অসময়ের শীতঘুম
মধুর বসন্ত এসেছে, মধুর মিলন ঘটাতে আমাদের, বলেছিলেন কবি। সেই বসন্ত আবার
সমাগত। শীতের হাড়হিম নিদ্রার অবসানে বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। খোল দ্বার খোল লাগলো যে
দোল বলে দ্বার খোলার আহ্বান প্রকৃতির অঙ্গনে। সেই আহ্বানে সাড়া দিতেই ফাগুনে পলাশে
কবিতাউৎসবের বিশেষ আয়োজন, তৃতীয় বর্ষের প্রারম্ভিক সংকলনের। এই বসন্তেই বাঙালির
জাগরণ মাতৃভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। অমর একুশের স্মৃতিচিহ্ন মর্মরিত বসন্তের
আদিগন্তে উৎসবের পরিসর। সেই কারণেই একুশে ফেব্রুয়ারী আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবসের আবিশ্ব স্বীকৃতিতে মহিমান্বিত। বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই অর্জনের গৌরবে
গৌরবান্বিত আমরা সকলেই। মধুর বসন্তের এই মিলন তিথিতে তাই কাঁটাতারের দুই পারের
নবতম মিলনতীর্থ কবিতাউৎসব তার প্রথম দুই বছর পার করে এই বসন্তেই তৃতীয় বছরের
যাত্রা শুরু করলো। বিগত দুই বছরেই কবিতাউৎসব দুই বাংলার সহস্রাধিক কবিতায় সমৃদ্ধ
হয়ে বাংলা কাব্যসাহিত্যে তার সামান্য অবদান রাখার প্রয়াসে যত্নবান ছিল আন্তরিক
ভাবেই। প্রতি মাসের ‘এ মাসের অতিথি” বিভাগে দুই বাংলা ও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা
বাঙালি কবি সাহিত্যিকদেরকে পাঠকের মুখোমুখি পরিচয় করিয়ে দিতেও অক্লান্ত কবিতাউৎসব। এমাসের অতিথি
ওপার বাংলার সাহিত্যিক জাকিয়া সুলতানা শিরিন। এই বিভাগে
আমন্ত্রিত সকল কবি ও সাহিত্যিকের কাছেই বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ কবিতাউৎসব। দুই বাংলার
কবি ও কবিতার মধ্যে সেতুবন্ধনের স্বপ্ন থেকেই যাত্রা শুরু কবিতাউৎসবের। সেই
স্বপ্নে উভয় পার থেকেই যারা সামিল হয়েছেন কবিতাউৎসবের এই ক্লান্তিহীন পথচলায়,
তাঁদের সকলের কাছেই কবিতাউৎসবের ঋণ অপরিসীম। মাসিক কবিতাউৎসবের সাথে সমান্তরাল
ভাবে এগিয়ে চলেছে পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভও। কানাডানিবাসী কবি মৌ মধুমন্তীর
অক্লান্ত উদ্যোমে ও সৌজন্যে পাক্ষিক কবিতাউৎসব লাইভ বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরে
অন্যতম একটি যুগান্তকারী সংযোজন। আমাদের আশা আরও বেশি করে কাব্যপ্রেমী বন্ধুরা
নতুন এই পরিসরে সংযুক্ত হয়ে সমৃদ্ধ করে তুলতে প্রয়াসী হবেন কাব্য ও কবিতা চর্চার
সামগ্রিক প্রয়াসকেই।
মধুর এই বসন্তে সবকিছুই যে সুমধুর থাকতে পারছে, তাও নয়। বাংলা কাব্য ও সাহিত্যচর্চার
বা আরও বিস্তৃত ভাবে বললে সামগ্রিক ভাবেই সংস্কৃতিচর্চার বর্তমান পরিস্থিতি ও
পরিসর নানাবিধ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। একজন সাহিত্যিকের মেধা ও
মননের মধ্যে সামঞ্জস্যের সূত্রগুলি সবসময়েই যে সুস্থ ও সুন্দর থাকছে আদৌ তা কিন্তু
নয়। ব্যক্তিগত অহং ও পেশাগত অহংকার একজন সাধারণ মানুষের মতো সাহিত্যিকের মননকেও
আচ্ছন্ন করে তুলতে পারে। পথভ্রষ্ট করতে পারে সাহিত্যিক বা কবির একান্ত অভিমুখকেই।
একজন কবি বা সাহিত্যিকের সংবেদনশীলতার পরিসর, সাধারণ ভাবেই অন্যান্যদের থেকে অনেক
বেশি বিস্তৃততর ও গভীরতর হয়ওয়ারই কথা। কিন্তু দুঃখের সাথেই লক্ষ্য করতে হচ্ছে, ক্রমাগত লাইমলাইটে
থাকার সুতীব্র আকাঙ্খা কবি সাহিত্যিকদের সংবেদনশীলতার শক্তি ও ঋদ্ধিকেই একান্ত
ভাবে দূর্বল করে ফেলছে। যেখানে অহং ও অহংকার খর্ব করে দিচ্ছে সংবেদনশীলতার অমোঘ
শক্তিকেই। এইরকম পরিস্থিতি যে কোন নামীদামী বা প্রতিভাশালী কবি ও সাহিত্যিকের
পক্ষে প্রবল ভাবেই বিপদজনক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশ সময়েই আত্মগরীমার আড়ালে
চাপা পড়ে যাওয়া বোধশক্তি অসাড় হয়ে পড়ে থাকার কারণেই কবি বা সাহিত্যিক নিজেই নিজের
অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকেন না। ভাসতে থাকেন নিজস্ব ইগো আর ভক্তপরিবৃত
আত্মতুষ্টির গড্ডালিকা প্রবাহে। যে কোন সমাজের পক্ষেই কবি ও সাহিত্যিকের এ হেন
পদস্খলন তৈরী করে ভয়াবহ এক সামাজিক অবক্ষয়ের। যেখানে ব্যক্তি অহং তছনছ করে দিতে
থাকে মননের সকল পরিসরগুলিকেই, সংবেদনশীলতার সকল অনুভবগুলিকেই। ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকে
সাহিত্য ও সমাজের সম্পর্কসুত্রের একাত্মতা।
সাহিত্য বা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে শিল্পসংস্কৃতি ও সমাজের সম্পর্কসূত্রের
এই একাত্মতার উপরেই নির্ভর করে সমাজ ও জাতির ক্রমোন্নতির। জাতির ভবিষ্যৎ সমাজ
গঠনের ভিত্তিটাই যদি ক্রমাগত তছনছ হয়ে যেতে থাকে, তবে আর যাই হোক শিল্প সাহিত্য
সংস্কৃতি চর্চা এক অর্থহীন ব্যাভিচারে পর্যবসিত হয়ে পড়তে বাধ্য। সবসময়েই যে
ব্যক্তিগত পদস্খলনের মহামারীই এই অবস্থা ডেকে আনে তাও নয়। অনেক সময়েই দেখা যায়
রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধজনিত অবক্ষয়ের হাত ধরেই সংস্কৃতিচর্চার দিগন্ত
অসাড় হয়ে পড়ে থাকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে। যেকোন সমাজের পক্ষেই সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।
বসন্তের এই ফাগুনে পালাশেই অনুষ্ঠিত হয় সারা মাসব্যপি অমর একুশে গ্রন্থমেলা। গোটা
বিশ্বে যার নজির এই একটিই। ঢাকার সেই ঐতিহ্যবাহী বইমেলাতেই বইপ্রকাশের স্বাধীনতা
এখন সঙ্কুচিত হয়ে অধীনস্ত হয়ে পড়েছে প্রাতিষ্ঠিনাকি স্বৈরতন্ত্রের কাছেই। বই
প্রকাশের স্বাধীনতাই যদি না থাকে, তবে মত প্রকাশের উপায়গুলিই তো শেষ পর্য্যন্ত
অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে বাধ্য। নিদারুণ দুঃখজনক হলেও, আজকের বাংলাদেশে ঠিক সেই ঘটনাই
ঘটছে। সংগঠিত ষড়যন্ত্রের সংঘটনে। মানুষের কাছে সঠিক তথ্য ও সত্য পৌঁছিয়ে দেওয়ার
দায় ও দায়িত্বই একজন প্রকাশকের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই প্রকাশক
যদি কোনভাবেই সেই দায় ও দায়িত্ব রক্ষা করতে না পারেন প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরতান্ত্রিক
চোখ রাঙানির দৌড়াত্মে, তবে কি করে তিনি অংশ নেবেন অমর একুশের গ্রন্থমেলায়? আর ঠিক
এই কারণেই অনেক প্রকাশককেই বয়কট করতে হয়েছে ঐতিহ্যবাহী অমর একুশের এই
গ্রন্থমেলাকেই। এই যদি শুরু হয় তবে অচিরেই একদিন প্রকাশকের স্বাধীনতায় হস্তখেপ
করার এই তালিবানী সংস্কৃতিই ঐতিহ্য হয়ে উঠবে বাংলাদেশে। মৃত্যু ঘটবে অমর একুশের
ঐতিহ্যের। এখন প্রশ্ন সেই মর্মান্তিক পরিণতি কি জাতি মেনে নেবে? না কি এখনই রুখে
দাঁড়াবে প্রতিরোধে। অমর একুশের গ্রন্থমেলায় বই প্রকাশের উপর চাপিয়ে দেওয়া
স্বৈরতান্ত্রিক সেনসরের প্রতিবাদে তো বাংলাদেশের সকল প্রকাশকই এবারের গ্রন্থমেলাকে
বয়কট করতে পারতেন। তাহলে একবার হয়তো মেলাটিই সংগঠিত হতো না। কিন্তু তার ফলে যে যুগান্তকারী আলোড়ন
উঠতো, তার সদর্থক প্রভাব পড়তো সংস্কৃতিচর্চার প্রতিটি দিগন্তেই। সারা বিশ্ব তাকিয়ে
থাকতো বাঙালির শিরদাঁড়ার ঋজুতার দিকেই। কিন্তু না, বাংলার সমাজ এখনো ততটা দৃঢ় ভাবে
নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে নি। পারে নি বলেই রমরম করে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
যার ভঙ্গুর ঝুরঝুরে ভিতটা আজকে হয়তো অনেকেরই চোখে পড়ছে না, কিন্তু যেদিন পড়বে
সেদিন হয়তো ঠেকা দেওয়ার মতো শক্তিই থাকবে না।
সামগ্রিক ভাবে বসন্তের এই মধুর সমীরণ বাংলার সাহিত্য
সংস্কৃতির দিগন্তে কতটা পৌঁছাতে পারছে, সেটাই এখন প্রশ্নচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে
গিয়েছে। বসন্ত যদি নবজীবনের দূত হয়, তবে নিতান্ত দুঃখের সাথেই স্বীকার করার সময়
এসে গিয়েছে যে, বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির দিগন্ত এখন এক বিস্তৃত অবক্ষয়ের তলায়
শীতঘুম দিচ্ছে। শীতঘুম হয়তো ততটা বিপদজনক নয়, যদি না সে জেগে ঘুমানোর সংস্কৃতিকেই
ধারণ করে। এখন সময়েই বলতে পারে বঙ্গসংস্কৃতির এই শীতঘুম আদৌ ভাঙ্গবে কিনা।