শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

সুমনা পাল ভট্টাচার্য



সুমনা পাল ভট্টাচার্য

গন্তব্য
---------------------------

শেষ ট্রেন আসার শব্দ
ঘরের জানলা পেরিয়ে প্যাঁচালো সাপের মত
আমার খাটের পায়া বেয়ে উঠছে....

আমি বালিশ চেপে রেখেছি শব্দরোধের নেশায়
তবু সমস্ত তুলোর ধূলো হাওয়ায় উড়িয়ে
ট্রেন এসে দাঁড়ায়....
মাঝরাতের নি:সঙ্গ উপহাসের মতো...

আমি ছুটছি আর ছুটছি
চটি খসে পড়ছে, পায়ে ঠোকর লাগছে
দরদর করে ঘেমে উঠছি
নি:শ্বাস ফুলে উঠছে

আমি হাঁ করে বাতাস নিচ্ছি একমুঠো বাঁচার লোভে...

ট্রেন ছেড়ে চলে যাবার আগে আমায় উঠতেই হবে ওটায়...
ওটাই যে শেষ ট্র্বেন..

বালিশের গা ভিজিয়ে,
চাদরের দলা পাকানো সভ্যতা ছাপিয়ে,
এমন ভয় পেরিয়ে
আবার আধছোঁয়া ভোর আসছে...

আস্তে আস্তে কালো থেকে সাদা চারপাশ
আমার দু:স্বপ্নের ছবিরা চাদরের গায়ে হাঁটছে

যে স্টেশনে ফেলে এসেছিলাম আমাদের শেষ চুমুর উজান
সেইখানে পৌঁছতে রোজ রোজ এই স্বপ্নের ভাঁটা তরী ...

আমার গন্তব্য হারিয়ে যায়
সাদা থেকে কালোয়
বারবার , প্রতিবার, আবার...
     -----------------------





তোমার মঙ্গল হোক...
---------------------------

ধরো, যখন সন্ধ্যের শাঁখ বেজে ওঠে তুলসীতলায়
চারপাশে কর্পূর গন্ধ
স্নিগ্ধ বাতাসী বিন্যাস
আমার বুকের ভেতরের নদীতে তখন একটা ভরাডুবি..

ডাক দিয়ে কানে কানে বলে যায়, " ফিরলে তো ঘরে?"

ধরো, যখন অনেক রাত
চারপাশের নিয়নের আলোগুলি ধুকপুকে
উলঙ্গ রাস্তায় নিজেদের গ্লানি লুকোয়
এক উম্মাদ ভ্রম অন্ধকারে কেবলই মায়াজাল বুনে যায়

ঠিক তখন আমার চোখের কোণে বালি কিচকিচ করে ওঠে,
ঘুমের দরজা ঠেলে কে যেন অস্ফুটে বলে যায়
"তোমার দুচোখে শান্তির ঘুম আছে তো?"

ধরো, সূর্যশিশু যখন প্রথম হামাগুড়ি দিচ্ছে আমার ঘরের জানলায়
এপাশ ওপাশ ছড়িয়ে পড়ছে নতুনের বিচ্ছুরণ
এক মৃত, কালো ঘনকের উপর জীবন মধু খুঁজছে

আমার দিনের সব পুণ্য ঈশ্বরের পায়ে বাজি রেখে
কে যেন চোখে চোখ রেখে শুনিয়ে যায় প্রভাতী সুর,

সেই সুরের একটিই স্বরলিপি,
" তোমার মঙ্গল হোক"....
             --------------------------------





নৌকাডুবি
-------------------

এক অরণ্য যাত্রায় সামিল হই রোজ
সাক্ষর জেগে থাকে বিচিত্র প্রলাপে

কপালে, চিবুকে,নাকের দুপাশে
নোনা মেঘ জমতে থাকলেই বুঝি...
             আমি পথ হারিয়েছি।

ভয়ার্ত স্রোত গলার নালি ঠেলে আছাড় মেড়ে এনে ফেলে
অস্তিত্বের অলিন্দ ঘিরে বেড়ে ওঠা কাঁটাঝোপে।

ঘূর্ণাবর্তে আবর্তমান সময় আর আমি মুখোমুখি দাঁড়াই
শিরায় শিরায় গনগনে আঁচ যখন তুফান তোলে
মনে পড়ে
এক বুক জোড়া শীতলপাটি
তোর দৈর্ঘ্যপ্রস্থ জুড়ে ফেলে এসেছি সেই কবেই....

এখন রোদে পুড়ি, জলে ভিজি,
রাতজাগা চোখে আলো-আঁধারের মিলমিশ দেখি।

মুখোশের ছায়ায় ঢাকি মুখ
পিছন দিকে হাঁটি এক পা, দু-পা, চার-পা
তারপর
সময়ের কাঁটা ঘুরিয়ে দেখি একের পর এক নৌকাডুবি.......
-------------------------------------------






ভালবাসা
----------
এক সবুজ দ্বীপের সন্ধানে নাবিক হৃদয়
বাইনাকুলারে ঠাসা স্বপ্নের দু-চোখ

ন্যাপথলিনের গন্ধ পেরিয়ে আসা পথে
নদী বেঁকে গেছে জীবনের ম্যাপ ঘেঁষে...

ভেজার জন্য দু আঙুল ডোবাতেই
কেমন কেঁপে ওঠে রেখাপথ

অনেক গুলো অন্ধকার গুহা পেরিয়ে
এক চিলতে প্রাণের খোঁজে এ সফর..

মাঝ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে দেখি ওই দূরে
দেখা যায় বড় কাঙখিত সেই ঠিকানা...

স্বপ্নের মত ছায়া নেমে আসে মুখে
আস্তে আস্তে
  জল মাপা চোখে নেমে আসে ঘুম

ভোরের স্বপ্নের নাম হয় বুঝি!!
বেশ তবে নাম রাখলাম
      " ভালবাসা"....

-------------------------------------------






দায়
-----

আমার জীবাশ্ম জমিতে যখন প্রথম চাষ শুরু করেছিলাম
তখন সম্বল বলতে ছিল একটিমাত্র চারা
কি যে অসম্ভব যত্নে একটু একটু করে তার শিকড় জুড়ে প্রাণ এঁকেছিলাম,
তা জানি কেবল আমি।

সারাদিন চেয়ে থাকতাম ওই কচি মুখের দিকে
জোরে হাওয়া দিলেই ছুট্টে গিয়ে আঁচলের আড়াল দিতাম ওকে।
বৃষ্টি নামলেই নিজের ভিজে যাওয়া সপসপে শরীরটা
টানটান করে ছাতার মত মেলে দিতাম ওর বৃত্তের উপর বৃত্ত মেপে।

যেদিন প্রথম ওর গা বেয়ে সবুজ চিকচিকে পাতাখানা মুখ বাড়ালো
মনে হয়েছিলো
আমার শিরা-উপশিরার সমস্ত রক্তস্রোত আছড়ে
অঞ্জলি দিতে পারি ওই মাটির উপর....

দিন,মাস,বছর পেরিয়ে সেই চারা আজ মহীরুহ।
ডালপালা মেলে, ফুল-ফলে ভরে
সে আজ জমির সীমানা ছাপিয়ে হেঁটে গেছে
আপন নেশায় দূরে বহুদূরে।

গা বেয়ে,পা বেয়ে তার বুকের কাছাকাছি,
ঘেঁষাঘেঁষি আরও অজস্র অজস্র সবুজের ভিড়।

সবাই মিলে রোজ ওরা রোদ ওঠায়,বৃষ্টি নামায়।

ওদের উৎসবের নেশা তীব্র হলে
আমার চোখে নামে মরচে পড়া কালো রাত
একবুক উজান নদীর বাঁক ঘুরে যেতে দেখলেই
ভাঁটার টান পড়ে পাঁজর-ঘরে

এঁকেবেঁকে আদরের নদী ছোঁয়া হয় না

কেবল রসদ হয়ে যাই আজীবন
একটুকু জল হয়ে
জীবন দেবার দায় নিয়ে, সবুজের পায়ে পায়ে।।
                      -------------------------------