মনিকা আহমেদ
তৃতীয় জন্ম
আমি অবগাহন করছিলাম, তন্ময়তার গভীর সমুদ্রে, আকণ্ঠ। এর বাইরে-
পৃথিবীর কিছুই চিনিনি তখনো!
একদিন, ঘন আঁধারে ঢেকে গেল
আকাশ। হঠাৎ হাজার হাজার তরঙ্গ, কম্পনে কম্পনে ধেয়ে
এলো প্রচন্ড ঘূর্ণঝড়! আমি গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছিলাম- সমস্ত অস্থিত্ব নিয়ে।
তারপর, হঠাৎ চোখ রাখলাম পৃথিবীর দুরবীনে। আকাশ-পৃথিবী, এক বিশাল প্রগতির সিঁড়ি আমার সামনে মেলে ধরেছে। আমি
ধীরেধীরে এগুলাম।
তীব্র ব্যথাতুর কণ্ঠে বলেছিলাম, চিনতে পারছো আমায়?
আমি সেই মুনুপাখি। যে দেবদূত এর কাছে একটা
বৃষ্টির রাত্রি প্রার্থনা করেছিলো একদিন! দেবদূত বিস্ময়ে বলেছিলেন, শুধু একটি বৃষ্টির রাত্রিতে ভিজতে চাও তুমি? কেন হে! আমি বলেছিলাম- এ আমার পৃথিবীর অনিন্দ্য সুন্দর এক
স্বপ্ন। তুমুল বৃষ্টিতে কেবলি সিক্ত স্নানের স্বপ্ন বুনি, স্বপ্ন আঁকি--- দিন- মাস -বছর -যুগ- শতাব্দী- একা একা----
বৃষ্টির ছোঁয়ায় জেগে উঠি, ছোট্ট চারাগাছ যেমন মাটিফুঁড়ে আকাশের দিকে তাকায়। ভাবি,অদৃশ্য কেউ গভীর ভালোবাসায় আমাকে ছুঁয়ে দেবে! অদ্ভুত এক
মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পাই। বাতাসে কান রেখে বুক হিম করা হু হু কান্নার শব্দ
শুনি।
সেই আমায় চিনতে পারছো রাত্রি সিন্ধু পৃথিবী? হুম সে চিনেছে। তার উষ্ণতাপে জুড়িয়ে গেলো চোখ আমার। আমি
গভীর আনন্দে, যেন এক নক্ষত্রের পাড়ে, ডুবন্ত সূর্যদেবের নীলিমার তলে হারিয়ে গেলাম! আহা--
মনে মনে সমুদ্র কে বললাম, 'পরাজিত হতে ভালোবাসি তার অর্থ এই নয়, জয়ের যোগ্যতা নেই!'
আর নক্ষত্রের নীলিমাপাড়ের নিঝুম দীপের ঘুমঘোর
ভাঙ্গতেই, দেখি- সূর্যদেবের এতটা কাছে এসে গেছি যে, তার ক্ষরতাপে ঝলসে যাচ্ছে আমার সমস্ত সত্ত্বা!
বেঁচে থাকার তীব্র আকর্ষনে, দ্বিতীয়বার সিঁড়ি বেয়ে এ আমি কোথায় এলাম? সূর্যের বিছানায় শুয়ে থাকা কি যায়? সূর্যের স্পর্ধা আছে, আমাকে পোড়াতে পারে!
মনে মনে সূর্যকেও বলেছি_
'পুড়ে যেতে ভালোলাগে, তার অর্থ এই নয়, অন্যকে পোড়াতে পারিনা'।।
ঝিনুক
ঝিনুক তুমি নীরবে থাকো নিঝুম দ্বীপের তলে-
ঝিনুক তুমি নীরবে কাঁদো সমুদ্র কল্লোলে-
ঝিনুক তোমার মায়াবী মোহন সুন্দর অমলিন
দৃষ্টির নেশায় পরাজিত হয় সমুদ্র সঙ্গীন-
একটি মানবী একাকী স্রোতে ঝিনুকের মত কাঁদে
একটি প্রবাল দ্বীপে ভাসমান কালো জলে।
নীল দরিয়ার ইতিহাস খোঁড় কালো পাথরের গান
সঙ্গম করে যাযাবর তিমি সমুদ্র সন্তান।
আজ শুধু হিমশীতল ভালোবাসার দিন
- আজ শুধু হিমশীতল ভালোবাসার দিন!
- মাথাটা কি তোমার সত্যই গেছে! পাগল হলে এ সন্ধ্যা রাতে?
- আজ সারাদিন শুধু বৃষ্টির ছাঁটে ভেজা স্নিগ্ধজলে,
উন্মাদ-উত্তাল হয়ে নিসর্গ চাই ছুঁতে-
- এক্ষুনি শুয়ে পড়ো জ্বর নামবে গায়ে! হে আকাশ বৃষ্টি ঝারিও না,আজকের রাতে।
- আজ সারাদিন কাঁদায় মাখা, মাটির ঘ্রান নাকে,
জাগছে তৃষ্ণা, হাওয়ার ঝড় উঠে-
- হায়! আর কতো? আর কত, জ্বালাবে? খুব
ভোরে যেতে হবে
সব সব পিছে ফেলে, করোনা ফুলের আঘাত শস্যের ক্ষেতে! অফিসে হবে যেতে-
- উহু! কাল শুক্রবার, অফিস বন্ধ। জানো তো?
হরতালে বয়ে গেছে রাজপথে নদী, সব সব তুলে নেবো, ভালোবাসা যদি!
- ভালোবাসা ছুঁড়ে ফেলে আগুন জ্বালাবো জলে, জল যদি হতে পারে এসো অন্তরে
- তোমার জন্যে জল হবো, শীতল নদী হবো,
হবো কাশফুল!
- জ্বালালেও জ্বলো না তুমি,
তুমি কি সন্ধ্যার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফুল?
নাও তবে বৃষ্টি ভেজা সাতটি বকুল
গেলে এভাবেই চলে যেতে হয়
যেতে হলে হুট করেই চলে যাওয়া ভালো-
তাতে ভারাক্রান্ত মেঘ, হৃদয়কে
প্রত্যাশা থেকে আড়াল করে। বলে গ্যালে
ফিরে আসার প্রত্যাশার তীব্র একটা যাতনা
বুকের ভেতর সারাক্ষণ শঙ্খ ধ্বনির মতন শব্দ করে
মরে, শূন্যে নাম ধরে ডাকে।
তখন হৃৎপিন্ডের পথে আলুথালু দাবানল,
কে নেভাবে?
রাতভর গুঁজে থাকি মুখ, পাখির শরীরে
রাত গভীরে নক্ষত্রকে শীতের মতন জাপটে ধরে
সাতকুঠিরে ঘুমের আনন্দ খুঁজি __
আমার হৃদয়ে বসে থাকে চুপচাপ অন্ধকার
অমাবস্যা রাতে খুলি বন্ধ কপাট
খুঁজি নদীর জলে তোমাকে-
সারারাত সাঁতার কেটেছি-আমার অসুখ দিনে;
কুয়াশায় ভিজেছিলাম তন্ময় ভোরে
তখনও ছিলাম একা ঘন অন্ধকারে..
হুট করে চলে গ্যালেই বুঝবে,
গেলে এভাবেই চলে যেতে হয়; স্তব্ধতার দেশে।
কুহক সময়
একদিন আমিও জলের স্রোতে গাইতাম
কাঁচ ভাঙা শব্দে খিলখিল কি ভীষণ হাসতাম
ছিপছিপে হরিণীর ছন্দে ঘরময় আলুথালু ভাসতাম;
খুব ভোরে যে যুবক বহুদূর-ট্রেনে ছুটে আসতো
তাকে যে কি ভীষণ ভালোবাসতাম!
সেই ট্রেন থামেনি তারপর-আর,
বোহেমিয়ান ভোর আসেনি কখনো-
নোনাজল-
নোঙর-নদী, প্রিয় শহর
শূন্য বালুচর, আঁধার ও গহীনজল
ভালোবাসে ব্যাপক আমায় ||
মৃত ছায়া
এখানে আজ মৃত ছায়া পড়ে আছে,
এখানে প্রেত্মার কন্ঠস্বরে কে তুমি শব্দ করে
হাসো?
আমি এই আধো ছায়াতলে কাঠ বেড়ালির মতো বসে আছি
গাছের আড়ালে;
তুমি আসবে বলেছিলে-
তুমি আসবেই বলেছিলে।
অনেক দূরে বেজে যায় লোকাল ট্রেনের তীব্র হুইসেল, হুইসেল শুনে কেঁপে উঠি!
আমার কোথায় যেন যাবার কথা ছিলো;
তবু 'আমি ঠাঁয় দাড়িয়ে, তুমি নিখোঁজ সংবাদ হলে!
এই গা ছমছমে জনশূন্য মৃত আমলকি গাছটির তলে
তুমি আসবে বলেছিলে, তুমি আসবেই বলছিলে...
প্রতীক্ষা করে করে আমি আজ
মৃত বৃক্ষমানবী হয়ে গেছি দ্যাখো ...।।