শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়



বৈশাখী সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতাউৎসব: বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ অনেকটাই লম্বা পথ পারি দিয়ে আজ এই অন্তর্জাল সাহিত্যপত্রের দরিয়ায় এসে মিশেছে। বিগত দশকগুলিতে খুব কাছে থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্বাধীনতাত্তোর ক্রমবিকাশকে দেখার সুযোগ হয়েছে আপনার। সেই প্রেক্ষিতে বর্তমানের অন্তর্জাল ভূবনের দিগন্তে বাংলা সাহিত্যের এই নতুন উদ্ভাসনকে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করেন আপনি?

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: ফেসবুক সাহিত্য, অন্তর্জাল সাহিত্য, ছাপাখানার সাহিত্য এরকম বিভাজন কি হয় সাহিত্য তো সাহিত্যই আপনি তাকে যে পাত্রেই রাখুন না কেন বেদ উপনিষদ থেকে আজকের  অন্তর্জাল এই ধারাবাহিক চলমানতা যদি আমরা পর্যালোচনা করি  তাহলে দেখব মানুষ যখন অক্ষর আবিস্কার করেনি, যখন লিপি আবিস্কৃত হয়নি সেই শ্রুতি যুগেও সাহিত্য ছিল মানুষের প্রাণএই মননচর্চার ভেতর দিয়ে বিকশিত হয়েছে মানুষের জীবন। গুহাগাত্রেও ছবির আকারে অথবা লিপির আবরণে লিখিত হয়েছে কবিতাই সাহিত্য তরল নয় যে পাত্র ভেদে তার আকার বদলে যাবে আপনি তাকে কাগজের দুনিয়ায় যখন রাখছেন ছাপার হরফে তার স্বাদ যা যখন তালপাতার উপর শরের কলমে লেখা হত পুঁথি তার স্বাদ অথবা আজ ওয়েব মাধ্যমে যখন সাহিত্যচর্চা চলছে মুলগত বিষয়টির কিন্তু তারতম্য হচ্ছেনা। অন্তর্নিহিত যে উপাদানগুলি দিয়ে সাহিত্য নির্মিত হয়  অর্থাৎ সাহিত্যরসের কোন তারতম্য হচ্ছেনা শুধু বদলে যাচ্ছে পাত্র বা কন্টেনার আমি কাপে চা খেতে পারি গ্লাসে খেতে পারি আবার মাটির ভাঁড়েও খেতে পারি আমি যদি চা রসিক হই আমার কাছে এতে চায়ের স্বাদের কোন ইতর বিশেষ হবেনা চায়ের প্রতি আমার আসক্তি কেমন এবং আমি একজন যথার্থই নিবিড়  চায়ের পিয়াসী কিনা এটাই কিন্তু আকর্ষণের মুল বিন্দু যারা সাহিত্য অনুরাগী নয় বরং সাহিত্যের প্রতি তীব্র বৈরাগ্য পোষণ করেন তাঁকে আপনি যেভাবেই সাহিত্য পরিবেশন করুন না কেন সে ফিরেও তাকাবেনা এদিকে আবার যারা সত্যিকারের অনুরাগী  এবং রসিক তারা কিন্তু  গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক খুঁজে নেবে তার মনের খোরাক 

আমার জন্ম সাতের দশকে সুতরাং ছয়ের দশককে দেখার সুযোগ আমার হয়নি সাতের দশকের সমস্ত ঘটনাও খুব পরিস্কারভাবে স্মৃতিতে নেই ফলে স্বাধীনতা উত্তর সময়ের সাহিত্যচর্চার বেশিরভাগই আমার অভিজ্ঞতার বাইরে যেহেতু একটি সাহিত্যমনস্ক পরিবারের জন্ম তাই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ খুব ছোটবেলা থেকেই এই আকর্ষণই আমাকে  প্রতি মুহূর্তে তাড়িত করেছে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বা স্বাধীনতা উত্তর  সাহিত্যযুগকে জানতে আমার অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষনসম্ভুত  না হয়ে  অনেকবেশি অধ্যয়নতাড়িত যেহেতু  আমি নিজে একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত তাই সামান্য হলেও  মুদ্রণ দুনিয়ার ভালো মন্দ বুঝি বই বা পত্রিকার যে গন্ধ সেই গন্ধ আমাকে মুগ্ধ করে আমি এই ফ্লেভারের প্রেমে পড়ি ছাপা অক্ষরের সাথে আমাদের  অনুরাগ আজন্মলালিত এই প্রেম এতটাই দৃঢ় যে তা হৃদয়ের তলদেশ অবধি প্রসারিত  তবে হ্যাঁ, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অন্তর্জালের দুর্নিবার গতিকে আমি অস্বীকার করতে তো পারিই না বরং এই গতির সাথে পা মেলানোর জন্য প্রতি মুহূর্তে নিজের পাদুটোকে আরোও প্রস্তুত করে তুলি আরও গতিশীল করি আরও সম্মুখগামী করি এ কথা ঠিক কবিতা তথা সাহিত্যভাবনাকে আজ সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অন্তর্জাল আন্তর্জাতিক চিন্তন দুনিয়ার সাথে মেলবন্ধন ঘটছে  প্রিন্ট ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে সার্কুলেশনের একটা সীমাবদ্ধতা থাকে তাকে পৌঁছে দেওয়ার দায়দায়িত্ব থাকে  লেখকের কাছে, পাঠকের কাছে এই কাজটি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল অন্যদিকে ওয়েব দুনিয়া অনেক প্রসারিত শুধুমাত্র একটি স্মার্ট ফোনের সুযোগসুবিধা এবং নেট কানেকশন থাকলেই  একজন সাহিত্যরসিকের কাছে উপলব্ধ হয়ে উঠছে আজকের পৃথিবীর সাহিত্যভান্ডার প্রিন্ট ম্যাগাজিনের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে এ এক অসীমের অনুসন্ধান আমি এই উদ্ভাসনকে দুহাত তুলে  স্বাগত জানাই এর অবদানকে  এই অনস্ব্বীকার্য ভূমিকাকে কাজে লাগিয়েই আগামীর দিকে আমাদের অভিযাত্রা  সাহিত্যকে মুক্ত  স্বাধীন  এবং সর্বত্রগামী করে তুলেছে অন্তর্জাল    


কবিতাউৎসব: অনেকেই বলে থাকেন বাংলাসাহিত্যের আতুঁড় ঘর হলো লিটলম্যাগাজিন। সেই লিটিল ম্যাগ আন্দোলন অন্তর্জালে সাহিত্যচর্চার বিপুল উন্মাদনায় কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে বলে আপনার ধারণা।

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: লিটল ম্যাগাজিন মানে ছোট কাগজ ছোট কাগজ মানে  প্রচারে প্রসারে এবং বাণিজ্যায়নের ক্ষেত্রে তার কিছু সীমাবদ্ধতা  আছে কিন্তু সাহিত্যমনস্কতার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সে আপামরের কাছে পৌঁছে যেতে পারেনা তার এই অপারগতাই তার অহংকার একজন সদ্য সাক্ষর নিশ্চয়ই কমলকুমার মজুমদার খুলে পড়তে যাবেন না  বা কোয়ান্টাম মেকানিক্স  নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতা দেখাবেন না ছোটকাগজ এরকমই  যার তার  জন্য নয় সে মাসের নয়, ক্লাসের  কেবলমাত্র পরিশীলিত এবং অনুশীলিত পাঠকের সকলের কাছে পৌছতে চাওয়ার প্রয়াস তার নেই চাওয়ার দাবিও সে করেনা সস্তা জনপ্রিয়তার বিপরীতে ছোটকাগজ এক মূল্যবান রত্নভাণ্ডার  বৌদ্ধিক পাঠক পাঠিকাই তার গর্ব অন্তর্জাল এসে যাওয়ায় ছোট কাগজের দুনিয়ায় ভবিষ্যৎ জিজ্ঞাসাচিহ্নের উপর দাঁড়িয়ে এরকম মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নেই ছোট কাগজের অবাণিজ্যিক  যে ভূমিকা প্রকৃত কালজয়ী সাহিত্য, নতুন চিন্তাপ্রনালীর  বিকিরণ, মেধাসম্পন্ন প্রতিভাবান কবি সাহিত্যিকদের আলোকিত করা তাঁদের মেধার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এবং উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন চিরকাল এক অগ্রণী ভুমিকা পালন করে এসেছে  আজকের ওয়েব ম্যাগাজিনের সাথে এই সদর্থক প্রশ্নে লিটল ম্যাগাজিনের কোন বিরোধীতা নেই বরং বলা চলে একে অন্যের পরিপূরক কারণ ওয়েব ম্যাগাজিনেরও ব্যবসায়িক কোন উদ্দেশ্য নেই, ছোট কাগজেরও নেই এই অর্থে তো দুই মাধ্যমের মূল অভিমুখ একই বরং আপনি বলতে পারেন ওয়েব ম্যাগাজিন এবং অন্তর্জালের লাগামছাড়া বিস্তারের ফলে বাণিজ্যিক কাগজগুলির নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে তাঁরা এতদিন প্রচার এবং প্রসারের যে সুকৌশলের উপর নির্মান করেছিল নিজেদের বিজয়যাত্রা তা আজ অনেকাংশেই থমকে গেছে তাদের ভয় পাওয়া এবং দুমড়ে যাওয়া মুখের চেহারা আজ বেরিয়ে আসছে  ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে চারদিকে অন্তর্জাল এসে আমাদের সবকিছু কেড়ে নিল, মান মর্যাদা এবং অহংকার আপনি যদি খুব নির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখতে পাবেন কমার্শিয়াল কাগজগুলির আজ একটাই আলোচনার বিষয় ফেসবুক কি বাংলা সাহিত্যকে বিপন্ন করছে ? অথবা অন্তর্জাল কি ঠিক করতে পারে সাহিত্যের অভিমুখ ? দিনের পর দিন বিভিন্ন সেমিনারে সভায় এমনকী বিভিন্ন চ্যানেলেও এই নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা চলছে তাহলে অন্তর্জালের এই ক্রম প্রসারে   কারা বিপন্ন বোধ  করছে কারা খুঁজে পেতে চাইছে নতুন পথ অনুসন্ধান করছে মুক্তির দিশা? লিটল ম্যাগাজিন কিন্তু নির্বিকার সবুজপত্র থেকে আরম্ভ করে  শতাধিক বছর ধরে পথ চলার ঐতিহ্য নিয়ে সে গরিমা মণ্ডিত ত  সে জানে অন্তর্জালের মধ্য দিয়ে আসলে তার ভাবনা আদর্শ এবং অসমাপ্ত কাজগুলিই এগিয়ে যাবে সুতরং নতুন এই প্রযুক্তিকে  সাদর অভ্যর্থনা জানাতে তার  চোখে কোন সংশয়চিহ্ন নেই    


কবিতাউৎসব: সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র সাহিত্যচর্চায় যে শৌখিন মজদূরী সম্বন্ধে আমাদের সচকিত করে দিয়েছিলেন, আজকের অন্তর্জাল সাহিত্যের হাটে সে কথা যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বলে মনে করেন অনেকেই। বাড়িতে আনলিমিটেড নেট, হাতে স্মার্টফোন বা কোলে ল্যাপটপ, হঠাৎ অবসর, ধরা যাক দু একটি শব্দ এবার। এই যদি সাহিত্যচর্চার সমকালীন প্রকরণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তো সত্যই চিন্তার বিষয়। আপনার অভিমত।

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়:  শৌখিন মজদুরী  যে হচ্ছেনা তা নয় প্রযুক্তির এই সুবিধাগুলো হাতের নাগালে এসে যাওয়ায় সকলেই কবি হতে চাইছেন এদের বেশিরভাগ অংশেরই সেভাবে সাহিত্যের সাথে সংযোগ নেই পড়াশোনা নেই এমনকী সাহিত্যের প্রতি যে ভালোবাসা থাকা দরকার তাও নেই আমি এই অংশের কিছু মানুষের সাথে কথা বলে দেখেছি তাদের লেখালেখির উদ্দেশ্য এবং  অভিমুখ জানবার চেষ্টা করেছি যেহেতু ফেসবুক দ্রুত কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয় এবং একটি কবিতা যা প্রায়  রচনার সাথে সাথেই ফেসবুকে  আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে  অগনিত পাঠক পাঠিকার নজরে চলে আসছে দ্রুত  মতামত (যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কবিতার অসাধারণত্বের শংসাপত্র ) পেতে পেতে কবিও চটজলদি  একটি সহজ  রাস্তার দিকে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন অপেক্ষা শব্দটি হারিয়ে যাচ্ছে ফাস্ট ফুডের মতো ফাস্ট পোয়েট্রির এক আবর্ত গিলে নিচ্ছে  ধৈর্য,সংযম  এবং মানসিক স্থিরতা তুমি আমার কবিতার পাঠক, আমি তোমার পারস্পরিক মতামতের উজ্জ্বলতা আসলে এক অন্ধকার নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের এই মিথোজীবিতা গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের প্রাত্যহিকতা। সাহিত্যের ধারাবাহিকতাও। সত্যিকারের কবিতা আড়ালে থেকে যাচ্ছে তবু সাহিত্যের সম্প্রসারণে ফেসবুক এবং অন্তর্জাল যে ভূমিকা পালন করেছে তাকে আমি বাহবা দেব কত কণ্ঠস্বরের সাথে প্রতিদিন পরিচয় হচ্ছে এই বা কম কী  যেকোন শিল্পই দীর্ঘমেয়াদী অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণতা পায় এর জন্য রাস্তার অনুসন্ধান খুব জরুরী সমালোচনা, ক্রমাগত ইতিবাচক এবং সদর্থক সমালোচনা, ব্যক্তিগত অনুভবের বিকিরণ,ধারাবাহিক অতৃপ্তি এবং সংশোধন ছাড়া  উৎকর্ষতার বিকল্প কোন যাত্রাপথ আজও তৈরি হয়নি এবং অবশ্যই  মেধার উপস্থিতি  আমি কিন্তু সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখি সবসময় এক বর্ষায় লক্ষ লক্ষ চারাগাছ অঙ্কুরিত হলেও সবাই বনস্পতির মর্যাদা পাবে না তবু প্রতিটি চারাগাছকে লালন পালন করে যাওয়া জরুরী কার ভেতর লুকিয়ে আছে বনস্পতির সম্ভাবনা আমরা কেউ জানিনা এর নামই প্রয়াস এত কবি কেন? শ্রদ্ধেয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়  বলেছিলেন প্রশ্ন তুলেছিলেন এক সময়  বা জীবনানন্দও বলেছিলেন সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি এ কথা মাথায় রেখেও কবিতার যে আনন্দযজ্ঞ সাহিত্যের যে প্রবাহ চলছে সেখানে অনেক স্রোত এসে মিলিত হবে  


কবিতাউৎসব: এই প্রসঙ্গে জানতে চাইবো জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে প্রগাঢ় সমবেদনা সাহিত্যের সূত্রপাতের মূল উৎস, বর্তমানের ভোগবাদী দুনিয়ার এই উর্দ্ধশ্বাস ইঁদুর দৌড়ে সেই অনুভব আর কি আমাদের মধ্যে জায়মান আছে? আমাদের সাহিত্যবোধও কি অনেকটাই মোড়ক সর্বস্ব বস্তুবাদী হয়ে ওঠেনি? অনেকটাই বাজারদর ভিত্তিক? কি মনে হয় আপনার?

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আজকের সময়ে যে সময়ের উপর পা রেখে আমরা  ভাবছি, লিখছি অথবা চিন্তাবিনিময় করছি এক জটিল আবর্তের উপর তার অবস্থান ব্যক্তিমানুষ আজ বিচ্ছিন্নতার শিকার সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে অনেক সময় আমরা নির্জনতার সাধনা নামে গৌরবান্বিত করবার চেষ্টা করছি মানুষ হন্যে হয়ে ছুটছে অর্থ বিত্ত,যশ,খ্যাতি আর ব্যক্তিগত সম্পদবৃদ্ধির দিকে সাফল্য মানে অর্থিক উন্নতি বৈষয়িক সমৃদ্ধি প্রয়োজন,কিন্তু তার প্রয়োজন কতটুকু!  সততা বিসর্জন  দিয়ে বা যেভাবেই হোক না কেম নিজের উন্নতির রাস্তা খুঁজে নিতে হবে ভোগ আর তুষ্টির আয়োজন ছাড়া  জীবনের আজ আর কোন উদ্দেশ্য নেই জীবন যাপনের প্রকৃত সংজ্ঞা আজ বদলে গেছে উন্নয়ন মানে বৈষয়িক সমৃদ্ধি ধনবাদী ভোগবাদী সমাজ সেখানে আবেগের কোন জায়গা নেই মানুষের সাথে মানুষের আন্তসম্পর্ক নিরধারিত হচ্ছে মূল্যের বিন্যাসে একান্নবর্তী পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ আনবিক হয়ে উঠেছে বন্ধনের বলয় সেই টানই বা কতটুকু স্বার্থ নিরপেক্ষ? আত্মকেন্দ্রিক ভাবনা আর স্বার্থ পাহারা দিতে দিতে  সাহিত্যের চর্চা মানবতার চর্চা থেকে সরে যাচ্ছে আমাদের ভাবনাবলয় অথবা সাহিত্যচর্চার মুখোশেও প্রবলভাবে আত্মকেদ্রিকতার ছায়া পড়ছে যা ঢেকে রাখতে পারছে না  চরিত্রের ব্যক্তিক পরিসর  শূন্যতার হাহাকার গিলে নিচ্ছে প্রতিদিনের জীবন ধনবাদের ফলশ্রুতি তাই বড় নির্মম সে  স্ত্রী সন্তান চেনে না, জানে না তারা চার পাশ, প্রকৃতি, জীবন,পারিবারিক- সমাজিক বন্ধন তাকে টানে না, এভাবেই তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতা পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, সন্তান থেকে এমনকী নিজের আত্মগত বিবেক চেতনা থেকে মার্কস বলেছিলেন পুঁজিবাদের বিবরে বেড়ে ওঠা অভিশাপগুলোকে চিহ্নিত করার কথা শুধু উপরতলা নয় সমাজের সার্বিক স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে এই অভিশাপ মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করছে জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে সঞ্চয়ের পরিসরকে আরও ব্যাপক বিস্তৃত করার প্রয়োজনে সুকুমার অনুভূতি, পরিবার স্বজনদের সাথে ভাবনার আদান প্রদান সুখে দুখে আনন্দে মিলেমিশে থাকার যে চিরন্তন জীবন তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আরও বিপন্ন মানুষকে দেখেও উদাসীন ভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে রাস্তা সংবেদনশীলতার যে মরমী হৃদয় তা পরিপুর্ন হয়ে আত্মকেন্দ্রিক চেতনায় ফলে প্রকৃতির রূপ, গানের সুর, কবিতার ছন্দ কিংবা ভালো লাগার মুহূর্ত খুঁজে পাচ্ছেনা  নির্লিপ্ত চোখ এখন মানুষের কাছে একটাই জিজ্ঞাসা কী পাবো? কী পাবো কবিতা পড়ে? গান শুনে? অথবা সাহিত্যে নিবেদিত হয়ে? পাওয়া মানে পারমার্থিক কোন পাওয়া নয়, পাওয়া মানে আত্মিক জাগরন নয় পাওয়া প্রকৃত অর্থেই আর্থিক উন্নতি বিষয়ভিত্তিক প্রাপ্তি হুমায়ূন আজাদের কথামতো বললে নষ্টদের অধিকারে চলে যাচ্ছে সমস্ত কিছু আমাদের এই ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা ভোগবাদের পিছনে নিরন্তর রুদ্ধশ্বাস দৌড় আমরা সংক্রমিত করছি শিশু কিশোরদের মনেও যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান  শিক্ষক অথবা অভিভাবক শিশুদের তৈরি করবে  তাদের অন্তঃকরণেই তো জমে আছে অনেক ফাঁকি এবং অনেক ফাঁকফোকর কী দিয়ে মেরামত করা হবে এই নষ্ট  হৃদয়ের চেতনাবোধের মানচিত্র? আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সাহিত্যরচনা করা তাই অত্যন্ত কঠিন কাজ তবু আমি আশাবাদী একমাত্র সাহিত্যই পারে  নৈরাশ্যপীড়িত, দিশাহীন সমাজকে রাস্তা দেখাতে যে মানুষ কোনদিন চোখের জল ফেলেনি বই পড়তে পড়তে তাকে ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখেছি।হতাশায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মানুষকে জীবনের অভিমুখে ফিরিয়ে দিতে পারে সাহিত্যই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা A teacher, a child and a pen can change the world  .


কবিতাউৎসব: আমাদের নাগরিক জীবনের অন্তঃসার শূন্যতা এবং দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে শিকড়হীন সম্পর্ক বর্তমানের এই অন্তর্জাল সাহিত্যজগতে কতটা ও কিরকম প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করেন আপনি।

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়:  একদিকে  নাগরিক জীবনের অন্তঃসার শূন্যতা অন্যদিকে দেশজ সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার  সেই  সম্পর্কে উদাসীনতা আর পাশাপাশি ভোগবাদী সমাজের  আত্মকেন্দ্রিকতা এই  থ্রী ডাইমেশনাল স্পেসে অবস্থান আমাদের এক ভয়ঙ্কর আত্মিক সংকটের মুখোমুখি আমরা ভোগবাদী বর্তমান ছাড়া আমাদের সামনে দ্বিতীয় কোন বিকল্প অস্তিত্ব নেই অতীতের  শিকড়ের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে সাম্প্রতিক ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন নিয়ে অগ্রগতির সোপান রচিত হয় তাও যেন মহাশূন্যের ভেতর বিলীয়মান অথচ আমরা জানি সংস্কৃতি এক পরম্পরার নাম আমরা বারবার স্মরণ  করি যে সংস্কৃতিকে বাদ দিলে সমাজ আর জঙ্গলের ভেদরেখাটি বিলুপ্ত হয়ে যায় কোন সংস্কৃতি? দীর্ঘ শ্রমলিপ্ত পথে যা আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে নিজস্ব ভাষার সংস্কৃতি নিজস্ব মাটির গন্ধে যা আমাদের প্রাণ ভরিয়ে দেয়  আজ যে তরুণ কবিটি লিখতে আসছেন তাঁর যদি ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে তিনি যদি পরম্পরার পথটিই না জানেন তাহলে তিনি গন্তব্যই বা খুঁজে পাবেন কীকরে? এক দিশাহীনতার ভেতর  অবিরাম সাঁতার  কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে  তাঁর  অভিযাত্রা আমি খুব চমকে যাব না যদি আজ লেখালেখির জগতে এসেও  কেউ প্রশ্ন করে   জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কে? সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অরুণ মিত্র নামগুলো খুব চেনা চেনা লাগছে আমি বিস্ময়ে শিউরে উঠবো না যদি কেউ একদিন এসে বলে রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী, শম্ভু রক্ষিত  উদয়ন ঘোষ, তপোবিজয় ঘোষ, মণি মুখোপাধ্যায়, অসীম রায়  এদের তো আমরা চিনিনা আর যারা এই নামগুলো কোন রকমে   মুখস্ত করেছেন তারাই বা কতদূর মনে রেখেছেন তাদের শিল্পকর্ম? অদ্ভুত আঁধার গিলে নিচ্ছে আমাদের চেতনা  কে কাকে মনে রাখছে কতটুকু? আমরা যাদের একটু ব্যতিক্রমী বলে মনে করছি এবং যারা নিজেদের আগামী দিনের সেলিব্রেটি লেখক হিসেবে আত্মগরবে গরীয়ান  হয়ে উঠছেন দু একটি পুরস্কার পাওয়ার আনন্দে বাজার নিয়ন্ত্রিত কিছু কবি লেখকদের পাশাপাশি ছবি তোলার গর্বে আমি খুব হলফ করে বলতে পারি পাঠক বা  পাঠিকা হিসেবে এরা চতুর্থ শ্রেণীর যে কবিকে  ধরলে যে লেখকের কাছাকাছি থাকলে পুরস্কার পাওয়া যায়, আলোকিত  হওয়া যায়  তাঁর দু একটি কবিতা কোন রকমে হোমওয়ার্কের মতো মুখস্ত করে  পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়াই যেন কবিতাপাঠের মূল আনন্দ আমি আগেই বলেছি-কী পাবো এই প্রশ্নটি আজ তোলপাড় করছে ব্যক্তিজীবন থেকে  জাতীয় জীবন রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী,আপনার কবিতা আমি পড়ব কেন ? কী পাবো আপনাকে পড়ে? কোন  পুরস্কার দিতে পারবেন আপনি? আজকের ফেসবুক কিন্তু নগ্ন করে দিচ্ছে এই বাস্তবতা  


কবিতাউৎসব: অন্তর্জাল বিপ্লব বাংলা সাহিত্যের গণ্ডীটিকে হঠাৎই যেন অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কাকদ্বীপ থেকে কানাডা বা সিলেট থেকে সিয়াটোল, যেখানেই হোক না কেন আজকের সাহিত্য আলোর গতিতে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। এর সবচেয়ে জরুরী সুফলটি আমরা দেখতে পাই, দ্বিখণ্ডীত বাংলার উভয় পারের সাহিত্যচর্চার মধ্যে পারস্পরিক সাহচর্য ও আদানপ্রদানের পরিসরটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে দিনেদিনে ও দ্রুতগতিতে। যেটি আগে প্রায় অসম্ভবই ছিল। এই পরিসরটিকে আরও ফলপ্রসূ ও শক্তিশালী করে তোলার বিষয়ে কোন কোন বিষয়গুলির উপর জোর দিতে চান আপনি? কি কি বিষয়ে আমাদের আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ বলে মনে হয় আপনার?

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: অন্তর্জাল বিপ্লবের এই দিকটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার আজ একজন কবিকে তার কবিতা প্রকাশের জন্য কোন দালাল ধরতে হচ্ছে না আমার কবিতাকে প্রথম শ্রেনীর কোন কাগজে পাত্রস্থ করে দিন বলে ঘটককে তোষামোদ করতে হচ্ছে না প্রকাশের এক উপযুক্ত মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে তরুণ কবি আত্মসম্মান বজায় রেখে সে মাথা উঁচু করে সাহিত্য চর্চা করছে অন্ধকার কুয়োতলায় বসে আত্মপ্রকাশের যন্ত্রনায় ছটফট করছিল যে নবীন  কবি ফেসবুক আর কিছু পারুক বা পারুক তাকে মুক্তির বার্তা শোনাতে পেরেছে তার কবিতাকে পৌছে দিচ্ছে কাকদ্বীপ থেকে কানাডা বুকের ভেতর আঁকুপাঁকু করতে থাকা শব্দের সেই আর্তি পুরুলিয়া থেকে এক নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছে প্যারিস বাঁকুড়ার তরুণ লেখককে স্বাগত জানাচ্ছে ব্রাজিলের সাহিত্যমনস্ক মানুষ মেদিনীপুর থেকে মাদাগাস্কার আজ কয়েক সেকেন্ডের রাস্তা কবিতা তথা সাহিত্যের প্রতিটি শাখা মুক্ত স্বাধীন এবং সর্বত্রগামী আজ একজন শক্তিমান এবং মেধাবী কবিকে দাবিয়ে রাখার সমস্ত রকম চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে খুব খুশি হই বিভাজিত বাংলাকে আবার যখন সংযুক্ত আকারে দেখি অন্তর্জাল এই কাজটি করেছে দুপার বাংলা আজ মিলেমিশে একাকার ভাবনা বিনিময় হচ্ছে,সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হচ্ছে কোন ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই এক মিনিটে এপার বাংলার গল্প চলে যাচ্ছে ওপারে আর ওপার বাংলার  কবিতা কাঁটাতারের বাধা না মেনেই আমাদের মননের গভীরে ঢুকে পড়ছে নিমেষে মৌ মধুবন্তীর সঞ্চালনায় শুভ্রর ভাবনা নিয়ে আমাদের আলাপন তো চলছেই  কবিতা উৎসবে কবিতা উৎসব পরিবারের আড্ডায় যখন আমরা আলোচনা করি তখন মনে হয় রত্নদীপা, আমি, শুভ্র, হাসিদা মুন, শৌনক দত্ত, মৌ মধুবন্তী  আমরা সবাই এক টেবিলে বসে গল্প করছি  অনেক কবিই নিজের লেখা প্রকাশের জন্য ব্যক্তিগত ব্লগ তৈরি করে নিয়েছেন অন্তর্জাল শব্দশিল্পীদের কাছে খুলে দিয়েছে এক অনন্ত সম্ভাবনার দরজা আজ তাই কোন কবিই হারিয়ে  যাবেন না ইথার তরঙ্গে ধরা থাকবে তার চিন্তনকর্ম এবং   কবিতাক্ষর আলোর নীচে অন্ধকারের মতো প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পাশাপাশি আছে, এই কারিগরী কৌশলকে কাজে লাগিয়ে অসৎ হয়ে ওঠার সুযোগ শিল্পকর্ম চুরির অভিযোগ যেমন বাড়ছে,উৎসাহিত হচ্ছে হ্যাকিং বা অন্যন্য   অসদুপায়গুলিও যেহেতু আমি এই প্রযুক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয়গুলি সেভাবে জানিনা তাই এখানে বিশেষজ্ঞের কোন মতামত দেওয়া সমীচীন হবেনা টেকনিক্যালী যারা এই বিষয়ে পারদর্শী তারাই ভালো বলতে পারবেন সতর্কতার তালাচাবি


কবিতাউৎসব: অন্তর্জাল সাহিত্যচর্চা যেন অনেকটাই চিত্ররূপময় কবি জীবনানন্দের সেই অমোঘ বাণীটিরই প্রতিস্পর্ধী! অন্তর্জাল যুগে সকলেই যেন কবি। কেউ কেউ কবি নয়! মাত্র একটি ইমেল পরিচিতি তৈরী করে নিতে পারলেই সোশ্যালসাইটের দিগন্তে পা রাখতে না রাখতে যে কেউ নিজেকে কবি বানিয়ে নিতে পারে এখন। যার যত বড়ো বন্ধুবৃত্ত, তার কবিখ্যাতি তত বেশি। যে কোন ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই এ যে বড়ো সুখের সময় নয়- সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অন্তর্জাল সাহিত্য দিগন্তের এইটাই কি স্বাভাবিক পরিণতি নয়? কি ভাবে তৈরী হতে পারে প্রকৃত সাহিত্যের রক্ষাকবচ?

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: আমি বিষয়টিকে কিন্তু এভাবে  নয় বরং উল্টোদিক থেকে দেখি  আনন্দের জন্য মানুষ তো কতকিছুই করে যদি কবিতা লেখে ক্ষতি কি? যদি গল্প লেখে  তাতেই বা ক্ষতি কি ? লিখুক না যত বেশি বেশি  মানুষ কবিতা লিখতে আসবে যত বেশি কবিতা নিয়ে উন্মাদনা শুরু হবে ততই তো মঙ্গল যারা কবিতা লিখছে সবাই রবীন্দ্রনাথ  হওয়ার জন্য লিখছেনা এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি সবাই নজরুল সুকান্ত হওয়ার জন্যও লিখেছেনা  বা নোবেল পুরস্কারের জন্যও লিখছেনা নিছকই আনন্দে হয়তো দুর্বল কবিতা, হয়তো কিছুই হচ্ছেনা, কবিতাও হয়ে উঠছে না তবু সে আনন্দ পাচ্ছে আনন্দ পাচ্ছে এই জন্য যে  অপটু হলেও এই নির্মান তার নিজস্ব সে এক অন্য পৃথিবীর সন্ধান পাচ্ছে হ্যাঁ,অনেককেই দেখি কবিতা লিখলে বাঁকা ভাবে কথা বলতে আরে তুমি তো ভাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলে বেদনা হয় যখন অনেক প্রখ্যাত কবিও বলে ওঠেন এই ফেসবুক সবাইকে কবি বানিয়ে ছাড়ল, কিছু না জেনেই সবাই লিখতে চলে এসেছে আমাকে আপনার ওই অপটু কবিতাগুলি ট্যাগ করে লজ্জা দেবেন না  কবিতা নিয়েই এতসব কথা হয় যে মেয়েটা গান শিখতে যায়, তার স্কুল আছে, স্যার বা ম্যাডাম আছে যে আঁকতে চায় তার জন্যও  বিভিন্ন ব্যবস্থা আছে, কর্মশালা আছে কিন্তু যে কবিতা লিখতে চায় ভালোবেসে শুধু কবিতাই লিখতে চায়, অথবা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ কোথায় যাবে সে? ফেসবুকে এসে শান্তিতে লিখলেও টিপুনি  কেউ গান করলে, ছবি আঁকলে, নাটক করলে তো  বলা হয় না এত  গায়ক কেন? এত শিল্পী কেন? যত দোষ কবিতার আমিও অল্পস্বল্প লিখি, আপনিও লেখেন, যে নতুন লিখতে আসছে সেও একই স্বপ্ন দেখছে আনন্দের স্বপ্ন আমার তো তার পিঠে হাত রাখা উচিত যারা বিখ্যাত কবি তাদের তো ধরিয়ে দেওয়া উচিত তার খামতিগুলো, ভালোবেসে বলা উচিত, একটু এই ভাবে ভাবলে কেমন হত বলো তো আমার খুব খারাপ লাগে কখনই কাওকে এভাবে বলতে শুনিনি ফেসবুকে তো আমার অভিজ্ঞতা কম হল না চুপচাপ বহু চরিত্র দেখে যাই তার মধ্যে একটি কমন চরিত্র আমাকে কবিতা ট্যাগ করবেন না একজন তরুণ কবি যদি তার কবিতার ভালো না মন্দ জানতে চায়, এ কি অপরাধ? আদৌ  কবিতা হচ্ছে কি হয়নি জানতে চায়  সে কি দোষের ? একজন কবির কাছে একজন কবিতাবোদ্ধা মানুষের কাছে একজন সদ্য কবিতা লিখতে আসা তরুণ তরুণী  তো এই আশা করবেই নইলে কোথায় যাবে সে? কার কাছে জানতে চাইবে কবিতার দিগন্ত অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ যারা কবিতা লিখছে, লিখে যারা  অল্পস্বল্প নাম করেছে  তারাও চায় না মানুষ কবিতা লিখুক অতএব সবাইকে নিরুৎসাহিত করো একটি আদর্শের প্রতি যদি আমার শ্রদ্ধা থাকে একটি কাজের প্রতি যদি আমার সত্যিকারের ভালোবাসা থাকে তাহলে আমি চাইব আরও বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ একাজে এগিয়ে আসুক ছোটবেলায় সব ছেলেই অল্পবিস্তর ফুটবল ক্রিকেট খেলে আমিও খেলতাম ক্রিকেট এই খেলাটা আনন্দের,প্রাণ ভরে বাতাস নেওয়ার জন্য গাভাসকার বা শচীন হওয়ার জন্য নয় এই যে ফেসবুক,এত কবিতা,সবাই আনন্দে লিখছে,লিখুক অনেক পাতাই ঝরে যাবে একসময় কিন্তু আনন্দ উন্মাদনার শ্যামল স্মৃতি থেকে যাবে


কবিতাউৎসব: আমরা দেখেছি সোশ্যাল সাইটগুলিতে সবাইকে নিজের কবিতা গল্প পড়াতে আমাদের যে তৎপরতা তার সিকিভাগও অন্যের লেখা পড়ার বেলায় নেই। পড়লেও সে কেবল বন্ধুকৃত্য সম্পাদনার্থেই মূলত। এবং পাঠ করা সেই সাহিত্যের বা লেখার ভালো মন্দ, সম্ভাবনা ও ব্যর্থতা নিয়ে কোন গঠন মূলক আলোচনা সমালোচনা করার পরিসরও প্রায় অনুপস্থিত অন্তর্জালের এই মায়াবী দিগন্তে। এই বিষয়টি কতটা কষ্ট দেয় আপনাকে? কিভাবে বদল আনা যেতে পারে এই দমবন্ধ পরিবেশে?

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: এই প্রবণতা চিরকালীন শুধু অন্তর্জাল বা ফেসবুককে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই আসলে এই মানসিকতা আমাদের রক্তের ভেতর প্রিন্ট ম্যাগাজিনে কি বন্ধুকৃত্য নেই? আছে হয়তো এতটা উলঙ্গভাবে প্রকাশিত নয়। একটু আড়াল আবডাল এবং গোপনতার আশ্রয়ে কিন্তু  আছে আর নিজস্ব কবিতাটুকু পড়া, অন্যদের কবিতা এড়িয়ে যাওয়া, অপরের চিন্তাভাবনার বিষয়ে অনাগ্রহ এও  আজকের অর্জিত মুদ্রাদোষ নয় চলে আসছে সভা বা অনুষ্ঠানে নিজের কবিতা পড়া হলে সরে যাওয়া এসব তো আছেই কিন্তু এভাবে সাহিত্য হয় না সাহিত্য শব্দের সাথে সহিত শব্দের যোগ রয়েছে আমি, আমি আমি এই মানসিকতার বাইরে বেরিয়ে না এলে প্রকৃত সৎ সাহিত্যের বাতাবরণ তৈরি হবে না কলুষিত হবে মুক্ত চিন্তাভাবনাও একজন মহৎ সম্পাদককে হতে হবে নির্মম বন্ধুত্ব বা স্বজনের পৃষ্ঠপোষকতা করা তাঁর উদ্দেশ্য নয় প্রকৃত সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন সাহিত্যচিন্তাকেই বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে যা আগামীর পক্ষে মঙ্গলজনক  নইলে সাহিত্য  আবর্জনার স্তুপে পরিনত হবে  শুধু অন্তর্জালে নয় খুব অলপ কিছু সংখ্যক পত্রিকা ছাড়া আজ আর  সাহিত্যের ভালো মন্দ, গঠনমূলক আলোচনা  এসব পরিলক্ষিত হচ্ছে না এ বড় দুঃসময়য় নিজস্ব গ্রুপের মানুষজনের পিঠ চাপড়ে বাহবা দেওয়া ছাড়া আর কোন অভিমুখ দেখা যাচ্ছে না আপনিই বলুন তো আপনাকে যদি বলি একটা কাগজের নাম করতে,যেখানে লেখা প্রকাশিত হলে আপনি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করবেন  আজ আর সেরকম কোন কাগজ নেই এই স্পর্ধিত অহংকারের এই মায়াবী দিগন্তের অন্ধকার আমাকে খুবই পীড়িত করে মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ি, এই নৈরাজ্যের প্রবহমান স্রোতের ভেতর সাঁতার কাটতে কাটতে  প্রকৃত পাঠক কোথায়? প্রকৃত সম্পাদকই বা কোথায়? একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে এই প্রসঙ্গে শৈবাল মিত্রের লেখা  একটি গল্প একজন ময়রাকে নিয়ে যে মিষ্টি বানায় তার সুখ্যাতি জেলা এবং জেলার বাইরে দূর  দূরান্তে একটি বিয়েবাড়িতে সে মিষ্টি সরবরাহের অর্ডার নিয়েছে কালই মিষ্টি পৌঁছে দিতে হবে সকাল সকাল রাতে সে টের পায় কেমন পচা গন্ধ চারপাশে রসগোল্লার ভেতর থেকেও গন্ধটা আসছে এই মিষ্টি সাপ্লাই করলে তার বদনাম হয়ে যাবে দীর্ঘ পরিশ্রমে অর্জিত সুনাম নষ্ট হয়ে যাবে আবার হাতে সময় নেই কী করবে সে চিন্তায় পড়ে যায় কর্মচারীদের নির্দেশ দেয় ওই মিষ্টি যেন সাপ্লাই না করা হয় যত সময়ই লাগুক আবার নতুন করে বানাতে হবে কিন্তু কেউ তার কথা শোনে না মিষ্টি প্যাকিং হয়ে পৌঁছে যায় বিয়েবাড়িতে সে ভয়ে ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে এই বুঝি কেউ এসে দোকানে অভিযোগ করে গেল ছিঃ মশাই ছিঃ কিন্তু আশ্চর্য সেরকম কিছুই হল না সে নিজেই গেল বিয়েবাড়িতে জনে জনে জিজ্ঞেস করল মিষ্টি ঠিক ছিল তো? প্রত্যেকেই তার  কারিগরি দক্ষতার প্রশংসা করল আপনার মিষ্টির স্বাদই আলাদা মুখে দিলেই বোঝা যায় সে দোকানে ফিরে এসে নির্দেশ দিল দোকান বন্ধ করে দাও আর মিষ্টি বানাবো না সবাই চমকে উঠল কেন ? -একজন রসিক মানুষও যদি না থাকে তাহলে কার জন্য শিল্প সৃষ্টি করব আমি ? পচা গলা আবর্জনার সাথে প্রকৃত শিল্প আজ ঘুলিয়ে যাচ্ছে ভেদরেখা নির্ণয় করার মতো মহৎ রসিক নেই ফলে নিরাশা বাড়ছে 


কবিতাউৎসব: শুধু নিজের ভাষার সাহিত্যচর্চাই নয়, অন্তর্জালের সাহিত্য দিগন্তে বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যচর্চার মধ্যে একটা সহজ আদান প্রদানের পথ খোলা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার? এবং সেই বিষয়ে আপনার নির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ যদি থাকে।

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: নিজের ভাষার সাহিত্যচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে রুদ্ধতার পারিপার্শ্বিক থেকে বেরিয়ে এক মুক্ত দিগন্তের দিকে আমাদের পদযাত্রা পাশাপাশি প্রতিবেশী সাহিত্যকেও জানতে হবে তাঁরা আজ কী ভাবছে? কবিতা কোন মানচিত্রে বন্দী থাকেনা সাহিত্যের পায়ে কোন শিকল নেই আমাদের সৃজনশীলতার সাথে আন্তর্জাতিকতার মেলবন্ধন খুব জরুরি একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি ধরুন আমি পাড়ার ক্রিকেটে বেশ ভালো সুনাম অর্জন করেছি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলি স্কিল ও প্রশংসনীয় কিন্তু আমি যতক্ষন না  দেশের সেরা ক্রিকেটারদের পাশে খেলছি  বা বিদেশের খ্যাতিমান খেলোয়াড়দের পাশে খেলছি ততক্ষন আমি বুঝতে পারব না আমার সীমাবদ্ধতা গুলো আন্তর্জাতিক সাহিত্য  না পড়লে আমরা কোথায় রয়েছি সেই অবস্থানকে চিহ্নিত করা যাবে না ইন্টারনেট এই পরিসর তৈরি করেছে,আজ সহজেই বিখ্যাত আন্তর্জাতিক কবিদের চেতনার রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে পারছি আমরা এবং এর সমান্তরালে তুলনা করে নিতে পারছি নিজদের কমজোরী দিকগুলো অসুখ নির্নয় না হলে তার নিরাময় তো সম্ভব নয়  পরামর্শ কি দেব ? আপনি এই কাজ তো নিরন্তর করে চলেছেন আপনাকে দেখে উৎসাহিত বোধ করছি


কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষথেকে আপনাকে আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে পরিশেষে জানতে চাইবো সাহিত্যের এই অন্তর্জাল দিগন্তের ভুবন আপনাকে কতটুকু তৃপ্তি দিয়েছে।

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়: অন্তর্জাল এবং তার দিগন্ত প্রসারিত দুনিয়ার সাথে পরিচয় হওয়া আমার কাছে এক প্রাপ্তি কত মানুষের সাথে যে পরিচয় হল এখানে এসে ভাবলে রোমাঞ্চিত হই কার্ল কেম্পটন এর মতো বিশ্ববরেন্য সাহিত্যিককে পেয়েছি এখানে এসে Mathematical Poetry নিয়ে তাঁর যে কর্মকান্ড তা অবাক করে দেয় পাশাপাশি ভিস্যুয়েল পোয়েট্রি নিয়েও প্রচুর কাজ করেছেন তিনি বাংলা সাহিত্যের দুপার বাংলার অগণিত প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিভাবান কবিদের ভালোবাসা পেয়েছি ভাবনার আদানপ্রদানে সমৃদ্ধ হয়েছি শ্রদ্ধেয় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় আমাদের ফাল্গুনীদা এত ভালোবাসেন, এত স্নেহ করেন এর জন্য অন্তর্জালের কৃতিত্ব আমি স্বীকার করবো না? শুভ্র ভট্টাচার্য আমাকে এত ভালোবাসে এত প্রশ্রয় দেয় আমি কি পেতাম অন্তর্জাল তাঁকে আমার কাছে না এনে দিলে ? কোন অনুষ্ঠানে গেলে এখন আর নিজের পরিচয় দিতে হয়না সদ্য লিখতে আসা কিশোর তরুণ মুখগুলি এগিয়ে আসে সামনে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসায়  প্রাণ খুলে গল্প করে –‘ দাদা তোমাকে কতদিন ধরে চিনি, আজ প্রথম দেখা হল এই যে সবাই মিলে একটা পরিবার কারও সাথে দেখা হয়েছে, কারও সাথে দেখা হবেআমরা স্পর্শ করে আছি প্রত্যেকের হাত এই তৃপ্তি ফেসবুক আমাকে দিয়েছে