সুতনু
হালদার
মৃগয়া
(১)
মেঘলা
দিনে হঠাৎ হঠাৎই যেন শৈশব ফিরে আসে। রাজপথ
ছেড়ে মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে কোনো এক অজানাকে আবিষ্কার করতে মনের আঙিনায় ঝড় ওঠে।
ধুলোমাখা পৃথিবী অচেনা পাখি হয়ে আমাকে কাছে ডাকে। সেই ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বা
বিলাসিতা কারোরই থাকে না, আমার তো একেবারেই নেই। জীবনে থরে থরে সাজিয়ে রাখা
রূপান্তরিত শিলাগুলো চমকে ওঠে। কে যেন ওদের অগোচরে বলে যায়, 'হেথা নয় অন্য কোথা
অন্য কোনোখানে'। এই অন্য কোনো
জায়গার সন্ধান যে একবার পেয়ে যায় তার রাজপথ ছেড়ে মেঠোপথে হাঁটা সার্থক, আর যারা পায় না, তাদের বাড়ির তুলসীতলায়
একটা প্রদীপ সদাজাগ্রত থাকে। হাঁটা শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না...
ছোটোবেলায়
মা-ঠাকুমার মুখে একটা কথা খুব শুনতাম-
'জল ন্যাওটা জল
ন্যাওটা জল কখনো ঘন হয়
হৃদের
মাংস কেটে খেলে পর কখনো আপন হয়?'
একটু বড়
হয়ে বুঝলাম যে,
জল
যেমন ঘন হয় না,
পরও
তেমন হয়ত আপন হয় না, কিন্তু অভিজ্ঞতায় মিললো কই? পরই তো চিরকালীন বংশীধ্বনিতে আপন হয়ে হৃদয় জিতে
নেয় আবহমান।
কত কিছুর
মধ্যে আপন হারিয়ে যায়! কত তুচ্ছ ঘটনায় আপন-পর ভেদাভেদহীন হয়ে একঢাল মেঘকালো চুল
ভিজিয়ে দিয়ে অনুভূতিকে বাঙ্ময় করে তোলে, সে কথা তো কারোরই অজানা নয়।
নদীর
মতোই পথেরও স্রোত থাকে, পথেও ঢেউ ওঠে, অলস চোখের ফাঁকফোকর দিয়ে রামপ্রসাদী সুরঝঙ্কার
আমাদের মুগ্ধ করে তোলে। সেই কারণেই শৈশব মূলত এক মেঘলা বাউণ্ডুলেপনা। এই সময়ের
বজ্রবুলি ভাষা কৃত্রিমতার কণ্ঠলগ্না না হয়ে মোহনার অনুগামী হতেই বেশি পছন্দ করে।
মোহনায়
ভেসে চলার অপর নামই তো জীবন। এই জীবন যেমন গাছের আরাধ্য, তেমনই আরাধ্য পাখিদের, তেমনই মানুষেরও...
(২)
পুরানো
অভ্যাসগুলো অনেকটা টিকটিকির মতো, তাড়ালেও যায় না! প্রত্যেক রবিবার আমার যাপনে সেই টিকটিকি
ফিরে আসে,
তাকে
আমি চাইছি কিনা সেই বিষয়ে তার কোনো ধার ধারার বালাই নেই; আর নেই বলেই হয়ত আকাশ
রৌদ্রাচ্ছন্ন থাকে। এই আকাশে আমিই একমাত্র পাখি হয়ে উড়ি। উড়তে উড়তে একসময় ক্লান্ত
হয়ে যখন মাটিতে পা রাখি ঠিক তখনই শুরু হয় এক বৈমাত্রেয় কোলাহল।
যারা
কোলাহল প্রিয় তাদের কোনো সমস্যা হবার কথা নয় কিন্তু আমি কোলাহলকে বরাবর এড়িয়ে
যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এই অনুভূতির কথাটা একমাত্র আমার সাড়ে চার বছরের
কন্যা শিঞ্চনী বুঝে ফেলেছে। সুতরাং রবিবার সে শান্ত থাকে।
ওই শান্ত
থাকাটার মধ্যে আমি আলপনার শান্তি খুঁজে পাই। প্রতিদিন নিয়ম করে বাড়ির তুলসী
মন্দিরের চারিদিকে যে আলপনা দেওয়া হয়, রবিবার যেন সেটা আরো উজ্জ্বল হয়ে আমার চোখে ধরা
পড়ে। সেটার মধ্যেই জীবনের গোপন সমস্ত জলতরঙ্গ লুকিয়ে রাখতে গিয়ে এক এক সময় একটা
কস্তুরী গন্ধ মন ছুঁয়ে যায়। মনে পড়ে যায়, জীবনই তো একটা আস্ত মৃগয়াক্ষেত্র, এক অবাধ চারণ
ভূমি...
সবুজ
ঘাসের ওপর নরম চাঁদের আলোয় মাথা রেখে মন গেয়ে ওঠে -- "মন্দির বাহির কঠিন
কপাট/চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট..."
আর
তৎক্ষণাৎ সেই অবাধ্য টিকটিকিটা কর্কশ স্বরে আবার ডেকে ওঠে!
(৩)
আজ দোল
পূর্ণিমা। রং খেলছে সবাই। আমার জানলার বাইরে যে আকাশটুকু আমার নিকট আত্মীয়, সেখানেও রঙের ইশারা।
গাছের পাতায় পাতায় আজ রঙের খেলা চলছে, উৎফুল্ল মেঘে মেঘে আজ উৎসবের আয়োজন...
এই
দেহভাণ্ড ছুঁয়ে রং অনায়াসেই পৌঁছে যাচ্ছে পঞ্চেন্দ্রিয়ই। নদীর পলিতে যে বিশ্বাস
থাকে তেমন বিশ্বাস পৃথিবী যেন ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে! এখনো যেটুকু রয়ে গ্যাছে তাতেই
ফুল আর নারীর সুষমা বাউণ্ডুলে বাতাসকে রঙিন আলিঙ্গনে মাতিয়ে দ্যায়; তবুও আমার মন আজ
কিছুতেই যেন সায় দিচ্ছে না! যে রং অন্ধকারের হাতছানিতে নিজের জিভকে দ্বিখণ্ডিত
করতে পারে সেই রঙে আর নিজেকে রাঙাতে ভালো লাগে না।
সব পাখি
ঘরে ফিরলে কে যেন পরম মমতায় আমাকে গান শোনায়- 'রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে
রহিল...'
(৪)
শুধুমাত্র
একাকীত্বে কখনো কোনো জোড়াতালি থাকে না, কেউ এমন অভিযোগ কখনো করেছে বলেও শুনিনি; তাই মেঘেরা এমন
নিশ্চিন্তভাবে ভেসে বেড়াতে পারে, ওদের কোনো একাকীত্বও নেই; নদীরও থাকে না।
যদিও ঠিক
আমার মতোই গাছেদেরও একাকীত্ব থাকে, আর একাকীত্বে ভোগে দুপুরের নিশ্চয়তাগুলো। অথচ তোমাকে এত
রেগে কথা বলতে আমি আগে কখনো শুনিনি, আজ যখন শুনলাম, তখনও ছিল ঠিক
একাকীত্বে ভোগা এক অখণ্ড দুপুরবেলা; এটাই ব্যতিক্রম, অখণ্ডতার মধ্যেও যে একাকীত্বের
মিশ্রণ,
তার
নিশ্বাসে একটা চোরাস্রোত থাকে, যেটা আজকেই প্রথম বুঝতে পারলাম, আর চিনলাম প্রতিটা মুহূর্তের
সূচনায় লুকিয়ে থাকা এক ভোরের বাতাসকে। সেই বাতাসে খসে পড়া পাতারা যেমন উড়ে যায়
তেমনই আজ তোমার রাগত কণ্ঠও সুর তুলেছিল, 'সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না এই
দুয়ারে...'
এই
অনুভূতি,
খসে
যাওয়া পাতারা বোঝে তাই নিঃসঙ্গতা তাদের
কষ্ট দেয় না,
বরং
অনাগামী বসন্তকে তারা আহ্বান জানাতে উদগ্রীব হয়ে উঠলে আবহ সংগীত ভেসে আসে- 'বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার
তারে তারে।'
(৫)
রুক্ষতার
মধ্যেও একটা নমনীয়তা থাকে। বেশ কয়েকদিন গৃহবন্দী থাকতে থাকতে আমি সহসা এই সত্যটা
অনুধাবন করলাম। হালকা আমেজ ধরতেই ব্লেন্ডার্স প্রাইডে ঘন কুয়াশা যেন নিজের
কুমারীত্বের দেমাকি চাল দিতে তৎপর!
অচিরেই
ফুটিফাটা দেমাক আজ সর্বত্র করোনা সন্ত্রস্ত ; গাছের পাতাগুলোর যে বিচ্ছেদ হয়
তা বসন্ত জনিত,
আর
আমরা গভীর শীতলতার নামাবলি গায়ে চাপিয়ে বিচ্ছিন্ন...
নিশ্বাসের নিটোল উপবাসে সার্জিকাল মাস্ক আকাশ
গড়ে তোলে,
পথের
ধারে ধারে স্মৃতিরা ওৎ পেতে বসে থাকতে থাকতে কোনো এক অবসরে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে!
কে বলে স্মৃতিরা কেবলই নির্বান্ধব? কেবলই ছবি? একশো পঁচিশ ন্যানোমিটারের আণুবীক্ষণিক শপথ রাস্তা
পারাবারে যখন প্রচণ্ড রকম ব্যস্ত ঠিক তখন ধুলোঝড়ে মনটা কেমন যেন আঁতকে ওঠে! ভীড়
জমায় আমাদের ফেলে আসা স্মৃতির তুষারবিন্দু...
কতদিন আর
যাওয়া হয় না বগা দার চায়ের দোকানে! আতশ কাচের সোচ্চার বাৎসল্য পুরোটাই আইসোলেশনে
রোদ্দুর পোয়াচ্ছে; ভবিতব্য সেখানে মেঠোপথ আর রাজপথের দাড়িপাল্লাকে সমান করে দিয়েছে!
এরথেকে বড় সাম্য এই পৃথিবী আগে কখনোই দ্যাখেনি...
এখন দিন
আর রাতের মূলত পার্থক্য শুধুমাত্র গা জোয়ারি উপকথা ভিত্তিক একটা বিষাদ মাত্র। নিপুণ জ্যোৎস্নার গর্ভাশয় সাবলীলতায় লকডাউন।
কখনও কখনও মমত্ব মিশিয়ে রাবীন্দ্রিক সুর মূর্ছনা ভেসে ওঠে -'আমি ভিক্ষা করে
ফিরতেছিলেম গ্রামের পথে পথে...'। সেই পথই রুক্ষতাতে পরম আদরে নমনীয়তা মিশিয়ে দ্যায়; প্রতিটা কণ্ঠে যে
আকাশসীমা থাকে সেখানে স্মৃতিমেদুর আবছা আলো-আঁধারি বারবার যেন হাতছানি দ্যায়...
(৬)
লকডাউনের
প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করত, কথা যেটুকু বলতাম তাতে মুঠোফোন হাঁপিয়ে যেন হাঁপর
কাটত; অথচ রাতের
জ্যোৎস্নাগুলো আমাকে ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমীর গল্প শোনাত! প্রতিটা রাত এখন নদীর হয়ে
আমাকে সঙ্গ দ্যায়, স্রোতে ভাসায়, জোয়ারভাটা দ্যাখায়; আমাকে কখনো নিজের স্রোতে মিশে
যেতে বলে না,
উল্টে
আমাকে পলি ভেবে নিয়ে নিজের ইচ্ছাতেই আমাকে নিয়ে বয়ে চলে! এই রাতের সঙ্গে তোমার কত
মিল! এখানেই আমরা একীভূত হয়ে গান শুনেছি কতবার, এস্রাজে আমরা পূরবী, ভৈরবী ফুটিয়ে তুলতে
তুলতে একসময় নিতান্তই বেখেয়ালে যেন অন্তরায় পৌঁছে গিয়েছিলাম...
হিমালয়ে
এখন অনেক বেশি বরফ জমে, প্রকৃতি এই কয়েকদিনেই অনেক বেশি যৌবনা হয়েছে; তোমার প্রিয় পশুরা
এখন আর রাস্তা পারাপার করতে ভয় পাচ্ছে না। ওরা সবাই এখন খুব কাছাকাছি! একদিন তুমি
আর আমিও তো এমনই ছিলাম। আজ ওরা আমাদের সেই পথেই শিশিরের প্রলেপ দিচ্ছে! রাজার বদল
হলেও পথের ভাগ্য চিরকালীন প্রজাস্বত্ব থেকে বঞ্চিত হতে শেখেনি।
যা কিছু
শেখার প্রকৃতি তা সর্বদা পুরুষকেই শেখাতে
পছন্দ করে। অন্য কেউ সেই ভাগের অংশীদার হতে পারে না;
তোমার
মুখ জ্যোৎস্নালোকিত হয়ে চোখের তারায় উষ্ণ মদিরা পানের আকুতি জানাত, সেই আকুতি অনেকদিন
পর আজকে আবার ভিডিও কলে দেখলাম! ক্ষুধার্ত পাকস্থলি ভর্তি করে আমি যখন খেয়ে নিতাম
এক আকাশ জ্যোৎস্না; পুরোটা দেখেও তুমি আমাকে কক্ষনও কিচ্ছুটি বলতে না! আশ্চর্য! তখন
জানার চেষ্টাও করিনি ওসব তোমার পছন্দের ছিল কী অপছন্দের? এখন বুঝি, মুখে বলার থেকে হাতে
ধরে বুঝিয়ে দেওয়াটাই তোমার বেশি পছন্দের...
ভোরের
নতুন আলোয় অনেকদিন পরে আজ আবার তোমাকে দেখলাম। আগেও এমন তো কতই দেখেছি! পরস্ত্রীর
মতো নিবিড় এক আকর্ষণে ছুটে গেছি তোমার কাছে, তুমি পরম আদরে কাছে টেনে নিতে।
প্রাথমিকভাবে
আজ অবশ্য তেমন কিছুই করলে না! নদীর স্বচ্ছতায় তোমার মধ্যে নিজেকেই বারবার দেখতে
পাচ্ছিলাম। ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করতেই তখন তুমি ব্যস্ত! বেশ কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাকে
আলিঙ্গন করে নিজেই ঢেউ হয়ে ঝাপিয়ে পড়লে আমার বুকে, একান্ত গোপনে যেভাবে নারীরা
প্রকৃতি হয়ে ওঠে ...