লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
১
কিছুই
পারি না। পারি না মন যুগিয়ে কথা বলতে, আহা উহু করতে কিংবা 'করতে হবে দিতে
হবে'
র প্রতিনিধিত্ব করতে, তবু বুকে ঝলসে ওঠে রোদ, গ্রামের হোঁচট
খাওয়া পথে ফাটল ধরে, জল জমে, পায়ের গাঁট ডুবিয়ে দেয় কাদা। দিনের বেলা পুকুর পাড়ে
হাঁসের ডিম নিয়ে রেণু বৌদি ও চারু কাকীর তুমুল ঝগড়াও বাঁধে। আমি শুনতে থাকি, ডাহুকের চঞ্চলতায় আকাশের দিকে তাকাই--
তবু
অসহ্য গুমোট কামড়ে ধরে শরীরে, অর্চনা মামির
মাদুর কাঠির বেড়ার লতানো হলুদ ঝিঙেফুল ছুঁয়ে দেয় আমাকে। কোন সূচিপত্র ছাড়াই
আমি কেবল হাঁটতে থাকি আলপথ ধরে।
২
আলো
আসছে। দুটো পাখি উড়ে যায় মাথার উপর দিয়ে। খাবার সন্ধানে কতদূর যাবে ওরা? বাঁক পেরতে হলে দুঃখুর ঘরটা পেরোতে হবে। আশে পাশে মাঠের
গন্ধ ভরে আছে হাওয়া। এখন ধান গাছের গর্ভাধানের সময়। সেই গন্ধের ভিতর দিয়ে হাঁটছে
দুঃখুশ্যামের বৌমা। ছেলেটা চলে যাবে কেরালা। বাতাসে ঠাণ্ডাভাব, ঘাম জুড়িয়ে যাবার সময়।
শালুকের
দীপ্তিতে ভরে আছে মাঠ, মেঘের টুকরো
গলা ডুবিয়ে বসে আছে জলে, সেই ফাঁক দিয়ে
মোরাম রাস্তাটা বাঁক নিচ্ছে সাপের মত। ভোরের সাথে সাথে একটা শিরশিরানি পা থেকে
ব্রহ্মতালু- কতকাল হাঁটছে মাটি। সমস্ত সত্ত্বা ধরে টান মারে- এগোতে থাকি - চাকায়
দেবে যাওয়া খড়কুটো ভরা পথের নিঃশ্বাসে।
৩
চকিত
বাঁশির সুর। নিজের মধ্যে মগ্ন থাকার পথটা ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশ পর্যন্ত, নানা ধরনের
উজ্জ্বল সবুজে রাশি রাশি বৃক্ষ, গাছগুলির মধ্যে কদমের সাথে মৃত্যুঞ্জয় কাকার কেমন ধ্রুপদী
সম্পর্ক। ময়লাটে ধুতির উপর গামছা গায়ে পুকুরে মাছের সাঁতার দেখে। সূর্যের দিকে
তাকিয়ে মাটিতে লেগে থাকা শিরির কনায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়।
লক্ষণের
বউ একা থাকে। বাঁশঝাড়ের ওপাশে উঁচু ভিটে থেকে গড়িয়ে আসা তেষ্টারা পুকুরে ঝাঁপিয়ে
পড়ে। সকালের রোদেও তাদের বুদ বুদ, কেমন মোহময়, সুসনি শাকের ঠাকাটা কাঁপতে কাঁপতে জলে ভিজে যায়। পাখিরা
লাফাচ্ছে ডাকতে ডাকতে। ঠেলাগাড়ির চাকায় বসে গেছে পথে। সেই দাগে জমে থাকা স্পর্শে
আমি মাটি চিনে নিতে থাকি।
৪
হোঁচট
লাগতে পারে, লাগলও - সামলাতে সামলাতে
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। শিশির ভেজা পাতাগুলো লেপটে আছে পথে, পথ মানেই নির্দেশ। দুপাশে লঙ্কেশ্বরী কিংবা ভুতভৌরির
বিশ্বাসে এগিয়ে যাচ্ছে আলপথ। গাছের ছায়ায় নিয়ে আস্তে আস্তে বেলা বাড়ে। আঁচল আঁচল
ফুলের ছাপ পেরিয়ে বেরিযে আসছে গঙ্গা শালিক।
পেঁপে
ফুলের উপর কালো মৌমাছির ঝাঁক, উড়ছে তো
উড়ছেই- গোয়াল নিকোতে নিকোতে সুমতি নিজের গালেই চাপড় মারে, মশা মারতে এত কষ্ট- কোমরের সাথে তলপেটে ব্যথাটাও চিন চিন
করে ওঠে,
সত্যি বলতে কি গতরাতের ঝিঁঝিঁ পোকা গুলো এখনো জমে আছে
মাথায়। পুবদিকের অজিতের চালা ছুঁয়ে আসুক শীতল বাতাস।
৫
অনন্ত
মারা গেছে। চারপেয়ে খাটের উপর থেকে কখন যে পড়ে গেল, বুঝতে পারলনা তার বউ। তারপর সব শেষ। বাকি রাতটায় শুধু কান্না। বসন্ত
প্রতিবেশীদের নিয়ে কাঠ কাটতে কাটতে রাত কাবার করে দেয়। ভোর হতেই দুঃখটা ছোঁয়াচে
হয়ে যায়। পোষা পায়রারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পথে- এবং তারা এলোমেলো ভাবে আশ্রয় নিতে থাকে
শিরীষ গাছের শাখা প্রশাখায়--
শুকনো
বাঁশপাতায় শিশির জমেছে খুব। ঘুমপায়ে পা পড়লেই ঠাণ্ডভাবটা মাথায় বিদ্যুৎ খেলে- আমি
অনন্তের কাছাকাছি যেতে চাই, সমস্ত চোখগুলোর সম্মতিতে থাকে মৌনতা। সেখানে চিবুক ছুঁয়ে
আছে গুঁড়ো গুঁড়ো পলিমাটির সত্যতা। চিতার আগুনে পুড়ে যাওয়ার আগে ছায়া সংগ্রহ করতে
চাই - আর হাড়মাসের দধিচী।