কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার ১৪২৬
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি:
বাঙালি আর উৎসব এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে,
এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে
ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই
কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র
কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব
এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই
প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: কবিতা আর বাঙালি, শব্দদুটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। চলচ্চিত্র
হোক বা জীবন, মুগ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে বাঙালি প্রায়শই বলে ওঠে- ‘কবিতার মতো
সুন্দর’। এই শব্দবন্ধটিই আমাদের বুঝিয়ে দেয়, অজান্তেই আমরা কবিতায়
ডুবে আছি। আমাদের শৈশবের প্রথম পাঠ শুরু হয় ছন্দে এবং সুরে। শৈশবে
কবিতা আমাকে জড়িয়েছিল অনেকটাই। পড়তে শেখার পর আমার সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল সঞ্চয়িতা।
বুঝি আর না বুঝি, কতবার যে কবিতাগুলি পড়েছি তার লেখাজোখা নেই। একটু বড় হবার পর
সুকান্ত পড়লাম। আগেকার বহু ধারণা দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে অন্য এক নগ্ন নিষ্ঠুর বিশ্বের
সম্মুখীন হলাম সুকান্তের হাত ধরে। ক্রমশ বুঝলাম, নিজেকে প্রকাশ করতে গেলে কবিতাই
আমার মাধ্যম হয়ে উঠছে। কবিতাপাঠ হয়ে উঠছে আশ্রয়। গদ্য লেখা তার বেশ কিছু পরে।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য
কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে
চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি
একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক
পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: দেখুন, যদি বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখি, তবে সাহিত্য
পাঠের সময় অনেকটাই কমে এসেছে। কারণ, মানুষের হাতে এখন হাজারো বিকল্প। তবু
যে মানুষ সাহিত্যের পথে আছে, তার সবটাই হুজুগ হতে পারে না। বিশেষত কবিতা। যে ষোলো সতেরো বছর বয়েসের ছেলেটি
বা মেয়েটি তার অঙ্কের খাতার এককোণে কবিতা লিখে রাখে, সে তো তার মনের কথা। উপলব্ধির
কথা। নিজেকে আবিষ্কারের কথা। তার সঙ্গে হুজুগের কোনো সম্পর্ক নেই। সেই কবিতা
বিশুদ্ধ, আত্মিক। সেই কবিতা কিন্তু সে চট করে কাউকে দেখাতে চায় না। যাঁরা ফেসবুকে
কবিতা লিখছেন, তাঁরা কবিতাকে ভালোবেসেই প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছেন। নিজেকে
প্রকাশ করতে চাওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। এটা মানুষের ধর্ম। কিন্তু যখন
প্রশংসা পাওয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, কবিতা তখন চলে যায় দূরে। স্নানঘরে গুনগুন করে
না, এমন বাঙালি ক’জন? তারা সবাই কি গায়ক বা গায়িকা হয়ে ওঠেন? কবিতাও তেমনি। আমরা
গান ভালোবাসি, তাই গাই। কবিতা ভালোবাসি, তাই লিখি। কিন্তু গায়ক বা কবি হয়ে উঠতে
গেলে বিরাট সাধনার প্রয়োজন। কবিতার মাধ্যমে কেউ যদি সামাজিক পরিচিতি লাভ করতে চান,
তাঁকেও একনিষ্ঠ ভাবে সাধনা করতে হবে,
নিরন্তর পাঠ করতে হবে। একথা মনে রেখে যাঁরা আসবেন, তাঁরাই এগিয়ে যাবেন কবিতার পথে।
তবে পরিচিতি লাভের আশাই যদি মুখ্য হয়ে ওঠে,তবে তাঁকে পরিচিতির পেছনেই দৌড়াতে হবে।
সেক্ষেত্রে কবিতা যে হবে না , এটা নিশ্চিত।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা বা সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যচর্চা বলতে
আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই সাহিত্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে
করেন কবিতা বা সাহিত্যেরও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব
সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার
নিরিখে, একজন
সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? যেমন ধরা যাক
একুশের চেতনা। বাংলা ভাষার স্বাধিকার বোধ। এইসব বিষয়গুলি। মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ
লক্ষ্যগুলি।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: কবিতা
একটি উপলব্ধি। একটি সৎ উচ্চারণ। অন্তত আমার কাছে তাই। কবিকে সামাজিক সমস্যা নিয়ে
লিখতেই হবে, এরকম জোর করা যায় না। তাতে কবিতা হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। সমাজের
কোনো বিচ্যুতি যদি কবিকে গভীরভাবে আঘাত করে, তবে আপনিই তা থেকে কবিতা জন্ম নিতে
পারে। কিন্তু না হলেও ক্ষতি নেই। তিনি অন্যভাবে তাঁর মত প্রকাশ করতেই পারেন। কবিতা
আমার কাছে চিরন্তন। ক্ষণস্থায়ী নয়। সুন্দর শব্দবন্ধ সাজিয়ে রাখলেই যেমন তা কবিতা
হয়ে যায় না, তেমনি প্রতিবাদী শব্দগুচ্ছকে কবিতার আকৃতি দিলেই তা কবিতা হয় না।
কবিতার খোলসটুকুই হয়ে ওঠে। কবিতাকে হতে হয় নিবিড়, সূক্ষ্ম, সম্মোহক। একুশের চেতনা,
ভাষার স্বাধিকারবোধ , মুক্তিযুদ্ধ- এগুলির প্রত্যেকটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সাহিত্যিক হতে গেলে সমাজ সচেতনতাও অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ সাহিত্য জীবনেরই অন্য রূপ।
তবে কেউ যদি তা নিয়ে কবিতা নাও লেখেন, তাঁকে আমি কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো না। কারণ
কবিতা মুক্তির আরেক নাম। কবিকে গণ্ডীতে বেঁধে রাখা যায় না।
কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজ সচেতনতার প্রসঙ্গে
একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই
প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি,
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে
তুলতে পারে? এমনকি
হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: দেশপ্রেম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই
থাকে। সাহিত্যিকও তার ব্যতিক্রম নন। তবে
সাহিত্য রচনার সময় যদি রাজনৈতিক আদর্শই মুখ্য হয়ে ওঠে, তবে তা দৃষ্টিপথকে অর্ধাবৃত
করে রাখবে। মুদ্রার একটি পিঠই দৃশ্যমান হবে। অপরটি নয়। সাহিত্য রাজনীতির ঊর্ধ্বে
হওয়াই বাঞ্ছনীয়। রাজনীতির আবর্তে পড়ে যদি ন্যায় অন্যায় বোধ হারিয়ে ফেলি, সত্যকে
মিথ্যার থেকে আলাদা করতে না পারি, তবে যে সাহিত্য আমি রচনা করব- তা দলীয় ইস্তাহার
হয়ে উঠবে। সাহিত্য হবে না।
কবিতাউৎসব: আবার এই সমাজ সচেতনতার ভিত্তি
সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি, এবং কেন? কবি
জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: ইতিহাসবোধ
খুবই জরুরী। গভীর ইতিহাসবোধ না থাকলে ঘট্মান সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হবে না। সময় বহমান। সাহিত্যিক যে সময়ে বাস করছেন, তা এই বহমান সময়ের একটি অংশমাত্র। ইতিহাসের কাছে তিনি অবশ্যই ঋণী। সময়ের ভবিষ্যৎ-প্রবাহকে বুঝতে হলেও তাঁকে ইতিহাসের কাছেই হাত পাততে হবে। ইতিহাসকে আত্মস্থ করতে হবে। তবেই দৃষ্টির প্রসার ঘটবে। মানুষকে বা সমাজকে বুঝতে হলে তার বর্তমানের পাশাপাশি অতীতকেও বুঝতে হবে। তবেই তার নিরবচ্ছিন্নতা উপলব্ধি করা যাবে।
কবিতাউৎসব: এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার
প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার
সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই সাহিত্যের
পরিমন্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম
আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে?
বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম
স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: আমরা যখন
ইলিয়াড বা ওডিসি পড়ি, চরিত্রগুলির দেশপ্রেম বা সেই দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে আমাদের সামনে। তবু তা কালোত্তীর্ণ। কারণ তা মানুষকে স্পর্শ
করে। যদিও মানুষের পাঠের অভ্যাস কমে আসছে, তবুও যাঁরা পড়েন- তাঁদের কাছে কাফকা,
মার্কুইজ, সিলভিয়া প্লাথ বা নেরুদা গ্রহণীয়। বিট পোয়েট্রি হয়তো অনেকেই পড়েননি।
কিন্তু বিট পোয়েট্রি দ্বারা প্রভাবিত ডিলান পড়েছেন। আমেরিকার সিভিল রাইটস
মুভমেন্টের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন। বাংলা ভাষাদিবস বিশ্ব ভাষাদিবস হয়ে উঠেছে।
টলস্টয়ের আনা কারেনিনা যখন পড়ি, তখনও রুশ দেশের সংস্কৃতিই প্রকট হয়ে ওঠে। তবুও তা
আমাদের কাছে গ্রহণীয়। একদেশের আন্দোলনের গান আরেক দেশের মানুষের মুখেমুখে ফিরছে। এ
ঘটনা আমরা বহুবার ঘটতে দেখেছি। অতএব দেশপ্রেম সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ হবার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে, এমন নয়। তবে বিশ্ববোধ বলতে
যদি মানবতাবোধ বোঝায়, তা অবশ্যই জরুরী। সাহিত্য তখনই কালকে অতিক্রম করবে, যখন তা
আগামীর মানুষকে স্পর্শ করবে। তা সে যে দেশেরই মানুষ হোক না কেন। দুর্নীতি,
বিশৃংখলা, যুবসমাজের পদস্খলন বা আদর্শের অভাব, অমানবিকতা, সামাজিক বৈষম্য – এসব
বিষয়গুলি সবসময়, সব কালেই প্রাসঙ্গিক।ভি এস নইপল ত্রিনিদাদকে ভিত্তি করে যে গল্প
লিখেছেন, সে গল্প ইওরোপের মানুষের কাছেও গ্রহণীয় হয়েছে। ভাষাটা এখানে
গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে গ্রহণীয় করে তুলতে দক্ষ অনুবাদের
প্রয়োজন। ঐতিহ্য বা দেশপ্রেম তত বড় সমস্যা বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় না।
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে
বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে
গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের
পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো
দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে।
এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন?
অনেকেই যদিও বলছেন,
এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায়
চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি
আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি?
না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: আপনার প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি অংশ লুকিয়ে আছে। আগেও
প্রচুর কবিতা লেখা হত। তবে তার বেশিরভাগটাই বাইরের আলো দেখতে পেত না। এখন
অন্তর্জালে লেখা হচ্ছে, আগে লেখা হত ঘরের কোণে নিভৃত খাতায়। অন্তর্জাল বিপ্লবে
কবিতার জাত চলে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি না ঠিকই, তবে পাঠকের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
শুধুমাত্র প্রিয়জন লিখেছেন বলেই তাঁকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিলে আদতে সেই
প্রিয়জনের ক্ষতি করা হয়। যাঁরা নতুন লিখছেন, তাঁরা প্রচুর কবিতা পড়ুন। ভালো লিটল
ম্যাগাজিন পড়ুন। কবিতার বই পড়ুন। শুধুমাত্র অন্তর্জাল থেকে পড়লে সঠিক পথ চিনে ওঠা
সম্ভব হবে না। যে কবিতা আপনাকে ভাবায় না, দ্বিতীয়বার পড়তে বাধ্য করে না, সে কবিতা তত
ভালো নাও হতে পারে। তার মানে যে শুধু দুর্বোধ্য কবিতাই পড়তে বলছি, তা নয়। প্রকৃত
ভালো কবিতা আপাতভাবে বোধগম্য হলেও দ্বিতীয় পাঠে তা থেকে নতুন কিছু আবিষ্কৃত হয়।
তৃতীয় পাঠে আরও কিছু। তাহলেই অকবিতা থেকে কবিতা পৃথক করতে পারবেন। নিজের লেখা
কবিতা হল কিনা, কিছুটা হলেও তা উপলব্ধি করতে পারবেন আশা করি। অকবিতার স্তূপের
প্রসঙ্গে বলি। অকারণ পরনিন্দা না করে কেউ যদি কবিতা প্রয়াসী হয়ে কাটাতে চান, সে ত
ভালোই। কে বলতে পারে, এই প্রয়াসের ভেতর থেকেই একজন নতুন প্রতিভা উঠে আসবেন না!
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা
সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের
কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায়
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন,
এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার
ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান
লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা,
রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত;
নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই
বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে কি? বা পারলে
সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: যন্ত্রণাহীন
প্রসব আর সোনার পাথরবাটি বোধহয় একই জিনিষ। উত্তাল পরিস্থিতিই ত নতুনের জন্ম দেবে।
বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস সে কথাই বলে। ডিকেন্সের ‘হার্ড টাইমস’, গোর্কির ‘মা’, জন
স্টেইনবেকের ‘দ্য গ্রেপস অফ র্যথ’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’- প্রত্যেকটি ক্লাসিকেরই মূল উপজীব্য ছিল সামাজিক
অস্থিরতা। সাম্প্রতিক সামাজিক পরিস্থিতি নিয়েও যে একেবারেই লেখা হচ্ছে না, তা নয়।
তবে এখনও হয়ত তেমন আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখা উঠে আসেনি। তবে আসবে, এ বিশ্বাস আছে। কবিতায়
কিছু কাজ হচ্ছে। অতিসাম্প্রতিক এরকম বইয়ের প্রসঙ্গে কৌষিকী দাশগুপ্তের ‘আমি
যাদবপুর হতে চাইনি’ বইটির কথা মনে পড়ছে। নাট্যপরিসরে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমি
আশাবাদী। এখন কিছুটা ভয়ের আবহ আছে ঠিকই। তবুও তারই মধ্যে হয়ত কেউ গোপনে কলম ধরছেন।
সময় হলেই তা প্রকাশ পাবে।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান
জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন।
যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক
অস্থিরতার দহন নেই, আছে
শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,
কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো
মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি
জুটবে? কবির
কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: কীটসকে একসময় পলায়নবাদী কবি বলা হত। কিন্তু গভীর অধ্যয়ন
করলে বোঝা যায়, ‘এসকেপিজম’ আসলে ক্ষণস্থায়ী একটি ঠিকানা। নিরন্তর জটিলতা থেকে
সাময়িক মুক্তি চাওয়া অন্যায় নয়। কবি অস্থিরতার হাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আশ্রয়
চাইছেন কবিতার কাছে, সাহিত্যের কাছে। সেই আশ্রয় পাঠকেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুজনেই
জানেন, বাস্তবকে এড়িয়ে থাকা যায় না। যন্ত্রণা আছে বলেই পলায়ন আছে। তাতেও যন্ত্রণাকেই
স্বীকার করে নেওয়া হয়। অসুখ সারাতে হলে অন্যান্য ওষুধের পাশাপাশি ব্যথার ওষুধেরও
প্রয়োজন পড়ে। তবে ব্যথার ওষুধ কখনোই নিরাময় এনে দেয় না। একথা কবিও জানেন। পাঠকও ।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার
তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক
সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে।
আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি
সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: শ্লীলতা ও শ্লীলতা আসলে আপেক্ষিক দুটি শব্দ। লেখক কী
লিখছেন, তার ওপরে এর অনেকাংশ নির্ভর করে। অকারণ অশ্লীলতা অবশ্যই বর্জনীয়। কিন্তু
ধরা যাক, কেউ একজন তাঁর উপন্যাসে সমাজের একেবারে প্রান্তিক অবস্থানের মানুষদের কথা
লিখবেন। সেক্ষেত্রে তাঁকে এমন কিছু ভাষা প্রয়োগ করতে হবে, যা সমাজের অন্য স্তরের
মানুষের কাছে আপাতদৃষ্টিতে অশ্লীল। একজন গুণ্ডা নিশ্চয় সাধু ও সুচারু ভাষায় হুমকি
দিতে আসবে না। যদি আসেও, তবে সেটা ব্যতিক্রম। সাহিত্যের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি সৎ
থাকতে গেলে কখনো কখনো এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবেই। এড়ানো যাবে না। তবে কতটা
বলবেন, আর কতটা সুতো ছাড়বেন পাঠকের হাতে- সেই মাত্রাজ্ঞানই লেখকের মুনশিয়ানা।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত বাংলায়
কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি
ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ
বাংলা সাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের
দু’পারে
দুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি
ভাবে দেখতে চান?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: ভাষাই দুই বাংলার যোগসূত্র। কাঁটাতারের ক্ষত সহজে শুকিয়ে
আসার নয়। তবে এই দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে
সামঞ্জস্য বিধান করতে গেলে পাঠককে অন্যপারের সাহিত্য নিয়ে আরও বেশি মনযোগী হতে
হবে। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখানকার সাধারণ পাঠক ওপারের লেখক কবি নিয়ে যথেষ্ট
আগ্রহী। তাঁরা আল মাহমুদ পড়েন,ইমদাদুল হক মিলন এবং হুমায়ন আহমেদও পড়েন। তবে
আরও বেশি পাঠের প্রয়োজন আছে। ওপার বাংলার মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাহিত্যে,
কবিতায় কাঁটাতার বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে না। অনেকসময় একপারের মানুষ অন্যপারের লেখক
কবির বই ইচ্ছা থাকলেও সংগ্রহ করে উঠতে পারেন না। কারণ সহজলভ্যতার অভাব। এ বিষয়ে
কিছু করা যায় কিনা, ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখন্ডিত
জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান; যাকে পুঁজি
করে ইঙ্গ-মার্কিন মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে
সদাসক্রিয় থাকে; নেট
বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে
মুক্ত করতে পারবো আমরা?
আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে
বলে আপনি মনে করেন!
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: এ প্রসঙ্গে প্রথমেই সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পটি মনে পড়ে গেল। ধর্ম
কথাটির মূল অর্থ হল এমন কিছু, যা আমার অস্তিত্বকে ধারন করে। মানুষের অস্তিত্বকে
ধারন করে মানবতা। যে ধর্মই আমরা পালন করি না কেন, যদি মানবতাকে ধারন করতে না পারি-
তবে আমরা ধর্মভ্রষ্ট হই। সাম্প্রদায়িকতা একটি সুচতুর রাজনীতি। তা সে যেভাবেই
প্রয়োগ করা হোক না কেন। উদ্দেশ্য যদি সৎ হয়, তবে কোন কিছুই অসম্ভব নয়। অন্তর্জাল
ব্যবহার করে যদি ঘৃণা ছড়ানো সম্ভব হয়, তবে তার সঠিক প্রয়োগে ঘৃণা মুছে ফেলাও সম্ভব
হবে। অসহিষ্ণুতা দুর্বলতার আরেক নাম। একথা বোঝার সময় এসেছে। মাটি শক্তিশালী, তাই
সে ধারণ করে। অকারণ ধ্বংসলীলায় মত্ত হয় না। সহিষ্ণুতাই ধর্মের শক্তি। সাহিত্য এ
কাজে বিরাট ভূমিকা নিতে পারে। সাহিত্য পাঠককে সচেতন করে তুলতে পারে। এখনই তা করা
প্রয়োজন। এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে। সাহিত্যই ভুলপথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনতে
পারে।
কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের
অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের
কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: লেখক যা লেখেন, তার গভীরে কিছু বক্তব্য নিহিত থাকে। আমি
অবশ্যই চাইব, পাঠক আমার কবিতা, গল্প এবং অন্যান্য গবেষণামূলক গ্রন্থগুলি নিবিড়ভাবে
পাঠ করুন। কী লিখলাম, কেন লিখলাম- সে কথা বঝার চেষ্টা করুন। তাঁদের বক্তব্যগুলি
আমাকে জানান। ভালো লাগলে জানান। মন্দ লাগলেও। পাঠকের নিবিড় পাঠই কবি সাহিত্যিকের
কাছে পৃষ্ঠপোষকতা। তাঁর এগিয়ে চলার রসদ। এতদিন অনেক পাঠকের ফোন বা মেসেজ পেয়েছি।
একটি বই পাঠ শেষ করে যখন তাঁরা অন্য বইয়ের খোঁজ করেছেন, তখন নতুন করে আবার লেখার
উৎসাহ পেয়েছি। এভাবেই উৎসাহ দেবেন , এই অনুরোধ রইলো।
কবিতাউৎসব: আপনার সাহিত্যচর্চার আজীবন
সাধনার বিভিন্ন পর্ব পেরিয়ে এসে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা তৃপ্ত আপনি? আর কতটা
আক্ষেপ রয়ে গেল? ভবিষ্যতের
বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার: সাধনা
আছে।
দু একটি নুড়ি কুড়িয়ে নিতে পেরেছি হয়তো। এখনও বহু পথ বাকি। বহু পাঠ বাকি। তৃপ্তি আসেনি। আক্ষেপ অনেক। তৃপ্তি আসার মত কিছুই করা হয়নি এখনো। প্রয়াস আছে, থাকবে।
ভবিষ্যতের
বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমি আশাবাদী। অনেক নতুন কলম উঠে আসছে। নতুন কাব্যভাষার খোঁজ অব্যাহত। পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। এর মধ্যে দিয়েই বাংলা সাহিত্য এগিয়ে যাবে।
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার:কর্মকার:কর্মকার: ইংরাজি
সাহিত্য এবং শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একটি স্কুলে ইংরাজি পড়ান। কবিতা তাঁর আশ্রয় । গল্প, প্রবন্ধ লেখেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দেশ, কবি সম্মেলন, কবিতা পাক্ষিক, দিবারাত্রির কাব্য, মাসিক কৃত্তিবাস ইত্যাদি পত্রিকায়। গল্প প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক বর্তমান, যুগশঙ্খ, সুখবর ইত্যাদি পত্রিকায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরোজা রঙের ঘুম’ (প্রতিভাস)। কাব্য সংকলন- বাছাই কবিতা ১, বাছাই কবিতা ২( বোধিসত্ত্ব)। প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থ- ‘বব ডিলানঃঅন্তহীন
যাত্রা (বোধিসত্ত্ব), ‘বিটলসঃ বদলের তালে তালে’ (বোধিসত্ত্ব), ‘পল রোবসনঃ শিকল ভাঙার গান’ (বোধিসত্ত্ব)। সম্পাদিত গ্রন্থ- ‘দহন’, ‘বাঁধভাঙা রোদ্দুর’, ‘শব্দের চুপকথা’, বেঁচে থাকার গল্প’ (বাতায়ন)। পুরস্কার- আন্তর্জাতিক বাংলা কবি ও কবিতা সম্মান (২০১৭, ২০১৮), পারিজাত সাহিত্য রত্ন সম্মান, সাতকাহন শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক সম্মান।