ব্রততী
সান্যাল
ক্যানভাস
--------------
স্মৃতির শহর জুড়ে বন্যা হয় রোজ,
রাত্রিকালীন মুহূর্ত ছুঁয়ে—
উজান স্রোত ঘেঁষে বাসা বাঁধে ঘুম..
চেনা কিছু মুখ পড়ন্ত বিকেলের অগোচরে খেলা করে,
জানলার গরাদে মেশে গোধূলির ওম—
বারান্দা বেয়ে নামে শৈশব-দর্পণ..
উঠোনে ছায়া ফেলে অতীত-বুনট,
সেই আমগাছ আজ স্বর্গযাত্রী বোধহয়,
কংক্রিট দেওয়াল ভেঙে জন্ম নেয় দূষিত শ্বাস..
দীঘির অতলে মাছগুলি রঙ হারায়—
ধূসর রঙ আঁকড়ে বাঁচে আজকাল..
জলরঙা সন্ধ্যার আঙিনায় ক্লান্তি ভুলে দাঁড়াই,
সাঁঝতারার বুকে এঁকে দিই আগামী সুন্দরের আশ্বাস—
যান্ত্রিক দৃশ্যকল্পের ধোঁয়া ঢেকে দেয় স্বপ্ন পরিসর,
হাল ছাড়ি নি তবু—
কল্পনার দূরবীনে গড়ে ওঠে মাঠ, বৃক্ষ—
আরও যা কিছু শ্যামল..
অবচেতনার হাত ধরে ডুবে যাই আমি—
ব্যক্তিগত বিষাদ ভুলে,
পা ফেলি সব-পেয়েছির দেশে..
ধুলো সেখানে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়,
রক্তস্রোত ঝরনা হয়ে ফুল ফোটায় প্রতিদিন..
© ব্রততী সান্যাল
অপেক্ষারত
-----------------
বিকেল-স্রোতে ভেসে চলা মনখারাপের কিনারে
তার পদধ্বনি নোঙর ফেলেছে,
রামধনু-আবেগে প্রেমিক হওয়া দুখানি চোখ
আমার চেতনার প্রাসাদে রঙ খোঁজে অবিরত,
অপরিবর্তিত অতীতের ব্যথিত সংজ্ঞা ভুলে
আসন্নতার ক্যানভাসে সে দেখেছে আমায়..
আমিও অবেলার বারান্দায়
উপন্যাসের আছিলায় অকপট
সেই পুরুষের অপরূপ জলছবি এঁকেছি,
নির্বিবাদ অনুভূতির অচিন স্বাক্ষরে উন্নীত হয়েছি ক্রমাগত..
অহেতুক সভ্যতার কথিত উপান্ত ছাড়িয়ে
প্রথাগত সমাজের নির্লজ্জ বিভক্ততা ভেঙে,
যে প্রকৃত ভালবাসা শেখাবে.
যাপনের জটিলতম অ্যাভিনিউয়ের শেষচিহ্নে
যে নিটোলতম হাসির আশ্বাস দেবে---
অঘোষিত দ্বন্দ্বের উপত্যকায়
তার আগমনী চিঠি আগলে অপেক্ষারত আমি..
ক্লান্তিহীন ঢেউয়ের আঙ্গিকে,
অতিক্রান্ত বিষাদের মৃত্যশয্যায় সে নিশ্চয় আসবে—
নুইয়ে পড়া দুটি হাত ও উপেক্ষায় জর্জরিত এক হৃদয়ের ক্ষত
সযত্নে মেপে বলবে,
‘চলো এগিয়ে যাই, প্রান্তর যে প্রভূত বাকি’..
© ব্রততী সান্যাল
নেশাতুর
------------
কিছু মুহূর্তের ঠোঁটে নেশা লেগে থাকে,
প্রাত্যহিকতা এসে থেমে যায় হঠাৎ, অকস্মাৎ..
ডুবো পাথরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজ যেমন
জলসিঁড়ি বেয়ে অতলে বাসা বাঁধে,
তোমায় ছুঁয়ে দেখা বোধগুলো
অচ্ছুৎ হয় ফ্রেমবন্দী মুহূর্তগুলোয়,
অবচেতনার দীঘিতে স্বেচ্ছায় ডুব দেয়—
ওপারে ভেসে ওঠে কিনা দেখা হয় নি আজও..
প্রত্যাশার দূরবীণটা ক্ষয়ে যায় রোজ,
ধূ ধূ বালুচরে ছুঁড়েই দেব একদিন—
অভিমানী সরিসৃপ হয়ে জন্মাবে যুগান্তরে,
জঙ্গল ভেঙে খোদাই করবে তোমার নাম..
আবেগ ভুলে জোৎস্নায় হেঁটে যাব আমি,
ডালপালা বিস্তৃত পরিসরে
পরিচয় হাতড়াবো— সম্ভ্রমের গুঁড়ো মাখবো দেহ জুড়ে..
ঘোর লাগা মুহূর্তগুলো এভাবেই
প্রাত্যহিকতা ছাপিয়ে গল্প লিখে যায়—
তুমি-আমি শোনার আশায় বসে থাকি,
সেই অবকাশ ফুঁড়ে গুপ্ত কিছু বিষাদ
ডানা মেলতে চায় নিজস্ব নিয়মে মেনে,
ছাঁটতে গেলেই দমকা হওয়া হয়ে ভাসে..
আমি পথ ভুলে ব্যর্থ ফিরে আসি,
প্রতিদিন প্রতিবার, অবিরাম..
© ব্রততী সান্যাল
এপিটাফ
------------
তোর নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছুঁয়ে ভিক্টোরিয়ার নুড়িপথে
বিকেল গোলাপি হয়েছে ক্রমশ..
খেয়ালী সেই ঠোঁটের সংজ্ঞা মেপে,
কত অপ্রকাশিত অভিমান প্রগাঢ়তা ভুলে
স্রোতের উপান্তে হারিয়ে গেছে—
প্রিন্সেপ ঘাট শুনেছে অঘোষিত বহু প্রতিশ্রুতি
সুদূরে ভেসে গেছে পালতোলা নৌকা—
যাবতীয় স্তব্ধতাকে সযত্নে ছাপিয়ে,
“ভালবাসি তোকে পাগলি!”,
ঘাটবাঁকে হিল্লোল তুলেছিল কি?
নিস্তব্ধ দুপুর ব্যস্ততার বিরতিপর্বে স্মৃতিকল্প এঁকেছিল
সেদিন—
কলেজস্ট্রিট মোড়ে,কফি হাউসের নিঃশ্বাস জুড়ে “ছেড়ে যাবি না তো?”,
প্রতিধ্বনি শুনেছিলি?
সাঁঝতারার কক্ষপথ বেয়ে নেমে আসা
সন্ধ্যের মায়াজাল মনে রেখেছে নন্দন?
তিলোত্তমার যানজট ছাড়িয়ে
এগরোলের গন্ধটা বেশ পাই আজকাল..
ধুলোমাখা হাওয়ার গন্ধও দিব্যি ভেসে আসে,
শুধু তোর গন্ধটাই হারিয়ে গেছে..
হলুদ শাড়িটা রাখা থাকে আলমারিতে, তবে..
মনখারাপের কমলা স্তর যেন লেগে আছে,
কেমিস্ট্রি বইয়ের ফাঁকে শুষ্ক গোলাপ
‘প্রাক্তন’ মানেটা বেশ বোঝে আজকাল..
ভিড়ঘেঁষা মেট্রো স্টেশনে যদি
চোখাচোখি হয় কোন অবসন্ন গোধূলিলগ্নে,
“নীল পাঞ্জাবিটা পরিস এখনো?”,
বিষাদ ভেঙে করেই ফেলবো প্রশ্নটা—
সেদিন ‘বেহায়া’ বলবি না তো?
© ব্রততী সান্যাল
ভালবাসা
রঙ বদলেছে
------------------------
যাপনের নৈমিত্তিক ক্যানভাস ছুঁয়ে
আজকাল বর্ণিত হয় প্রেম,
ব্যস্ততম মিলিসেকেণ্ডের কেন্দ্রস্থলে
পরিচিত কিছু আবেগ ঘনায়মান হয়..
ক্লান্তিবিহীন নিশাচর সত্তার প্রয়োজন তলানিতে এসে ঠেকেছে,
উপেক্ষার উপকূলে অনৈতিক অভিমান
‘প্রাক্তন’ আখ্যায় ভূষিত হয়েছে..
নিষিদ্ধ অনুভূতিগুলো মুহূর্তের
আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে,
চেতনার অঘোষিত পরিসরেও
বাসা বেঁধেছে সেই বিষাদ-বৈরাগ্য---
ভালবাসা সদ্য উদীয়মান প্রভাত নেই আর,
সে আজ স্বাভাবিক ছন্দে বহমান নদী---
অন্তিম সমাপ্তির মোহনা অবধি
নিরন্তর অস্থিরতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সগর্বে..
:
© ব্রততী সান্যাল