শুক্রবার, ২১ জুলাই, ২০১৭

রাবেয়া রাহীম



রাবেয়া রাহীম

মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর

- রজনী
আমার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রক্রিয়াগুলো
গভীর মমতায়-নিপুন হাতে-সুচারুভাবে শেষ করে
আমার বাবা তার বুকের সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
মায়ের পার্থিব শরীর আজ থেকে বিলীন হয়ে যাওয়া মেনে নিতে
বাবার কষ্ট কতটা তীব্র সেটা বুঝার বয়স আমার তখনও হয়নি
তবে তাঁর দুচোখ গড়িয়ে জলের ধারা
এখনও আমার কপালে- চোখে-মুখে লেগে আছে ।।


আমার ছয় বছর বয়সে মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে
বাড়িজুড়ে অতিথির কোলাহলকে আমি আনন্দ উতসব ভেবেছিলাম।
গোপনে বয়ে যাওয়া বাবার চোখের জল বুঝার মত বয়স আমার তখনো হয়নি।
তবে আব্দারের কমতি ছিলনা তার কাছে।
নামাজের কাতার, গির্জার ঘণ্টা, ভজন গাওয়া পুরুত
সব মিলেমিশে একাকার ছিলো  সে সময়।।

বয়স বাড়ে;
অশরীরী মায়ের অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠে মানসপটে
এক গভীর রাতে, বৃষ্টি হয় খুব
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির টুপটাপ--কুকুরের ডাক।
নাহ! এ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিলো না ।
হঠাত মায়ের সাথে দেখা--
কপালে কোমল করতলের স্পর্শ দিয়ে  ঘুম ভাঙ্গায়
অন্ধকারে স্পষ্ট আমার মা আর তার চোখ।
নবভাঁজের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ধূসর অবয়বে
শাহাদাৎ আঙুলে ঠোট চেপে মা খিলখিলিয়ে উঠে
উচ্ছল এক কিশোরী যেন সে এই সময়ে
ফিসফিস করে কিছু বলতে চায়। অস্পষ্ট। আমি কান পাতি।
আমার সাথে মলিন স্মৃতিস্তুপও চেয়ে থাকে,
দেখা হয় মায়ের সাথে--
অশরীরি মায়ের বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি,
মাঝরাতে তখনও  বৃষ্টি।

মায়ের অপেক্ষা যে পথ শেষ হয় সে পথে চেয়ে থাকি
পশ্চিম আকাশে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে।

প্রার্থনার জন্য  শ্রেষ্ঠ সময়।কাঁদবারও।।





জীবিত সংসারে জন্মের অস্তিত্ব

ব্যস্ত নগরীর যান্ত্রিক কোলাহল কমে আসতে থাকে

সন্ধ্যে জেগে উঠে গভীর অন্ধকারচ্ছন্ন আকাশ নিয়ে

নির্জন একলা রাজপথ, দাম্ভিক ফ্লাইওভার, মাটিতে পড়ে থাকা জেব্রাক্রসিং,

রাত আরো গাড় হয় বস্তির ঘরের ভেতর মোটা কাঁথা দিয়ে বিভক্ত করা ছোট ছাউনিতে

ষোল বছরের উঠতি বয়স -- খেয়ে পরে গায়ে গতরে বেশ।

মাতাল, লম্পট আর শিকারী টহল পুলিশের তির্যক চাহনি

ছোট দুটি অবুঝ ভাই বোন, অসুস্থ মা ---চারটে পেটের জ্বালা ।।



নীল ব্লাউ্জটাও ঘামে ভিজে হয়েছে কালচে নীল

অস্ফুট কান্নার স্বর ভেসে এল-- "সাহেব টাকাটা দিইয়ে যেও"

রুঢ় বাস্তবতার মুখে কিছু কাগুজে নোট ফর ফর শব্দ তুলে ঘুরপাক খায়

মাঝরাতে শরীরে হাজার হাজার বিছার কামড় টের পায়, শেফালি

হাট করে খুলে রাখা ময়দানের বুকে-- ছুটে বেড়াচ্ছে অজস্র বিষাক্ত বাতাস,

ক্ষুধার্ত অবুঝ পেট গুলো ডাকছে কাতর স্বরে।।



"বেশ্যা শরীর" নাম নিয়ে জীবিত সংসারে জন্মের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখে সে

রোজ লোকালয়ে চেনা মুখ অচেনায় পাশ কাটিয়ে যায়।

তাচ্ছিল্যের সাথে ধিক্কার দিয়ে বলতে চায় শেফালি--"দিনের আলোয় আমি খুব অচেনা"

নগ্ন, নোংরা পর্দাহীন শরীর ডুবে থাকে পঙ্কিলতায়

প্রয়োজন শেষ সব শেষ,

অচেনা সাহেবেরা শহরের আনাচে কানাচে নগ্নতার উপহাসে মত্ত,

বাতাসে ভাসেনা কখনো পারিজাত সুবাস, আকাশে জুড়ে ছেয়ে থাকেনা প্রশান্তি।

প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে দেখা হয় শেফালিদের ।





উপলব্ধি

দ্বিধাগ্রস্ত মন  চিনতে পারে কি নিজ সত্তা!

এইতো আছি বেশ ...হাট করে খোলা দরোজা

অচেনা বকুলের চেনা ঘ্রাণে বাতাস

আসা-যাওয়ার জানালার শার্শিতে বন্দী দৃষ্টি

দেহ নামক  শখের রঙিন খাঁচায় আটকে আছি--

শত শত  চাপা আর্তনাদ, লুকিয়ে রাখি বুকের জমিনে

বিদ্রোহী ক্ষণে-- মন হয়ে উঠে অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্যা ভাগ্যের কাছে

নির্বাক এই আমি. মুক্তি চাই, আত্মার পরিশুদ্ধি চাই  !!



আলোকিত অতীতের দ্বার খুঁজে ফিরে পেতে

হারিয়েছি দৃষ্টিশক্তি---নিঃশেষ করেছি প্রাণ শক্তি !

হৃদপিন্ড জুড়ে অস্তিত্বের স্পর্শ দুঃস্বপ্নের বুদবুদ তুলে

হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনিচ্ছার লেহনে !

দুঃখ দেখিনি ,কষ্ট সইনি,সুখও চিনিনি!

তুলনাও আসেনি....শুধু পাজর ভাঙ্গার শব্দ

রাত-দিন শিরায় শিরায় পায়চারি করে

জান্তব চিৎকার দিয়ে জানান দেয়

জন্মান্ধ এই আমি নিজেকেই  কখনো দেখিনি  !!





শরম

ধর্ম যদি উস্কে দেয় ধর্ষণ এমন ধর্মে আমার বড্ড শরম

ধর্ম যদি উস্কে দেয় "অনার কিলিং" এমন ধর্মে আমার বড্ড শরম।।

আমার জন্মভুমি,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি মাটিতে লুটায় আমি পাই শরম

নাঙ্গা তলোয়ার হাতে দেয় ধর্মের পাহারা আমি পাই শরম

নারী দেহ কবরেও হয় বেইজ্জত আমি পাই বড্ড শরম ।।

হিংস্র,উগ্র,ধর্মান্ধদের পরাতে কনডম

ধর্মের নামে অধর্মে উঠুক গর্জে সকল কলম।।

মৌলবাদী কাপুরুষদের রক্তচক্ষু করে উপেক্ষা

একবিংশ শতাব্দীতে সময়ে ওষধ হবে মানবতা ।।






নীল বেদনারা

কপালের উপর এলোমেলো কিছু চুল

ঘাড়ের কাছের চুলগুলোও ছিলো বড্ড উচ্ছ্বল

নীল শাড়িতে তুমি ছিলে আনমনা--সু,

তোমার লং রুটের বাসটা থামতেই চোখে পড়লো

আমি বাস স্টপে ঠাই দাঁড়িয়ে।



একবারও কি তোমার ঐ ছলছল চোখ

আমার উদাসীন চোখে বেদনায় কতোটা নীল ছিল দেখেনি --অনি!

আচমকা নীল আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে

উদ্দাম-উত্তাল তুমি খুলে নিয়েছিলে অস্থির আত্মা

সে থেকেই ব্যাকুল অনুভূতিগুলো ঝুলে আছে ব্যক্ততার অক্ষমতায়

একদিন বলেছিলে---নীল রঙে আমায় মানায় ভীষণ

সে থেকেই নীল আমার কি যে প্রিয়!