কালের লিখন
শূন্যভিটা
দুটো প্রকাণ্ড
পুরনো টিনের ঘর;
অবিন্যস্ত
গাছপালা, চারপাশে সবুজ!
একটা খড়েরগাঁদাও
দাঁড়িয়ে আছে অবুঝ।
সবুজঘেরা শূন্য
একটা ভিটা!
কোথাও তার ধান
নেই, পড়ে আছে চিটা!
যারা এই ভিটায়
জন্মেছে,
হয়েছে সোনার ধান, জীবনের টান-
তাদের উড়িয়ে
নিয়ে গেছে অন্য জনপদে!
এখনও তাই রাত
হলে এই ভিটা একাকী কাঁদে!
তিনপ্রজন্ম
উধাও! পাশের গ্রামের নদী;
এখনো সচল আছে, বয়ে যাচ্ছে নিরবধি!
কিন্তু এই বাড়ির
উঠোনে আর
সন্ধ্যা হলে
জ্বলে না বাতি,
এই ভিটায় কোলাহল
এখন শুধুই স্মৃতি!
এখানে আর শিশুর
হইচই নেই
হাঁস-মুরগীর
লম্ফঝম্ফ নেই
নেই গৃহিণীর
ব্যস্ততা কোথাও;
বাতাসে নেই
খাবারের সুঘ্রাণ!
এই ভিটা এখনো
সজাগ, শুধু ভিতরে নেই প্রাণ!
পেয়ারা গাছের
কচি ডাল,
এখনো বড়বেশি
সঙ্গ কাঙাল!
দীর্ঘদিন পায় না
মানুষের হাতের স্পর্শ!
উঠোনের
উর্বরমাটি ভুলে গেছে উৎকর্ষ!
জানলার শিকে
ধরেছে সময়ের মরীচিকা!
মেঝেতে
বাস্তুসাপ, ইঁদুরের উপদ্রপ; অচল চাকা...
কল'তলায় দীর্ঘদিন নেই জলের ছোঁয়া;
ঝরা'পাতা জমে, মরে গেছে আয়না কুয়া।
এখানে আদরের
জীবন্ত'রঙ নেই কোথাও,
শুধু সবুজ আছে, অযত্নের অবুঝ সবুজ!
শেকড় জানে যদিও
পত্র-লতার খোঁজ;
তবুও যারা চলে
যায়, ফিরে আসে না রোজ!
পাখির চেয়েও মানুষ
বড় পরিযায়ী;
মানুষ মাত্রই
আমৃত্যু দায়হীন দায়ী।
মানুষ মুহূর্তকে
বরণ করে স্মৃতি নিয়ে বাঁচে!
মানুষ স্পর্শ না
করেও পুড়তে চায়, পুরনো আঁচে।
মানুষ শেকড়
বিশ্বাস করেও ছিঁড়ে ফেলে,
মানুষ স্থায়ী নয়, ফিরেও আসে না একবার গেলে।
মানুষ ভুলে
গেলেও ভিটা ঠিক মনে রাখে,
সে প্রতিদিন
প্রতিমুহূর্ত শূন্যতার ছবি আঁকে।
দরজা চায়- কেউ
ছিটকিনি তুলে দিক নরম হাতে!
উঠোন চায়-
পারিবারিক গল্পের আসর জমুক রাতে।
গাছ চায়- ছায়ায়
তার, দাঁড়াক কেউ এসে,
মাটি চায়- তার
সাথে কেউ খেলুক ভালোবেসে।
বৃষ্টি এলে এখনো
ভাবে টিনের চালা,
কোনোএক কিশোরীর
হোক কান ঝালাপালা!
বড়কর্তার ডাক
আসুক গম্ভীর গলায়,
রাস্তায় কে ওটা? কে হেঁটে যায়?
বহুবিধ
প্রতীক্ষায় নানামুখী আয়োজন;
এসব ডাক উপেক্ষা
করেই মানুষের পরিভ্রমণ!
মানুষ হাঁটে, দৌড়ায় ঘাট থেকে ঘাটে
মানুষ ছোটে পথ
থেকে পথেপথে
মানুষের চলাচল
দেশ থেকে দেশ,
মানুষের ভাগফল
আছে, অনির্দিষ্ট অবশেষ!
মানুষের
যাপনবিলাস শহর থেকে শহরে!
মানুষ নতুন
আশ্রয় খোঁজে প্রহর থেকে প্রহরে!
বসতি গড়ে এখানে
ওখানে সুবিধেমতো;
মানুষের বুকে
লুকানো থাকে বাস্তুভিটার ক্ষত।
শূন্য ভিটেরা
আরও শূন্য হয় থমকে তাকায়;
যাপনের ধুলো
জমেছে তার সময়চিত্র আঁকায়!
ফাঁক গলে যায়
ক্ষণরোদ; হৃদয় করে খাঁখাঁ!
মানুষ কোথায়? শূন্যভিটা দাঁড়িয়ে আছে একা!
এপ্রিল- ২০১৭
রেলস্টেশনে
ঝুমার সাথে দেখা
রেলস্টেশনে।
আশেপাশে ফল'দোকানে ফল;
অজস্র মানুষের
এলোমেলো কোলাহল।
এক'দেখাতেই আমি চিনে গেছি
সেই চোখ, বড়বড় করে তাকানো।
মুহূর্তে শুরু
হলো স্মৃতির উঠোন নিকানো।
আমার গাড়ি
এগারোটা তিরিশ
ইচ্ছে করলো
আড়ালে দাঁড়িয়ে
ফস করে একটা
সিগারেট জ্বালাই!
নিজেকে ধাতস্থ
করার একটু সময় চাই!
আবার মনে হলো-
না যাই,
পায়েপায়ে ঝুমার
কাছে এগিয়ে যাই!
সুদীর্ঘদিনের
সেই চিরচেনা মুখ
একমনে আবাদ করা
অজস্র মুহূর্ত!
সিগারেট ছুঁড়েফেলে
এগিয়ে গেলাম...
ঝুমা!
আমার ডাক শুনে
ফিরে তাকালো,
চোখেমুখে
বিস্ময়!
সাথে ফুটফুটে
ছোট্ট একটি মেয়ে,
এক নিপাট
ভদ্রলোক অদূরে।
মেয়েকে ডেকে
বললো- উমা!
দেখো-দেখো!
তোমার বিপ্লব মামা!
এপ্রিল- ২০১৭
নিঃস্ব
নদীর কাছে গেলে
নিজেকে ছোট মনেহয়,
ছোট মনেহয় বিশাল
আকাশতলে দাঁড়ালেও।
সমুদ্রের
বিশালতা মনে করিয়ে দেয় ক্ষুদ্রতা,
আমি ক্ষুদ্র হয়ে
যাই রবীন্দ্রনাথের কাছেও!
শুধু তোমার কাছে
গেলেই আমি তৃণ থেকে বৃক্ষ!
তোমার কাছে
গেলেই আমি আলোকিত কৃষ্ণপক্ষ।
জলের কাছে গেলে
নিজেকে ছোট মনেহয়;
ছোট মনেহয় সংসদ
ভবনের সামনে দাঁড়ালেও!
অসময়ের মাতাল
বাতাসের কাছে ক্ষুদ্র আমি,
নুয়ে যাই
বাল্যশিক্ষক হারু মিয়ার কাছেও!
শুধু তোমার কাছে
গেলেই আমি ভুল থেকে ফুল!
তোমার কাছেই
জীবন নাচে, তুমুল হুলুস্থুল!
ছায়ার কাছে গেলে
নিজেকে ছোট মনেহয়;
ছোট মনেহয়
সূর্যরোদের উষ্ণতায় দাঁড়ালেও!
মহাশূন্যের
বিশালতা মনে করিয়ে দেয় ক্ষুদ্রতা,
আমি ক্ষুদ্র হয়ে
যাই আকাশতত্ত্বের কাছেও!
শুধু তোমার কাছে
গেলে, আমি নিজেই মহাবিশ্ব!
সবটা দিয়ে কাঙাল
আমি, পৃথিবীর মতো নিঃস্ব!
এপ্রিল- ২০১৭
বই কেনা
যখন তুমি একটি
বই কিনে নাও,
তুমি সেই বইয়ের
গল্প'কবিতার চেয়েও
আরও বেশি কিছু কিনে
নিচ্ছো।
তুমি কিনে
নিচ্ছো লেখকের ভুলত্রুটি সংশোধন
বা সম্পাদনার
অনেক সময়।
তুমি কিনে
নিচ্ছো একজন লেখকের
নৈমিত্তিক
সাবলীল তাল ও লয়।
তুমি কিনে
নিচ্ছো লেখকের নির্মল আনন্দ;
তুমি কিনে
নিচ্ছো লেখকের সমুদয় বেদনা!
তোমার হয়ে
যাচ্ছে লেখকের হতাশা ও দীপ্তি।
বইয়ের সাথে
পাচ্ছো তুমি অজস্র প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি।
যখন তুমি একটি
বই কিনে নাও,
তুমি সেই বইয়ের
গল্প কবিতার চেয়েও
আরও অধিক কিছু
পেয়ে যাচ্ছো।
তুমি পাচ্ছো
একজন লেখকের ভাবনার স্ফুরণ,
তোমার হয়ে
যাচ্ছে একজন লেখকের নিজস্ব চেতনা।
একটা বই কেনা
মানেই তোমার সামনে আরেক তুমির দ্যোতনা।
তুমি শুধু একটি
বইই কিনছো না,
ভাগাভাগি করা
যায় এমন কিছু মুহূর্তও কিনে নিচ্ছো।
একজন লেখকের
হৃদয়ের একটি অংশ হয়ে যাচ্ছে তোমার;
একজন মানুষের
সমগ্র জীবনের একটি অংশ তুমি কিনে নিচ্ছো!
তোমার বিনিময়
মূল্যের সামান্যকিছু অর্থ এসবের কাছে তুচ্ছ!
এপ্রিল- ২০১৭
সস্তা-রাস্তা
ট্রেনের নিচে
ঝাঁপদিয়ে বাপ-বেটির আত্মহত্যা;
এই সংবাদ আজকেই
এদিকওদিক গড়াচ্ছে
আগামিকাল সবাই
ভুলে যাবে;
যেভাবে ভুলে
গিয়েছিলো থানার বড়কর্তা
বাপের আর্জি
আমলে না নিয়ে
দিয়েছিলো
গ্রাম্যশালিসির বার্তা।
হতভাগা বাপের
পাশে দাঁড়ায়নি থানা।
দাঁড়ায়নি
প্রতিবেশী, সমাজ, বা রাষ্ট্র!
বিচার যখন
বাপ-বেটির কাছে প্রহসন;
রাষ্ট্রীয় ছায়া
যখন চরমভাবে দুষ্প্রাপ্য;
নাগরিক অধিকার
যখন হাস্যকর;
চারিধার
হাহাকার!
তখন ওভাবে মরে
যাওয়া ছাড়া উপায় কী আর!
ওরা মরে গিয়ে
বেঁচে গেছে;
মেয়েটা হয়তো
একদিন ধর্ষিত হয়ে
এমনিতেই মরে
যেতো;
অনাহারক্লিষ্ট
দরিদ্রপিতার ভবিতব্য
খুব সহজেই
অনুমেয়!
হে হতভাগ্য
পিতা! হে ভয়ার্ত কন্যা!
তোমরা আরেকবার
জন্ম নিও!
তবে এদেশে নয়; এখানে মানুষ বড়ো সস্তা;
এখানে প্রহসনের
ধাক্কায় আত্মহত্যাই রাস্তা!
এপ্রিল- ২০১৭