গৌতম দত্ত
হ য ব র ল – (১)
এখনো
তোমার ওড়না আঁচলে স্পর্শ মাখা সুখে
আমার
রক্তে ঝর্ণা ঝরায় গোপন সে স্রোতমুখে।
কতবার
; কতবার সে স্পর্শিত শিহরন ! কতবার সে চমক দিয়ে ওঠা ! সরস্বতীর জল যেন। কোথা দিয়ে যে বহে যায়। মাঝে
মাঝে মনের বালিয়াড়িতে দপ করে জ্বলে ওঠা গোপন নদীর জল। ফিনকি দিয়ে চোখে ভাসা। আবার
রোদের ছায়ায় নতুন সে ধারাপাত।
সেদিন
বিকেল নেমেছিল ছুঁয়ে কপালেতে পড়া চুলে
একপাশ
থেকে অপলক আমি আর সব কিছু ভুলে।
যদিও
হেমন্ত বাতাস ওড়াউড়ি করছিল সারা দৃশ্যমানতায়, বসন্ত আসতে অনেক দেরী তবুও সেই খস্খসানি
হাওয়ায় তোমার অন্যগালে পুরো সোনা রোদ। সে আমার অনুভবের ডাকাতি আয়না। উদাসীন। অপলক।
লজ্জাভয় মাখা এক কোমল মুখ। বিকেল চলে গেলে সন্ধ্যের শিশিরের অপেক্ষায়। নির্নিমেষ। অগোচর।
তখন
কি আমি তোমার মনের দরজা দিয়েছি খুলে ?
জানলার
পাশে বকুলের ছায়া খেলছিল দুলে দুলে।
পশ্চিমদিগন্তে
কনে দেখা আলো। পুবাকাশে নামবে আঁধার। অদ্ভুত এক মায়াবী দোলাচল। আমার
ময়ূরমহলে। ফল্গুর ধারা মেশা মৃদু ব্যথা।
তুমি তো পাওনি কখনো ! এ যেন 'এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে' মার্কা অযাচিত কল্পনা। আমার চিদাকাশে।
শয়নে, স্বপনে, জাগরণে 'যে ছিল আমার স্বপনচারিণী', তার কাছে শুধুই জমার হিসেব। মনে মনেই
গেয়ে গেলাম জীবনভোর, 'আমার লতার একটি মুকুল / ভুলিয়া তুলিয়া রেখো--
তোমার / অলকবন্ধনে।'
জীবনের
মাঝখানে কেন এ কে জানে মুকুলিত পাতা
চেয়েছিনু
মনে মনে কিছুটা সঙ্গোপনে, হল
না গাঁথা।
ভেবেছিলে
একবার অগোছালো সংসার হয়তো কখনো-
তাই
নিয়ে বেঁচে থাকা স্বপ্নের চিতা মাখা বাগান সাজানো।
এই
করেই চলে গেল তো নষ্ট জীবন। লীলা আসন্নপ্রায়। সন্ধ্যাসূর্য নামবে ক্রমশ:। ঢালু পথ
গড়িয়ে নামে দক্ষিনাকাশে। এইখান থেকেই কি শুরু হবে মহাপ্রস্থানের সূচনাপর্ব অথবা
অনিশ্চিত উৎরাই ! জানিনা। জানতেও চাই না।
তোমার সেই স্পর্শের অনুভবেই কাটিয়ে দেয়া যাবে বাকি নি:শ্বাস। এমনি করেই তো রঙিন
লুকোচুরি। জলের বুদ্বুদ মাখা। গহন জলের থেকে জীবনের আকুতিতে ভেসে ওঠা মাছের অনর্থক
নামাওঠা।
“ প্রেম এসেছিল, চলে গেল সে যে খুলি দ্বার-- / আর কভু
আসিবে না। / বাকি আছে শুধু আরেক অতিথি আসিবার, / তারি সাথে শেষ চেনা।............ ” “আকাঙ্খায় দিন গোনা। নতুন বরনডালা নিয়ে— “আরো প্রেমে আরো প্রেমে / মোর আমি ডুবে যাক নেমে”। নত নয়নে স্তব্ধ প্রহর। নিশ্চই আসবে
তুমি। হোক না সে অন্য রূপে। বাসবদত্তার মত করে। প্রাণের লহরী তুলে স্তিমিত ছন্দে।
গাঁথব
না হয় নতুন করে সন্ধ্যাবেলায় যুথীর মালা—
আপনি
এসে পরবে নিজে পিছন থেকে যাবার বেলা।
২৩শে অক্টোবর, ২০১৬
ডোরান্ডা, রাঁচি।
হ য ব র ল – (২)
ফাঁকা
ক্ষেত ভরে থাকে তোমার ছায়ায়
নীল
শাড়ি কস্তা পাড়ে চোখে পড়ে আলো
বিকেলের
গন্ধ ওড়া নদীটির পারে
তোমার
অলীক ছোঁয়া আমায় জড়ালো !
সন্ধ্যার
মেঘমালা হেমন্ত হাওয়ায়। সাঁওতাল পরগণার পাথুরে মাটিতে তোমার আমন্ত্রণ আমার বকুল
ঝরা মনে। দিগন্ত বিস্তৃত শাল-সেগুনের অরণ্য চিরে যে পীচের পথগুলি যে তোমার
অপেক্ষায় ! যদি একবার পথ ভুলে— কোনো
এক কালো পীচঢালা রাস্তাকে গোধূলির সূর্য ডোবার রঙে রঙিন করে দিয়ে – নীল শাড়ির কস্তা পাড় আঁচল উড়িয়ে এই
যাবার বেলায়, সম্রাজ্ঞীর মত মাথা উঁচু করে তুমি এসে
পড়, আমার সেই জেগে থাকা প্রেমে আভূমি নত
হয় বরণ করে নেব। কথা দিলাম।
অস্ত-পারের
আলো ছড়িয়ে পড়বে শাল-সেগুনের পাতার ছায়ায় ছায়ায়। তোমার সুবাসে থেমে যাবে সব কিছু।
আঘ্রাণে হেমন্ত মায়া ! ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান, / কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে’। সে যায় যাক্। তুমি এলে আমার বোধোদয়।
আমার বেঁচে থাকা। আমার আগামী জীবন।
আসছ
তুমি হঠাৎ দেখি শাল মহুয়ার পাতার ভীড়ে,
দূর
হতে পাই গন্ধ তোমার পুরোনো সেই স্মৃতি চিরে—।
হারানো
মনে এখনো, তোমার কি উজ্জ্বল উপস্থিতি ! মনের
কোনে কোনে কালবোশেখের ঈশানী বিদ্যুৎচমক। উদ্দাম ঝড় হৃদস্পন্দনের ওঠা-পড়ায় ! শুধু
তোমারি নামে উত্তেজনার প্রাথর্না সঙ্গীত সারা দেহে। ‘অঙ্গে অঙ্গে প্রাণ তব / কত গানে কত
নাচে / রচিয়াছে / আপনার ছন্দ নব নব / বিশ্বতালে রেখে তাল; / সে যে আজ হল কত কাল।’
তুমি
এলে, অনেকদিনের পরে যেমন বৃষ্টি আসে
তেমনি
তোমার নামটা এলেই,
আমার
মনে শিউলি ভাসে।
ব্যাখ্যা
আছে কি কোনো ? সে তুমিই ভাল জান। আমার উচাটন মন কাকে যেন খুঁজেই চলেছে সারাদিন— , যতক্ষন জেগে থাকে। সেই রক্তের অবিরাম
প্রবাহ যেন ! ছন্দ বা লয়ের পরিবর্তন হয়ত আছে। কিন্তু অপরিবর্তনীয় তার ছুটে চলা— শেষ নিঃশ্বাস ফেলা অব্দি ! তারপর আর
কোনো গ্রহণ নেই শরীরের। আছে শুধু
অতীন্দ্রিয় অনুভব।
তুমি
যদি পাশ ফেরো অনুভবে যেন আমিও সতত,
তোমার
সে ছায়া ঘিরে যাপিত জীবন এখনো আয়ত।
তোমার
সে লীলাময়ী করপুটে শিহরিত আমার মুখমণ্ডল। কুন্তলরাশির অস্ফুট স্পর্শে ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশী।’ চরাচর স্থির। শুধু তোমারই সে আহ্বান— স্পর্শে। অকাতর স্নিগ্ধ সন্ধ্যার
দোলাচলে রাত্রি আগতপ্রায়। মনে হয় কুরুক্ষত্রের সন্ধ্যার শাঁখ ঘোষনা করবে আজকের
যুদ্ধবিরতি। কর্ণ প্রস্তুত হচ্ছে জাহ্নবীতীরে সন্ধ্যাসবিতার বন্দনায়। মাতা কুন্তী
সলাজে ধীর পায়ে পৌঁছলেন যেমন করে কর্ণ সমীপে, তেমনি করেই না হয় আমি বন্দনা করি
তোমায়। আমার সমীপে এই সুবর্ণরেখার পশ্চিম তীরে তুমি রয়েছ আমার খুব কাছাকাছি, প্রায় শরীরে শরীর ঘেঁষে। কলাপিত
মূর্ছনায়।
কিশোরী
বেলায় তোমার বেণীটি পিঠের ‘পরে
খেলত দুলে
আমি
তখন চন্দ্রাহত নব্য কিশোর পড়াশোনা শিকেয় তুলে।
কতদিন
উৎরে গেল ! চলার ছন্দ কতই না পরিবর্তিত হ’ল। তবু কেন ! তবু কেন এখনো চোখের কোনে
চিক্চিক্ করে জল। এমনই বাঁধন এ ! মাধবীলতা যেমন দড়ি বেয়ে ওঠে আকাশের দিকে। লতানে
বাঁধন। দুজনের। তবেই তো পূর্ণ হয় প্রেম। তবেই তো গন্ধ ছড়ায় কামিনী, হাস্নুহানা। মান অভিমানের কত খেয়াতরী
শান্ত হয়ে ফিরে আসে পারে। সন্ধ্যা নামে সাঁওতাল পরগনার পশ্চিম দিগন্তপারে।
অবাক
রাতের তারারা এবারে মিটিমিটি করে জ্বলবে
তোমার
স্পর্শ আমার ভেতরে গুনগুন গেয়ে চলবে।
রাত
সারারাত চাঁদ দেবে আলো, আঁধার
বিশ্বময়,
তোমার
ছটায় ভরে উঠবেই রোমকূপে বিস্ময়।
২৪শে অক্টোবর, ২০১৬।
ডোরান্ডা, রাঁচি।
হ য ব র ল – (৩)
খুব
প্রেম পায় এই অবেলায় মনের ভেতরে।
ঋজু
শাল গাছ ঝুঁকে চায় প্রেম অবাক করেই।
কেন
এমন হচ্ছে বলো দেখি ? এমনতো হওয়ার কথা ছিল না ! সেতো কতকাল হয়ে গেল। তুমি ফেলে গেলে আমায় নতুন
চিকন পাতা খুঁজে। ভুলেও তো গেছিলাম আমি। ‘সেদিনের চুম্বনের 'পরে / কত নববসন্তের মাধবীমঞ্জরী থরে
থরে / শুকায়ে পড়িয়া গেছে ;’। স্মৃতি ফিরলেই যন্ত্রণার দায়ভাগ। তার চেয়ে এই বেশ। কিন্তু মন তো মানে
না। বেলা অবেলায় এবং এই পড়ন্ত বেলায় রেখে যাই কিছু কথা। ‘হঠাৎ দেখা’র মত যদি তোমার চোখের আলোয় ছায়া ফেলে
এই নির্জন মগ্নতা। এই বর্ণসমষ্টিগুলোর ফুটে ওঠা পাপড়িতে যদি একবার তাকাও কখনো। তখন
মনে কোরো, এই দিনান্তবেলায়ও আমি, ‘তবু জানি, একদিন তুমি দেখা দিয়েছিলে বলে / গানের
ফসল মোর এ জীবনে উঠেছিল ফলে, / আজও নাই শেষ ;...’
পড়ে
থাকা কার্তিকের খড়-ভরা মাঠে, যেমন
গিয়েছে চলে ধানশীষ সব
আমার
জীবন থেকে কবে যেন চলে গেছ দূরে— মুছে
দিয়ে সব উৎসব।
তবুও
জীবন চলেছেই। সময়ের হাত ধরে। কালের চাকায় সবকিছু মিটে যায় বটে ! তবে কেন আজ এই মায়াবী স্মরণ। মনে হয়, এই তো সেদিন যেদিন তুমি জড়ালে জীবন
তোমার নতুন জগতের চৌহদ্দিতে তখন তো আমি সাঁওতাল পরগণায়। শক্তি চাটুজ্জের কবিতার
কলম ধরে, মহুয়ায় নেশায় জ্বালা জুড়োব বলে এই
শাল-সেগুনের দেশে ‘মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে
ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয় / জন্মেই হাঁটতে হয় / হাঁটতে-হাঁটতে
হাঁটতে-হাঁটতে / একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি...।’ তবুও কি যায় পৌঁছনো যে পথ থেকে তুমি
চলে গেছ অনেক দূরে—আকাশ যেখানে লুকিয়েই গেছে আমার চোখের
সামনে থেকে ? এক জন্মের কাজ না কি তা ? ‘দুটো জন্মই লাগে / মনে মনে দুটো জন্মই
লাগে’।
কবেই
তো ফিরে গেছি নিজের খেয়ালে চাকরীর টানে—
প্রেম
তবে শখ ছিল নাকি ? তবে কার ? কেউ-ই কি জানে ?
সেই
ছোটোনাগপুর ! সেই সাঁওতাল পরগণা ! আর তাই
কি মনের গহনে সেই পুরোনো সেলুলয়েডের রিল !
কে জানে। নিশ্চই কেউ জানে। কে সে ? সে কি এই শাল-মহুয়ার হাওয়া। দূরে দূরে অবিশ্রান্ত টিলা আর খোলা মাঠে
মঙ্গলবারের হাট ! প্রকৃতির সান্নিধ্যতায় ফেলে আসা দিনের প্রজাপতির রঙিন পাখনার
ওড়াউড়ি। বয়ে চলা সুবর্ণরেখা’র
হাঁটু জলে তোমায় পায়ের ওঠানামা। কি স্বর্গীয় সেই অনুভব। কি অপরূপ দৃশ্যকল্প !
এখনো
তো মনে হয় তুমি আছ, আছো তুমি সারাক্ষণ ধরে
মহুয়ার
নেশা চাই, মাথায় তোমার ছবি কেন এত ঘোরে !
পেছন
থেকে তোমার সে কস্তা পাড় নীল শাড়ি ওড়া দেখি। তুমি হাঁটছো। আমি অল্প পেছনে। চারদিকে
খুশীর হেমন্ত বাতাস। শির্শিরানি। রাস্তা নেমে গেছে বাঁধের জমা জলের দিকে। জলে চিকচিকে
ঢেউ-এর খেলা। তুমি হেঁটেই যাচ্ছ। যেভাবে হয়ত হেঁটেই চলে গিয়েছিলে আমার স্মৃতির
দরজা পেরিয়ে খিড়কি’র অন্বেষনে। তবে কেন ফেরা ? আমার দমবন্ধ বুকের অতলে। আমার চোখের প্রতিফলনে। আমার মুগ্ধতায়। আমার
সর্বাঙ্গ জুড়ে ফিনিক্স পাখির মত।
পেরেছ
কি ভুলে যেতে কত স্মৃতি কত সাজ
আমি
তো ভুলিনি কিছু, গালে টোল, চোখে লাজ
ঠোঁট-দুটো
থরথর কথা শেষ হলে পরে
তারপর
বারবার আমি ফিরে গেছি ঘরে।
২৫শে অক্টোবর, ২০১৬।
ডোরান্ডা, রাঁচি।
হ য ব র ল – (৪)
তখন
তোমার কিশোরী বেলা, মনেতে নতুন সুর
সারাদিন
ধরে ডাকে বাঁশুরিয়া স্বপ্নেতে বহুদূর-
উচাটন
মন যখন তখন, কাছে পেতে শুধু চায়,
হলদে
পাখীটি ডানা মেলে ওড়ে নীল আকাশের গায়।
ছেঁড়া
ছেঁড়া মেঘে পাখী উড়ে চলে দূর থেকে আরো দূরে-
তার
সাথে চলে তোমার স্বপ্ন সোনাঝরা রোদ্দুরে।
মন
বলে হায়, কবে পাব তারে, কোন সে অচিন দেশে
যদি
কাছে এসে হাতটা বাড়ায় একফোঁটা ভালবেসে।
মন খালি
বলে হাতটা বাড়াতে সব কিছু দ্বিধা ফেলে
অজানা
ভয়েতে থাকো জড়সড় কোনো কিছু না বলে।
সেই
কবেকার কথা। তবুও তো মনে এসে গেল। এই বোধহয় প্রকৃতি’র দান। শহরের ব্যস্ততায় সুপ্ত যা, এখানে, এই সাঁওতাল পরগনার হৈমন্তী হাওয়ায়
বিদ্যুৎচমকের মতো মনে মনে ধাবমান। কেন এমন হল ? যাত্রাপথের শেষ বেলায় এ কি অনুরণন !
শব্দেরা
আজ বহুদূরগামী
অভিলাষে
ফাঁকা ঘর
কাঙ্খিত
রূপ পথ খুঁজে ফেরে
বিরহিত
প্রান্তর।
কেন ? কেন ?
কেন ?
উত্তর
অজানা। শুধু বয়ে চলা সবকিছু। এই জীবনের পাতায় পাতায় যতকিছু রোদ—বৃষ্টি—ঝড় সব যেন মমি হয়ে ছিল মনের মিশরে। এই
কদিন ধরে ছোটনাগপুরের দৃশ্যকল্প আমায় ফেরৎ দিচ্ছে পুরোনো হাহাকার। মনের প্রহরে
প্রহরে উঠে আসছে সামুদ্রিক লাল কাঁকড়া। আনন্দের। যন্ত্রণার। বিষাদের। এমনই কি হয়
প্রেমে ! না কি এটা ব্যতিক্রমি এক উপাচার।
এ শুধু আমারই বোঝা। তুমি তো নৌকো ভরে তোমার বোঝা নিয়ে কোথায় যে চলে গেলে ! হতভাগ্য প্রেমিক আমি একাকীই বয়ে বেড়াচ্ছি আমার
সোনার ধান।
উদাসী
বাতাস খুঁজে পেতে চায় সামান্য ভিজে হাওয়া
মরুভুমি
আজ মেলেছে পাখনা শুকিয়ে গিয়েছে মায়া।
মন্দিরে
বাজছিল ঘন্টাধ্বনি। দামোদরের বুকে উপছে পড়েছে ভৈরবী’র জল। সাদা ফেনায় ফেনায় ঝর্ণার উচ্ছলতা
সর্বক্ষণ। মন্দির সোপান নেমে গেছে দামোদরের বুকে। ছবি এল মনে। এবারে তোমার লাল পাড়
কস্তা শাড়ি। হাতে পুজো উপাচার। জল স্পর্শ করে সোপান বেয়ে উঠছ মন্দির প্রান্তে। ‘পিছন হইতে দেখিনু কোমল গ্রীবা / লোভন
হয়েছে রেশম চিকন চুলে।’ কোমর
ছাপানো কালো চুল মাঝে মাঝে হাওয়ায় উড়ছে। আলতা মাখা পা’য়ে রুপোর সরু নুপূর। কোমল অথচ গভীর
ছন্দে তুমি টপকে যাচ্ছ একটার পর একটা সিঁড়ি। আমার দৃষ্টি স্থিত। অচেতন।
বাহ্যজ্ঞানহীন।
তুমি
মিলিয়ে যাচ্ছ ক্রমশঃ মন্দির প্রাঙ্গণে। আমি নিরুপায়।
শূন্যপানে
চেয়ে থাকা শুধু উড়ে যায় প্রজাপতি
পাতারা
হাওয়ায় কাঁপে তবু যেন অন্ধ নিয়তি !
ফিরে
আসি একা। টালমাতাল। হেমন্তের অরণ্য চিরে। ঝরে পড়া পাতা মাড়াই। দূরে সব কিছু আবছায়
আবৃত। শুকনো পাতার গন্ধে নাক বুঁজে আসে। দুপুরের রোদ ঝরে পড়ে শাল—সেগুন—মহুয়ার মাথায় মাথায়। দামোদর দূরে সরে
যেতে থাকে। ঝর্ণার কলধ্বনি অস্পষ্ট মেদুর। বেলা বাড়ে ছিন্নমস্তা’র মন্দির চাতালে। সম্রাজ্ঞীর মত তুমি
চলে যাও আমাকে পেছনে রেখে। মারুতির কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যায় পীচ ঢালা রাস্তায়।
সকাল
দুপুর বিকেল হারালো মন থেকে বহু দূরে
বাস্তবতাও
পরাধীন হয়ে মিশে গেল রোদদুরে।
জীবন
এখন যন্ত্রণা বোধ পদে পদে দিন গোনা
আমি
যেন তার ক্ষ্ণিক অতিথি অকারণ যন্ত্রণা।
২৬শে অক্টোবর, ২০১৬।
রাজারাপ্পা, ঝাড়খণ্ড।
হ য ব র ল - (৫)
সবুজ
বাতাস বয়ে নিয়ে আসে হাসনুহানার গন্ধ
তোমার
সে ছবি মুক্তির স্বাদ অবিরাম চেনা ছন্দ।
আজ
মুক্তি। আপাতত:। কদিনের সঞ্চয় আজ কলকাতাগামী। ছোটনাগপুরের শাল-সেগুনের ধোঁয়া ওঠা
গন্ধের বিরতি। হয়তো বা তোমার ও। শহুরে জঞ্জালে আবার সেই পুরোনো ছক। বিষাক্ত
নি:শ্বাস। ফেলে আসা দিনের সিল্যুয়েট মনের আনাচে কানাচে।
কখন
তোমার সুখস্পর্শে হারিয়ে ফেলেছি সব
ফিরে
গিয়ে যদি তোমাকেই পাই তৃপ্ত এ অনুভব।
রাঁচি
ফিরিয়ে দিল কত কিছু। সময়টা পলকেই ছুঁয়ে দিল কিশোরবেলা। রেডিওতে বাজছে 'তুমি প্রিয়া আমি প্রিয়'। জয়শ্রীতে দেখছি 'পথে হল দেরী'। তুমি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি। ভোরের কলেজ।
ফাঁকা বাস। লাফিয়ে ওঠা বাসে। তুমি ঠিক ড্রাইভারের পেছনে। আমি পাশের জেনারেল সীটে।
বাসের দরজার দিকে আমার মুখ। তোমার চোখ বাঁদিকের জানলায়। ভোরের হাওয়া ওড়ায় আমার
চুল। শ্যামবাজারে ঘোড়ার পিঠে নেতাজী প্রস্তুত। ঘোড়ার লেজ উড়ছে হাওয়ায়। বিধান সরণীর
বদলে তখনো কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট। ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে ছুটে চলা ভোরের বাস। তোমার
নামার পালা। শুধুই চেয়ে দেখা। তারপরে বাড়ি ফেরা।
"...জীবন
গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের
পার,-
তখন
হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার !"
পাওয়া
তো হল না আমার। হারিয়ে গেল মেঠো পথ। হারিয়ে গেল আমার প্রথম রতি। প্রথম কত কিছুই !
জীবনে
যায়না ফেলা সবকিছু বুকে করে নিয়ে
হারায়
যে হলুদ কেশর কদমের বুকে গিয়ে।
তেমনি
তোমার ছবি অস্ফুট হয়ে এলে পরে
যত
পারি ফিরে যাই সেদিনের সেই খেলাঘরে।
২৭শে অক্টোবর, ২০১৬।
রাঁচি।