সম্পাদকের কলমে
বাংলা
সাহিত্য পত্রের ইতিহাসে কি এই প্রথম? শুধু মাত্র আদিরসাত্মক
কবিতার কাব্য সংকলন? জানা নাই সত্যি করে। অন্তর্জালে?
তাও জানি না। শুধু জানি, ভারতীয় সনাতন
সাহিত্যের ইতিহাসে আদিরসাত্মক কাব্যের অস্তিত্ব চিরন্তন। তার লাবণ্যও শাশ্বত। সেই
ধারার উত্তরসূরী কিনা তাও বলার এক্তিয়ার নাই আমাদের, তবু
কবিতাউৎসবের আয়োজনে গত ভাদ্রের প্রথমেই প্রকাশিত হয়েছিল আদিরসাত্মক কাব্যসংকলন।
দুই বাংলার আটচল্লিশ জন কবির কলমে প্রায় দুইশত কবিতায় জীবনের অন্যতম গূঢ়সত্যকে
সাহিত্যের দিগন্তে ধরার প্রয়াস হয়েছে অত্যন্ত সততার সাথে। সততার সাথে বলার কারণ একটাই, সাহিত্যে
যৌনতার অনুভবের ভাষিক চিত্রণে আদিরসের রসাস্বাদনে সাহিত্যিক পরিমিতি রক্ষা করা খুব
একটা সহজ কথা নয়। কলমে কালি ভরে নিলেই বা কীবোর্ডে আঙুল চালাতে শুরু করে দিলেই তা
হয় না। অনেক অধ্যাবসায় ও সাধনার প্রয়োজন। সুখের কথা, মূলত অন্তর্জালের
দিগন্তেই সাহিত্য সাধনায় যাঁদের পরিচিতি, তাঁরা সেই কঠিনতম
কাজটিও সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই। আর সেটিই ছিল কবিতাউৎসব
সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম আশা।
বস্তুত
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যৌনতার ধারণায় ঘুণ ধরে গিয়েছে বহু শতাব্দীব্যাপি অন্ধকার
চর্চায়। কিন্তু হাজার হাজার বছর কিংবা তারও আগে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ জীবনে
যৌনতা,
জীবনধর্মের অনুষঙ্গ হিসাবে মানব মননে জীবনলীলার মূল স্বরূপ বলেই
প্রতিভাত হতো। তাই এই বিষয়টি নিয়ে সনাতন ভারতীয় সমাজ সভ্যতায় কোন ট্যাবু ছিল না।
ছিল না বলেই ভারতীয় শিল্পকলার সুপ্রাচীনতম নিদর্শনগুলি আজও শাশ্বত নান্দনিকতার
সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত দুই হাজার
বছরের সময়সীমায় দিনে দিনে সেই উজ্জ্বল অধ্যায় সম্পূর্ণ অস্তমিত। তার নানাবিধ
ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। আমরা সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের স্থবির সমাজ জীবনে,
জীবনের অন্যতম গূঢ় সৌন্দর্য্যকে আমরা আড়াল দিতে দিতে এমন একটা
অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছি, যে আজকে আমাদের শিল্পসংস্কৃতিকে
পাশ্চাত্যের কাছে আধুনিকতার পাঠ নিতে ছুটে যেতে হচ্ছে। এটাই আমাদের করুণ পরিণতি।
সমাজজীবন
থেকে শিল্পসংস্কৃতি,
সাহিত্য প্রায় সকল শাখাতেই এর প্রভাব নিদারুন। বাংলা সাহিত্যের দিকে
একটু নিবিষ্ট ভাবে তাকালে দেখা যায়, আমাদের বুক ফাটে তবু মুখ
ফোটে না। ফলে আমাদের সাহিত্যও যেন আবর্তিত হতে থাকে স্থবির সমাজজীবনের চারিদিকে।
এই যে একটি ঘুর্ণন, যার মূলত কোন অভিমুখই নাই, তা আর যাই হোক জীবনের সম্পূর্ণ উদ্বোধনের দিশা দিতে পারে না। আর পারে না
বলেই তা থেকে অর্থাৎ বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সাহিত্যও কোন
পুষ্টি খুঁজে পাচ্ছে না আর। সহজ করে বললে বলা যায় বাংলা সাহিত্য আবিশ্ব কোন ভাষার
সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয় নি আজও। এই ব্যর্থতার দায় আমাদের সকলের। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর সংকীর্ণতার। আমাদের
অগভীর চেতনার অসাড়তার। আমাদের সমাজজীবনের স্থবিরতার। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি
কোনটিই জীবনের গভীরতম তলে গিয়ে পৌঁছাতে পারে নি। পারে নি কারণ, আমরা
জীবনকে খণ্ডিত করে দেখতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছে। আমরা জীবনকে ঘোমটায় ঢেকে দেখার ভিতরেই
বাহাদুরি মনে করি। মনে করি সেটিই শিল্পসম্মত। কিন্তু তাতে করে যে শিল্পের সত্যই
হারিয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, অনুধাবন
করতে পারি না আমরা সেটিই। এইখানেই আমাদের সীমাবদ্ধতা।
ঠিক
সেই সীমাবদ্ধতাতেই একটু ঠেলা দিতে ছিল কবিতাউৎসবের এই আয়োজন। না, জীবনের
একটি বিশেষ অনুষঙ্গকেই শুধুমাত্র মাথায় তুলে নাচতে থাকলেই যে শিল্পসংস্কৃতির
শিখরদেশে পৌঁছিয়ে যাবো আমরা, তেমনটি মনে করার কোন কারণ নাই।
বস্তুত তা হয়ও না। কিন্তু জীবনের সত্যকে, ঘোমটার আড়াল দিয়ে
দেখতে গেলেই সত্যের বিনষ্টী। ঠিক যেদিন থেকে প্রাণের আনন্দকে আমরা বেড়া দিয়ে রাখার
পরিকল্পনা নিয়েছি, সেই দিন থেকেই আমরা সত্যভ্রষ্ট হয়েছি।
হারিয়ে ফেলেছি জীবনরসের ভাঁড়ার। সেই রসভাঁড়ারে চাবিকাঠি আমরা আবার ঠিক মতো ফিরে
পাবো কি পাবো না, সে’তো ভবিষ্যতই বলবে।
কিন্তু চাবিকাঠিটি খোঁজার দায়িত্বও যদি স্বীকার না করি আজও, তবে
তো নিজের কাছেই মুখ দেখানো ভার।
বিগত
সংখ্যার এই অভিনব প্রয়াসে অভুতপূর্ব সাড়া পেয়ে আমরা সত্যই উৎসাহিত। উদ্দীপ্ত। কিন্তু
সেই উৎসাহের পরিমণ্ডলেও আমাদের স্মরণে থাকা দরকার যে,কবিতা
লিখতে গেলেও, সকলের আগে দরকার সমাজ ও সমকাল সম্বন্ধে
সুস্পষ্ট ধারণা এবং কবিতা লেখার শৈলীকে সুদীর্ঘ সাধনায় ঠিকমত আয়ত্ত করতে পারা।
প্রধানত প্রাথমিক এই শর্তগুলি পুরণ না হলে কখনোই কবিতা লেখা সম্ভব নয়। এর সাথেই
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত থাকে। সেটি হলো মানবিক সংবেদনশীলতা। এইটিও অর্জন
করতে না পারলে, কবিতা
লেখা যায় না। অনেকেই মনে করতে পারেন, মনের ভাবাবেগ থেকে
যাঁরাই কবিতা লিখে থাকেন, মানবিক সংবেদনশীলতা তাঁদের
স্বভাবজাত একটি গুণ। না। মনের ভাবাবেগ থাকলেই যে মানবিক সংবেদনশীলতা অর্জিত হবে,
এমন কোন নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে না। মনের ভাবাবেগ মানুষ মাত্রেই
একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সমাজ ও সমকাল সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে এই
মানবিক সংবেদনশীলতা অর্জন করা যায় না। দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ
মানুষেরই সমাজ ও সমকাল সম্বন্ধে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকে না। মূলত খবরের কাগজ পড়ে,
আর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের ভাষণ শুনে অধিকাংশ মানুষের ভাবনা
চিন্তার পরিসর গড়ে ওঠে। সাথে যুক্ত থাকে নিজ গোষ্ঠীর আচার বিচারজাত আবহমান
সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। এবং একটু গভীর ভাবে তলিয়ে দেখলেই দেখায় যাবে যে,
এই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার মূলত প্রশ্নহীন আনুগত্য ও অন্ধবিশ্বাসজাত।
ফলে অধিকাংশ মানুষই স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনা করার শক্তি রাখেন না। সমাজ ও সমকালকে
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার ও বিশ্লেষণ করার শক্তি ও সাধনা থাকে না আমাদের
অধিকাংশ মানুষেরই। আর ঠিক এই কারণে নিজ সময়ের শক্তি ও দুর্বলতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা, অসুখ ও নিরাময় সম্বন্ধে আমরা
বেশির ভাগ মানুষই অজ্ঞান রয়ে যাই। ফলত মানবিক সংবেদনশীলতার গভীরে আমাদের আর অবগাহন
করার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকে না। এবং থাকে না বলেই আমরা আমাদের সমাজকেও সঠিক ভাবে
চিনে উঠতে পারি না। সারা জীবন ব্যায় করেও। দেশ সমাজ ও পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে সম্যক
জ্ঞানও থেকে যায় আমাদের অধরা।
এমত
অবস্থায় এমন অসম্পূর্ণ চৈতন্যে কবিতা লেখা কি করে সম্ভব? যে
কবিতা অন্যদের মন মননে চিন্তা চেতনায় আলোড়ন তুলতে পারবে। এখন প্রশ্ন একটাই কি করে
সম্ভব হবে তাহলে সেই কবিতা লেখা? প্রথমতঃ বর্তমান আলোচনার
সূত্র ধরেই বলা যায়, সকলের আগে আমাদের সমাজ ও সমকাল সম্বন্ধে
গভীর ও সার্বিক জ্ঞান অর্জন অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। কিন্তু কি করে সম্ভব সেটি?
সম্ভব সমাজের বিভিন্ন স্তরের সাথে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করার মধ্যে
দিয়ে। সমাজকে পাশ কাটিয়ে, কেবলমাত্র নিজ গোষ্ঠীর সুরক্ষিত
পরিসরে সুনিশ্চিত জীবনযাপনের ভিতর দিয়ে কিন্তু সেটি সম্ভব নয় কখনোই। সামাজিক সংযোগ
বৃদ্ধি মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। তার দৃষ্টিশক্তিকে প্রসারিত করে। এবং যে মানবিক
সংবেদনশীলতার শক্তি কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান আয়ুধ, সেই
শক্তিকে মননশীলতায় সঞ্চারিত করে তোলে। এখানেই সমাজিক সংযোগ বৃদ্ধির মূল গুরুত্ব।
অর্থাৎ সমাজ ও মানুষকে একেবারে অভ্যন্তর থেকে দেখতে হবে সুস্পষ্ট করে। তবেই মানবিক
সংবেদনশীলতার অর্জিত শক্তিকে কাজে লাগানো যাবে কাব্যসৃষ্টির নান্দনিকতায়। এর সাথে
যুক্ত করতে হবে কবিতা লেখার অনুপম শৈলীকে। অর্জন করতে হবে নিজস্ব কাব্যভাষা। তবেই
সম্ভব ভালো কবিতা লেখা। আর এরই সাথে নিরন্তর কাব্যপাঠ ও সাহিত্য আলোচনা আমাদের মন
ও মেধাকে ধারালো ও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। কবিতা লেখার সময় যা প্রভুত সাহয্য করতে
সক্ষম। কবিতাউৎসবের প্রতিটি আয়োজনে এই লক্ষ্য ও সাধনার অভিমুখে এগিয়ে চলার একটি
সচেতন প্রয়াস থাকেই। সেই প্রয়াস থেকেই বাছাই করা নির্বাচিত কবিতার আরও একটি সংকলন
নিয়ে প্রকাশিত হল কবিতাউৎসব আশ্বিন ১৪২৬ সংখ্যা, দুই বাংলার
শতাধিক কবিতার ডালি নিয়ে।
~কবিতাউৎসব আশ্বিন
১৪২৬ চতুর্থ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা~