কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার ১৪২৪
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। ‘কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই নিয়ে কোন
সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায়
থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির
এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা
বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে।
হাসনাইন সাজ্জাদী: ধন্যবাদ। বাংলার জনজীবনে কবিতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এই দুই ভাবেই ভুমিকা রাখে বলে আমি
মনে করি। আমি যদি বলি, ‘আমাদের দেশে হবে সেই
ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। তবে
প্রথমে আসে প্রত্যাশার কথা, তারপর চলবে তার প্র্যাকটিস। আমি অন্যের কাছে প্রত্যাশা করার পাশাপাশি নিজেকেও সেভাবে গড়ার প্রত্যাশা করি। নিজের মধ্যে নিজেকে গড়ার যুদ্ধ চলে।
অন্যকেও জ্ঞান দেই। কবিতা এখানে গণমাধ্যম। কেবল বিনোদন নয়, কবিতার প্রধান
কাজ জাতির মধ্যে চেতনার বিকাশ। ভাবনার চর্চা। এ চর্চাই কবিরা জাতিসত্ত্বার বিকাশে
করছেন এবং করবেন। আর্ট ফর আর্ট বা কলা কৈবল্যবাদ যারা বলেন তাদের কথা ভিন্ন। আমরা আর্ট ফর
লাইফ বা জীবনের জন্য কবিতার যারা চর্চা করি, তাদের শক্তিটা এখানেই। আমি মনে করি আমাদের মানসিক বিকাশে কবিতার
ভূমিকা অনেক অনেক বেশী কার্যকর।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা
হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ জানতে
চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি
একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
হাসনাইন সাজ্জাদী: প্রেম
ভালবাসার চর্চা করতে গিয়ে কারো কারো কবিতায় হাতে খড়ি হয়। বাঙ্গালি প্রেমে পড়লে
কবিতা লেখে বলেন অনেকেই। কবিতার সাথে এই অর্থে আত্মিক যোগাযোগ থাকে। তারপর এটা
শিল্প চর্চায় গড়ায়। তখন এটা রক্তের সাথে মিশে যায়। এ পর্যন্ত সব হুজুগেই থাকে।
পরিচিতির বিষয়ও এখানে কাজ করতে পারে। কিন্তু আর্ট ফর লাইফ বা জীবনবোধ তৈরির
প্রসঙ্গ ভিন্ন। কেউ কেউ এখানে সে বোধ তৈরির জন্যেও আসেন। তাদের ক্ষেত্রে এই আত্মিক
যোগটা অনেক গভীর। যারা কবিতাকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য মনে করেন, তাদের কাছে কবিতায় পরিচিতির
লাভের চাইতে কল্যাণের দিক বেশী বিবেচ্য।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা বলতে
আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে করেন কবিতারও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? আপনার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি
একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?
হাসনাইন সাজ্জাদী: আমি কবিতার চর্চা করি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। শিল্প
সাহিত্যকে আমি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের উপলক্ষ্য করতে চাই। বিজ্ঞানমনস্ক
একটি সমাজ ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের জন্য আমি বিজ্ঞানবাদ নামে একটি রাজনৈতিক
দর্শনের কথা বলি। সেখানে সমিতিভিত্তিক অর্থনীতির একটি রাষ্ট্র আমার স্বপ্ন। সকলের
অধিকার যেখানে সমান হবে। আমি বিজ্ঞানবাদ থেকে বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব নিয়ে কাজ করছি। ৬
দফার বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বে আমি এমন একদল কবি তৈরির স্বপ্ন দেখি, যারা বিজ্ঞান
সমাজ গঠনের জন্য পরিবেশ তৈরি করবে। এ কাজটি আমাদের মধ্যে সামাজিক দাইয়বদ্ধতারই ভীত তৈরি করবে। আসলে
আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতাই বড়। নিজেদের জন্য সুন্দর পৃথিবী এবং প্রজন্মের জন্য সুন্দর আবাস গড়ার জন্যেই এই
দায়বদ্ধতা। এর জন্যেই আমি কবিতায় বিজ্ঞান চর্চার কথা বলি, বিজ্ঞান কবিতা আন্দোলন
করে থাকি।
কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে? এমনকি হারিয়ে
যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
হাসনাইন সাজ্জাদী: দেশপ্রেম থেকেই দায়বদ্ধতা, ভালবাসা থেকে প্রজন্মের জন্য দায়বদ্ধতা। দায়বদ্ধতা
নিজের জন্যেও। আপনি প্রকৃতির আলো বাতাস নিবেন, আর প্রকৃতির জন্য আপনার দায় থাকবেনা তা
হবেনা। এই শৈল্পিক চিন্তা থেকেই বিজ্ঞান কাব্যভাবনা। সকল চর্চাই জীবনের জন্য। কবিতাও। কিন্তু এখানে বোর হয়ে থাকার নাম শিল্প নয়। নতুন নতুন গবেষণার দ্বারা কবিতাকে বৈচিত্রময়
করা যায়। কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও
চিত্রকল্পের বিজ্ঞানমনস্কতাই বিজ্ঞান কবিতা। বিজ্ঞানে সবাই সমান, সকলের অধিকার
সমান। এই সামাজিক সুবিচারই বিজ্ঞান মতাদর্শ। এটা
প্রচলিত রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়। এতে
সাহিত্যিক উৎকর্ষতা খর্ব হবে বলে আমি মনে করি।
কবিতাউৎসব: আবার এই
সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে
করেন আপনি, এবং কেন? কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
হাসনাইন সাজ্জাদী: সমাজ সচেতনতার বিষয়টি আমি সমাজ বিবর্তনের দ্বারায় দেখে
থাকি। আমরা গুহা থেকে এখন বহুতল ভবনে বাস করছি। নিজের সাধনায় মানুষ আজ এই জায়গায়।
কিন্তু আমরা অলিক ভাবনায় বাস করি। আমরা ভাগ্য নিয়ে চর্চা করি। এখান থেকে বের করে
মানুষকে বিজ্ঞানচেতনায় নিয়ে আসার অর্থ মানুষকে আত্মশক্তিতে বলিয়ান করা। আমরা চাই মানুষ
তার নিজের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে সবার কথা ভাবুক। এটা শুধু কাল চেতনা নয়, পুরো
বিবর্তনবাদের চেতনা। বিজ্ঞান কবিতায় একটি দফা আছে বিজ্ঞান যুগকে কবিতায় ধরে রাখা।
এটাই কাল চেতনা। তবে এই কাল চেতনা বিজ্ঞান কবিতার এক ষষ্টমাংশ মাত্র। আরো দফা আছে এবং জীবন একটি বিবর্তন ধারার নাম। আমি
কবিতায় এই পুরো বিবর্তন চেতনার কথা বলি। এই ইতিহাসবোধের ওপর আমি জোর দেই, জোর দিয়ে
থাকি।
কবিতাউৎসব: এই যে
স্বদেশপ্রেম,নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি
দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে
তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই
বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী
তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের
উর্ধে উঠতে পারে? বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি
করে না?
হাসনাইন সাজ্জাদী: নিজের স্বকীয়তার ওপর আমি জোর দেই বটে, তবে তা
আন্তর্জাতিকার প্রেক্ষাপটে। বিজ্ঞান কবিতায় আমি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও ভাবনাকে
নিয়ে এসেছি। যেমন ছোট ক্যানভাভাসে বড় উপমা আমার ৬ দফার একটি। আমেরিকার কবিরাও এখন
ছোট কবিতা লিখছে। বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনায় কবিতা লিখছে। আপনি যখন দেশের বাইরে থাকবেন তখন আপনার
ভাবনায় যে দেশ থাকবে তা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেই থাকবে। কবিতাও এমন একটি
আন্তর্জাতিকতাবাদ যা দেশে বসে লিখলেও আপনার চেতনায় বিশ্ব ভাবনা থাকবে, থাকতে হবে।
আপনি যখন স্বাদেশিকতার উর্ধে উঠবেন তখন কোন বিপত্তি থাকবেনা। দেশপ্রেমকে বিশ্ব
প্রেমের ক্যানভাসে নিয়ে যান। নিজের সমস্যাকে বৈশ্বিক ভাবনায় তুলে ধরুন। তাতে আরো
মহৎ কাব্য হবে।
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের
ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও
ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো
দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে।
এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে
অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা।
এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
হাসনাইন সাজ্জাদী: আমি এটাকে পজেটিভলি দেখি। এতে ঘরে বসে আমি বিশ্ব বাংলার
সাথে যুক্ত হচ্ছি। বিশ্ব বাংলা এই অন্তর্জালেরই দান। লিটলম্যাগ থেকে বিগম্যাগ কি
আশীর্বাদ নয়? ভাল লেখাকে আপনার আমার বেছে
নিতে বাঁধা নেই। এই ব্যাবস্থায় স্তুপাকার
নেই। সব রানিং এবং ফ্লাট। যেটা ভাল
লাগবে পড়বেন। প্রয়োজনে ভাল লেখা কপি করে রাখবেন।
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে
কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান
হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, এপারের সত্তরের
উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার সাহিত্যচর্চার
ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান
লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা, রাজনীতি ও
মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের
ক্রমাগত ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে
পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি? বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?
হাসনাইন সাজ্জাদী: সমাজ জীবনের অস্থিরতা
আমাদেরকে লেখার বিষয়বস্থু দেখিয়ে দেয়। এতে গবেষণার পথ সুগম হয়। ভাষা আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন,
মুক্তিযুদ্ধ সবইতো আমাদেরকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা সাহিত্যের উত্তরণইতো এগুলোর দান।
তারপর এসেছে বিজ্ঞানের চরম ও পরম উৎকর্ষতা। একে রুখে দিতে এসেছে মৌলবাদ। তারপর তাতে
জঙ্গিবাদ যুক্ত হয়েছে। মৌলবাদ হচ্ছে থিয়োরি আর জঙ্গিবাদ তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড এরই ধারাবাহিকতার নামান্তর।
বুদ্ধিজীবি বলুন আর আর রাজনীতিবিদ বলুন, যারাই আঁতাত
করছে তারা হালুয়া রুটি বা আখের গোছানোর জন্য তা করছে। এটা শেষ কথা নয়। শেষ কথা
হচ্ছে আমাদের পচন আছে বলে আমরা বৈদ্য খুঁজছি । আমাদের চিকিৎসা হবে। আমরা তাতে
আরোগ্য লাভ করবো। তারপর এর ক্ষতিকর দিকও আছে। সাময়িক হলেও সুস্থ ধারার সাহিত্য ও
সংস্কৃতি চর্চার পথে তার বিরূপ প্রভাব থাকবে। তা কাটিয়ে ওঠার নামই আলোর সন্ধান
করা। আলোকিত থাকা।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন
সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক
অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি
এড়িয়ে গিয়ে, কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে
ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই
পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত
থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?
হাসনাইন সাজ্জাদী: না। যেখানে মানুষের কথা নেই সেখানে কোন বিশুদ্ধতা নেই, যেখানে
মানুষের সমস্যার সমাধানের দিক নির্দেশনা নেই, সেখানে কল্যাণ নেই। সেখানে মানুষ যাবে কেন? নজরুলের কবিতার পাঠক,
সুকান্তের কবিতার পাঠক সবসময় থাকবে। সেখানে প্রাণের কথা আছে। এমনকি আমাদের শামসুর রাহমান,
সৈয়দ হক, নির্মলেন্দু গুণ তারাও থাকবেন স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু আর বাঙালি মননের কথা
বলার জন্যে। কবি সাযযাদ কাদির তাঁর কবিতা ছাড়াও বিজ্ঞান উপন্যাসের জন্য বেঁচে
থাকবেন। কল্পনার বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষিক উদ্ভাসন থাকলে বিজ্ঞান কবিতাও থাকবে।
বিশ্বায়ন সমস্যার বিজ্ঞান ভিত্তিক চিত্রায়ন ও এর সমাধানে বিজ্ঞান কবিতাও
বিশ্ববাসীকে বুকে টেনে নিবে। এভাবেই তা স্থায়ীত্ব পাবে।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের। আজও সে বিতর্কের
অবসান হয় নি বলা যায়। নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে
অভিযুক্ত হতে হয়েছিল তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছে। আপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের
অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের
পাঠকবৃন্দকে।
হাসনাইন সাজ্জাদী: এ বিতর্ক আছে তবে তা থাকবে না, যদি আমরা কবিতাকে জীবনের জন্যে বাছাই করি। শরীরটাকে
নিজের সম্পদ এবং তার ব্যাবহার একান্ত নিজস্ব বলে মনে করতে পারি। এটা না করে কবিতায়
নারী শরীরকে এক শ্রেণির লেখক ও কবিরা বেশ অশ্লীল ভাবেই চিত্রায়ন করে থাকেন। মানুষের
চাওয়া পাওয়া চিরন্তন। তা সাবলীল থাকবে। একটি স্বাভাবিক জিনিষের রগরগে ও রসালো
উপস্থাপনা অশ্লীল। অরুচিকর কিছু পাঠকদের কারণে তা জনপ্রিয়ও হয়। তাই এই বিতর্ক। না
হলে এই বর্জ্য সাহিত্য বেশী দূর যাবার নয়। কিন্তু তার এখনো দৌরাত্ব্য আছে। ল্যাডি
চ্যাটার্লিজ লাভার এখনো সমাদৃত। আমরা যদি বিজ্ঞান সময়োপযোগী লেখা উপহার দিতে পারি এবং তা মানুষের কাছে পৌছাতে
পারি, তবে মানুষ তার সমাদর করবেই। লাভার তখন
আর কভার স্টোরি হবে না। মানুষ তাতে আগ্রহ দেখাবে না।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার
দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন
পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা।
এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি
আপনি কি ভাবে দেখতে চান?
হাসনাইন সাজ্জাদী: ‘৪৭পরবর্তীকালে কলকাতায় দেশভাগ নিয়ে সমৃদ্ধ সাহিত্য
হয়েছে, সেখানে মানবতার চর্চা হয়েছে। কবিতায়ও বড় কাজ হয়েছে। শাস্ত্রবিরোধী কবিতা, ক্ষুধাবিরোধী
কবিতা প্রভৃতি হয়েছে। এখানেও মানবতার চর্চা ছিল। এখন তাদের মাঠে শুন্যতা বিরাজ
করছে। উত্তর আধুনিকতার নামে যা হচ্ছে তা পাঠক ধরতে অক্ষম। আমাদের এখানেও বর্তমান
অবস্থা তাই। এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোকগাথা
কাব্য ভাল হচ্ছে। তবে তা আর বেশীদিন ডিমান্ড করে না। ভাল ভাল কালজয়ী কবিতা এ ধারায়
হয়ে গেছে। একটি ধারায় কালজয়ী কবিতা হয়ে গেলে নতুনদের আর এ ধারায় জায়গা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধ, গণ-আন্দোলন, ছাত্র-সংগ্রাম কিংবা আরো পেছনের ভাষা সংগ্রামের
ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সবখানেই কালজয়ী কবিতার পর তার ধারা পরিবর্তিত হতে বাধ্য
হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা যে বিজ্ঞান কবিতার আন্দোলন শুরু করেছি তা কলকাতা, আসাম,
ত্রিপুরা সবখানেই এখন আলোচিত ও চর্চিত হচ্ছে। জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। এমনকি জাপানের
টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্ট্যাডিজে আমি বিগত ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ‘বিজ্ঞান
যুগে বিজ্ঞান কবিতা’র যে থিয়োরি উপস্থাপন করি তার গ্রহনযোগ্যতা পাওয়া গেছে। তার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান কবিতার ধারণা বিশ্বব্যাপী
ছড়িয়ে গেছে। উত্তর
আমেরিকার ‘ইভেন্ট হরাইজন ম্যাগাজিন’ তাৎক্ষণিক ৫০০
ডলারের বিজ্ঞান কবিতার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ইউ আর আই”র একটি সিসি
অনুমোদন নিয়ে আমি ‘ইউ আর আই সায়েন্স পোয়েট্রি বাংলাদেশ’ নামে কাজ করছি। যা কলকাতাতেও
এখন সুপরিচিত। এভাবে ঢাকা কলকাতার বাংলা সাহিত্যের ঐক্যই শুধু নয়, গোটা বিশ্ব
বাংলা সাহিত্য আজ এক ধারায় চলে আসছে। বিশ্ব সাহিত্যকে এ ধারায় নিয়ে আসতে আমরা এখন
অনুবাদ সাহিত্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে
চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান, যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও
তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার
চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা? আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!
হাসনাইন সাজ্জাদী: মৌলবাদ আমাদের দ্বিখণ্ডিত করে রাখতে চায় বটে, তবে তা আর বেশীদিন স্থায়ী হবে না। বিজ্ঞান
সাহিত্য ও বিজ্ঞান কবিতা এর প্রোটেকশন দেবে। বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে গেলে এই বর্জ্য থাকবেনা। আন্তধর্মীয়
সম্প্রীতি ও আন্তসাহিত্যিক বিস্তৃতি একই সূত্রে গাথা। সাহিত্যের ভূমিকা এখানে
মুখ্য। বিজ্ঞানচিন্তা
এখানে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। সাহিত্যই
সাম্প্রদায়িকতা দূর করবে যদি তা বুর্জোয়া সাহিত্য না হয়ে থাকে। যদি তা বিজ্ঞান
সাহিত্য হয়- তবে বিশ্বকে তা বিশুদ্ধ ও মানবিক করবে। অবশ্যই সাহিত্য তা করবে।
কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি
জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?
হাসনাইন সাজ্জাদী: আমি মনে করি পাঠকই সব। তাদের কাছে পৌঁছানো জরুরী। কিন্তু
আমার বিষয়টি একটু ভিন্ন। আমি এখনো লেখকদের জবাবই দিয়ে যাচ্ছি। যেহেতু বিজ্ঞান
কবিতার এ ধারণা নতুন। আমাদের কবিরাই বলেন, কবিতায় আবার বিজ্ঞান কি? কবিতাতো
কবিতাই। কবিতা মুক্ত বলাকা। তাকে কোন বিধানে বাঁধা যাবেনা। আবার কেউ কেউ বলেন, কবিতা নিজেইতো বিজ্ঞান। এসবের জবাব আমাকে দিতে হয়। বলতে হয় কে
কোথায় বিজ্ঞান বিরোধী কবিতা লিখছেন। আর যাচ্ছে তাই লিখে কবিতাকে মানব কল্যাণে লাগানো
যাবেনা। সময়ের দায়বদ্ধতা ও সমাজের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করে শুধু শিল্পের নামে কবিতা
লিখলে তা বর্জ্যই থেকে যাবে। এর পরেই আসে আমার পাঠক প্রসঙ্গ । বাজার জাতের
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অনুসরণ ছাড়াও আমি সৌজন্য বইপুস্তক সরবরাহ করি। পত্রপত্রিকায়
লেখা ছাপাই। ফেসবুককেও আমি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হিসাবে গ্রহন করে থাকি।
কবিতাউৎসব: ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন
ছায়পাত পড়ে?
হাসনাইন সাজ্জাদী: স্বাভাবিক কারণে ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য ইলেক্ট্রনিক
মাধ্যম নির্ভর হতে বাধ্য। ই-বুক বা আরো সহজ কোন পদ্ধতি আসতে পারে। প্রজন্ম এগোবে
টেকনোলজির পথে। সাহিত্য এগোবে তার সাথে সাথে। উইকিপিডিয়াও সাহিত্য ভান্ডারে পরিণত
হতে পারে। এককথায় সর্ট ও সহজ হয়ে যাবে সাহিত্যের ওলিন্দ্য।
হাসনাইন সাজ্জাদী: বিজ্ঞানবাদ রাজনৈতিক দর্শন ও বিজ্ঞান কাব্যতত্ত্বের উপস্থাপক এবং সাবলীল
ছন্দের প্রবর্তক। সাংবাদিক,মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও সমাজচিন্তক। সম্পাদক ও
প্রকাশক-সাপ্তাহিক খোঁজখবর এবং সাহিত্যমাসিক পূর্বাপর। এশিয়াটিক সোসাইটির মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা
প্রকল্পে কর্মরত । সভাপতি-বিজ্ঞান কবিতা
আন্দোলন ও বিজ্ঞানবাদ চর্চা
কেন্দ্র। চেয়ারম্যান- ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি ফর রুরাল পিপল। চেয়ারম্যান- বাংলাদেশ
বিজ্ঞানবাদী পার্টি [প্রস্তাবিত]