বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সম্পাদকের কলমে



মানবিকতার উৎসব

প্রকৃতিতে আশ্বিন মানেই উৎসবের আয়োজন। উৎসব মানুষের সাথে মানুষের আনন্দের মিলনে। ভাবের মিলনে। আত্মীয়তার মিলনে। বাংলা প্রকৃতির মধ্যেই এই উৎসবের বীজ। বাঙালির মন মনসিকতার প্রকৃতিও সেই উৎসবের রঙে রাঙানো। আর আশ্বিনের আগমনে বাংলা প্রকৃতি যেন নবরূপে সেজে ওঠে। সেই সাজের সাথেই আমরাও নিজেদের সাজিয়ে নিতে উৎসুক হয়ে উঠি নানান ভাবেই। উৎসবের সাজ আসলে অন্তরের আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশেরই নান্দনিক উদ্বোধন। সেই প্রকাশ সকলের সাথে মিলিত হয়েই সার্থক হতে চায়। আর তাই উৎসব মানেই সকলের সাথে মিলনের আনন্দ। মিলনের আর্তি। মিলনের তৃপ্তি। এই যে মিলনের একটি টান অনুভব করি আমরা উৎসবের সমাগমে, সেটি আসলেই আমাদের হৃদয়ের ভালোবাসারই নিঃস্বার্থ উদ্বোধন। সারা বছরব্যাপি এই আবেগটি ততটা সক্রিয় থাকে না। যতটা সক্রিয় হয়ে ওঠে উৎসবের সমাগমে। আমাদের জীবনের প্রাত্যহিকতায় ক্ষুদ্র আমির বেষ্টনে নানান রকমের জাগতিক প্রয়োজন ও স্বার্থের জালে আটকে থাকতে হয় আমাদের। কিন্তু উৎসবের দিনে, উৎসবের অমোঘ টানে সেই জাল কেটে মুক্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে আমাদের সেই ক্ষুদ্র আমি। মিলতে পারে বৃহৎ আমির আনন্দে। সারাবছর ক্ষুদ্র আমির প্রয়োজন মিটিয়ে এইবার বৃহৎ আমির দিগন্তে মুক্তির স্বাদ। সেখানেই আত্মার উৎসব। সেখানেই উৎসবের প্রাঙ্গনে সকলের সাথে নিঃস্বার্থ মিলনের আনন্দ।

কিন্তু অবিমিশ্র আনন্দ বা সুখ নিয়ে নয় এই জগৎ। আনন্দের আতিশয্যের আড়ালেই বিষাদের ঘনঘটা। এখন প্রশ্ন, বিষাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে কেবলমাত্র আনন্দের উদ্বোধন কি আদৌ সম্ভব? মানুষের পক্ষে। সম্প্রতি মায়ানমারে সংগটিত জাতি দাঙ্গায় ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা উপজাতির শরণার্থীদের ঢেউ আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মায়ানমার বর্ডারে তাদের সাথে আমাদের সরাসরি আত্মীয়তা না থাকতে পারে; কিন্তু মানুষ হিসাবে তাদের এই চরম দুর্দিনে আমাদের উৎসব কি সত্যই আলোকিত হয়ে উঠতে পারে? সার্থক হতে পারে উৎসবের আনন্দ? যদি হয় তবে মানুষ হিসাবে আমাদের পরিচয় হয়ত মুখ লুকাবারও জায়গা খুঁজে পাবে না। মানুষের দুর্দশার দিনে মানুষের উৎসব কিভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। দুর্দশাগ্রস্তদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোই যে সময়ের আশু কর্তব্য সেই সময় অন্য কোন কথা ভাবাও কি অশোভন নয়?

কিন্তু কি করতে পারে সাধারণ মানুষ? আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের দাবা খেলার এক একটি চালে লক্ষ লক্ষ মানুষের চরম দুর্দশা চোখে দেখা ছাড়া? বিচারের বাণীর নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলার সময়, কি করবে সাধারণ মানুষ? একথা ঠিক বিভিন্ন সংগঠন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ইতিমধ্যেই পৌঁছিয়ে গিয়েছে, যাচ্ছে শরণার্থীদের কাছে। সেখানেই মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। সুখের কথা, ঘোরতর দুঃসময়েও সেরকম মানুষের অভাব হয় না। অভাব হয়নি এক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের প্রধাণমন্ত্রী নিজেও ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন আর্তদের মাঝে। সরকারীভাবে নানান ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এই দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা বাংলাদেশ। সেটা আশার কথা। কিন্তু সংকটের কথা, মায়ানমারের এই জাতিদাঙ্গা ও নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যার বিরুদ্ধে সে দেশের সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে চাপ দেওয়ার বিষয়ে বিশ্বের প্রধানতম শক্তিগুলির টালবাহনা দেখে সত্যিই মানুষের দিশাহারা অবস্থা।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানাবিধ কূটকৌশল বোঝার কথা নয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের। আমরা সেকথা বুঝতে উদ্গ্রীবও নই। আমারা শুধু বুঝতে চাই একবিংশ শতকে মানুষের উপরে মানুষের এইরকম পাশবিক অত্যাচার নিপীড়নের ভয়াবহ আদিমতা সংঘটিত হয় কি করে? তাহলে কতটা এগোলো আমাদের তথাকথিত সভ্যতা? যে সভ্যতার অন্যতম অভ্রংলিহ অহংকার রাষ্ট্রপুঞ্জ! প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলি নিপীড়নের বীভৎস তাণ্ডবলীলার সময়েও সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্লজ্জ ভুমিকার সাক্ষী থেকেছি আমরা। এবারেও সেই একই চিত্র। অর্থাৎ যেখানেই দুর্বলের উপর প্রবলের অত্যাচার, সেখানেই ঠুঁটোজগন্নাথ হয়ে কালক্ষেপের এক অসাধারণ দৃষ্টান্তের নাম রাষ্ট্রপুঞ্জ। সাধারণ মানুষের করার কিছু নাই ঠিকই, কিন্তু সভ্যতার নামে এইসব আদিম বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষকেই কিন্তু গর্জে উঠতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। সুখের কথা অল্প অল্প করে হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেইরকম কিছু লক্ষ্মণ দেখা দিতেও শুরু করেছে বিক্ষিপ্ত ভাবে। কিন্তু আশংকার কথা, মানুষের সেই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদী কন্ঠগুলিকে হাইজ্যাক করে নেওয়ার রাজনীতিই ওঁৎ পেতে সময়ে তা দিতে থাকে সবসময়ে। সাবধান থাকতে হবে সেই দিক দিয়েও।


আমরা হয়তো বেশি কিছু করার মতো কোনরকম অবস্থাতেই নাই। কিন্তু মানুষের এই চরম দুঃখ দুর্দশার দিনেও আমাদের উৎসব যেন আনন্দের আতিশয্যে অমানবিক না হয়ে ওঠে কোনভাবেই। আমাদের যেন খেয়াল থাকে উৎসবের এই মরুশুমেও লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের কোন ঠিকান নাই। সেই ব্যাথাটুকুর মানবিক বোধের সীমানাতেই উদযাপিত হোক এবারের উৎসব। এবারের কবিতাউৎসবের এই উৎসব সংখ্যাও তাই অবিমিশ্র উৎসবের উদযাপন নয়। আবার উৎসবের এই মরুশুমে স্বতঃস্ফূর্ত মিলনের যে টান, সেই টানকে স্বীকার করেই সজানো হয়েছে এই সংখ্যা। এবারের সংখ্যার অন্যতম বৈশিষ্ট সম্পূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থের সংযোজন। বিশিষ্ট কবি রত্নদীপার বহু আলোচিত বিতর্কিত কাব্যগ্রন্থ “৩৬-৩২-৩৪” এর সর্বপ্রথম অন্তর্জাল সংস্করণের প্রকাশ এই সংখ্যার কবিতাউৎসবের বিশেষ আয়োজন। আমাদের আশা কাব্যগ্রন্থটির এই ওয়েব সংস্করণ পাঠকদের চাহিদা পুরণে সমর্থ হবে। এই সংখ্যায় এ মাসের অতিথি বিভাগে আমরা আমাদের মধ্যে পেয়েছি বিশিস্ট কবি তৈমুর খানকে। তাঁর সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারে বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত দিগন্তে কবির চিন্তাভাবনার বিস্তৃত পরিসরের পরিচয় পাবেন অভিনিবেশি পাঠক। এবং এরই সাথে দুই বাংলার তেত্রিশ জন কবির দেড়শতাধিক কবিতার বিপুল সম্ভার। উৎসবের নৈবেদ্য পাঠকের দরবারে।