মিঠু নাথ কর্মকার
অভিনয়
গুমোট বাতাসের ক্যানভাসে
আনমনে এঁকে যেতাম ভালো লাগার পোট্রেট,
নিষিদ্ধ পথে বিষণ্ণতার ধুলো মেখে নীরবে দেখছিলে নৈসর্গিক
দৃশ্য,
তোমার অনুভূতির বুকে মাথা রেখে চলে যাই রূপকথার রাজ্যে,
আমার দুঃখবিলাসী নদী তোমার সাগর সঙ্গমে উন্মত্ত,
অসময়ের বাউল বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া প্রিয় নীল
যত্ন করে বেঁধে রেখেছিলাম সোহাগী আঁচলের খুঁটে,
সুখী কষ্টের চেনা গন্ধে সম্বিত্ ফিরতেই----
উপেক্ষার পর্দা সরিয়ে তোমার নিখুঁত অভিনয় দেখে বিস্মিত হলাম,
বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় বিশ্বাসের ভগ্ন প্রাচীর,
মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিপজ্জনক ঝুলন্ত সাঁকোটা সাবধানে পার
হয়ে দেখি
এখনও অলস দুপুরে জলকেলি করে যায় বেয়ারা স্মৃতির মরাল,
ধূসর বিকেলে ছড়িয়ে থাকা খুচরো মুহূর্তে নীরবে পাঠ করি নক্সীকাঁথা,
রাতের গহীনতায় নিঃশব্দে একান্তে মেপে যাই সম্পর্কের
পারস্পরিক দূরত্ব …………
সিনোটাফ
অসময়ের দিনলিপিতে থাকা খুচরো মুহূর্তগুলো বাঁধা ছিলো সুখের খুঁটে ,
উদাত্ত আকাশের নির্জন অরণ্যে নিশ্চিত আশ্রয়ে ডানা মেলতো
ইচ্ছেপাখি,
হিমেল বাতাসে
নিঃশব্দে ঝড়া মুক্তকণা দিয়ে নিবিড় আবেশে গেঁথে নিতাম কাব্যমালা,
সময়ের চোরাস্রোতে চড়া মেকআপ ধুয়ে গেলে ,নগ্ন ভালবাসার কদর্যতা প্রকট হয়,
অবিশ্বাসের ধর্ষণে ক্ষত বিক্ষত দেহ আগলে রাখে কাফনে
জড়ানো অভিশপ্ত মন,
স্মৃতির কবর খুঁড়ে মরীচিকা সুখ থাকে দাফনের অপেক্ষায়,
সিনোটাফে বাসী গোলাপের কাঁটা শূন্যতার নীরব সাক্ষী ||
নান্দনিক চিত্রকল্প
নির্ঘুম রাতের দেওয়ালে লিখেছিলে হৃদয়কাব্য,
খেলার ছলে গোধূলির সৈকতে গড়েছিলে স্বপ্ননীড়,
মিথ্যার প্লাবনে ভেসে গেছে তোমার নান্দনিক সৃষ্টি,
তোমার বিলাসী বাগানে রক্তাক্ত গোলাপের হাহাকার,
বুড়ো বটের পাতার ফাঁকে কলঙ্ক ঢেকে রাখে সোহাগী চাঁদ,
জ্যোৎস্নার সমুদ্রে তোমার নিঃসঙ্গ নৈসর্গিক সুখযাপন,
নিস্তব্ধতার বুক চিরে কঁকিয়ে ওঠে রাতপেঁচা তারাখসার
যন্ত্রণায়,
তোমার স্মৃতিসৌধের চোরাকুঠুরীতে
মাকড়সার জালে জড়ানো একটা
ভাঙাচোরা অবয়ব,
বিশ্বাসের গর্ভে জন্মানো চারাগাছ পাথরের নীচে বিবর্ণ ||
অপেক্ষা
কোনো এক অজানা বিপদের আশঙ্কাতেই হয়তো কেঁদে উঠেছিল ঘুমন্ত শিশুটা……
মুঠোবন্দী নরম হাতটা ছেড়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়,
একটু একটু করে মিলিয়ে যায় নোনাজলের প্রাচীরের আড়ালে
প্রতীক্ষার দরজায় দাঁড় করিয়ে সে বিদায় নেয় |
ক্লান্তির ধুলোজমা অবসন্ন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোতে থাকে
বিষণ্ণ হাওয়ায়,
পাথর কঠিন অপেক্ষার আগ্নেয়গিরিতে বিরহী যন্ত্রণার
অগ্ন্যত্পাত ……
গোধূলীর আলো মাখা সোহাগী টিপটা ছোঁ মারে অমাবস্যার রাত
মেঘভাঙা অকাল বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় রামধনু রং
দূষিত বাতাসে ভাসতে থাকে গায়ে লেপ্টে থাকা খুব চেনা সেই
আলসে গন্ধটা
আলাপী দুঃখগুলো নিঃস্বার্থভাবে জড়িয়ে রাখে বিবর্ণ শরীরটাকে
সময়ের আগাছায় ভরা থাকে করতলের মতো বিছানো স্মৃতির আলপথ
শিশুটির কপালে জ্বলজ্বল করে একটা কালো জড়ুল ||
ডেথ সার্টিফিকেট
--- কেমন আছো ? চিনতে পারছো আমাকে?
--- কই না তো ! কে তুমি?
---- ভালো করে তাকিয়ে দেখো
একবার আমার দিকে|
--- এতো অন্ধকারে কিছু দেখা যায় নাকি ?
--- এতদিন তো নির্ঘুম রাতের আয়নায় আমার জলছবি আঁকতে , রামধনু রঙে সাজাতে মনের মতো করে , পরিপাটি করে হৃদয়ের চাদর বিছিয়ে অপেক্ষা করতে আমার জন্য…
--- স্পষ্ট করে বলো কে তুমি?
---- এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে ! অন্তরের শেষ নির্যাসটুকু দিয়ে
সারাক্ষণ যাকে আগলে রাখতে , আমি তো
তোমার সেই ভালবাসা |
--- না না না
---- একবার আমার চোখে চোখ রাখো আগের মতো …… মনে পড়ে ……দুজোড়া
দৃষ্টি একাত্ম হয়ে জন্ম নিত এক নতুন সকাল সযত্নে লালন করতে সোমত্ত দুপুর গোধূলির
রং মেখে রাতের শতায়ু কামনা করতে ……
--- আর কখনও তা হতে পারে না |
--- কেন ? কেন হতে পারে না ?
--- আমি নিজের হাতে আমার ভালবাসাকে অবিশ্বাসী ছুরির নৃশংস আঘাতে
কেটে টুকরো টুকরো করেছি | ঘুণ
ধরা বিশ্বাসের সাজানো চিতায় অভিমানী আতর মাখিয়ে টুকরোগুলো ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে
দিয়েছি | সময়ের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি
তোমার অর্ধদগ্ধ নাভিকুন্ড | রক্তগঙ্গার
আতপস্নানে শুদ্ধ আমি, পাথুরে
শোক দিয়ে বিনির্মাণ করেছি নিশ্ছিদ্র মৃত্যুপুরী |
--- বেশ তবে আমার ডেথ সার্টিফিকেটটা দেখাও |
--- ওরা তো সেটা আমাকে দেয়নি |
--- কেন?
--- ওরা তোমার সচিত্র পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছিল |
---- তুমি দেখাও নি ?
---- না |
---- দেখাও নি কেন ?
---- তুমি তো আমার অনুভূতির শিরায় শিরায় রক্তজালিকার মতো ছড়িয়ে
ছিলে ,
শরতের মেঘের মতো আমার অন্তরাকাশে ইচ্ছে মতো
ভেসে বেড়াতে কখনও বা বর্ষার জলদগর্ভ মেঘ হয়ে ধরা দিতে , একসাথে প্রথম বৃষ্টি ভেজার আনন্দ গলে গলে পড়তো তোমার চিবুক
বেয়ে আমি আঁজলা ভরে জমিয়ে রেখেছিলাম চোখের কোলে | সবার সামনে আমি তোমাকে বেআব্রু করতে
পারিনি ……