বাংলা। কিন্তু মুখের ভাষা হলেই যে সেটি কাজের ভাষা বা সাহিত্যের ভাষা হিসাবে উৎকর্ষ মানের হবে তেমন কোন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। কিংবা একথাও জোর গলায় বলা যায় না, মুখের ভাষা হিসাবে বেঁচে থাকলেই একটি ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসাবেও সমৃদ্ধশালী হয়ে বেঁচে থাকবে। দৃষ্টান্ত হিসাবে সাঁওতালি ভাষার কথাই যদি ধরা যায়, এটি বহু সংখ্যক মানুষের মুখের ভাষা। এবং বয়সের দিক দিয়ে হিন্দী উর্দূ এমন কি আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার থেকেও সুপ্রাচীন। কিন্তু তাই বলে বিশ্বসাহিত্যে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে সাঁওতালি ভাষার বিশেষ কোন পরিচয় আজও গড়ে ওঠে নি। তার হাজার রকম কারণ রয়েছে। ফলে মুখের ভাষা হলেই যে সাহিত্যের ভাষা সৃষ্টি হয়, বিষয়টি ঠিক তেমনও নয়। আবার একথাও সত্য সাহিত্যের ভাষা মাত্রেই মুখের ভাষা নাও হতে পারে। যেমন সংস্কৃত। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সাহিত্যের ভাষা আর মুখের ভাষা আদৌ সমার্থক নয়। তাই একথা জোর দিয়ে নিশ্চিত করে বলা যায় না, একটি ভাষা মুখের ভাষা হিসাবে টিকে থাকলেই সাহিত্যের ভাষা হিসাবেও টিকে থাকবে।

সাহিত্যের ভাষা হিসাবে টিকে থাকতে গেলে প্রধানতম শর্ত কিন্তু একটিই। সেই ভাষায় যথেষ্ট সংখ্যক মানসম্মত লেখক এবং প্রচুর পরিমাণে বোদ্ধা পাঠক থাকতে হবে। একমাত্র তবেই একটি ভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসাবেও টিকে থাকতে পারবে। অর্থাৎ শুধু কথায় কাজ হবে না। সেই ভাষায় লিখতে ও পড়তে হবে। কথায় বলে কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হও। কবির কথায়, ‘আমাদের দেশ বলো সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে। সাহিত্য সেই কাজের ভাষা। সেটি লেখা ও পড়ার উপরেই নির্ভরশীল।

জানি অনেকেই ভাবছেন, ধান ভানতে এ কোন শিবের গীত শুরু হলো! আমাদের দেখতে হবে বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্যের আজকের সঠিক অবস্থান কেমন। এবং কোন দিশার অভিমুখে এর আগ্রগতি। অনেকের মনে হতেই পারে, এ আসলেই অবান্তর আলোচনা। দুই বাংলা মিলিয়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লেখা প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। হাজার হাজার বই প্রকাশিত হচ্ছে। শহরে নগরে শতশত গ্রন্থমেলা হচ্ছে। এত এত লেখক। বাংলা সাহিত্যে বা বাংলাভাষা নিয়ে চিন্তার তো  কোন কারণ থাকতেই পারে না। সত্যিই তেমনটা হলে চিন্তা হওয়ার কথায়ও নয়। কিন্তু আমরা কি সকলে সত্যিই নিশ্চিত, চিন্তার কোন কারণই নাই?

না বন্ধু আজ চারিদিকে এই এত এত সাহিত্যসংকলন প্রকাশের ধুম দেখে, এত সংবর্দ্ধনা এতো পুরস্কার দেখে আমরা অবাক হতে পারি। পুলকিত হতে পারি। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারি না। প্রদীপের শিখায় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে গেলে শিখার নীচের অন্ধকার দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। তাই আমরা সেই অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি না। আর পাচ্ছি না বলেই অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি। আমরা সাহিত্যসভার আলোর ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়ে বসে আছি। আজ আর আমাদের তলিয়ে দেখার অবসর নাই। সত্যিই, আমাদের চব্বিশ ঘন্টার ব্যস্ততাই আমাদের মানসিক শান্তির রক্ষাকবচ। তাই আমরা তাৎক্ষণিক আনন্দের আতিশয্যে বিহ্বল। আমরা বুঝতে পারছি না, আমরা প্রায় একটি চোরাবালির স্রোতের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভারসাম্যের একটু এদিক ওদিক হওয়া শুরু হলেই আজকের এই বিহ্বলতা কেটে যাবে। আমরা বুঝতে পারবো, এত বই প্রকাশের ধুম, এত পত্রিকা উন্মোচনের আনন্দ, এত সাহিত্য পুরস্কার, এত সাহিত্যসভা, বইমেলা কোন কিছুই শেষ কথা নয়। যদি না বাংলা সাহিত্যের পাঠক থাকে।

সেকি! বাংলা সাহিত্যের পাঠক নাই? কে বলল? তবে চারিদিকে এত ভিড় কাদের? একটু তলিয়ে যদি দেখি, দেখতে পাবো, আমাদের লেখালেখির পাঠক আমরাই। আমাদের বাইরে পাঠকের বৃত্তটা অতি দ্রুত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে আসছে দিনে দিনে। দশকে দশকে। আমার লেখার পাঠক যেমন আপনি। ঠিক তেমনই আপনার লেখার পাঠক আমি। কারণ আমরা উভয়ই বাংলাসাহিত্য সভ্যায় নিজেদর স্থান ধরে রাখার বিষয়ে উদগ্রীব ও উৎসাহী। উদ্দমী ও উৎসুক। আমাদের সেই সাধারণ অভিমুখ বা স্বার্থেই আমরা পরস্পরের লেখা পড়ি ও পিঠচাপড়াই। যাদের সেই ঠেকা নাই, তারা আমার আপনার লেখা পাঠের বিষয়ে আগ্রহীও নয়। যদি হতো, তবে আমাকে আপনাকে, নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যায় করে গ্রন্থ প্রকাশ করতে হতো না। করতে হতো না গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানেরও কোন বিশেষ আয়োজন। পাঠক গ্রন্থ প্রকাশনীর বিপনীতে গিয়ে আপন গরজেই খুঁজে নিত নতুন কার কোন বই প্রকাশিত হলো সম্প্রতি। আমি বা আপনি লেখালিখিকেই নিজেদের পেশা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম। কিন্তু তা হয় না। হয় না কেন? না আমার আপনার লেখালেখির কোন বাজারদর নাই। আমরা কি লিখি্? গল্প কবিতা ভ্রমণকাহিনী। নয়তো রম্যরচনা। বা কখনো সখনো প্রবন্ধ কিংবা নাটক। হয়তো উপন্যাসও হতে পারে। এইগুলিই তো বাংলাসাহিত্যের সামগ্রী নাকি? তাহলে যদি এইগুলির কোন বাজারদর নাই থাকে, তাহলে একথা নিশ্চিত; এগুলির কোন পাঠকও নাই। তাহলে? পাঠক ছাড়া সাহিত্যের আয়ু কতদিন? গ্রন্থপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আমার আপনার বই প্রকাশ। জনে জনে বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রফুল্লচিত্তে প্রিয় বন্ধবান্ধবদের বই উপহার। রাত্রে বাড়ি ফিরে সুখানুভুতির ঘুম। কিন্তু তারপর?

তারপর আপনিও যেখানে আমিও সেখানে। আমরা সকলেই ঠিক একবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। নাই নাই। আমাদের লেখালিখির কোন পাঠক সমাজ নাই। আমাদের চেনাজানা মানুষজনের বাইরে। তাই আমাদের লেখালিখির কোন স্থায়ী বাজারদরও নাই। এবারে আসুন এই আমার আপনার সংখ্যাটিকে দুই বাংলার সাহিত্যের দিগন্ত জুড়ে যোগ করতে থাকুন। আর সেই যোগফলটুকু দুই বাংলার মোট  জনসংখ্যার শিক্ষিত লেখাপড়া জানা মনুষের মোট সংখ্যা থেকে বিয়োগ দিয়ে দেখুন। সত্যই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। বাংলা সাহিত্যের পাঠকসমাজের বৃত্তটুকু এতটাই সীমিত। না এইটুকুই সমস্ত চিত্র নয়। হলে ততটা চিন্তার ছিল না। নিশ্চিত থাকা যেত, প্রতিযুগেই এই সামান্যতম বৃত্তে হলেও বাংলাসাহিত্যের প্রাণভোমরা টিকে থাকবে।

এই যে বছরভর চারিদিকে ঢাকঢোল বাজিয়ে এত মোড়ক উন্মোচনের ধুম। নিজের বই প্রকাশের সেল্ফিতে এত এত লাইক আর ভালোবাসা ওয়াল জুড়ে, আসুন তো একটি বার নিজের ঘরের দিকেই নাহয় তাকিয়ে দেখি একবার উঁকি দিয়ে। আমার আপনার সেই বহু কষ্টার্জিত অর্থে প্রকাশিত বই কয়টির কজন পাঠক আছে আমার আপনার দুই কুঠুরি তিন কুঠুরির রাজত্বে? আজকে দুই বাংলার অধিকাংশ শিক্ষিত পরিবারেই সন্তানদেরকে হামাগুড়ি দেওয়া বয়স থেকেই প্রায় চ্যংদোলা করে নিয়ে গিয়ে ইংরেজী মাধ্যমের খোঁয়ারে ভর্তি করে দেওয়া হয় না? এই যে শিশু কিশোর কচিকাঁচা বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, ঠিকমত বাংলা অক্ষর চিনছে কি আদৌ? নিশ্চিত আপনি? এরা গড়গড় করে ইংলিশ টেক্সট পড়তে পারলেও, বাংলা বাক্য পড়তে পারছে? না পারবে ঠিকঠাক? হ্যারী পটারের বই হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো প্রজন্ম বাংলাসাহিত্য মুখী হবে কোনদিন? আপনি নিশ্চিত?

শুধু যদি পশ্চিমবাংলার কথাই ধরি। গত দুই দশকের সময় সীমায় কতগুলি বাংলামাধ্যম স্কুল উঠে গিয়েছে জানেন? জানি আমরা ঠিক মতো? আর এই সময়সীমায় কত শত ইংরেজী মাধ্যমের এমনকি হিন্দী মাধ্যমের ছোট বড়ো বিশাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে এই বাংলায়? এই মাধ্যমগুলি থেকে পাশ করে হোক, ফেল করে হোক বেরোনো প্রজন্ম হবে বাংলাসাহিত্যের পাঠক? এর সাথে যোগ করুন, ইতিমধ্যেই কত বাংলা মাধ্যম স্কুলে শুরু হয়ে গিয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠনের আত্মঘাতী ব্যবস্থা। এবং একথাও শোনা যাচ্ছে, অনেক বাংলা মাধ্যম স্কুলকে ইংরাজী মাধ্যমে রূপান্তরিত করার ভাবনা চিন্তা চলছে। কারণ বড়ো সাংঘাতিক। স্কুলে যথেষ্ট সংখ্যক পড়ুয়া পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ এই প্রজন্মের অভিভাবক সন্তানকে আর বাংলা মাধ্যমে পড়াতেই রাজী নয়। সেই একই অভিভাবক কি করে আশা করবে, তাদের সন্তান বাংলাসাহিত্যের পাঠক হয়ে উঠবে একদিন? না আমি বা আপনি কেউই তা বিশ্বাস করি না। আর করি না বলেই খুব ভালো করেই জানি আজকের প্রকাশিত আমাদের লেখার কোন পাঠক আমাদের নিজেদের গৃহেই আর অবশিষ্ট নাই।

এবার আসুন এই প্রবল প্রভাবের ধারাটিকে ঠিকমতো অনুধাবন করি। আজ থেকে বেশ কয়েক দশক পরে, আমাদের আয়ুর সমাপ্তির পর। এই বাংলায় বাংলা হরফ বুঝতে পারার মতো কজন বাঙালি থাকবে আমার আপনার মতো শিক্ষিত পরিবারের ভাবী বংশধরদের ভিতর? আর অশিক্ষিত নিরক্ষর বাঙালি তো কোনদিনই বাংলাসাহিত্যের ছায়া মাড়াতে আসে নি। আসবেও না। ফলে ঠিক যেকথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, যে কোন সাহিত্যের প্রাণ ভোমরা হল ভাষা। আর সেই ভাষায় অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষিত পাঠকই যদি যথেষ্ঠ সংখ্যায় নাই থাকে, তবে সেই ভাষার সাহিত্য শুকিয়ে যেতে বাধ্য। একদিন না একদিন। ঠিক যেমন শুকিয়ে গিয়েছে এক কালের সমৃদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্যধারা। আমাদের বাংলাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ যে সেই অভিমুখেই হাঁটছে না, না বলতে পারি না আজ আর সে কথা বুক ঠুকে। আপনি?