রবিবার, ২১ জুন, ২০২০

সম্পাদকের কলমে




সম্পাদকের কলমে

মানুষের সভ্যতায় এক এক কালে কোন কোন সময়ে মহামারী দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি হয়তো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটা সামঞ্জস্য বিধান করে নেয়। আমাদের জানা শোনা ইতিহাসেই এরকম একাধিকবার ঘটে গিয়েছে। কিন্তু সে আমাদের ইতিহাসের পাতা থেকে উদ্ধার করা সত্য। কিন্তু সেই সত্যই যখন নিজের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে, তখন সে বড়ো দুঃসময়। ২০১৯ শেষ হওয়ার লগ্নে শুভ নববর্ষের অভিনন্দন জানানোর সময়ে আমরা কেউই কল্পনাও করতে পারিনি, সামনে কোন দিন আসছে। আজ ২০২০’র মধ্যপর্বে পৌঁছিয়ে মানুষের বিশ্ব থেকে ঝরে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। ঘরে ঘরে আত্মীয় বিয়োগের প্রিয়োজন হারানোর শোক। কিন্তু সেই শোকও আজ আত্মরক্ষার তাগিদের কাছে পরাজিত। আমরা জানি না, পরবর্তী মৃত্যুর ঠিকানায় কার নাম উঠে আসবে। এ যেন প্রায় এক লটারী। সকলেই মনে করছি, মহামারী শেষ হলে কিভাবে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো। কেউই ভাবছি না মহামারী শেষ হওয়ার আগেই নিজের নামটাও মৃত্যুর ঠিকানায় উঠে যেতে পারে। এইভাবেই লক্ষ লক্ষ মানুষের ঠিকানা বদলিয়ে গিয়েছে গত পাঁচ মাসে। ঠিকানা বদলিয়ে যাওয়ার একান্ত এই দুঃসময়ে মাথার উপরে মৃত্যুর খাঁড়া নিয়েও মানুষের জীবন থামিয়ে রাখা যায় না। অথচ আমরা সেই জীবনকেই গত কয়েক মাস থামিয়ে রাখার বিধান দিয়ে বসে আছি। থেমে থাকা সেই জীবনের নতুন ধারাপাতের সাথে অভিনব ভাবে সামঞ্জস্য বিধানের এক প্রক্রিয়ার ভিতর ধিয়ে চলেছি আমরা। অনেকেই মনে করছি লক ডাউন উঠে গেলে বাঁচা যাবে। কিন্তু সেই বাঁচার ভিতরে আরও বেশি মৃত্যুভয় নিয়ে আমাদের ঘর করতে হবে না’তো? সামান্য একটা হাঁচিই নাড়িয়ে দিতে পারে মনের শান্তি। মানুষের নৈকট্য, মানুষের সঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্কের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে আজ। ফলে মানুষের সমাজ আজ জনবিচ্ছিন্ন এক বাস্তবতার অভিমুখে দাঁড়িয়ে। সমাজবদ্ধ মানুষ কি তবে জনবিচ্ছিন্ন সত্তায় পরিণত হবে?

সাক্ষাৎ মৃত্যুর ভয় সমাজ সংসারের ভিত টলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। মানুষের সাথে মানুষের সামাজিক সম্পর্কগুলির রসায়নের ভিতরে সেই মৃত্যুভয় একবার থাবা গেড়ে বসলে তার পরিমাণ সাংঘাতিক। অনেকেই আমরা এই পরিস্থিতিতেও আশাবাদী চেতনাকে সজীব রাখতে স্বচেষ্ট। অন্তত সেটাই প্রকৃত মানুষের ধর্ম। আর সেই কারণেই আমাদের প্রতিদিনের কাজকর্মের ভিতের, জীবনযাপনের ভিতরে একটি সৃজনশীলতার ধারা বহমান রাখা জরুরী। হ্যাঁ লকডাউনের ভিতরেও। লকডাউন আংশিক ভাবে শিথিল হলেও। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, মৃত্যুই অন্তিম পরিণতি হলেও, মৃত্যুই শেষ কথা নয়। নয় বলেই শত শত মহামারী দুর্ভিক্ষ অতিক্রম করে এতদূর এসে পৌঁছাতে পেরেছে মানুষ। কিন্তু মুশকিল হয় তখনই, যখন আমরা সমষ্টির চেতনা থেকে সরে এসে শুধু মাত্র আত্মচেতনার পরিসরে দেখতে যাই সামগ্রিক বিষয়টি। অর্থাৎ আপনি বাঁচলে বাপের নাম। সাধারণত সেটিই ব্যক্তি মানুষের জীবধর্ম। শুধু ব্যক্তি মানুষই বা কেন, প্রতিটি জীবের জীবধর্ম সেটিই। সেই জীবধর্মের বাস্তবতাতেই আটকিয়ে গেলে আমাদের চেতনার পরিসরে এক মস্ত চাপ পড়তে শুরু করে। আমাদের যাবতীয় চেতনা ব্যক্তিক ও সাংসারিক অর্থাৎ পারিবারিক কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজের ও নিজের পরিবারের অস্তিত্ব সুখদুঃখ ভালোমন্দের বাইরে বৃহৎ জীবনটাকে আর দেখতে পাই না আমরা। আর তখনই মৃত্যুভয়ই বা কেন, যে কোন ভয়ই পাহাড় প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে আমাদের এগিয়ে চলার সামনে। এই যে একটি দমবন্ধ করা অবস্থা, এমন একটি পরিস্থিতি মানুষের চেতনার স্থিতিতে বিপর্যয় নামিয়ে আনলেও অবাক হওয়ার বিষয় নয়। আর তখনই আমাদের উপলব্ধি করার দরকার হয়ে পড়ে, নিজের কারণেই নিজের বাইরের জগতটার সাথে একটি আত্মীয়তা গড়ে তোলার। শুধুই নিজের অস্তিত্ব নয়, সামগ্রিক ভাবে সকলের অস্তিত্বই যখন আমাদের কাছে সামগ্রিক দুঃশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তখনই আমরা যেকোন ভয়, তা সে মৃত্যুভয়ের মতো সর্বাত্মক ও চরম হলেও তার মুখমুখি দাঁড়াতে পারি। দাঁড়াতে পারি সঠিক ভাবে মোকাবিলা করার জন্যই। সুখের কথা এইসময়ে মানুষের সমাজ ঠিক সেই পথেই নিজের এগিয়ে চলার অভিমুখটিকে সজীব ও ক্রিয়াশীল রেখেছে।

এখন ব্যক্তি আমিকে সেই পথে বাকি সকলের সহযাত্রী করে তুলতে পারার ভিতরেই আমাদের ব্যক্তি আমির মানসিক স্থিতিরক্ষার বিষয়টি নির্ভর করছে। শুধু যে সামাজিক বিপর্যয়ে মানুষের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়াই এই বিষয়ে একমাত্র পথ তাও নয়। সকলের পক্ষে সবসময় সেটি সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকে একটি মানসিক সংযোগ তৈরী করা ও সেটিকে সতত ক্রিয়াশীল রেখে সজীব রাখাটি কিন্তু খুবই জরুরী। সুখের বিষয়, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির বিপুল সহযোগিতার উপর নির্ভর করে আমরা অনেকেই আজ এই পথের পথিক। তাই আমরা চিন্তাও করতে পারি না, এমন সময়ের কথা, যখন মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ শুধুমাত্র নিজ নিজ গ্রামের পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল। সেই সময়ের মানুষ কিভাবে এইরকম মহামারী মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল, জানা নাই আমাদের। সে বড়ো কঠিন পরিস্থিথি। শুধু যে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিপুল উন্নতিই আজ আমাদের বল ভরসা, তাই নয়। সামজবদ্ধ মানুষ আজ যেমন নানান উপায়ে পারস্পরিক সংযোগের পরিসরটিকে দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত করে তুলতে পেরেছে, তেমন সুযোগ কিন্তু পূর্ববর্তী মহামারীর সময় ছিল না। তাই এই দুঃসময়েও বলতে হচ্ছে আমরা সত্যই অনেক বেশি ভাগ্যবান। এই যে মানুষের সাথে মানুষের এক বৃহত্তর সংযোগ, এটিই মহামারী দুর্ভিক্ষ বা যে কোন বিপর্যয়ের সময়ে আমাদের প্রধান আয়ুধ। এইটুকু শুধু যে আজ আমাদের কাছে মস্তবড়ো সান্ত্বনা, তাই নয়। এইটিই আমাদের আশার আলো। সেই আলোটিকে নিরন্তর প্রদীপ্ত করে আরও বেশি উজ্জ্বল করে যেতে হবে আমাদেরকে।

আর ঠিক সেই উদ্দেশেই মাসিক কবিতাউৎসবের আয়োজনে মৃত্যু মহামারী দুর্ভিক্ষ নিয়ে এই অভিনব কবিতা সংকলন। এইসময়ের অভিঘাতে একদিকে বিপর্যস্ত হয়েও অন্যদিকে বিপর্যয় মোকাবিলার পথে চিরন্তন প্রাণের জয়গানে সামিল হতেই সমবেত আজ আমরা সকলে। ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার দিগন্তে স্বাক্ষর রেখেও পারস্পরিক মানসিক সংযোগের প্রশস্ত রাজপথকে নিরন্তর সচল রাখাই হোক এইসময়ের শপথ। সেই শপথ নিয়েই প্রতিবারের মতোই দুই বাংলার কবিদের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে কবিতাউৎসবের বিশেষ আষাঢ় সংখ্যা কবিতাউৎসব আষাঢ় ১৪২৭। আমাদের যাবতীয় উদ্যোগ ঐক্যবদ্ধ মানবিক সময়ের প্রতীতিতেই স্থিত থাকুক।

৬ই আষাঢ়’ ১৪২৭