অসুখের কবিতা
কবি বলেছিলেন ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া নিজের মাঝে
বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’। নিজের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া না পেলে কি সার্থক কবিতা লেখা
যায়? আমাদের নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিকতায় ব্যক্তি স্বার্থের বাইরে বেরোনোর অবসরই
বা কোথায়? সময়ের সাথে জীবনধারণের তাগিদে মনুষকে ছুটতে হচ্ছে দুরন্ত গতিতে। অবিরাম
নিরন্তর। প্রতিটি নতুন শতক জন্ম দিচ্ছে দ্রুততর গতির। নিজেকে নিয়েই অধিকতর ব্যস্ত থাকতে
হচ্ছে প্রতিটি নতুন দশকেই। আগের দশকের তুলনায়। ফলে নিজেকে ছাড়া আর কিছু ভাবা ও
করার ফুরসুৎ কই আজকের মানুষের? একশ বছর আগের পরিমণ্ডল আজ আর নাই। তাই কবির পরামর্শ
মত চলার সাধ থাকলেও সাধ্য নাই আজ আমাদের অধিকাংশেরই। সময়ের অভাব মস্ত বড়ো অভাব।
সময়ের এই অভাব থেকেই স্বভাব নষ্ট হওয়ার আশু সম্ভাবনা রয়ে যায়। আর সত্যি করে বলতে
কি, আমাদের অধিকাংশের জীবনেই সেটাই ঘটে চলেছে। এক একজনের ক্ষেত্রে এক এক রকম ভাবে।
তাই নিজের চারপাশটা ছাড়া আমাদের আর দেখা হচ্ছে না বাকি বাস্তবতাটুকু। এই নিজের
দেখাটুকু নিয়েই একটি সংকীর্ণ পরিমণ্ডল গড়ে উঠছে আমাদের চেতনার জগতে। অনেকেই বলতে
পারেন, দেখা তো নিজেরই হওয়ার কথা। তবে অসুবিধা কোথায়? না নিজের চোখে দেখার কথা বলা
হচ্ছে না। বলা হচ্ছে শুধুমাত্র নিজেরটুকুই দেখার কথা। কারণ বাকিটা দেখার সময় ও
সুযোগ অবশিষ্ট থাকছে না আর প্রতিদিনের ব্যস্ত ক্যালেণ্ডারে। ফলে যা দেখছি আর
যতটুকু অনুভব করছি, সবটুকুই এই ব্যক্তি আমির সীমাবদ্ধ পরিসরেই। এর বাইরে বেরোনোর
অবসর না থাকতে থাকতে একদিন দেখা যায়, বেরোনোর সক্ষমতাটুকুই গিয়েছে হারিয়ে। আজ না
গেলেও কাল হারাবে অবশ্যই। তখন আর উপায় থাকে না নিজের থেকে বাহির হয়ে নিজের ভিতর
বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়ার। তখন নিজের ভিতরের সবটাই ভরে থাকে ব্যক্তি আমির আমিত্বেই। আর
আমরাও মজে থাকি সেই আমিত্বের অহংকারটুকু নিয়েই। এইভাবেই সময়ের অভাব আমাদের জীবনে
ঘটিয়ে দেয় স্বভাব দোষের। আমরা প্রত্যেকেই হয়ে উঠি আমি সর্বস্ব।
কিন্তু যিনি লিখবেন কবিতা। কি হবে তাঁর? এই আমি সর্বস্বতার
পরিসরেই তো গড়ে উঠতে থাকবে তার কাব্যবোধের দিগন্ত। তবে কি করে পাবেন তিনি কবি কথিত
বিশ্বলোকের সাড়া? আপন জীবনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চেতনার অলিন্দে কি করে অনুভব করবেন
তিনি বিশ্বমানবের সংবেদন? যা কিছু লিখবেন তিনি, সে’তো হয়ে উঠবে তাঁরই চাওয়া পাওয়ার,
ভালো লাগা না লাগার, বিশ্বাস অবিশ্বাসের সন্দর্ভ! কি করে মিলবে সেখানে কবি ও
পাঠকের অন্তর্লীন একাত্মতা? আমাদের বিশ্বাস, আধুনিক জীবনে কবি ও কবিতার এই এক
গুরুত্বপূর্ণ সংকট। এখন প্রশ্ন দুইটি। আজকের কবিতার এই সংকট সম্বন্ধে আমরা নিজেরাই
বা কতটুকু সচেতেন? এবং সংকট মোচনের উপায়ই বা কি?
না, এর উত্তর সত্যই জানা নাই আমাদের। প্রতিদিন যে অজস্র
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে। সংখ্যা গণনার অতীত যে কবিতার স্তূপ জমা হচ্ছে বিভিন্ন
মাধ্যমে। তা যে কি বিশাল পরিমাণে এই সংকটকেই আরও ঘনীভুত করে তুলছে সেই বিষয়ে আমরা
কজনই বা ওয়াকিবহাল! ফলে সংকট মোচনের পথই বা কোথায় কে বলবে। কিন্তু তার মধ্যেও ভাবতে
হবে আমাদের নিজের ভিতর বিশ্বলোকের সাড়া পাওয়ার সূত্রগুলিকে কি করে প্রাত্যহিক
ব্যস্ততার মধ্যেও পরিচর্যা করা যায়। আমাদের মন মনন সৃজনশীলতার সংবেদনে কি করে
নিরন্তর পরিপুষ্ট করে তোলার চেষ্টা করা যায়। না হলে সবটাই পর্যবসিত হবে একদিন
শব্দের কঙ্কালের নিষ্প্রাণ কোলাহলে। সেটাকে কাব্যচর্চার কোঠায় ফেলতে আমদেরই
দ্বিধ্বা হবে একদিন। সে বড়ো সুখের সময় হবে না মোটেও।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক কবিখ্যাতি নয়। নয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের
সংখ্যার হিসাব। আমাদের খুঁজে নিতে হবে প্রকৃত কবি ও তার কবিতাকে। নিজের ভিতর যিনি
খুঁজে পাওয়ার তীব্র চেষ্টা করছেন সেই বিশ্বলোকের সাড়ার। যে বিশ্বলোকের সাড়া না
পেলে শব্দের অক্ষরে কবিতার স্বাক্ষর পড়ে না ঠিক মতো। আজকের প্রকাশিত কবিতা জমে ওঠে
কালকের বাজে কাগজের ঝুড়িতে।
আমরা দেখেছি অনেকেই আজকের কোলাহলে নিজের আপন অক্ষের
কেন্দ্রেই ঘুরপাক খেতে খেতেই জন্ম দিচ্ছেন অজস্র কবিতার। বাৎসরিক প্রকাশনার জৌলুসে
অনেকেরই কাব্যগ্রন্থ উপচিয়ে পড়ছে বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারে। বিস্তর হইচই একটু থিতিয়ে
গেলেই দেখা দিচ্ছে শব্দের কঙ্কাল খ্যাতির বিরম্বনার আড়ালে। আর এই ভাবেই কবিতাহীন
হচ্ছে বাংলা কবিতা। তাই বাংলা কবিতার পরিমাণগত প্রাচুর্যে যারা দিশাহারা, বা
আহ্লাদে আটখানা, তারা নিশ্চিন্তে থাকলেও বাংলা কবিতার নাড়ীর স্পন্দন যাঁদের
সংবেদনশীলতায় ধরা পড়ে নিয়মিত, তাঁদের কপালে আজ সত্যই চিন্তার ভাঁজ।
আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের পরিসরের মতোই আমাদের সৃষ্টির
ক্ষেত্র সৃজনশীলতার দিগন্ত ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। ক্রমেই সীমায়িত হয়ে পড়ছে
সংকীর্ণ এক একটি গণ্ডীতে। এই গণ্ডীবদ্ধ আধুনিকতা নিয়ে অনেকের মধ্যে ভ্রান্তির কারণও
ঘঠছে দেখতে পাই। অনেকেই মনে করছেন এটাই আধুনিক কাব্যের বাস্তবতা। একে স্বীকার করে
নেওয়াই সময়ের দাবি। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন কাব্যসাহিত্যের বাস্তবতা কখনোই
সংকীর্ণ কোন জীবন সত্যের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আজকের যে জীবন সত্য, তার
মধ্যে যদি শাশ্বত বিশ্বসত্যের ইশারা না থাকে, তা যদি মূলতই আজকের কোলাহলজাত হয়,
তবে তা আর যাই করুক সার্থক কাব্যসাহিত্যের জন্ম দিতে পারবে না। পারছেও না আসলেই।
ঠিক যে কারণে আজকের কবিরাও কবিখ্যাতির তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন নিজেরদের অজান্তেই।
একদিন সেই খ্যাতির আস্তরণ সরে গেলেই দেখা যাবে পড়ে রয়েছে কবি খোলসের দুই
মালটটুকুই।
এই যে কবি খোলসের মলাট, যা দিয়ে আমরা বিচার করতে চাই আজকের
কবিতার ক্যানভাসকেই, এও আরও এক ভ্রান্তি। এই ভ্রান্তি পাঠক থেকে শুরু করে সাহিত্য
পরিমণ্ডলেরও। কবিখ্যাতির সাময়িক জৌলুসে যে পরিমণ্ডলকেই আমরা মরিচিকার মতো
সাহিত্যপরিমণ্ডল বলে ভুল করে বসি। এও আমাদের সেই নিজেরই অক্ষের চারপাশে আবর্তনের
সরাসরি ফল। যা দেখি, যতটুকু দেখি, নিজের মতো করেই দেখি। সেই দেখায় বাদ পড়ে যায় মূল
সত্যটুকুই। কারণ সে যে নিজের থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখা নয়। নিজেরই মধ্যে সমগ্রের
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আংশিক দেখা। সমগ্রের সাথে এই একান্ত বিছিন্নতাই আজকের মূল
অসুখ। সেই অসুখেরই কবিতা লিখে চলেছি আমরা।
আর এই অসুখের বিপ্রতীপেই কবিতাউৎসবের যাবতীয় প্রয়াস। সে
প্রয়াসের সাধ ও সাধ্য উভয়ই যতই সীমাবদ্ধ হোক না কেন। কবিতাউৎসব তাই সুস্থতর
সৃজনশীলতার দিগন্তের অভিমুখেই চলিষ্ণু বরাবর। আমরা এখানে কবি ও পাঠকের মেলবন্ধনের
পরতে পরতে সেই বিশ্বলোকের সাড়া খুঁজে পাওয়ারই অভিসারী। সেই অভিসারেই পূর্ববর্তী
সংখ্যাগুলির মতোই কবিতাউৎসবের কার্তিক সংখ্যার এই প্রস্তুতি। এই সংখ্যায় আমরা
আমাদের মধ্যে পেয়েছি এ মাসের অতিথি হাসনাইন সাজ্জাদীকে। তাঁর সাথে একান্ত
আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাঁর সাহিত্যবোধের বিস্তৃত দিগন্তের সত্যনিষ্ঠ পরিচয়।
আমাদের আশা কবিতাউৎসবের পাঠক তাঁর চিন্তা চেতনার সাঁকোতে ভর দিয়ে অনেক নতুনত্বের
পরিচয় পাবেন। তৃপ্ত হবেন। সঙ্গে রয়েছে দুই বাংলার শতাধিক কবিতার বিপুল সম্ভার।
কবিতাউৎসবের ফেসবুক পেজ :
https://www.facebook.com/amaderkobitautsov/ কে লাইক করে ফেভারিট করে রাখলে কবিতাউৎসবের যাবতীয় তথ্য ও
বিজ্ঞপ্তি সরাসরি আপনার ফেসবুক ওয়ালেই দেখার সুযোগ ঘটবে। এই পেজেই কবিতাউৎসবে
প্রকাশিত কবিতাগুলিও নিয়মিত প্রচারিত হয় লিংকসহ।
এবং এরই সাথে কবিতাউৎসবের ফেসবুক গ্রুপ: https://www.facebook.com/groups/kobitaautsov/# এ জয়েন রিকোয়েস্ট পাঠালে গ্রুপের সদস্য হিসাবে গ্রুপের ওয়ালে
আপনার কবিতা ও কবিতা বিষয়ক মূল্যবান মতামত সরাসরি পোস্ট করে সকল সদস্যদের সাথে
শেয়ার করেও নিতে পারবেন। গ্রুপের পিনপোস্টে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশাবলীও দেওয়া
আছে।
এছাড়াও কবিতাউৎসব গুগুল কমিউনিটি: https://plus.google.com/u/0/communities/117144176931778027450 তে সরাসরি জয়েন করে একটি
সম্পূর্ণ ওয়েবসাইটের মতো সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন। এখানে আপানার কবিতা পোস্ট করার
সুবিধা ছাড়াও আপনার নিজস্ব সাহিত্য ব্লগের লিংক নিয়মিত ব্যবধানে প্রচারের
সুবন্দোবস্ত ও অন্যান্য একাধিক বিভাগে আপনার যোগদানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে সুস্পষ্ট
নিয়মাবলীও।
***কবিতাউৎসবে লেখা পাঠানোর সাধারণ নিয়মাবলী:
১) স্বনির্বাচিত স্বরচিত ৫টি প্রিয়কবিতা পাঠাতে হবে
২) অভ্র বাংলা হরফে টাইপ করে একটি এমএস-ওয়ার্ড ফাইলে এটাচ করে
৩) কোনভাবেই পিডিএফ ফাইল ও বিজয় ফন্ট গ্রহণযোগ্য নয়
৪) একটি প্রফাইল চিত্র অতি অবশ্যই
আবশ্যক
৬) পাঠানোর শেষ দিন প্রতি বাংলামাসের ১লা তারিখ
***কবিতাউৎসবে প্রকাশিত
কবিতার স্বত্ত্ব লেখকের নিজস্ব।
কবিতাউৎসব আপনার সৃষ্টিশীলতার প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধাশীল
থেকে সবরকমের সহযোগিতার বিষয়ে সাধ্যমত অঙ্গীকারবদ্ধ। কবিতাউৎসবের সাথে থাকুন
কবিতাউৎসব আপনার পাশে রয়েছে সবসময়।