সৌরভ মজুমদার
প্রত্যয়ী
চলে যাব একদিন নিশ্চয় ।
তবুও যাওয়ার আগে
দেখে যেতে চাই -
প্রজন্ম প'রে রেখে যেতে পেরেছি এক
নির্ভীক আস্থা আর অটুট বাঁধন
সাময়িক অবুঝ দেয়ালের ওপারে
এক বিবাদহীন দৃঢ় প্রত্যয় ।
বিষণ্ণতা
সচেতন ভাবে ঢালী নি কখনো, বিষণ্ণতা -
অবচেতনে সে আপনিই মিশে যায়
আমার যত লেখায়, কথায় আর কবিতায় ।
ভেবে দেখো, ছবিলেখাকার অবন ঠাকুর
অনেক যত্নে ঢেলেছিলেন বিষণ্ণতা সমস্ত,
"শাজাহান এর মৃত্যু" র ভিতর । যেখানে
মৃত্যুশোক সন্তানের, পাক দিয়ে ওঠা
ব্যাথার ক্রন্দন, মূর্ত হয় শিল্পাচার্যের হাতে ।
বাঙ্ময় তুলিতে যার ছবি লেখা হয় -
ভারতসম্রাট এর অনিমেষ চোখের তারায় ।
যে নিয়েছে দায়ভার অমোঘ সৃষ্টির -
সচেতন বিষণ্ণতা, ভেবে দেখো, তাহারই তূণীর ।।
একটু আলো
একটু আলোর জন্য,
কতদূর যাব, যেতে হয় !
অতলান্ত নালিখাত আর
পার হয়ে এক বুক অন্ধকার,
এবার একবার থামি নাহয় !
জলস্তর ভেদ ক'রে,
উঠে এসে জলেরই পাড়ে,
আর এক নতুন পথের খোঁজ -
কয়েকশ নতুন ক্রোশ, হেঁটে যেতে হবে ।
ফেলে রেখে মাইলফলক
শতাধীক, সোনালী অতীত,
আবার নতুন উদ্দ্যমে শাঁস নেওয়া,
এক বুক ভ'রে ।
অবিচল চলার ফাঁকে, জলছবি
আঁকা হয় সময়ের কাচে,
আর কিছু বিষয়প্রলাপ,
পিছু টেনে ধরে, গতিরোধ হয় ।
প্রতিরোধ ভেঙ্গে আসা অনন্ত যাত্রায়,
যতিবোধ হয় কি বিষয়তৃষ্ণায় !
অন্তহীন চলার শেষে, আলো -
অবশেষে সুজনের সাথে দেখা হয়
এবার, একেবারেই থামি না’হয় ।
এটা কোন জায়গা ?
এটা কোন জায়গা ?
এটা সেই জায়গা…
যেখানে বহুবার যাওয়ার পরও, প্রতিবার যে নতুন আলিঙ্গনে
ধরা দেয় । নিরালা সৈকত যেখানে নিত্যনতুন পসরা সাজিয়ে
আরও কিছু নতুনের অপেক্ষায় থাকে । যেখানে সারি সারি
ঝাউ গাছের ফাঁকে, ছোটনদী নিজেকে নিঃস্ব করে
উপসাগরের বুকে ।
এটা সেই জায়গা…
যেখানে নীল আকাশ আর নীল জল আর নীল ব্যাথা আর দিকভোলা বাতাস
দল বেঁধে দরবারীর সুরে তান তোলে আর লেখা হয় ইতিহাস । যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝিনুক
আর যত সন্ন্যাসী কাঁকড়া আর যত সি-এনিমন আর গুটিকয় ব্রাত্যজন অজস্র বালি
আর অগুন্তি কাঁকর সরিয়ে সরিয়ে হেঁটে চলে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে ।
এটা সেই জায়গা…
যেখানে অনন্ত সময় জড়িয়ে টুকরো টুকরো কত জলকাব্য তৈরি হয় অনাবিল
আর ভেঙে যায় বারবার আর তাদের গড়া-ভাঙার ছন্দে সামিল যত গাংচিল আর
দু-একজন মানুষ আত্মজর সাথে পায়ে-পা মিলিয়ে হেঁটে যায় শৈশবে, আর বোনে
মিহিকথার জাল জেলেদের সাথে মিশে, কালো আলকাতরায় চুবিয়ে শাদা নাইলনে ।
এটা সেই জায়গা…
যেখানে দিনান্তে কৌণিক আলোয় ফিরে পাওয়া সূর্যমুখী ক্যানভাসের রঙ্গিন অবয়বে
জেগে ওঠেন ভ্যান গঘ আর কাদামাখা দস্যি ছেলের ছবিতে আরও কোন নতুন সেশাদ্রি ।
যেখানে অনায়াস কন্ত্রাজুর আর নির্ণয়ী মুহূর্তে মিলে যায় কারতিয়র ব্রেস আর এই
হরিপদ
আর রাতজাগা মানুষের কলরবে ঘুমচোখে জেগে ওঠা মাছের বাজার, সকালের জনপদ ।
এ’টুকুর পর যদি ভেবে নাও
কোনএক বেলাভূমির গল্প বলছি তোমায়, তবে তুমি অংশত ঠিক ।
এ আমার মন । তোমারও হতে পারে, যদি তুমি চাও । আমি তার
কথাই বলছিলাম এতক্ষণ ।।
শিরোনামহীন ১১১
এখন ---
আমার কোনো বাগান নেই, শুধু আছে একটা করমচা আর
দুটো আমলকী গাছ, অশোকের রাজপাটে ।
আমার কোনো নদী নেই, শুধু আছে দুটো স্টীমার, একটা নৈহাটি আর একটা চুচূড়ার ঘাটে ।
আমার কোনো রাস্তা নেই, শুধু আছে একটা ঘড়ির মোড় আর
একটা পাঁচমাথা, দুটো দুই শহরে ।
আমার কোনো বাড়ী নেই, শুধু আছে একটা ঘর আর একটা
বারান্দা, এই নিঃশব্দপুর জুড়ে ।
যখন ---
আমার কোনো মাঠ ছিলনা, ছিল কিছু দূর্বা, কিছু ঘাস ।
আমার কোনো পাহাড় ছিলনা, বুগিয়াল কিছু ছিল, আর কিছু পাস ।
আমার ছিলনা কোনো ঠাঁই, ছিল কিছু ঠিকানা, আর একটা আকাশ ছিল, তাতে সাতরঙ থাকতনা ।
তখন ---
আমার একটা শৈশব ছিল আর একটা বাগান । একটা নদী আমার ছিল আর একটা দালান ।
আমার একটা রাস্তা ছিল আর একটা মাঠ । আমার একটা সাগর ছিল, কিছু দড়ি আর কিছু শুকনো কাঠ । আমার একটা পাহাড়
ছিল আর একটা বিরাট মন, তা দিয়েই বানিয়েছিলাম আমার
নৌকা, ময়ূরপঙ্খি যেমন ।।