বৃহস্পতিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭

শেখ সামসুল হক




শেখ সামসুল হক

সেই বলছে না

হৃদয়ে সাগর শপথ ঢেউ তুলে
যখনি যাকে বলেছি এই কুমার তীরে এসো
সেই বলেছে না

তারপর থেকে এই আমি সেই আমি নেই
সদাশয় অমানুষ হয়ে গেছি
রক্তে পশুবৎ সারেঙ্গী বেজে চলেছে একটানা
খাই খাই ভাব লেগে আছে সারাক্ষণ

ভালো আছি কি মন্দ আছি
ভেতরে শিক্ষিত বেকার যুবকের হাউকাউ
সমকালীন অন্ধকূপ হত্যাকে
বলছে সাবধান! শেষ দেখে নেবো

আর যে কিছুই বলার নেই বাকি
যখনি যাকে বলেছি লাল নদীর দেশে যাবো
সেই বলেছে না

এই ভাবে একটি যুগ পালিয়েছে
বেগমতি হারিয়েছে গঙ্গায়
গঙ্গা লুকিয়েছে পদ্মায়-আর আমি
কোথায় পালাবো, পালাবার পথ নেই কোন ?

লোক ভয়ে ভীত নই সে কথা সবার জানা
তবুও অজানা কামনার কাছে
তা না হলে এই তুমুল ডাকাডাকি
কেউ না কেউ শুনতে পেতো, শুনেনি তাইতো
বলেনি কেউ এসেছি ফিরে
অসীম পাওনা সবটা বুঝে নিতে।





শব্দের ভেতর

শব্দের ভেতর শব্দের আকাশ আলোহীন
দুর্দাম ভয়ের শহরে ছড়ায় হরতাল
হাতের কাজ ওঠে না হাতে বিষন্ন মুখ
কাছের লোকজন ছুটে পালায় কেন যে
কিছুই তার জানা যায়নি বুঝি না এসব
চেষ্টা করে দেখেছি অনেক লাভ নেই

চোখ মুখ বুকের হাহাকার রাত দিন বাড়ছে
ক্ষমা চেয়ে তবু অসহায় ভঙ্গিতে বলছে ;
শব্দের শরীরে ভয়ানক ক্ষতের কালো দাগ
বসে যাচ্ছে ঠেকানো যাবে না, বন্ধু বিদায় ...।






শেষ দেখা

একদিন দেখা হবে, জানি না কোথায় ?
তখন চোখের নদী শ্রাবণ মেঘের
থাবায় টগবগিয়ে পলকবিহীন
চেতনা ছিঁড়ে আবক্ষ যাতনা উঁচিয়ে
কুশল জানার মুখে তীব্র অভিমান
সহসা চৌচির হয়ে নাগিণীর ফণার
মতোন হারাবে বিষ; ভালোবাসা প্রার্থী
মহৎ জীবন কিছু বলার সাহস
নিকটে পাবে না খুঁজে নেশায় বেহাল
সাবেক হৃদয় তবু ছটফট বুকে ;
আকাশ পাড়ের সেই রাজসাক্ষী এনে
বরাহ নগরগামী ট্রেন ফেল করে
সমতট থেকে ধরে আনা আসামীর
মতো নীরবে দাঁড়িয়ে কিছুই বলতে
পারবে না যুগ যুগ পাপের চাকায়
মুখ থুবড়ে তোমার হাতে পরাজিত শুধু
সকাল বিকাল নেই দৃশ্য হীনরাত
তোমাকে ভুলতে পারে, এমন বাতাস
আজো এই নীলিমায় ছুটতে পারেনি
তবু পাবো কিনা বলো : শেষ দেখাটুকু।






নিখোঁজ সেই ছবি

তুমি এখনো অজানা এক অন্ধকার রাতের ছবি
দেখার সুযোগ নেই নেই; দেখতে চাই দেখার কথা
কি করে বলি হয় না বলা অবাক হই নদীর কাছে
পাখির গান, হাতের রেখা, সুখের ভাষা পালটে যায়

তাই যদি হয় পেছনের একপাতা আজে বাজে লেখা
দেখে আর কেউ এই দিকে এই পথে ফিরে আসবে না
চোখ তুলে হেরিবনাকোনদিন সাদা কাপড়ের দাগ
আজীবন শোকের কালো পতাকা হয়ে উড়বে আকাশে

নদীতে শেষ জোয়ার এসে বড় একা একা ফিরে যাবে
সে ছবি দেখতে যে কি মধুর হবে আমি তা জানিনা
বলতে পারি সে ছবি কাছে এলে একা হয়ে যাবো
আর চোখ হারিয়ে যাবে পরিচিত লোকালয় ছেড়ে
নিখোঁজ সেই ছবির কাছ থেকে আজ উড়ে গেছে পাখি
এসব দেখে পালাতে চাই, পালাবার কোন পথ নেই
ঠোঁটের তীরে ফুলের হাসি যা ছিল ঠিক তাইতো আছে
কাজল কেশে ধরেছে পাক আরতো কিছু বদলায়নি

নিশিদিন চলার মেশিন ঠিকঠাক চলছে চলবে
জানি একদিন সেও হঠাৎ বিগড়ে যাবে, যেতে হবে।




মৃত্যু এসে হাত বাড়ায়

জীবনের একলা দুপুরে ভালোবাসাহীন
মৃত্যু এসে হাত বাড়ায় হৃদয় সমুখে
এবারও বলে কয়ে তারে ফিরিয়ে দিলাম
আগামীতে এলে আর কিনা যাবে না ফেরানো
বয়সের ক্ষমাহীন দাবীর ভীরু দোহাই
মৃত্যুর কঠিন নদীতে জাগাতে পারে না
তোলপাড় কেবলি হাকায় বিশাল বেদনা

যা বলার সবইতো বলা হয়ে গেল
বাকি জীবন এখন, যখন তখন মরণকে
বরণ করার গানে গানে মুখর আজ
কি করে ঠেকাই তাকে বিগত দিনের
মোহন আশার তরুলতা কাছে আর নেই
তার কিছু কথা পেছনে এসে দাঁড়ায় তবু
ঘরের বাধনে ফুটো ছাদে মুখরা আকাশ

লেকের পাড় দিয়ে হেঁটে অবেলা বাড়ি ফেরা
শুকনো বাঁশ পাতা নড়ে চড়ে উঠলে ভয় হতো
গভীর রাত ঠেলে ভোর ছুটতো জানালার দেশে
কিছুই যাচ্ছেনা সাথে তাহলে কি হবে তারপর
ভীষণ নীরব মাটিতে মাটি খামচে পড়ে থাকা।





আমার লাশ

দিনের পর আরেক দিন কাছে এসে যায় ফিরে
যাবার বেলা কিছুই রেখে যায় না চিহ্নমাত্র
অথবা সেই মোমের আলো যেখানে অতীত ছিলো
স্মৃতির কাছে বন্দী, ভুল পৃথিবী এবং তার
সকল আশা হারানো পথ খুঁজতে চায় না আর
দিনকে দিন রাতের দিকে চলে যেতে চাই আজ
বিগত সব কাজের কথা ভুলে যেতে চাই শুধু
নগর নয় সাগর জয় করে যেতে চাই আমি
রাতকে রাত অচেনা হাতে তুলে দিতে চাই
আমার সুখ আমার ব্যথা ধরে রাখতে চাইনে
চোখের দেখাদেখির শেষ সাধ বলছে বিদায়
উপরে উঠাউঠির ভালোবাসা বুকের মানুষ
আমি তো নই, আমার লাশ নিয়ে বড়াই করিনে
তবু বলে রাখছি আশা কম সেদিকে যাবার।





অসমাপ্ত কবিতা

একটা কবিতা খসড়া করে রেখেছি সেই কবে
সময় হয় না ওটাকে ঠিক করার
কত কাজ সকাল থেকে মধ্যরাত অব্দি
করে যাচ্ছি সময় পাইনে খসড়া কবিতাটিকে নিয়ে বসার
আজ বসি কাল বসি তবু বসাটা হয় না
এমনি করেই চারটি দশক চলে গেছে
আর যাবার বাকিইবা আছে কদিন
ফিরে যাবার সময় এখন খুবই কাছে
খসড়া কবিতা খসড়া রেখেই চলে যেতে হবে
দুঃখ নেই এতে দুঃখ নেই
খসড়া তো রেখে যেতে পেরেছি।



কবি ও সাংবাদিক শেখ সামসুল হক ষাটের দশকের কবি, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা। মাতা-মৃত কুলসুম বিবি, পিতা-মৃত শেখ জয়নাল আবেদীন। জন্ম ২২ নভেম্বর, ১৯৪৯ সালে ফরিদপুরের পশ্চিম চর টেপাখোলা। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন। কাব্যগ্রন্থ-৪টি : চমৎকার সাহস-১৯৮৫, যাই ফিরে যাই-১৯৮৯, রমণীয় স্বাধীনতা-২০১৪, রূপালী জলের করাত-২০১৬। গবেষণা গ্রন্থ-১টি (ফরিদুপরের লোকসাহিত্য-১৯৮৪), যৌথ কাব্যগ্রন্থ-১টি (শব্দের আকাঙ্খায় সূর্য-১৯৭২), বিষয়ভিত্তিক কাব্য সংকলন সম্পাদনা ২০টি। একক কবির সমালোচনা গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা ৫টি। সম্মাননা- ৫টি, পুরস্কার-৩টি ও স্বর্ণপদক-১টি। সভাপতি-ছাত্র ইউনিয়ন (ফরিদপুর শহর কমিটি- মেনন গ্রুপ-১৯৬৮-৬৯), ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়ে কারাবরণ, ২০ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে কবি রফিক আজাদের কবিতার ফিচার লিখে গ্রেপতারি পরোয়ানা। আহবায়ক- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (অনুপ্রাস ইউনিট-১৯৯২), ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্বে গণগ্রেফতার। ফরিদপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠাতা ও আলাওল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তকদের অন্যতম। সম্পাদক মাসিক নীলাঞ্জ ও মাসিক অনুপ্রাস। খলিলউল্যাহ মৃধা স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বনবাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক ও অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি।