বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১৮

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়






কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  ১৪২৫

কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: কবি ও চিত্রকর শ্রদ্ধেয় রমেন আচার্য মহাশয় কবিতার শিল্পকলা প্রসঙ্গে বলেছেন, কবিতা হল মানুষের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠতম শিল্পমাধ্যম। সেই কবিতাকে নিয়ে যে উৎসব, তা তো আর পাঁচটা উৎসবের মত নয়!  প্রবীণ-নবীণ সব কবিরা জাতিধর্ম নির্বিশেষে যূথবদ্ধভাবে এত সুন্দর একটা সৃষ্টির মধ্যে থাকেন, দেখে অনুপ্রাণীত হই।বাংলা কবিতা নিয়ে একটা নিশ্চিন্ত বাতাবরণ তৈরি হয়। বিপুল প্রভাব তৈরিতে আবৃত্তিকারদের অনস্বীকার্য ভুমিকার কথাও এসে যায়।   
    
না, আমার লেখকসত্ত্বা গড়ে ওঠার পেছনে কবিতাউৎসবগুলির সরাসরি যোগসূত্র ছিলনা। একটা সময়ে কবিতা এসেছিল অবশম্ভাবী হয়ে। এটা আমার মনের একটা অভিবাসন ছিল বলা যায়। তবে পরে এই  উৎসবে আমিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামিল হয়ে গেছি। এরা আমাকে উজ্জীবিত করে। ‘বিশ্ব কবিতা উৎসব’ আমার কবিতাজীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট।


কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার শুরুর সময় থেকে আজ অব্দি সময় সীমায় কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে কি? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব আমাদের বঙ্গসংস্কৃতিতে কবিতা লেখা কতটা হুজুগ সর্বস্ব আর কতটা সাধনা সাপেক্ষ বলে মনে হয় আপনার।

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: বিষয়ের সঙ্গে কবিতার ফর্মও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। উত্তর-আধুলিক কবিতা  থেকে সাধারণ পাঠকরা দূরে চলে যাচ্ছেন, সেগুলি শুধু কবিদেরই অধিগত। আবৃত্তিযোগ্যতা না থাকায়, বাচিকশিল্পীরাও সেগুলি থেকে দূরেই থাকেন। পুরোনো ঘরানার কবিতাগুলি সাধারণ মানুষের অন্তরে সহজে ঘা দেয় এখনও, এ এক অমোঘ সত্য।
    
কবিতা তো শিল্প, তাই সাধনা-অর্জিত হতেই হবে। বঙ্গসংস্কৃতিতেও তার অন্যথা হয়নি, হবেওনা। তবে কবিতার হুজুগ সমাজের কোনও ক্ষতি করেনা, বরং সৃজনে দলবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখে।  আজকের এই বিপন্ন সময়ে তার দাম আছে। কবিতার এই হুজুগ থাকুক না। মহাকাল নিরপেক্ষ দক্ষ শল্য-চিকিৎসক। বাকিটা তাঁর হাতেই থাক  


কবিতাউৎসব: কবিতা লেখার প্রেরণায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ না কি অভিজ্ঞতাজাত জীবনবোধ সঞ্জাত চেতনার নান্দনিক বিকাশ, কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার কাছে? যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন এই বিষয়ে।

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: কবিতা কবির আত্মগত হওয়ার মাধ্যম। দৃশ্যমান বস্তুজগতের ভালমন্দই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা। কবিতায় শব্দে, ছন্দে চিত্রকল্পে এগুলির প্রক্রিয়াকরণ হয়। এই প্রক্রিয়াকরণ যদি বৃক্ষশরীর হয়, তবে স্বত:স্ফুর্ত আবেগ তার মাটিজল, যা তাকে ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ থেকে ‘নীরস তরুবর’ করে তোলে এটাই নান্দনিকতা। আমি মনে করি দুটিকে পৃথক করা যায়না।


কবিতাউৎসব: কাব্য সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক চিরন্তন। একবিংশ শতকের প্রথম পর্যায়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী আমরা।

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: কাব্যসাহিত্যে এইদুটির সীমারেখা ক্রমশ ধূসর হয়ে যাচ্চে কিন্তু শব্দ তো ব্রহ্মসেই অস্ত্রের প্রয়োগে আমি কিছুটা সীমা টানার, তাকে সান্ধ্যতে সীমিত রাখার পক্ষপাতী। প্রসঙ্গত: নারী হিসেবে আমার একটি অনুভব আছে। সমাজে ধর্ষণে নারী কবিরা বেশ সোচ্চার হন, অথচ সীমা-অতিক্রান্ত কবিতায় কেউ কেউ অংশগ্রহণও করেন। এক প্রাক্তন কবি বলেছিলেন, কবিতা হল নারীর জঙ্ঘার মতন, তাকে নীরবে নিভৃতে অনুভব করতে হয়। আমার মনে হল, তিনি কবিতাকেও অপমান করলেন, নারীকেও। জানি আমার এসব কথা অনেক বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। কবিতা তো অলৌকিক সৃজন! এখানে নিছক লৌকিক আনন্দ বহনের পক্ষে আমি নই। এগুলি আসলে সুযোগ নিয়ে কবিতাকে বিক্ষত করাও বটে। এসব কবিতা ক্ষণিকের, কোনওদিন চিরায়ত হয়নি, হবেওনা। এক্সপেরিমেন্টের শেষে তাঁরা ক্লান্ত  হয়ে ফিরে যাবেন গুরুদেব জীবনানন্দের স্থিতধী প্রেমের আলোমাখা আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে। কবিতার শালীনতা রক্ষার কাছে মাথা নীচু করতেই হবে।


কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আদিগন্ত জুড়ে যে তিনজন কবির ভুমিকা বা প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেই রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও জীবনানন্দের কাব্য ভুবন ছাড়িয়েও বাংলা কাব্যসাহিত্য আজ অনেকদূর বিস্তৃতি লাভ করেছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে আজকের বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ণ সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন বিস্তারিত ভাবে।

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: সত্যি, এ বিস্তৃতির তুলনা নেই। সবচেয়ে ভাল লাগে ভাবতে, মহিলা ও পুরুষ কবিদের অংশ আজ বোধকরি সমান সমান। তাঁদের মধ্যে থেকে শক্তিশালী অনেক কবি বেরিয়ে এসেচেন এবং আসচেন। বিষয়-বৈচিত্র্যে, মননে ও শিল্পকলায় তরুণ কবিরাও অনেকেই প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন, ধারা শুকিয়ে যাবার প্রশ্নই নেই। কবিতার উপলব্ধিতেও আজকের পাঠকরা আগের থেকে ঋদ্ধ। অনেক নবীন কবি এবং পাঠককেও বলতে শুনি, তাঁরা জীবনানন্দকে বুঝতে পারছেন টীকা ভাষ্য ছাড়াই। এবং তাঁরা রবীন্দ্র নজরুলের পর ঘোরতর ভাবে জীবনানন্দে ডুবে আছেন। জীবনানন্দকে কেন্দ্র করে তরুণ কবিদের সমান্তরাল ঘরানাও তৈরি হয়ে গেছে দেখতে পাই। কিছু কিছু এক্সপেরিমেন্টও কবিতায় নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্চে। এ সবই তো বাংলা কবিতার সদর্থক ফিউচার ট্র্যাভলের সংকেত! দুইবাংলার কবিতার দৈহিক বিস্তৃতিতে ফেসবুকও ফেলনা নয়। এখানে পোস্ট করা অনেক কবিতা রীতিমত উচ্চমানের, চোখে পড়ে।  ব্লগের কবিতাউৎসব গুলোও তো বাংলা কবিতায় বিশ্বায়ন এনে দিয়েচে! এত এত উদ্যম বিফলে যাবেনা।   


কবিতাউৎসব: কবি আর কবিতার পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে সাহিত্য সমালোচকদের ভুমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: সঠিক সমালোচনা কবিকে অনুপ্রেরণা দেয়, সংশোধন করে, কখনও কম প্রচারে থাকা প্রতিভাদের পাদপ্রদীপের নীচেও নিয়ে আসে। সাহিত্য-সমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এ ব্যাপারে লিটল-ম্যাগগুলির ভূমিকা ধারাবাহিক ও প্রশংসনীয়। যাঁরা আলোচনা করবেন, তাঁদেরও নিজেকে তৈরি করার দায় থেকে যায়। নইলে সেখানেও সমালোচনা আসতে পারে। আসচেও, ফেসবুকে দেখচি।


কবিতাউৎসব: কবি হিসাবে একজন কবির সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্বন্ধে আপনার অভিমত কি? আপনি কি কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতায় আদৌ বিশ্বাসী?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রতিটি মানুষইতো সমাজের কাছে দায়বদ্ধ। তাহলে কবিরা নয় কেন? মানুষ কবিদের কাছ থেকে একটু বেশিই দায়বদ্ধতা আশা করেন, যেহেতু তাঁরা কবিদের বৌদ্ধিক মানুষ বলে বিবেচনা করেন। তাঁদেরকে রোলমডেল হিসেবে দেখতে চান। তাই কবিদের দায়বদ্ধতার স্খলন দেখলে মানুষ তাঁদেরকে ক্ষমা করেন না। সংঘাত তীব্র হয়। আদর্শে বিশ্বাসী তরুণ কবি তখন হয় হতাশ হন, নয়তো ‘মহাজন যে পথে গেছেন’- ফলো করেন! দুটি প্রতিক্রিয়াই সমাজের জন্য, কবিতার সামাজিক দায়বদ্ধতার জন্য সুজলা সুফলা নয়।


কবিতাউৎসব: নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্যের পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন আপনি। না কি রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি থেকেও মহত্তর কবিতার সৃষ্টি সম্ভব?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: রাজনৈতিক মতাদর্শ কবিতার সাহিত্যমূল্য নষ্ট করে, এটা বিশ্বাস করিনা। তাহলে কবি বিষ্ণু দে, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখদের কবিতাকে কোথায় রাখব? আসলে মতাদর্শটি খাঁটি আর দৃঢ়ভূমি হলেই মহৎ কবিতার সৃষ্টি সম্ভব বলে আমি মনে করি। সেই প্রেক্ষিতে রাজনীতিকেও সৎ থাকতে হবে, নইলে দৃঢ় মতাদর্শ তৈরি হবে কী করে? মহত্তর কবিতা?


কবিতাউৎসব: কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, ‘সাহিত্যের, সমাজের, আমাদের মূল্যবোধের, আমাদের জীবনযাপনের সামূহিক ক্ষতি করাই এস্টাবলিশমেন্টের কাজআপনিও কি সেই মতে বিশ্বাসী? আবার আমরাই দেখতে পাই এই এস্টাবলিশমেন্টেই অনেক কবি সাহিত্যিককে খ্যাতির শিখরে পৌঁছিয়ে দেয়। একজন সত্যিকারের কবির পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা দুরূহ বলে আপনার মনে হয়?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: কবির কথাটি আংশিক সত্যি বলে মনে করি। মানুষ তাদের নিজেদের মতই এস্টাবলিশমেন্ট পায়, এ তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গোড়ার কথা। এস্টাবলিসমেন্ট রাবণের দশটা মাথার একটা-দুটো মাথা মাত্র একজন সরাসরি আমাকে বলেছিলেন, খাওয়া দাওয়া, মলে শপিং, এবং নিজের পরিবারের বাইরে কিছু নিয়ে তিনি ভাবতে চান না। তবে? এটাই আজকের জনমানস, এস্টাবলিশমেন্ট নিরালম্ব গজায় না।

এস্টাবলিশমেন্টের সাহায্য চন্দ্র-সূর্যের মতই বাস্তব। সেখানে দৃঢ় থেকে একজন সৎ মানুষ ও সৎ কবিই পারেন পরিস্থিতির সামাল দিতে। এগুলি এতই বিরল ঘটনা যে কিছুই প্রমাণ করেনা।


কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যের উপর বিশ্বসাহিত্যের প্রভাব সর্বজনবিদিত। আপনার কাব্যচর্চায় এই প্রভাব কতটা সচেতন ভাবে এসেছে? এই প্রসঙ্গেই জানতে চাইব, আপনার খুব প্রিয় বিদেশী কবি কারা?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়:  সচেতন ভাবে কবিতায় কিছু ফরম্যাট নিয়েচি, ‘ত্রিয়োলে’ আমার খুব পছন্দের। প্রিয়: ব্রেখ্ট্, ল্যাংস্টন হিউজ, অস্টিন ডবশন, রুমি, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা – আরো অনেকেই কম বেশী অছেন।


কবিতাউৎসব: কিন্তু বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রভাব কি বিশ্বসাহিত্যের কোন অংশের উপর দেখা যায় আদৌ? না গেলে কেন?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়:  না। ট্রান্সক্রিয়েশন করার লোক কোথায়? বা টাকা?    তাঁরা নিজেদের মৌলিক লেখাকেই অগ্রাধিকার দেন। বাঙালি পরিশ্রম-বিমুখও বটে। গীতাঞ্জলিই বা কতটা প্রভাব ফেলেছে, সেটা আমার জানা নেই। সরকারি আনুকূল্যে অনুবাদ হতেই পারে, কিন্তু করবার ক্ষমতা, শ্রম দেয়ার ইচ্ছে এবং আন্তরিক আবেগ - এই ত্রিবেণীসংগম হওয়া চাই। বাংলা অকাদেমির যৎসামান্য অনুবাদ ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে আদান প্রদান করে কলকাতায় বিশ্ব কবিতা উৎসবের সভাপতি ও আহ্বায়ক কবি শ্রী আশিস সান্যাল বহু বছর ধরে ওই উপলক্ষ্যে বাংলা তথা ভারতের কবিতার ইংরেজী সংকলন বার করেছেন। বিশ্বের নানাজায়গা থেকে আসা অতিথি-কবিদের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই সংকলন। কিন্তু এইটুকু প্রচেষ্টায় তাঁরা কতটা প্রভাবিত, তা জানতে পারিনি। আমার সৌভাগ্য, তাতে আমার কবিতারও ইংরেজী অনুবাদ (অনুবাদক প্রশংসিতও হয়েচেন) ঠাঁই পেয়েচে, আমি অনুপ্রাণীত। নবীনেরা চাইলে এরকম প্রচেষ্টা শুরু করতেই পারেন। বিন্দু বিন্দু জল দিয়েই তো সাগর!


কবিতাউৎসব: একজন প্রকৃত কবির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার কতটা মূল্যবান? পুরষ্কারের খ্যাতি কবির প্রতিভাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় না কি এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে আরও?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: পুরস্কৃত কবিরা তো সানন্দেই পুরস্কার গ্রহণ করেন দেখি। কখনও কখনও কেউ বর্জনও করেছেন, কিন্তু অর্থমূল্য কি ফেরানো যায় আইনত? সঠিক জানিনা। প্রকৃত কবি উজ্জীবিত হবেন কি হবেন না, সেটা নির্ভর করে তাঁর ব্যক্তিত্বের ওপর। তবে লিটল-ম্যাগ গুলি তরুণ নতুন কবিপ্রতিভাদের  পুরস্কৃত করে থাকে, এই স্টিমুলাস তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। প্রবীণদেরও এঁরা সম্মানিত করেন। এইসব ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটাগুলি বাংলা কবিতার শিকড়ে জল দিয়ে চলেচে।


কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় সাধন কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এই বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের কবিদের ঠিক কি পরামর্শ দিতে আগ্রহী আপনি?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: ঐতিহ্যই একটি জাতির মূল কাঠামো। এই ট্রানজিশন-পিরিয়ড বার বার এসেচে,, কবিতা আবার ঐতিহ্য নিয়েই নতুন করে বেঁচেও উঠেচে দক্ষ ও প্রকৃত কবিদের হাত ধরে। এও তো বাংলা কবিতার ঐতিহ্য। নবীনদের বলি, এমন ভাবে জেল করো, যাতে শ্যামও বাঁচে, কূলও বাঁচে। নিপুণ ফিউশন গড়ে তোলা - এও তো এক কবিতারই  শিল্পকলা।


কবিতাউৎসব: আজকের বাংলা সাহিত্যের দিগন্তে কবি খ্যাতির যে একটি বাজার মূল্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে সেটিকে আপনি কিভাবে দেখেন। অর্থাৎ এর ভালো মন্দ দুই দিকের বিষয়ে যদি বলেন।

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: ভাববার বিষয়।। আগে কবিদের বাজারমূল্য ছিলনা, কথা-সাহিত্যিকদেরই ছিল। ইদানীং হয়েছে, ভালই তো। কবিরা খেতাব, পদ সবই পাচ্ছেন, ভোটও আনছেন। গরিব কবিরা বাসগৃহ পাচ্ছেন, খারাপ কী? কবিতা তো জীবিকা দেয়না! অর্থহীন নরে সবাই অনাদর করে – এও তো সত্যি! আবার তাঁদের দলদাসও বলা হচ্ছে। তাঁরাই বা কী করবেন?  উচ্চাশা তো মানুষেরই ধর্ম। মনে পড়ছে এক অমোঘ পঙ্ক্তি –‘ জীবন এত ছোট ক্যানে?’


কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। পরিশেষে জানতে চাইব বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?

শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: যতদিন লিটল-ম্যাগগুলো থাকবে, ততদিন বাংলার আকাশে কাব্যসাহিত্যের সূর্য অস্ত যাবেনা। আমিও তো লিখে যাচ্চি তাঁদের কাঁধে ভর দিয়েই।


শ্যামলী বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম চন্দননগরে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কল্যানিতে বি এড। কর্মজীবন শুরু কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে। বিবাহ-পরবর্তী সময়ের বেশির ভাগটাই কাটে দিল্লি ,শিলং ,বাংলাদেশ ইত্যাদি করে। লেখালেখি ছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে। বাংলাদেশে থাকাকালীন কবি বেলালভাইএর (চৌধুরী) সম্পাদনায় ওখানকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’য় কবির ‘প্রথম  কবিতা’ প্রকাশিত হয়। ২০০০-এ আবার দিল্লি।  ২০০৪ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন  কিছু কিছু লিটল-ম্যাগ এবং কবিতা-উৎসবের সঙ্গে তখন থেকে যোগাযোগ নিয়মিত হয়। গদ্য লেখেন, কবিতার তুলনায় সামান্য। বিষ্ণুপুর ঘরানায় গান শেখা কলকাতা যুববাণীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি পরিবেশনও করেছেন একটানা দশবছর। পড়তে ভালবাসেন পৃথিবীর প্রাগিতিহাসকে অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর মধ্য থেকে যাঁরা মানুষের ঠিকানা খোঁজেন, তাঁদের সমীহ করেনপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ‘অন্তরিণ’ ও ‘এই ঘ্রাণ এই অভিমান’। ছড়ার বই ‘বকম বকম’।