রাবেয়া রাহীম
অনিকেত মঙ্গল
মন খারাপ হওয়াটা যেন প্রাত্যাহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন বেলা আহারের মত, সকালের নাস্তা বিকালের চায়ের মত
ঠিক যেন হবেই না কোনও ভাবে--
তুমি কি কখনো ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডে গিয়েছ, অনিকেত?
দেখেছ সেখানের প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল নীল জলরাশি?
আমি দেখেছি--ওখানেই চলে গেলাম সেদিন।
আমার বাড়ি থেকে খুব বেশী দূরে নয় তো,এই ধরো- প্লেনে তিন ঘন্টার ফ্লাইট।
যদিও প্লেন ভ্রমণ কিছুটা একঘেয়েমি থাকে তারপরেও ভালোই
লাগছিলো,
প্লেনটা যখন বিশাল শরীর নিয়ে আকাশে উড়াল দিলো ,
জানালা দিয়ে নীচে হাডসনের নীল জল দেখে
হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো তোমার মনটাই ছুঁয়েছিলাম
তাই যেন মনে হোল।
সেখানে যাওয়ার পর সেদিন আষাঢ়ের রাত ছিল।
সারারাত জুড়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি---তারাদের আলোয় টুপটাপ জলের
কণা
হীরের কুচির মতো অভিমান আর বিরহের বিবর্ণ রঙ আঁকড়ে,
সুখেরা ঝরে চলেছিল কান্নার হাত ধরে ।
তখনও ভোর হয়নি ছলছল চোখে বালুকা বেলা ধরে
হাঁটছি! হাঁটছি! হাঁটছি!
আলোক বর্ষের মত দীর্ঘতর মুহুর্ত পার হয়ে
প্রতিনিয়ত শূন্যতা অাবিষ্কার করেছি অাপন সত্তায়!
এমন দুঃসাহসী ছোঁয়া না দিলেই কি হতো না,অনি?
চেয়ে দেখো, কি করে ভস্ম হয়েছে আমার বোধের গৃহটি
তোমার ঐ ভরাট কন্ঠ ভেংগে চুর চুর করেছে পাঁজরের প্রতিটি
হাড়
শব্দ শুনতে পাও নি?
বুকের ভেতর অস্থির চঞ্চল জল-তরঙ্গ অকারনেই কি বেজেছিল সেই
রাতে?
একরাতের রোমান্থনে কেন প্রতিটি রাত মরে যাই অনি?
ভোরের সুর্যের মায়াময় আলোতে তোমার প্রতিচ্ছবি
হৃদয়ে আশ্চার্য গোঙানি অবিরাম--এলো চুল- ঠোঁট, বুকে জড়িয়ে
ভালোবাসায় ছুঁয়ে যাচ্ছিলে যেন তুমি!
নরম ছোঁওয়ায় ব্যথার তন্ত্রী গুলো আরো-বেশি জোরে বেজে
উঠেছিল,
স্পর্শ গুলো চিরস্থায়ী করে, সুখ উষ্ণ দেহ ছেনে
আবক্ষ কাছে টেনে তৃপ্ত করেছিলে তৃষিত হৃদয়
আকণ্ঠ নেশায় বুঁদ আমি তোমার প্রেমে, তোমার ছোঁয়াতে, অনুভবে!
কম্পিত বিহ্বল হয়ে শুধু বলতে পারলাম, ভালবাসি তোমায় অনিকেত!
তুমি তো জানোই ধরা তোমায় দিতেই হবে,তুমি ঠিকই জানো ।
ঈশ্বরের শপথ--বলে দাও
এই অপেক্ষা, এই ব্যাকুলতা কাছে পাবার জন্যে এই অধীর আকুলতা
এতো কল্পনা-ভাবনা--কোন কারন ?
নতুন জীবনের বার্তায় নাকি অনন্ত মৃত্যুবাণ?
কক্ষচূত নক্ষত্রের মত এসেছিলে জড়িয়ে নিয়েছি ভালোবাসার
ছলে
আশাবাদী এক স্বপ্নচাষী আমি মরিচীকার ধোঁকা উপেক্ষা করে
মরুভূমিতে বুনে চলেছি স্বপ্নবীজ,
চাইছি আর একটিবার তোমার আলিঙ্গন --অনি!
কেমন আছো---যেমন আছি
প্রিয়তম,
কেমন আছো তুমি..
কাটছে তোমার দিন কেমন করে বলো...
রাতে বার বার ঘুম ভাঙ্গার বাজে অভ্যাস হয়েছিল
সেটা এখনো আছে কি ?
আমিহীন রাতগুলো তোমায় যন্ত্রণায় রাখে কি ?
প্রেশার বেড়েছে বলেছিলে, সুগারটাও নাকি ছিল বেশী-
এখন কেমন ?
নিয়মিত চেকআপ করানোতে ছিল তোমার আলসেমি
কত বার মনে করিয়ে দিয়েছি গা করতেনা।।
তোমার ওখানে এখন কেমন শীত ?
শুনেছি অনেক শীত নাকি এবার তোমার শহরে !
ঠান্ডায় বুকে ব্যথা বাঁধিয়েছিলে...
দেখ আবার হাঁপানির টান যেন না হয়
তোমার প্রতিটি শ্বাস আমায় ছুঁয়ে থাকে যে,
কষ্ট আমারও হবে...সাবধানে থেকো।।
আজ সারা রাত তুমুল তুষারপাত !!
তাপমাত্রা হিমাংকের অনেক নীচে
পেঁজা তুলোর মতো নয়...বাতাসে ভাসছে
শরীরে হুল ফুটানো ভারি মাত্রার বরফ কুচি
জীবনের উচ্ছাসে ভরপুর পুরো শহরটাই যেন
জনমানবহীন এক ভুতুড়ে নগর।
অবোধ মৌনতা আর নিঃসঙ্গতা নিয়ে কেটে যাচ্ছে
এখানে আমার প্রতিটি প্রহর।
কত বছর দেখিনা জোছনায় প্লাবিত নদী,
শান্ত শীতল পূবালী বাতাসে পাল তোলা নাও,
শরতের খোলা আকাশ, ফাগুনের মৃদু মন্দ বাতাসে
হাল্কা কুয়াশা ভেজা শান্ত ভোর-শিশির ভেজা হলদে সর্ষে ফুল!!
নিঃস্ব জীবনে একাকীত্বের পাহাড় ভেদ করে খুব
শুনতে ইচ্ছে করে উদাসী ঢেউয়ে নাইয়ার বাঁশির সুর !!
ফায়ারপ্লেসের গনগনে আগুন বাড়ির নিস্তব্ধতা
আরও বেশী বাড়িয়ে শুধু তোমাকেই ভাবায়--
বিশ্বাস করবে কি, চোখ বুজলে এখনো স্পর্শ পাই
কপালে এঁকে দেওয়া তোমার মমতা ভালবাসায় সিক্ত উষ্ণ চুম্বন
!!
প্রিয়তম, তুমি শুধু তুমি...নতুন করে..ভোরের প্রথম রোদে
চিকচিক করে উঠবে তোমার মুখ--
শীতের ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠার মিষ্টি সুবাসে তোমাকে আমন্ত্রণ
আসবে কি বহু প্রতীক্ষার প্রহর শেষে ?
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে তোমায় জড়িয়ে
একবার সুখের কান্না কাঁদতাম !!
শুধু একটিবার তোমাকে জড়িয়ে ধরার
অদ্ভুত এক আক্ষেপ নিয়ে অপেক্ষায় আছি...
একবার আমাকে জড়িয়ে ধরো...তুমিই যে আমার সমর্পণ ।।
বহুদূরের তুমি –আমি
বসে ভাবি চুপচাপ প্রতিদিন —
হয়তো কোথাও একইভাবে বয়ে যাচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস ,
ভেসে যাচ্ছে মেঘ তোমার শহরেও ;
কোন এক বারান্দার দড়িতে ক্লিপে আটকানো
তোমার গায়ের গন্ধ মাখানো হাফ হাতা সাদা টি শার্ট;
আর এখানে পুড়ে
যাচ্ছি আমি
তোমার গোপন-গভীর প্রণয়ের তাপে ।।
বসে ভাবি চুপচাপ প্রতিক্ষণ —
কি করে বেয়াড়া স্বপ্নগুলো বাড়ন্ত হয়ে উঠে
উঁচু দালানের কার্নিশ আর কনক্রিটের দেয়াল বেয়ে;
কিভাবে আবেগের জোয়ারে-পিছুটান যায় ভেসে;
কতবার তোমার চিবুক স্পর্শ করি কল্পনায়-হাত ধরি স্বপ্নে;
সবকিছু ছাপিয়ে তোমার মুখ--স্বস্তি আনে মনে ।।
হঠাত যেন নিশুতি রাতের শব্দহীনতায় সম্বিত ফিরে পাই
পাপপুণ্যের উষ্ণতায় হাতড়ে বেড়াই অবোধের মত
সব শেষ যা বুঝতে পারি বহুদূরের মানুষ তুমি- বহুদূরের আমি-
আর সেটা সহজে মেনে নিতে গিয়ে ভেঙে যাই,
নিজেকে জোড়া লাগাই, আবার ভেঙে ..!!
কি করে বিষন্ন হই
আবিষ্কারের মাতাল নেশায়
আংগুলের কড়ায় দিন গোনা সময়--
ত্রিশ দিন, নব্বই দিন
তিন শত পঁয়ষট্টি দিনও শেষ হয়...অপেক্ষার।
কুরুশ কাঁটায় বাতাসে স্বপ্ন বুনন
কর্ণের মতো জন্মের ভুলে
বুকের ভেতর অনাবিস্কৃত নীল হ্রদ --ভীষণ কৌতুহলে উঁকি দেয়
নূহের প্লাবনে ডুবে যাওয়ার অভিপ্রায়ে,
কি করে বিষন্ন হই!!
কোথাও নেই কেউ
-----------------
কেমন আছো
হীমশিতলতা গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে প্রান্তর জুড়ে হু হু বয়ে
যায়
জেগে থেকে জোছনারাও ক্লান্ত
কেবল আমি, কেবল আমিই সারারাত
গভীরের গভীরতর অনুভব গুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে
বসে আছি নদীটির তীর ধরে।।
তারা জ্বলা আকাশ
জুড়ে রাত পাখির হাহাকার
স্বপ্ন খুলে মাপি অাহত স্মৃতি গুলো নিজেরে চিতায় রেখে
সময়ের মায়াজালে শৃঙ্খলিত চাপা নীরবতা
ভাবনাদের ভীড়ে জল টলমল চোখ
নিশ্চুপ সন্ধ্যায় নির্লিপ্ত দৃষ্টি চেনা শহর ছাড়িয়ে
দূর বহুদূরের কোন এক শহরে কুয়াশা ভেজা ভোর ছুঁয়ে
জানতে চায়---কেমন আছো তুমি?
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, মাস থেকে বছর, বছর থেকে যুগ
ভ্রান্তির ঘেরা কারাগারে ভাষাহীন, আদিম এক বোবা গর্জন
ঝরা পাতাদের মাড়িয়ে নিশাচর বিড়ালের ছন্দ
নিস্তব্ধ মাঝ রাতে দেয়াল ঘড়ির টিক্ টিক্
গুমোট বাতাসে ছুটে চলা ট্রেনের শব্দ
আহ! সময় কেটে যায়- কি নিদারুণ নিশ্চুপ !
স্থির দাঁড়িয়ে চলমান পরিবর্তনের সাক্ষী
চমকে ওঠা স্পর্শিত শিহরনে উথাল পাথাল ঢেউ
ডুবিয়ে মনের বালিয়াড়ি থৈ থৈ গোপন নদীর জল
কোথাও নেই যেন কেউ !!