ব্রততী
সান্যাল
অবিন্যস্ত
বোধ ছুঁয়ে
--------------------------
মুহূর্তযাপনের প্রাত্যহিকতা ছাপিয়ে
ফেলে আসা ঋণের আবয়ব ফুটে ওঠে,
হলদেটে অভিমানের পরিসর পেরিয়ে
জন্ম নেয় অনভ্যস্ত ভোরের পাখি..
ভেঙে যাওয়া হাত-আয়নার কোলাজ
গোলাপী বিকেলের ফিসফাস গল্প বলে,
প্রত্যাশার লোহিত সাগরে ঢেউ ভাঙে—
সবুজাভ প্রান্তর ছুঁয়ে হেঁটে চলে দুপুর..
ব্যস্ততাময় শহরতলীর ভাঁজে
নিভৃতে ডানা মেলে সোহাগী শীত,
হিল্লোলিত ছায়াবট উষ্ণায়ন হাতড়ায়,
পাতায় লেগে আছে কুয়াশা-আদর..
যাবতীয় স্মৃতির অভিধান ঘিরে
প্রশ্বাস ফেলে অসংলগ্ন শব্দমালা,
জলরঙা গোধূলি ক্যানভাস মেলে ধরে—
অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্যকল্প কবিতা হয়ে ওঠে..
শিলালিপি
---------------
অনিয়মিত হাওয়ার আনাগোনায় ‘যাপন’ লেখা থাকে,
ধুলোর দীর্ঘশ্বাসে ক্যানভাস পাল্টায়
বড়রাস্তার মোড়ে রোজ..
ঝাউবনের মাটিতে ছায়া সরে যায়,
দীঘির অতলে মেশে নিঃশেষিত কাঠামো রোদ্দুর ছোঁয়া বিকেলে..
অযুত তারা’র খনিগর্ভে ‘মহাশূন্য’ লেখা থাকে,
এঁকে রাখি বিষাদের এপিটাফ
চাঁদের সীমান্ত ঘিরে সন্ধ্যায়—
প্রাসঙ্গিক ঋণ ঠেলে সাযুজ্য খোঁজে দিনান্ত,
অস্তরেখায় নিহিত আছে আগামীর দৃশ্যকল্প..
বিবর্তনসুখ
----------------
ব্যস্ততার আবর্তনে মিলিয়েছে প্রেমিক,
অভ্যাসখামে বন্দী
পূর্বরাগস্মৃতি...
মুগ্ধতাবেষ্টিত উপত্যকায় গতানুগতিকতার মৃদু বর্ষণ শ্রুত
হয়...
টেলিফোন ও ইলেকট্রিক বিলের সংকেতযুক্ত আপাতত দাম্পত্যের
পৃষ্ঠা—
ভিক্টোরিয়া ও গঙ্গাতীরের উষ্ণ কোলাজের ফ্রেমে ক্রমান্বয়ে
আস্তরণ জমায়
সময়স্রোতের
মৃদু স্পন্দন—
মুহূর্তের ভগ্নাংশে আচমকা মনে হয়,
পাতা-ঝরা
হেমন্তেরও ত্রুটি আছে বোধহয়,
উন্মুক্ত
বালিয়াড়িরও আছে অন্তিম নির্ধারিত সীমা...
সম্পর্কের অ্যানালিসিসে তবু ঘোষিত হয়—
দাম্পত্যের ভাঁজে আবৃত নির্ভরতা আঁকে ঐক্যসুখবৃত্ত,
নিপুণা গৃহিনীর তকমাযুক্ত নীলাম্বরী প্রিয়তমা
গোধূলিরাগের তান ভাঁজে আজও...
আলিঙ্গনাবদ্ধ জীবনদুটির ক্যানভাসে
প্রত্যহ আবিররঙ ছড়ায় নিশিসমাপনের সূর্যোদয়....
বয়ঃসন্ধির
উপান্তে
-------------------------
স্কুলবাড়ির শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাসার্ধের স্মৃতিচারণ
প্রিয় হয়ে উঠছে আজকাল,
আপাত চেনা শহরের অলিগলিতে
শৈশবের গন্ধ খুঁজে বেড়াই— নিস্তব্ধ মনখারাপের
উপকূল ঘেঁষে প্রতিদিন..
দুপুর রোদের আঙিনায় পূর্ণতাপ্রাপ্ত খেলার মাঠ,
অবিন্যস্ত আঁকিবুকির সাক্ষী ক্লাসের বেঞ্চি ও
ফিসফাস গল্পে প্রাণবন্ত সেই করিডোর,
মুহূর্তের অকপট মহিমায় পর হয়েছে বহুদিন..
তিতিবিরক্ত ভোরের ওজনদার স্কুলব্যাগ
হাল্কা হয়েছে এখন— চিন্তনের জটিলতাই বেড়েছে কেবল,
অঙ্কের খাতাগুলি কবেই হারিয়ে গেছে
ভুলে গেছি জ্যামিতিক বহুভূজের সংজ্ঞা,
প্রাত্যহিক যাপনের অপ্রিয় হিসেবখাতা
আগলানোর ভানেই অভ্যস্ত হয়েছি ইদানিং..
সীমান্তহীন উদ্দামতার আঙ্গিকে
সেজে ওঠা সদ্য যৌবন, এবং
হৃদয়ভঙ্গের স্রোতে ভেসে থাকা অবচেতনার বালিয়াড়ি,
ড্রয়িং বুকের নিষ্পাপ রঙে উদ্ভাসিত
বেখেয়াল শৈশবের খবর রাখে না নিয়মিত..
তবু অনায়াসে ভুলতে পারি নি আজও
স্নেহময় শিক্ষার সযত্ন বিন্যাস ও চেনা অবয়ব,
নৈমিত্তিক দৃশ্যপটের অন্তরালে আজো শুনি
আলোকিত দিনের সমস্বর সেই প্রার্থনাসঙ্গীত---
অঘোষিত বিষণ্নতার ফাঁকে স্বমহিমায় জীবিত ছন্দময় অতীত..
নেশাতুর
-----------
কিছু মুহূর্তের ঠোঁটে নেশা লেগে থাকে,
প্রাত্যহিকতা এসে থেমে যায় হঠাৎ, অকস্মাৎ..
ডুবো পাথরে ধাক্কা খেয়ে জাহাজ যেমন
জলসিঁড়ি বেয়ে অতলে বাসা বাঁধে,
তোমায় ছুঁয়ে দেখা বোধগুলো
অচ্ছুৎ হয় ফ্রেমবন্দী মুহূর্তগুলোয়,
অবচেতনার দীঘিতে স্বেচ্ছায় ডুব দেয়—
ওপারে ভেসে ওঠে কিনা দেখা হয় নি আজও..
প্রত্যাশার দূরবীণটা ক্ষয়ে যায় রোজ,
ধূ ধূ বালুচরে ছুঁড়েই দেব একদিন—
অভিমানী সরিসৃপ হয়ে জন্মাবে যুগান্তরে,
জঙ্গল ভেঙে খোদাই করবে তোমার নাম..
আবেগ ভুলে জোৎস্নায় হেঁটে যাব আমি,
ডালপালা বিস্তৃত পরিসরে
পরিচয় হাতড়াবো— সম্ভ্রমের গুঁড়ো মাখবো দেহ জুড়ে..
ঘোর লাগা মুহূর্তগুলো এভাবেই
প্রাত্যহিকতা ছাপিয়ে গল্প লিখে যায়—
তুমি-আমি শোনার আশায় বসে থাকি,
সেই অবকাশ ফুঁড়ে গুপ্ত কিছু বিষাদ
ডানা মেলতে চায় নিজস্ব নিয়মে মেনে,
ছাঁটতে গেলেই দমকা হওয়া হয়ে ভাসে..
আমি পথ ভুলে ব্যর্থ ফিরে আসি,
প্রতিদিন প্রতিবার, অবিরাম..
© ব্রততী সান্যাল