কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার ১৪২৪
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। ‘কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’
এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন
সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায়
থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির
এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র
কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব
এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই
প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
মণিজিঞ্জির: প্রথমেই শুভকামনা
জানাই আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজদের,আমার বন্ধুদের এবং বাংলার সমস্ত
পাঠকবৃন্দকে। জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশু বড় হয় তার মায়ের সাহচর্যে। মায়ের ঘুমপাড়ানি
গানের সুর বা দুলে দুলে কবিতা পড়ার মধ্য দিয়েই একটি শিশু অবচেতনে বা চেতনে গান বা
কবিতার কথা অনুধাবন করে। আমারও কবিতার শুরু ঠিক সেইভাবে। প্রথমে হাত মুখ মাথা
দুলিয়ে দুলিয়ে আদো আদো করে বলে উঠেছিলাম “ বর এসেছে বীরের
ছাদে / বিয়ের লগ্ন আটটা / পিতল -আঁটা লাঠি কাঁধে / গালেতে গালপাট্টা . ………সেই শুরু। তারপর তো কবিগুরুকে স্নান
করতে করতে, বই গোছাতে গোছাতে, খেতে খেতে। এরপর একে একে একে
জীবনানন্দ থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়……
কবিতাউৎসব: কিন্তু উ প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা
প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে
আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
মণিজিঞ্জিরি: আমার মনে হয় প্রতিটি কাজের পেছনেই
নিষ্ঠা, পরিশ্রম, অধ্যাবসায় একে অপরের সাথে জড়িত। আমি ছোট
থেকেই লিখতে বা পড়তে ভালোবাসি। ছোটবেলায় কবে পরীক্ষা শেষ হবে তার অপেক্ষায়
থাকতাম। পরীক্ষা যেদিন শেষ হতো সেদিন
থেকেই গল্পের বই পড়া শুরু। বাঙালি মানেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি এক নিবিড় বন্ধন।
কিন্তু হ্যাঁ একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই আজকের দিনে সাহিত্য-চর্চা অনেকটাই
হুজুগে। আসলে সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্যে এই কবি হওয়ার বাসনাকেই সবচেয়ে সহজ
উপায় মনে করেন তারা কিন্তু তার জন্যে কোনো সাধনা বা অধ্যাবসায় নেই।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা
বা সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যচর্চা বলতে আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই সাহিত্যচর্চায়
বিশ্বাসী? না কি মনে
করেন কবিতা বা সাহিত্যেরও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার
নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক
দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী
বলে মনে হয় আপনার? যেমন ধরা যাক একুশের চেতনা। বাংলা ভাষার
স্বাধিকার বোধ। এইসব বিষয়গুলি। মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ লক্ষ্যগুলি।
মণিজিঞ্জির: আমার প্রতিটি লেখা
জীবন্ত আর আমি সবসময় মানুষের কথা বলি। তাঁদের দুঃখে আমার দুঃখ, তাঁদের আনন্দে আমার
আনন্দ। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সমাজের প্রতি আমি কতোটা দায়বদ্ধ। সমাজ ছাড়া সাহিত্য হয়
কি? আমরা সমাজবদ্ধজীব, মানুষের দুঃখ-
কষ্ট- হতাশা -আনন্দ নিয়েই আমাদের জীবন। এই
যে পাহাড়ে বা চা-বাগানে বা জঙ্গলে বেড়াতে যাই। সবাই জানে আমি প্রকৃতি পাগল একটা
মেয়ে কিন্তু প্রতিটি বেড়ানোর পেছনে আমার শুধু যে ভালোলাগা কাজ করে তাই নয়; কতো মানুষের যাপনকে কতো কাজ থেকে দেখেছি, তাদের
জীবনের কথা শুনেছি, শুনেছি তাদের দৈনন্দিন আচরণ, খাওয়া- দাওয়া, পোশাক-আশাক সবকিছু। জীবনকে ভাল না বাসলে, সমাজকে
দু-চোখে না দেখলে তাহলে আর সাহিত্যিক কি? আমি যে শুধু গদ্যে
তাদের কথা তুলে ধরেছি তা নয়, কবিতার মধ্যেও তাদের কথা বলেছি
বারবার। আমি শুধু প্রকৃতি প্রেমিক নই; আমি বাস্তব জগতেও
মানবদরদী
কবিতাউৎসব: এখন
এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা
গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই
প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ
একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে? এমনকি
হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
মণিজিঞ্জির: একদম তাই, অন্ধ বিশ্বাস বা
অন্ধ ভালোবাসা কোনো কিছুই শুধু একজন সাহিত্যিকের জীবনে কেন, যে
কোনো ব্যক্তির জন্যেই ঠিক নয়। আমি নিজের দেশকে জীবন দিয়ে ভালোবাসি; পাশাপাশি অন্য দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকবে না তা কেন? এ ব্যাপারে আমার সাথে কেউ একমত নাই থাকতে পারেন। আমি আমার নিজের সন্তানের
মতোই অন্য সন্তানকে ঠিক সেই ভাবেই ভালোবাসি। কথাটা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও
সত্য। যারা আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন বা জানেন তারা আমার আবেগকে বোঝেন। ঠিক
তেমনি ভাবেই আমার দেশের মতোই অন্য দেশকে ভালোবাসি। আমার দেশের কোনো মানুষ ব্যথা
পেলে আমি যে কষ্টটা পাব, একজন বিদেশীর ব্যথা লাগলেও সেই
কষ্টটাই পাব। আর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
মতাদর্শ যদি কারো থেকেও থাকে সেক্ষেত্রে সাহিত্য সাধনায় তার যেন ছাপ না পড়ে। আমার
মনে হয় কিছু কিছু জিনিস ব্যক্তিগত থাকাই ভাল।
কবিতাউৎসব: আবার
এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে
মনে করেন আপনি, এবং কেন?
কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
মণিজিঞ্জির: আজকের কথাই তো কালকে
ইতিহাস হয়ে যাবে। সভ্যতা দিনে দিনে পাল্টে যায়। আদিম যুগ থেকে আজ অবধি মানুষের
ভাবনা -চিন্তা শক্তি- কল্পনা শক্তি পরিবর্তিত। আমরা যখন কিছু লিখি বা সৃষ্টি করি
তখন কিন্তু খুব মেপে -বুঝে শুনে -হিসেব করে লিখিনা। আমরা চারপাশে যা দেখি তার-ই
প্রতিফলন ঘটে লেখায়। জীবন বড় অস্থির; আমাদের মানব মন বড় অস্থির। ইতিহাস আমরা নিজেরাই গড়ি, আবার নিজেরাই ভাঙ্গে ফেলি। তাই
আজকের দিনটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করাই শ্রেয়।
কবিতাউৎসব: এই
যে স্বদেশপ্রেম, নিজের
দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার
প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ
আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই
সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার
স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে? বিষয়টিকে
আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম
স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
মণিজিঞ্জির: আমি পুরো
পৃথিবীটাকেই একটা ভূখণ্ড মনে করি এবং আমাদের একটাই পরিচয় তা হচ্ছে আমরা মানবজাতি
এবং ঠিক এই কারণেই আমি চাইব দেশ-কাল-জাত-ধর্মের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের পারস্পরিক
সাহিত্য চর্চা একটা গন্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক। আমার কাছে
যে লেখা হৃদয়গ্রাহী তাই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য; সেক্ষেত্রে সেটি
আমার দেশের সাহিত্য হোক বা ফরাসি সাহিত্য হোক। সাহিত্যের আবার জাত থাকে নাকি?
সাহিত্যের আবার সীমানা থাকে নাকি?
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা
সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে
সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে
অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না। আজ
কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টাকে আপনি
ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে,
যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা
সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি
এটি আসলেই অশনি সংকেত?
মণিজিঞ্জির: একে এককথায় বিশ্লেষণ করা যাবে না।
কোনো মাধ্যমকেই ছোট করা উচিত নয়। আমি খুব পজিটিভ চিন্তা ভাবনায় নিজেকে তৈরি করেছি।
সব কিছুর মধ্যেই আমি সবসময় ভাল জিনিসটা সংগ্রহ করি, এটি শুধুমাত্র আমার সাহিত্য
জীবনে নয়, বাস্তব জীবনেও। তাই এই অর্ন্তজালের জগতে কে কীভাবে
সময় নষ্ট করবে বা সময়কে সুন্দর কাজে ব্যবহার করবে সেটা সম্পূর্ণ তার নিজস্ব ভাবনা।
অন্যদিকে নেগেটিভ দিকগুলি নিয়ে যদি ভাবি তাহলে দেখা যায় পাঠক অনেকটাই কমে যাচ্ছে
বাস্তব জগতে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে সবাই লেখক, পাঠক
কম। লাইক-কমেন্ট এসব নিয়ে মাথা ঘামানো কিন্তু সত্যিই বোকামো কারণ এই জগৎটাতে শুধু
যেন লাইক-কমেন্টের প্রতিযোগিতার খেলা। অদ্ভুত সব শব্দমালাকে কবিতা বলে এবং নিজে
কবি পরিচিতি দিয়ে ফেস বুকে রমরমিয়ে যা খুশি ভাবে সময় নষ্ট করছে। সিরিয়াস পাঠক আছেন,
তবে সংখ্যায় কম। অনেকেই না পড়েই লাইক-কমেন্ট করছেন তা বোঝাই যায়।
সস্তায় নাম করার একটা দারুণ মাধ্যম এই ফেস বুক দুনিয়া। অনেক সময় ইচ্ছে করে গল্প
লিখি কিন্তু না পড়েই শুধু ‘ কি ভাল, কি
ভাল ‘ মন্তব্য
যথেষ্ট বিরক্তির কারণ। তাই কালে ভদ্রে গল্প লিখি কিন্তু নিজস্ব অনুভূতির কথা যখন
লিখি সেটা কিন্তু পাঠক পড়েন কারণ সেগুলোর মন্তব্যেই সে কথা বুঝিয়ে দেন। মাঝে মাঝে
কবিতা লিখি। কবিতা সিরিয়াস কিছু পাঠক কিন্তু মন দিয়ে পড়েন সেটা আমি অনুভব করি। তবে
ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিছু বন্ধুর লেখা নিয়ম করে পড়ি কারণ অনেক কিছু শেখার আছে যা
আমাকে ভাবায় আর অবান্তর লেখা পড়ে সময় নষ্ট করিনা। বোঝা যায় সত্যিকারের সাহিত্য
চর্চা কারা করেন। তবে এর একটা পজিটিভ দিক আছে যারা শহরতলীর বাইরে থাকেন তাঁরা অনেক
কিছুর সূত্র পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে
কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার
কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন,
এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা
যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা, রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক
আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায়
বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত ভোলবদল- এই
বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি?
বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?
মণিজিঞ্জির: সবকিছু তো আপনি-ই
বলে দিয়েছেন। উত্তরে শুধু বলি একজন কবি বা সাহিত্যিক হৃদয়ের যন্ত্রণাই নিংড়ে বের
করেন তাঁর কলমের ডগায়। সামাজিক অবক্ষয়ের যন্ত্রণা- মন্ খারাপ সবটাই শব্দমালা হয়ে
বেরিয়ে আসে ঐ সাদা কাগজের গায়ে গায়ে ।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে
মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে
রাজনীতি নেই, সামাজিক
অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী।
জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,
কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো
মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি
জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে
বলে মনে করেন?
মণিজিঞ্জির: জীবনকে মানুষ কিভাবে দেখবে সেটা
সম্পূর্ণ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে নির্ভর করে। কিছু লেখা তো কল্পনার জালে নির্ভর
করে সৃষ্টি হয়েই থাকে। লেখা আসে তার নিজস্ব ছন্দে। কবিতা তো সম্পূর্ণ অনুভবের ওপর
নির্ভর করে। তবে হ্যাঁ পাশের বাড়ির একটি বাচ্চা না খেয়ে মরে গেল, আর আমি যদি সেই সময়
লিখি ‘ আহা আমার চারপাশে শুধুই বসন্ত’ তখন
মনে হয় নিজের কাব্যচর্চা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যাবে কারণ মৃত্যু যেমন
চিরন্তন সত্য; তেমনি
অনাহারে একটি শিশুর মৃত্যু ততোটাই ভয়াবহ। তখন সমাজের আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর
প্রশ্ন এসেই যায়। তখন সেই পরিস্থিতিতে সেই শিশুটির ভয়াবহ মৃত্যুর কারণ অবলোকন
করাটাই একমাত্র পথ। কিন্তু তা না হয়ে যদি কল্পনার জগতে সেই সময় নিজেকে ভাসিয়ে দিই,
তাহলে পাঠক আমাকে গ্রহণ করবে কেন?
কবিতাউৎসব: সাহিত্যে
শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের
লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে
বিভিন্ন সমালোচকের কাছে। আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই
বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে।
মণিজিঞ্জির: শ্লীল-অশ্লীল এই শব্দদুটোর সাথে
সুন্দর- অসুন্দর শব্দের দারুণ সাযুজ্য। ইচ্ছা করলেই যে কোনো বিষয়কে সুন্দর দেখা
যায় না। সুন্দর দেখা অনেকাংশে সুন্দর
হওয়ার উপর নির্ভর করে। শিল্পকর্মের বীজ নিহিত শিল্পীর সৃষ্টিশীল কল্পনায়। এখন কোনো
একটা গল্পকে একজন সাহিত্যিক কোন ভাবনার আঙ্গিকে শব্দগুলো প্রয়োগ করলেন তা পাঠককে
বুঝতে হবে। যখন কোনো একটি বস্তি জীবনের জীবন আলেখ্য তুলে ধরব তখন যদি তাদের
কথ্যভাষাকে আধুনিক সমাজের কথ্যভাষায় তুলে ধরি তখন সেই গল্প বা উপন্যাস লেখাটাই
ব্যর্থ হয়ে যাবে। পাঠকের কাছেও তা হাস্যস্পদ হবে। তবে হ্যাঁ শব্দ প্রয়োগের
ক্ষেত্রে নিজেকে ঠিক ঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে। আজকের দিনে কিছু মানুষ সস্তা প্রচার চাইছেন;সেক্ষেত্রে কিছু
অশালীন শব্দ ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যবহার করে প্রচারের শিরোনামে আসতে চান। একটা শব্দকে
দুরকম ভাবে ব্যবহার করা যায় অন্তত কবিতার
ক্ষেত্রে। বাংলা সাহিত্যে শব্দের ভাণ্ডার শূন্য নয় নিশ্চয়ই। একটা শব্দ দিয়ে বোঝাই। যেমন “ব্রা“না লিখে “অন্তর্বাস“ শব্দটি
অনেক বেশি সুন্দর। এবারে অনেকে বলতেই পারেন স্পষ্ট কথায় কষ্ট কোথায়? আবার পাশাপাশি এ কথাও ভাবতে হবে নিম্নশ্রেণীর মানুষের ভাষা নিশ্চয়ই একজন
শিক্ষিত মানুষের মতো হবে না, তাই গল্প লেখার সময়
স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শব্দ প্রয়োগের করতে হবে। এক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত একজন পাঠক
ঠিক সেটা বুঝতে পারবে বলে আমি মনে করি। অনেকেই আবার সস্তা প্রচার পেতে কিছু
অপ্রাসঙ্গিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে থাকেন। আমি মনে করি টানটান সহজ সরল বাস্তবধর্মী
লেখাই বাংলা সাহিত্যে একদিন ঠিক জায়গা করে নেবে আর সেই সৃষ্টিই কালজয়ী হবে।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডীত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা
কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন
বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর
দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে
কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?
মণিজিঞ্জির: আজকের দিনে মনে হয় আর কোনো কাঁটাতার
নেই এই জন্যে অনেকটাই দায়ী এই অন্তর্জাল।
আমরা পরস্পর মত বিনিময় করতে পারি অনায়াসে। দেশ বিভাগ হলেও এক-ই ভাষাভাষীর মানুষ
কিন্তু কখনো আলাদা হতে পারেনা। তাই দেশভাগের জন্য বিশাল কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত
হয়না বরং আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের জন্যেই কারণ এই ভাষার
জন্যে তাঁরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের
লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?
মণিজিঞ্জির: প্রথমেই বলি আমার
লেখালেখিটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে নিজের ভালোলাগার ওপর। আমি মনের আনন্দে লিখি।
সমাজের চারপাশে যা দেখি বা শুনি তাই আমি কাব্যে রূপ দিয়ে থাকি। আমি বস্তিতে যাই, সেখানকার জীবনকে
খুব কাছ থেকে দেখি। ট্রেনে যেতে যেতে একবার পরিচয় হয়েছিল একজন নপুংসকের সাথে।
যাত্রাপথের অনেকটা সময় তাঁর সাথে কাটিয়েছিলাম। সে জানিয়েছিল তাঁর জীবনের দুঃখ-
কষ্ট- যন্ত্রণার চিত্রকথা। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন বিদায় জানিয়ে ছিলাম
তাঁকে। না না একেবারে বিদায় জানাই নি তাঁকে। একদিন তাঁকে নিয়ে লিখে ফেললাম একটা
অনেক বড় গল্প। এরপর লিখলাম একজন সমাজবিরোধীকে নিয়ে। তাঁকে নিয়ে লেখার আগেও আমি
সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম একজন নিষিদ্ধ পল্লীর মহিলার। সেখানকার প্রতিদিনের জীবন
কাহিনী শুনতে শুনতে চোখে জল এসে পড়েছিল। তাঁর ব্যথাভরা চোখদুটো দেখে আমার বুকের
ভেতরটা হুহু করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল ওনাদের নিয়ে লিখতেই হবে। এইভাবে বাড়ির কাজের
মেয়ের জীবনকথা কিম্বা রিকশাচালকের জীবনের রূপ খুব কাছ থেকে জেনেছি-চিনেছি-বুঝেছি।
আমার প্রথম পরিচয় একজন গল্পকার হিসেবে। তাই মানুষের সাথে খুব সহজভাবে মিশি। তাদের
প্রাত্যহিক রূপকে খুব কাছ থেকে জানার
চেষ্টা করি। পাশাপাশি কবিতা কিন্তু একটুও
সচেতন ভাবে লিখি না। কবিতা আমার ঠিক সেইভাবে আসে না। গল্প যেমন যে পরিবেশেই
থাকি না কেন মোটামুটি একটা বিষয়কে তার মতো করে সাজিয়ে লিখতে পারব কিন্তু কবিতা
সেইভাবে আসে না। যখন ভীষণ মন খারাপ হয় কিম্বা পাহাড় বা ঝরনা বা ভাল কিছু দেখে মনে
হয় ঈশ্বর আমাদের কতো কিছু দিয়েছেন তাও আমরা খুশী নই, এইভাবে
মনের ভেতর একটা অনুরণন সৃষ্টি হয়। তারপর শব্দমালায় ভরে ওঠে আমার কাগজ আর সৃষ্টি হয়
আমার কবিতা।আমার গল্প- উপন্যাস- কবিতা বা ভ্রমণকাহিনী সব শ্রেণীর মানুষ-ই পড়তে
পারবেন কারণ আমি খুব সহজ ভাষায় লিখি। একটা জিনিস আমি ভীষণ ভাবে মানি তা হচ্ছে যে লেখা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয় বা যে লেখার
অর্থ বোঝার জন্যে অভিধান খুলে বসতে হয় সে লেখা আমি কোনোদিনই লিখব না।
কবিতাউৎসব: আপনার সাহিত্যচর্চার আজীবন সাধনার
বিভিন্ন পর্ব পেড়িয়ে এসে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা তৃপ্ত আপনি? আর কতটা আক্ষেপ রয়ে গেল? ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?
মণিজিঞ্জির: কোনো মানুষই তাঁর
কাজের জায়গায় তৃপ্ত থাকতে পারেন বলে মনে হয় না। আমার লেখা তো সবে শুরু বলা যেতে
পারে। এখনো তেমন কিছুই লিখে উঠতে পারিনি। মনের মধ্যে সবসময় নতুন নতুন গল্প ঘুরে
বেড়ায়। ভাবনাগুলো এসে ভিড় জমায়। আমি পথে চলতে চলতে সবরকম মানুষকে দেখি। তাঁদের
কথাবার্তা, চাল-চলন সবকিছু প্রত্যক্ষ করি।
তাঁদের মান-অভিমান সবকিছু আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। লেখার এখনো অনেক অনেক কিছু
বাকি। জানি না কখন লিখব, কিভাবে লিখব। তবে লিখতে আমাকে হবেই।
আমার কাছে আমার বন্ধুদের (পাঠক) অনেক প্রত্যাশা। জীবনে কোনো কিছু নিয়েই কখনো তেমন
কোনো আক্ষেপ নেই। আমি সব-সময়ই পজিটিভ চিন্তা করি, হতাশ হয়ে
পড়ি না। আসলে আমি কারো সাথে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় যাই না। আমার যেটুকু আছে
সেটুকুই আমার। আমি কারো কাছে হাত পাতি নি কখনো। ভিক্ষা চাওয়াকে আমি খুব ঘৃণা করি
তা সাহিত্যের ক্ষেত্রেই হোক বা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই। কার লেখা কোথায়
প্রকাশিত হল সেটা আমার কাছে বড় কথা নয় কিন্তু কারো লেখা পড়ে ভাল লাগলে আমি তাঁকে
শুভেচ্ছা জানাই। আমি যেহেতু নিয়ম করে কিছু মনীষীর বই পড়ি তাতে আমার মনের রূপচর্চা
হয়, সে কারণেই হয়তো হিংসা-ক্ষোভ এসবকে জয় করতে আমি সক্ষম
হয়েছি। কারো ওপরেই আমার কোনো রাগ বা বিদ্বেষ নেই। তবে হ্যাঁ সাহিত্যের নামে যারা
ব্যবসা করেন, সময় নষ্ট করেন বা অন্যায় ভাবে নিজেকে প্রচার
করেন বা জাহির করেন, সেই মানুষের কাছ থেকে অনেকটা দূরে থাকি।
একটা সাহিত্য আসরের চাইতে একজন মানুষের জীবন কাহিনী আমাকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করে।
আমার মাঝে মাঝেই অবাক লাগে যাঁরা প্রতিদিন সাহিত্য আসরে যান, তাঁরা ঠিক কখন সাহিত্য চর্চা করেন বা পড়াশোনা করেন। এই সাহিত্য আসরে তেমন
খুব বেশি কিছু একটা পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না; আর সময়
ধরে কবিতা পাঠের আসরে গিয়ে চার মিনিটে দুটো কবিতা পাঠের চেয়ে, বাড়িতে বসে গল্পের বই পড়লে অনেক
উপকার হবে বলে মনে হয়।
ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমি এই কারণেই ভীত যে ভাল
লেখার চাইতে আজকের কবি-সাহিত্যিকরা কোন কাগজে লেখা ছাপা হলো বা কার কতোগুলো লেখা
প্রকাশিত হলো তা নিয়ে বড়োই সন্দিহান।
এছাড়া আজকের দিনে বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে তাই মনে হয় এই যে এতো এতো বই
প্রকাশ, বই-এর পাঠক পাওয়া যাবে তো?
তারপর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করার জন্যে নিজের মাতৃভাষাকে
অবহেলা করা এ যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সেক্ষেত্রে চিন্তা একটা থেকেই
যায়। তবু আমার বিশ্বাস ভাল লেখা কালজয়ী হবেই হবে। আর একটা কথা অনেক বেশি বেশি না
লিখে অল্প লেখা উচিত আর সে লেখা যেন লেখার মতো লেখা হয়। কিছু একটা লিখতে হবে বলে
বেশি না লেখাই উচিত তাতে লেখার মান খারাপ হবে। বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখার দায়
আমাদের. হাজার হাজার কবি আর হাজার হাজার লেখা। কিন্তু সত্যিকালের লেখাটি কালজয়ী
হবেই হবে।
মণিজিঞ্জির সান্যাল থাকেন শিলিগুড়িতেই। সেখানেই জন্ম।
স্কুল -কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবই এই শহরে। সাহিত্য শুধু নয় তিনি ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্য
প্রভাকর। বাংলা সাহিত্যে এম.এ। আঞ্চলিক উপন্যাসের ওপর পি. এইচ. ডি শুরু করেছিলেন
একসময়ে। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ে হয় অনার্স পড়তে পড়তে। বিয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে
থেকে শুরু করে সবকিছু। কমার্শিয়াল পত্রিকার হাত ধরেই তাঁর লেখার শুরু আর তারপর
বিভিন্ন লিটিল ম্যাগে। তিনি লেখেন কম কিন্তু যেটুকু লেখেন তা হৃদয় দিয়ে। প্রকৃতিই
তার কাছে সাহিত্য চর্চা। তাই একটা সাহিত্য আসরের চাইতে প্রকৃতির কাছে নিজেকে
সমর্পণ করে তিনি অনেক অনেক বেশি আনন্দ পান। এই মুহুর্তে ব্যস্ত তাঁর লেখা আর সংসার
নিয়েই।