অভিজিৎ পাল
বিষাদমুখর বিরহ সিরিজ : দুটি কবিতা
১.
ফিরে আসার পর শরীরে মিশে থাকে বিষাদসুন্দরী দাগ। রঙহীন
আনন্দযাপনের মধ্যে আমার যে সব কথা মন্দিরের গায়ে সেজে উঠেছিল এক পাক্ষিক জীবনাংশে
তার কাছে আবার ফিরে যেতে চাই। মন্দিরের ধাপে ধাপে মিশে আছে আমার আনত বিক্রম। আমার
রুদালি সংগ্রাম প্রতিবারই অন্যরূপে সাজে। বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর মতো দৃঢ়চেতা তো
এখনও হতে পারিনি। বিষাদের ছায়া এসে লাগছে ক্যানভাসে। যন্ত্রণার দাগগুলো জেগে উঠছে
জলজ রেখার ইশারায়। তাঁর পরমপদে ফিরে আনার আর্জিপত্র পেশ করে হারিয়ে যাচ্ছি
বহুদূরে। আমার শুদ্ধ সন্ন্যাসযাপনের বাসনা জাগে। চেনা চেনা সোদা গন্ধ উঠছে
গঙ্গায়...
২.
আমায় এনেছো যখন ফিরিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও এখন তোমার উপরই
বর্তায়। কোনো পরমান্ন বিলাসের বাসনা নেই। রতিবিলাসের কামনা নেই। প্রচুর দগ্ধবোধ
জেগে উঠছে জলজ রেখার। শ্রান্তি চেতনার রঙে মিশে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘ মেয়াদী ঘোর
ঘিরে রেখেছে আমায়। যেন এর থেকে আমার ক্রমমুক্তি নেই। মন খারাপের মেঘ জমেছে
চালচিত্রে। বদলে গেছে তাদের কথকতা। ধারাবাহিক উপন্যাসের জটিল অম্লমধুর আমিগুলো একে
একে মুছে দিচ্ছে আদিম ঔপন্যাসিকের প্রেক্ষাপট। আমার হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নযাপন। যাত্রাভিনয়ের
বর্ণমালা বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ধীরে। দীর্ঘমেয়াদি মিলনের দৈবী ইচ্ছে রাখছে হাতের
উপর হাত। এই স্পর্শটুকুই আমার বহুজন্মের চেনা...
.......
পুনর্মিলন
আজ আমার আর কোনো স্থানু পটভূমি নেই। আমার কোনো
কাহিনিবিন্যাসের নির্মিতি নেই। নেই জীবনযাপনের ছন্দ। এক কল্পভূমি সময়ের হিসেব
বেঁধে রেখেছি হাতের মুঠোয়। কাটিয়েছি একাকীত্বের কোনো এক অজানা সতর্ক হিতৈষীবার্তা।
চেনাদৃশ্য পুঞ্জিভূত হয়েছে দূরে কোথাও। সেখানে আমার প্রয়োজন আর অপ্রয়োজনের ভাগশেষ
এক অঙ্কে মিলে যায়। সরে আসছি খানিক পরে পরে। পা মেলাতে গিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি।
ছবিগুলো সরে যাচ্ছে অপার শূন্যতায়। আমি পুনর্মিলনের ইচ্ছে নিয়ে নিজের চারিদিকে
পাঁচিল গেঁথে তুলছি। আকাশ ছুঁয়ে তাকিয়ে আছে একটা শঙ্খচিল...
............................................................
আয়ণ
একদল কর্ষক জেহাদ ঘোষনা করে উঠে দাঁড়ালো বুকের উপর।
রামকথার প্রাক্ ইতিহাস জানতে গিয়ে হলের অগম্যা অহল্যাকে অন্য সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত
করতে বড়ই দুবিধা তৈরী হয়েছিল, অজানাদের ভাবী সময়ের
অসংস্কৃত সংস্কৃত মনে। চিরকাল তোমরাই অমোঘ সতর্ক নির্দেশে পৃথিবীকে তুমি নারীর মতো
শুধুমাত্র ফলবতী জেনে এসেছ। জানিয়েছ ওর আমার আমাদের অন্যসূত্র গাঁথা আছে বীরের
হাতে! তোমার নাগরিক পরকীয়া আত্মিকরণের সূত্রে শুধু বলেছ কোনো কোনো অনাবৃষ্টির সময়ে
রাজাকেও হলধর হয়ে যেতে হয়। তোমার বণবৎ মুখীভবন কোনোদিনই কর্ষকদের রাজা ভাবাতে
শেখায়নি!
............................................................
সাহিত্যের নবভাবনার
পর থেকে
হাততালি আর হাততালি। সমস্ত দর্শকের উঠে দাঁড়ানোর অভিবাদন।
গুমরে ওঠে চেনাপথ জুড়ে অজস্র অতীতে আমার হারানো কথোপকথনের বাক্যিক বিন্যাস।
চর্যাগীতিকোষ শুনছি। যেসব রাগের সুর এখনও অজ্ঞাত, তার সামনে নতজানু হয়ে বসে আছি। তিনটি বিষণ্নরেখায় এঁকে
দিচ্ছি কাহ্নপাদ আর ডোম্বীর ভালোবাসার কবিতা। শব্দ হচ্ছে ক্রমশ। বিকৃত গবেষণার মতো
ঘোষণাহীন কথা বলতে চাই সমস্ত পূর্বরাগ মাখানো সূত্রগুচ্ছ মুছে দিয়ে। আজানুলম্বিত
ঋতুহন্তার বিমর্ষ জমে ওঠে অন্ধকারের স্নেহটুকুকে সম্বল করে। লুইপাদ হাততালি দেবেন
প্রথম। তারপর ভুসুকুপাদ, শবরপাদ, বীণাপাদ আর সবশেষে একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে করতে আমি...
............................................................
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের উপর দাঁড়কাক বসে আছে
কেরিয়ার গড়ে তোলার পর আস্থাশীল হয়ে উঠছিলাম নিজের
উপর। বুঝতে শিখছিলাম মহাকাব্যের পাঠ। সম্ভাষণ আর সম্মানের থেকে কিছু বর্ণ মুছে
নিচ্ছিলাম অজ্ঞাতেই। হে কৃষ্ণ, তুমি নব মহাভারতের প্রেক্ষাপটে উচ্চকন্ঠে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলে
সত্যিই একটা ধর্মরাজ্য তৈরী করে দেবে। আমরা একশো শতাংশ বিশ্বাস করেছিলাম তোমায়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে মেনে নিয়েছিলাম তোমার শর্তদের, তার গোপনে চলে বেড়ানো অভিসন্ধিদের। ভেবেছিলাম
ধর্মরাজ্য যদি কেউ তৈরী করে দিতে পারে, তবে সে তুমি। আমরা কেরিয়ারের সার্টিফিকেট হাতে তখনও ঠিক ঠাক
বুঝতে পারিনি তোমাদের আর আমাদের কাছে ধর্মরাজ্যের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ পৃথক।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আঠারো দিনের পর আজ উনিশে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার আকাঙ্ক্ষিত
ধর্মরাজ্য স্থাপন করতে চলেছ যাদবপতি। শুধু আমার হতদরিদ্র পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের
উপর দাঁড়কাক বসে আছে, ওকে একটু উড়িয়ে দাও আগে...
..................................................
কাশী বোস লেনে হেঁটে চলে আমাদের দ্বৈতজীবন
অনেক দিন পর আবার পথ চলা। কিছুই বদলায় নি আমার
শহরে গত কয়েক বছরে। আলোর নীচে আলো, নীল-সাদার মেকাপ, বড় বড় তামাম হোডিং বসেছে শুধু। সেন্ট্রাল বা সূর্য সেন
স্ট্রিটের গুমটি, ফুটপাত জুড়ে ঘুমিয়ে থাকা শিশুমুখ, কিছুই বদলায় নি। অল্পে অল্পে বদলেছি আমরা। শিখেছি মেকি
হাসির ভদ্রতা দেখিয়ে কী করে মনে মনে বিরুদ্ধ বাক্য বলা সহজ। শিখেছি আরও অনেক
কিছুই। হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার নির্ভরশীল না বলা কথাদের এখন আর বুঝতে অসুবিধা হয়
না। সাপ্তাহিক নিয়মে কাশী বোস লেনে হেঁটে চলে আমাদের দ্বৈতজীবন। চক্ষুলজ্জা হারিয়ে
দিচ্ছি অজানা সাহসে। ভালোবাসতে ভালোবাসতে আমরা পুনরায় পরস্পর নির্ভর হয়ে ওঠার
স্বপ্ন দেখছি..
..........................................
পর্ণমোচী
নীল আকাশের কোনো সীমারেখা নেই। কাঁটা তাঁরের
বেড়া নেই দু'টো দেশ বরাবর। ভেদাভেদের ভেদরেখা নেই নতুন গম্যপথে। নেই ঢাকা কিম্বা
কলকাতার আলাদা নামকরণ। আমাদের সব দৈনন্দিন কথাগুলো বেড়ে ওঠে গলির মোড়ে। জেহাদ
ঘোষনা করে মুঠোয় চেপে। বুকের ভিতর আগুন জাগায় বৈপ্লবিক ক্ষুধায়। একটা হঠাৎ করে
আমূল বদলানোর স্বপ্নকুচি জন্মায়। সময় জমিয়ে দেয় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের শরীরী পলি। শুধু
অপমানের ভার বহন করতে থাকে অসময়ে.. থমকে যায় স্বপ্ন বদল যায় চাওয়াটা। মেনে নিতে
শিখি প্রতিবন্ধকদের। আমাদের জন্য আনন্দ জমে ওঠে অন্ধকারে। মাটির উপর ইঁটের পাঁজা
করে তুলি। যতটা পথে চলেছি আমরা দাগ কাটি। পতাকার প্রতি অঙ্গিকার করি ঐক্যতান সুরে।
গাছের মতো বড় হয়ে উঠি সূর্যালোকের দিকে চেয়ে। শিকড় বেড়ে ওঠে গন্ডী দেওয়া টবের
ভিতর। সব সম্পর্কের ঘোষণাহীন কথা বলতে বলতে। আমরা ঠিকঠাক পর্ণমোচী হয়ে যাই। নতুন
কোনোও স্বভাব সিদ্ধতায় নতুন সমীকরণে..
......................................
সংক্রামক
আলো মাখি। চুপ শব্দের সঙ্গে বসে থাকি। ভালোবাসি
আর প্রতিবাদ করি নিজে নিজে। দাঁতে দাঁতে চিবিয়ে স্বকীয় ভঙ্গিমায় পড়ে ফেলতে শিখি
রবীন্দ্র-পাঠের সোপান। হাততালি আর হাততালি। আনন্দ হতে পারে আবার নাও হতে পারে
আমার। সমস্ত তুইরা ক্রমশ আপনি হয়ে যাচ্ছেন। ক্যানভাসে চোখ ঠেকাই। আয়নায় ছবি দেখি।
হঠাৎ ভয় নেমে আসে শরীরময়। সন্দেহ হয় আপনি আর তুই-এর মাঝে থাকা তোমায়। যে কোনো
দিকেই ঘুরে যেতে পারো। আপনিতে কিংবা তুইতে। দোষ দেবো না। সময় মতো বদলে যাওয়া
অভিযোজনেরই নিয়ম। বড় বেশি রকম আবহমান ও বিজ্ঞানসম্মত। আধুনিক। কর্কট রোগের চেয়েও
ভয়ংকর এক বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে আলোর নীচে। এবার দ্বিধাহীন হয়ে একবারের জন্য তুমিও
সংক্রামক হয়ে উঠতে পারো!
.................................................................................
দেওয়াল লিখনে আটকে রাখি আমাদের মিথগুলো
আমার পরিচিত অবিসংবাদিত হাসি আর অহাসিদের ছড়িয়ে
দিচ্ছি পাড়াময়। আমাদের বাড়ির বাইরেই দেওয়ার কত যুগ আগে থেকেই যেন রাজনৈতিক
পতাকার কাছে বলিপ্রদত্ত। এগরিমেন্টহীন কোনো এক অজানা এগরিমেন্টে দেওয়ালটুকুর উপর
আমাদের আজ অবধি সম্পূর্ণ আয়ত্তের অধিকার বোধ আসে নি। এ সব গার্হস্থ্যর অত্যন্ত বাহ্যিক
উপকরণ বলেই হয়ত উপেক্ষা করতেন আমার প্রপিতামহ। পিতামহ। পিতাও। হয়তো এটা একটা
বিশালাকার মিথ, যেই মিথের
সঙ্গে সত্যি আর মিথ্যে মিশতে মিশতে যার আজ আর নতুন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখা পাওয়া
দুষ্কর। দেওয়াল লিখনে আটকে রাখি আমাদের মিথগুলো। যা আমার পূর্বপুরুষ আর পূর্বনারীরা
একই সঙ্গে মান্যতা আর উপেক্ষা করতে শিখিয়েছেন। নতুন চুন সাঁটা দেওয়াল দেখছি। আবারও
কারা যেন দেওয়াল লিখবে বলে সেই পুরাধুনিক এগরিমেন্টের নিয়ম মেনে আগামী পাঁচ বছরের
জন্য স্বত্ব লিখে দিয়ে গেছে...
..........................................................................................................................