সৌরভ মজুমদার
প্রণাম নারী
আমি যখন ছোট ছিলাম,
দোতলা বাস ওপরতলায়, জানলার ধার প্রথম সারি
মামার বাড়ির পথে তুমি আমার সাথে, বোনের সাথেও, মা’গো আমার -
প্রণাম নারী ।
প্রথম স্কূল এ ভর্তি হলাম,
নিত্ত যাওয়ার ইচ্ছে এবং সাহস দিলে
মাতৃভাষায় হাল ধরেছ, এল্জেব্রার পাঠেও তুমি ছিলে আমার পাশেই, মা’গো -
প্রণাম নারী ।
মামার বাড়ি পৌঁছে গিয়ে
মনের জমা দামালপনা আগল খুলে বাইরে এলে,
তুমিই তো দুহাত দিয়ে আগলে ছিলে সবার প্রথম,
পরম স্নেহে মাইমা আমার,
প্রণাম নারী ।
স্কূল থেকে রোজ ফেরার পথে,
শেষ বিকেলে সঙ্গী হতেন আমার হাঁটার,
মাটির পাহাড় পেরিয়ে এসে বড় রাস্তা পার করিয়ে
গলির ভেতর পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিতেন, কাবেরী ম্যাম,
প্রণাম নারী ।
যখন বড় দাদার সাথে
ঘুরে বেড়াই হাটে বাটে, গান্ধীঘাটে
ঘরে ফিরতেই তোমার আদর,
মাটির দাওয়ায় সরাপীঠে, অপার শান্তি, মাসীমণি,
প্রণাম নারী ।
স্কূল থেকে রোজ বাড়ী ফিরে
হাতপা ধুতে কুয়োপাড়ের তোলা জলে, কাচা জামায় তোমার পরশ
খেলনাগুলো হারিয়ে গেলে খুঁজে আনা ঝগড়া করে,
মায়ের বকা আড়াল করায় তুমিই ছিলে, আলোদিদি,
প্রণাম নারী ।
বড় মামা চলে গেলে
ছোট্ট দুই দাদার সাথে আর এক দিদি বড় হল তোমার ছায়ায়
শক্ত হয়ে পা ফেলতে
তুমিই প্রথম শিখিয়েছিলে, বড়মাইমা,
প্রণাম নারী ।
বই এর পড়ার পাঠের সাথেই,
বোনের নাচে পায়েখড়ি তোমার কাছে,
তুমিই পরে মাকে আমার বলেছিলে,
ছেলে আপনার গানটা শিখুক, পিয়ালীদি,
প্রণাম নারী ।
একটু বড় হতেই আমি দেখেছিলাম
পাড়ি দিতে, সদ্য পড়াশেষের পরে
নিজের চাওয়া ভাসিয়ে দিয়ে, ইস্স্পাতের শহরে এক
ইস্পাতের-ই কঠিনতায়, বড়দি আমার,
প্রণাম নারী ।
ছোটদি আমার শান্ত বড়,
চুপটি ক’রে কাজের ভিড়ে হারিয়ে যেত হাশিমুখে,
যার প্রেরণায় প্রথম আলাপ গুহবাবুর লেখার সাথে,
মিষ্টি ছোড়দিভাইরে আমার, ঋণী আমি,
প্রণাম নারী ।
আমার ছোট্ট বোনের দলে,
বৌদিদির বা অন্য ঘরে, লড়াই কারো শেষ হয়েছে
কেউ এখনও লড়েই চলে নিজের সঙ্গে এবং বাইরে,
অশ্রুগল্প লুকিয়ে রেখে অনেক ব্যথায় দীর্ণ হয়ে,
প্রণাম নারী ।
আমি যখন বাবা হলাম,
পরিজনের ভিড়েই কখন হারিয়ে গিয়ে, কষ্টরাতের
ওপার থেকে ভোরের আলোয় আমার সুজন
সহযাত্রীনী আর প্রতিদিনের খেলার সাথী -
মুহূর্তে এক পিতার ভিতর পুত্র যেন বলে ওঠে,
মা’গো আমি তোমায় নমি
-
প্রণাম নারী ।।
বড়দা কে…
যুগান্তরের পথে যখন
প্রাণের নতুন আলোকরেখা,
স্বপ্ন দোলায় ভেসে ভেসে,
একশ হাজার প্রিয়জনের
নতুন রূপেই ফিরে আসা ।
কল্পনা আর সরোজ বাবুর
সৃষ্টিপথের সকল যাত্রী,
সময় নিয়ে পাশ ফিরেছে,
দিন হয়েছে অমল ধাত্রী ।
মোহন বাঁশির করুণ সুরে
ইমন কিম্বা দেশ এর বিস্তার,
ঐশী আবেশ ছড়িয়ে দিল
জলছবি ও সময়ের পার ।
গহন কালো নষ্ট দিনের
এই সময়ের কষ্টিপাথর,
স্বপ্নত্যাগীর মুঠোয় ধরা
কান্নাধূসর সোনার আকর ।।
--------------------------------------------------------------------------------
যে কথা হচ্ছিল…
যে কথা হচ্ছিল…
উৎসবের কথা, মিলনের কথা
আনন্দের আর আড্ডার কথা ।
যে কথা হচ্ছিল…
বিরহের কথা, প্রেমের কথা,
কুড়িয়ে পাওয়া গতকালের কথা ।
যে কথা হচ্ছিল…
পৌছনোর কথা, গন্তব্যর কথা
গতির কথা, যতির কথা ।
যে কথা হচ্ছিল…
জীবনের কথা, পদ্যর কথা
ছন্দের কথা, ছবির কথা ।
আজকের অবসরে যে কথা হয়নি…
হয়তবা কেউ ফিরে আসেনি
অনেকেই ঘুমায়নি ভালবেসে রাত্রিকে -
যাপন পথের সে অস্ফুট সংবেদ
গাঁথা হবে সংরাগে, কালকের লেখনী ।।
--------------------------------------------------------------------------
ভালবাসা অভিযান
অন্ধকারের ডানায় ভর দিয়ে একশো জোনাকির সাথে উড়ে উড়ে
খুঁটে খুঁটে এক একটা পায়রাজীবন, জলখেলার পানকৌড়ি জীবন,
খানিকটা হরিণজীবন কুড়িয়ে, শেষ না হওয়া শ্রমণের রাতে এসে দাঁড়াই
মানুষজীবনে একবার। ভেঙে পরা আপাদনখশির আমার সবটুকু আমিত্ব জড়িয়ে –
সে অঝোর ভাঙনের মুখে, তোমার নিবিড় হেঁটে আসা । ধীর পায়ে
ভালবাসা অভিযান । গভীর মমতায় আঁজলা ভ’রে আনা অতল রাত্রির
আলতো শব্দের মত । কবেকার পুরনো ট্রাক্টরের ক্ষীণ আওয়াজে মিশে -
রাতকর্ষণের । আদিগন্ত চৌচির মনজমির আলপথ ছুঁয়ে ছুঁয়ে । আশ্লেষে ।
এরপর আমাদের কত কত হাঁসজন্মের পর এসেছে বিকেল আবার, নেমেছে
সন্ধ্যা । পাকে পাকে শহরের বুদবুদ তোলা জানলা, কদমগাছ, রেল লাইনের
আগ্নেয় পাথর, ফায়ার ব্রিগেড, অনুবর্তী হয়েছে এখন তোমার । আকাশ যাপনের ।
তবু আমি একা নই আর । তারাঝরা নিকনো উঠোনের বিন্যাসে, তুমিও যে -
নেমে এলে শেষে । তারপর - হ’লে নভোচারী ।
আবহমান ভালবেসে ।
-------------------------------------------------------------------------------
কথাশেষ ! আনোয়ার এর...
দিন চলে যায় অন্য দিনের মতো
রাস্তা চলে সোজা কিম্বা বেঁকে
সময় বুঝে কখনো ভার বাড়ে
আবার কখন হালকা হওয়ার ফাঁকে ।
আমি যে আজ পড়েই আছি পথে
ধীরে ধীরে চেতন যাচ্ছে থেমে
স্রোতের মত রক্ত ধারাপাতে -
সবার মাঝে - ওগো মানুষ দল,
একটু এসে হাতটা নেবে হাতে !
দেখছি আমি তলিয়ে যেতে যেতে
হাতটা তোমার নিচ্ছে মুঠোয় ফোন
তুলে রাখছে একের পর এক দৃশ্য
আমার সদ্য দুর্ঘটনার ভাষ্য ।
সামনে ঘটা রক্ত ধারার বন্যা -
এসডি কার্ডে চটজলদি বন্দী
জাহান্নামে যায় যদি যাক অন্যে
বয়েই গেছে ভাবতে প্রাণের জন্যে ।
ওগো মানুষ, প্রাণের মানুষ -
বলো দেখি মানুষ কবে হবো !
জীবন চাওয়া শুকনো মানুষ,
অন্যদেশে আবার কবে যাব !
মানুষমৃত্যু গা সয়েছে, স্মার্ট হয়েছি -
মৃত্যু, হাতের তালুর মতই চিনি ।
আলতো ছোঁয়ায় মানুষ মারি,
স্পর্শ দিয়েই মৃত্যু ধরতে পারি - অনেকখানি ।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
১লা
ফেব্রুয়ারী ২০১৭, বুধবার, এই মহাভারতের এক শহরের রাস্তায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত ১৮/১৯ বছর বয়সী যে আনোয়ার আলী, পথচলতি মানুষ নিজেদের মুঠোফোনে যার ছবি তোলার ফাঁকে, অমৃতলোকে পাড়ি দিল সবার চোখের সামনেই – তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে -
------------------------------------------------------------------------------------------------------
সৌরভ ৩রা ফেব্রুয়ারী ২০১৭ * পাটনা
------------------------------------------------------------------------------------------------------