মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২০

সম্পাদকের কলমে




সম্পাদকীয় কবিতাউৎসব মাঘ ১৪২৬

এই সংখ্যার সাথেই সম্পূর্ণ হলো কবিতাউৎসবের চতুর্থ বর্ষ। সামনের ফাল্গুনে কবিতাউৎসব পাঁচে পড়বে। এই চার বছরে কবিতাউৎসব থেকে একটি শারদ সংখ্যা সহ মোট ৪৯টি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এবং ধরাবাহিক ভাবে। ধারাবাহিক ভাবে একটি মাসিক কবিতা পত্রিকার একটানা চার বছর প্রকাশিত হয়ে চলা খুব একটা সহজ কথাও নয়। হ্যাঁ ওয়েব পত্রিকার একটি বিশেষ সুবিধা আছে। ছাপাখানাজাত পত্রিকার সেই সুবিধা থাকে না। সেটি ব্যায়বহুল একটি প্রয়াস। ওয়েব পত্রিকা প্রায় নিখরচায় প্রকাশ করা যায়। সম্পাদকের পরিশ্রমকে যদি খরচের ভিতর ধরা না হয়। তাহলেও দুই বাংলার কবিতার সম্ভার নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ৪৮টি সংকলনের প্রকাশ একটু বিস্ময়ের বইকি। বিশেষত শুধুমাত্র কবিতা ছাড়া আর কোন রকমের লেখা যেখানে প্রকাশিত হয় না। শারদ সংখ্যাটিকে এই হিসাবের বাইরে ধরেই। আবার এটাও ঠিক যে, শুধুমাত্র কবিতার পত্রিকা বলেই হয়তো এইটি সম্ভব হয়েছে। প্রতিদিন যে পরিমানে কবিতার জন্ম হয়, সেই পরিমাণে কেন তার অর্ধেক পরিমানেও গদ্য সাহিত্যের জন্ম হয় বলে মনে হয় না কিন্তু। অর্থাৎ কবিতা যত সহজে পাওয়া যায়, গদ্য লেখা তত সহজে পাওয়া যায় না। তাই কবিতার পত্রিকা প্রকাশ করা কিছুটা সহজ কাজ।

একদম প্রথম সংখ্যা থেকে কবিতাউৎসবের প্রধান যেটি বৈশিষ্ট ছিল, সেটি হলো প্রত্যেকের ন্যূনতম পাঁচটি করে কবিতা প্রকাশিত করা। তার একটি বড়ো কারণ এই যে, আমরা মনে করেছিলাম পরপর পাঁচটি কবিতার ভিতর দিয়ে কবিতা রচয়িতার কাব্যধারা সম্বন্ধে পাঠকের মনে একটি স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠবে। যেটি একটি মাত্র কবিতা পড়ে সম্ভব হয় না। তাই এই ভাবেই প্রতি সংখ্যায় সর্বাধিক সাতচল্লিশ জনের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে প্রথম তিন বছর। ফলে প্রায় প্রতি সংখ্যায় দুই বাংলার দুইশতাধিক কবিতার একটি বিপুল সম্ভার আমরা তুলে দিতে পেরেছি আমাদের পাঠকের হাতে। সাম্প্রতিক বছর থেকে অবশ্য আমরা ন্যূনতম পাঁচটির বদলে ন্যূনতম তিনটি করে কবিতাই প্রকাশ করছি। আমাদের আশা এতে উৎকর্ষতার সাথে পরিমাণের একটি ভারসাম্যও রক্ষিত হতে পারে। বিশেষ করে যাঁদের কবিতা নিয়েই এই কবিতাউৎসব, তাঁরা অধিকাংশই ন্যূনতম তিনটি করে কবিতা প্রেরণেই অধিকতার সন্তুোষ জ্ঞাপন করছেন।

অনেকেই মনে করতে পারেন, কবিতাউৎসব বিপুল পরিমাণে কবিতা প্রকাশের দিকে অধিকতর মনোযোগ দিতে গিয়ে হয়তো বা সাহিত্যের উৎকর্ষতার সাথে আপোষ করে ফেলছে। এখানে সম্পাদক হিসাবে একটি কথা বলে রাখা ভালো। আমরা কখনোই এমন দাবি করি না, কবিতাউৎসব দুই বাংলার শ্রেষ্ঠতম কবিতা মাসিক। আমরা এও দাবি করতে পারি না যে, কবিতাউৎসবে প্রকশিত সব কবিতাই সেরা মানের। না অমন হাস্যকর দাবি কবিতাউৎসবের নয়। প্রতি সংখ্যাতেই আমাদের মূল প্রয়াস থাকে আরও বেশি করে, ভালো কবিতা প্রকাশ করার। সেই প্রয়াসকে স্বতঃসিদ্ধ করেই কবিতাউৎসব পরপর পেরিয়ে এল চার চারটি বছর। এই প্রসঙ্গে বিনয়ের সাথে এইটুকুই প্রশ্ন রাখা যায়, যত বড়ো নামিদামি ঐতিহ্যশালী কবিতার পত্রিকাই হোক, প্রকাশিত সব কবিতাই কি কালোত্তীর্ণ হয়? নিশ্চয় নয়। বরং সমসাময়িক অনেক উৎকর্ষ মানের কবিতাও যুগের দাবিতে হারিয়ে যায়। বা ক্ষয়ে যায় তার সাহিত্যিক প্রতীতি। এও যেমন ঠিক, অনেক উৎকর্ষ কবিতার পাশাপাশি অনেক দুর্বল কবিতাও প্রকাশিত হয় বহু বিখ্যাত পত্রিকায়। এটাই সাহিত্যের বাস্তবতা। তাই যদি কেউ দাবি করেন অমুক পত্রিকা শুধুমাত্র উৎকর্ষ কবিতাই প্রকাশ করে, তবে সেই দাবির পরীক্ষা হবে আজকে নয়। ভাবীকালে।

কবিতাউৎসব এমনও দাবি করে না যে, অমনোনীত সব কবিতাই প্রকাশযোগ্য নয়। বা তার কোন না কোন সাহিত্যমূল্য নাই। বরং কবিতাউৎসব এই কথাই স্বীকার করে, উৎকর্ষতার নিরিখে কবিতার বিচার করা মোটেও সহজ কথা নয়। সে বড়ো দুরূহ কাজ। যে কাজে পদে পদে পদস্খলনের সম্ভাবনা প্রবল। যে কোন ভাষার সাহিত্যের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে বরং। আজ যে কবিতা হয়তো কবিতাউৎসবে প্রকাশিত হলো না, কে বলতে পারে সেই কবিতাই অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সাড়া ফেলে দেবে না? তাই কবিতাউৎসবে কবিতা পাঠিয়ে প্রকাশিত না হলেও নিরাশ হওয়ার কিছু নাই। কোটি কোটি কবিতা পত্রিকা রয়েছে কবিতা প্রকাশের জন্য। কবিতাউৎসব তার ভিতরেই একটি পত্রিকা। আমাদের সবসময়ের প্রয়াস এটাই থাকে, ভালো কবিতাকে জায়গা করে দেওয়ার। আমরা নাম দেখে কবিতা প্রকাশ করি না। করি কবিতা দেখে। সেই দেখায় ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। হলে সেই ভুলের দায়িত্ব কবিতাউৎসবের সম্পাদকের।

কবিতাউৎসবের সম্পাদক হিসাবে, বাংলা কবিতার বর্তমান গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে খুব বেশি আশাপ্রদ হওয়ার মতো অবস্থা নাই বলেই মনে হয়। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি না। বলতে চাইছে, বর্তমান নিয়েই। আসলে কবিতা সময়ের দর্পণ। কবিতা সমাজেরও দর্পণ। বর্তমান সময় যে সুস্থ, সেকথা অতিবড় আশাবাদীও হয়তো বলতে পারবেন না। বর্তমান সমাজ যে স্বাস্থপ্রদ, মনে হয় কি তেমনটাও? সাহিত্যের ইতিহাসের পাঠক মাত্রেই হয়তো বলবেন, এইটিই প্রতি কালে সাহিত্যের সত্য। প্রতিকালেই সাহিত্যের দর্পণে সময় ও সমাজের অসুখের চিত্রই প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। ফলে একথা ভাবার কারণ নাই যে অতীতে সময় ও সমাজ অধিকতর সুস্থ ও সুন্দর ছিল। আমরা সকলেই কম বেশি বিষয়টা জানি। বুঝতে পারি। সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা অন্যখানে। সাহিত্যের অন্যতম যে কাজের কথা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গে এইমাত্র আলোচনা করা হলো, সেই সময় ও সমাজের সঠিক প্রতিফলন ঘটানো; সেইটি কি ঘটছে এইসময়ে? আমরা কি আজকের সময়কে তার সঠিক মাত্রায় ধারণ করতে পারছি আজকের কবিতার দর্পণে? আমরা কি আমাদের শব্দ ও ছন্দের খেলা ঘরে বসে বর্তমান সমাজের আর্তনাদকে ধরতে পারছি ঠিকমতো? তাই কি মনে হয় এই সময়ের কবিতা পড়ে? না, দুঃখের বিষয় ব্যক্তিগত ভাবে কবিতাউৎসবের সম্পদক হিসাবে অন্তত সেকথা মনে হয় না। বরং মনে হয়, বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে যে মধ্যমেধার প্লাবন চলছে একটা, যার সুযোগে রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি সর্বত্র মেধাহীন এক জগদ্দল শক্তির দাপট পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে, সেই মেধাশূন্যতার দিগন্তই আমাদের সাহিত্যে, আমাদের কবিতায় থাবা গেড়ে বসেছে আজকে। না কাউকে কটাক্ষ করে নয়, কাউকে ছোট করেও নয়, আজকের কবিতায় বর্তমান সময়ের মেধাহীন সংলাপের আলাপ বড়ো বেশি প্রকট বলেই মনে হয়।

এই কারণেই হয়তো আজকের কবিতা তার সময় ও সমাজকে সঠিক দিশায় ধরতে অপারগ হয়ে পড়ছে ক্রমশ। সাহিত্য সংস্কৃতিকে লালন পালনের জন্য প্রয়োজনীয় মেধার ভাঁড়ারেই কি টান পড়ে নি আজ? আমাদের প্রশ্ন সেইখানেই। আমাদের সংশয় সেইখানেই। আমাদের কষ্টও সেইখানেই। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন খরার সময় হয়তো আগে আসে নি আর। কিন্তু তাই বলে খরা যে একটা চলছে, সেটাই যদি বুঝতে ভুল করি আমরাই, তবে সেও বড়ো পরিতাপের বিষয়। আমাদের আরও নিবিষ্ট হয়ে দেখতে হবে, এই সময়ের কবিতা তার সময় ও সমাজকে সঠিক দিশায় ধরতে পারছে কিনা আদৌ। বিষয়টা যত না বিতর্কের তত বেশি চিন্তার। আমি কাঁটাতারের উভয় পারের কথাই বলছি। কাঁটাতার একটি রাজনৈতিক বিভেদরেখা মাত্র। কিন্তু তাই দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে পুরোপুরি দুইটি পৃথক সত্ত্বায় ভাগ করে দেওয়া সম্ভব নয় কখনোই। এক পারে অসুখ হলে অন্য পারও সুস্থ থাকতে পারে না। এটা ভৌগলিক নিয়মেই সম্ভব নয়।

কবিতাউৎসবে আমরা অন্তত এই বিষয়ে সজাগ থেকে সাধ্যমত আলো ফেলতে প্রয়াসী। যাঁরা এই খরাতেও জল সিঞ্চনের কাজ করে চলেছেন, তাঁদের জন্য কবিতাউৎসব উন্মুখ হয়ে উৎসুক সবসময়। আর তাই কবিতাউৎসব বিশ্বজনীন জীবনের শাশ্বত উদ্বোধন। কবিতাউৎসবের সাথে থাকুন। কবিতাউৎসব সবসময় পাশে আছে আপনাদের।

৬ই মাঘ ১৪২৬