কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। ‘কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে,
এই নিয়ে কোন সংশয়ের
অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতায় থাকতে
ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই
উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক
পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে
প্রভাবিত করে।
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: বাংলার জনজীবনে কবিতার যে বিপুল প্রভাব
তা বোঝা যায় আমার নিজের দিকে তাকালেই। মানে আমি যে কবিতা লিখি, সেটা বোধহয় এই প্রভাব থেকেই। আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িগুলোতে যে
লেখাপড়ার চল, সেখান থেকেই তো শিল্পের প্রতি অনুরাগ
জন্মায়।
কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা
প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন? অর্থাৎ
জানতে চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই
এটি একটি সামাজিক হুজুগ, সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায়
হিসাবে।
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এইখানেই আসে গভীর হবার কথা। অনেক সময় আমাদের কাব্যচর্চা
সিরিয়াস জায়গায় যায় না। আমরা আটকে থাকি আবেগ নিয়ে। কবিতার অন্যদিকগুলো দেখা হয়ে
ওঠে না। এর সঙ্গে অবশ্যই সামাজিক পরিচিতি পাওয়ার একটা সচেতন প্রচেষ্টা আছে। কিন্তু
কবিতা লিখে একজন মানুষ ৩০ দশকে যে সামাজিক পরিচিতি পেতেন সেটা এখন আর পাওয়া যাবে
না। তার একটা প্রধান কারণ এই অতিরিক্ত লেখা। আমরা পড়ি কম লিখি বেশি। তার ফলে কেউই
তাঁর প্রাপ্য গুরুত্ব পান না । আমার ধারণা এটা কমে যাবে। আরও ২০/৩০ বছর পর
প্রযুক্তির কী চেহারা হবে জানি না, কিন্তু এই হুজুগ কমে যাবে বলেই মনে হয়।
কবিতাউৎসব: কাব্যচর্চা বলতে আপনি
কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না
কি মনে করেন কবিতারও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? সামাজিক
দায়বদ্ধতার নিরিখে,একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা
জরুরী বলে মনে হয় আপনার?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমরা এমন এক সময়ে বাস করি
যেখানে কবি চাইলেও সামাজিক হতে পারবে না। ধরা যাক পাবলো নেরুদা। তিনি খনি
শ্রমিকদের জন্য কবিতা লিখেছেন, শুনিয়েছেন তাঁদের। এখন কি সেটা সম্ভব? নয়। কারণ সেই শ্রমিকের অন্য বিনোদন আছে। কবিতা মোটের ওপর মধ্য
ও উচ্চ-মধ্যবিত্তেরই সম্পদ (যদি পাঠক হিসেবে দেখা যায়)। একজন ব্যতিক্রমী নিশ্চয়
থাকবেন কিন্তু তা ব্যতিক্রমই। তবে তার মানে এই নয় যে কবিতার কোনও সামাজিক দায় নেই।
কবিতা লিখে বা পড়ে কিছুই বদলায় না। শুধু যিনি কবিতার স্পর্শে আছেন তিনি দুনিয়াকে
একটু অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করেন। কোথাও এই বিপুল কর্মকাণ্ডের পৃথিবীতে তিনি একটু
উদাস থাকতে পারেন। কবিতার সমাজচেতনা তার লেখকের সমাজচেতনা। একজন কবি তাঁর সময়কে কি
করে অন্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন সেটা এক মস্ত কাজ। সেখানেই তাঁর বিষয়
নির্বাচন ও নির্মাণ। তবে উচ্চকিত কবিতা বেশিদূর যায় না। সময় ফুরোলে সে কবিতা পিছনে
পড়ে থাকে।
কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার
প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে এই কথাও মনে হয় না কি, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে
বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে? এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক
উৎকর্ষতাও?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: আগের উত্তরের রেশ ধরে বলি,
নির্দিষ্ট রাজনৈতিক
বা অন্যকোনও মতাদর্শ যদি সরাসরি কবিতাকে প্রভাবিত করে তাহলে সে আদর্শ কোনও কারণে
মুছে গেলে কবিতাও মুছে যায়। শিল্পের কাজ উইশফুল থিংকিং নয়, বরং সত্যের কাছাকাছি থাকা। কবির রাজনৈতিক আদর্শ তাঁকে সেই
সত্যকে দেখার চোখ তৈরি করে দেয়।
কবিতাউৎসব: কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে
বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে
প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এটাও খানিকটা ওই রাজনৈতিক মতের কাছাকাছি। অতিরিক্ত দেশপ্রেম
কখনই সত্যের কাছে যায় না। আবার নিজের দেশকাল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে সে
লেখা দাঁড়ায় না। কবিকে নিজের দেশের কাছে ফিরতেই হয়, সেই
ফেরা সত্যনিষ্ঠ হওয়া দরকার। সত্যনিষ্ঠ হলে বোধহয় বিশ্ববোধের বাহ্যিক দায়টা থাকে না।
কবিতাউৎসব: যে কোন ভাষার
সাহিত্যিক সমৃদ্ধি অনেকাংশেই নির্ভর করে, সেই ভাষায় অন্যান্য ভাষার সাহিত্য কি
পরিমাণে অনুদিত হচ্ছে; তার উপর। আপনি নিজে এই মতে কতটা
বিশ্বাসী?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: একদম ঠিক কথা। অনুবাদ এক জরুরি বিষয়। সাংস্কৃতিক গুরুত্বের
কথা তো আমরা জানি, তাছাড়াও নিজের ভাষার অব্যবহৃত
শব্দভাণ্ডারের কাছে পৌঁছনোর এক অব্যর্থ রাস্তা অনুবাদ।
কবিতাউৎসব: আমাদের বাংলায় অনুবাদ
সাহিত্যের পরিসরটি আজো যে যথাযথ ভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি তার কারণগুলি কি কি বলে
আপনার মনে হয়? এই প্রসঙ্গে এই কথা কি মনে করা যেতে
পারে, ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যবাহী বাঙালির ইংরাজী
ভাষার ওপর একান্ত পরনির্ভরতাও এর অন্যতম প্রধান কারণ?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এই প্রসঙ্গে দুটি
বিষয় মাথায় রাখা দরকার। বাংলায় অনুবাদ হওয়া অনেক বই কিন্তু আমাদের চেতনায় রয়ে
গেছে। দেখা যাবে মফস্বলের লাইব্রেরিতে অনুবাদ হওয়া বইয়ের যথেষ্ট চাহিদা। কিন্তু সে
সব বইই বেস্টসেলার গোত্রের। কিন্তু
শহরাঞ্চলে সে চাহিদা কম, ইংরেজি শিক্ষিত পাঠক ইংরেজিতে পড়তে
পছন্দ করেন। এর পিছনে হয়ত খানিকটা বাংলায় হওয়া অনুবাদের প্রতি অনাস্থা, খানিকটা নিজের পছন্দের বই অনুবাদে না পাওয়া। দুটোই কাজ করে।
বাংলায় “লিটেরারি উপন্যাস” বা কবিতা কম অনুবাদ হয়। আর মূল ভাষা সঙ্গে যোগ না থাকায় সে
দূরত্ব আরও বাড়ছে।
কবিতাউৎসব: আপনি নিজে দীর্ঘদিন ভাষাচর্চার সাথে যুক্ত।
আমাদের দেশে ভাষাচর্চার সামগ্রিক পরিস্থিতি ও পরিসর সম্বন্ধে আপনার মূল্যায়ন কি? এই বিষয়টি আমাদের কাছে এই কারণেই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যে, ভাষাচর্চার বিস্তার আর অনুবাদ সাহিত্যের সমৃদ্ধি পরস্পর
সম্পর্কিত। ভাষাচর্চার জন্যে যে উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন, আমাদের রাজ্যে বর্তমানে সেই পরিকাঠামো কতটা উন্নত বলে মনে করেন
আপনি?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এই প্রশ্নটা ভীষণ সময়োপযোগী। না আমাদের রাজ্যে ভাষা শিক্ষার
আধুনিক পরিকাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। জার্মান, রুশ, ফরাসী ও জাপানি ভাষা শেখার কাঠামো থাকলেও অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের ভাষা যেমন স্প্যানিশ বা ইতালীয় ভাষা পরিকাঠামো বেশ দুর্বল, প্রায় না থাকার মত। এদিকে আমাদের মন দেওয়া উচিত। কিন্তু
শিল্প-বানিজ্য না থাকলে সে পরিকাঠামো উন্নত হবে না।
কবিতাউৎসব: এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় জানতে চাইবো
আপনার কাছে, আমরা দেখেছি, বিশেষত ইউরোপীয় ভাষাগুলির ক্ষেত্রে আমাদের এখানে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাষাগুলি সেখানো হয় ইংরাজীর মাধ্যমে। এক
জন বাঙালি শিক্ষার্থীর প্রেক্ষিতে বিষয়টি কতটা অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করেন আপনি। আমরা
জানি, ইউরোপের দেশগুলিতে বিভিন্ন ভাষাগুলি
শেখানোর মাধ্যম হিসাবে ইংরাজীর প্রচলন নাই। একমাত্র গ্রেট বৃটেন ছাড়া। কিন্তু আমরা
তো আর ইংরাজ বা বৃটিশ নই, তাহলে অন্যান্য ইউরোপীও ভাষা শিখতে গেলে
একজন বাঙালি শিক্ষার্থীকে কেন আগে ইংরাজী জানতে হবে? এই
যে ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক পরাধীনতা, এই বিষয়টি ঠিক কি ভাবে আলোড়িত করে
আপনাকে?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: আধুনিক ভাষাশিক্ষায় মাধ্যম হিসেবে অন্য ভাষার ব্যবহার হয় না।
ক্লাসের প্রথম দিন থেকেই সরাসরি শেখানো হয়। ফলে অন্য ভাষা জানার দরকার পড়ে না।
কলকাতায় ফরাসী জার্মান, রুশ,
ফরাসী ও জাপানি ভাষা
সেভাবেই শেখানো হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি পাঠশালায়। যে ভাষা শেখানোর কাঠামো নেই সেখানেই
১৯ শতকের ব্যাকরণ-অনুবাদ পদ্ধতিতে শেখানো হয়।
কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা
কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের
সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে
থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার
দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে
হাজির করতে পারছে। এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে। এত বিপুল
পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত
কবিতা। এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এ এক জটিল বৃত্ত। কবিতার গণতন্ত্রীকরণ হয়েছে ইন্টারনেট এ।
কবিতার পাঠক বেড়েছে বলেই মনে হয়। আমি নিজে কৌরব অনলাইন সম্পাদনার ক্ষেত্রে দেখতে
পাই সেটা। আর বাজে কবিতার ভিড় যদি বাড়ে তাতে কী ক্ষতি। সময় নিজের নিয়মেই ছেঁটে
নেবে সবকিছু। সিরিয়াস কবিতা চর্চা আরেকটু বাড়লে ভাল হয়।
কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে
মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন
প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে। যেমন ধরা যাক
ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের
দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
বাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে
সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা, রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের ক্রমাগত
ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে
দিতে পারে কি? বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে
বলে মনে করনে আপনি?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: খুব কঠিন প্রশ্ন। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলন
যতটা প্রভাব ফেলেছে আমাদের নকশাল আন্দোলন কি সেভাবে প্রভাব ফেলেছে? থীমা প্রকাশনীর নকশাল পর্বের কবিতা সংকলনটা দেখলে বোঝা যায়।
বাংলা কবিতা সামাজিক কবিতা থেকে বহুদিন বেরিয়ে গেছে। তবে ক্ষমতার সঙ্গে থাকাটা তো
বাঙালি কবিদের অনেকদিনের অভ্যেস। তা থেকে বাংলা কবিতার বিরাট কিছু তফাৎ হয়েছে বলে
মনে হয় না। আমাদের সমাজে যেহেতু এখনও কবির একটা সামাজিক চাহিদা আছে, তাই এই ক্ষমতার খেলা চলতেই থাকবে যতদিন না কবির সেলিব্রিটি
স্টেটাস যাবে। আমার চেনা স্পেনে এটা একেবারেই হয় না। সেখানে কবির সামাজিক ভূমিকা
খবরের কাগজে কোনও প্রবন্ধ লেখা অব্দি। কবির ভূমিকা বিরোধী দলের। আমি নিজে এই মতে
বিশ্বাস করি। সামাজিক উপাদান কবিতার কতটা কাজে লাগবে সেটা কবিই ঠিক করে
নেবেন। তবে হ্যাঁ সামাজিক অস্থিরতা যদি কবিতার বিরাট উদ্দীপক হত তাহলে লাতিন
আমেরিকায় শুধুই বিদ্রোহী কবিতা লেখা হত, তাহলে আমরা অনেক বড় কবিকে পেতাম না। বা
আফগানিস্তানে দুনিয়ার সেরা কবিতা লেখা হত।
কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন
সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই, সামাজিক অস্থিরতার দহন নেই,
আছে শুধু ছন্দসুরের
অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে, কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর
বিশ্বস্ত কলম। কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির
কাছে পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত
থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: এখানে একটা কথা বলি স্পষ্ট করে। বিশুদ্ধ কবিতা বলে একধরণের
কথা উঠেছিল ২০ শতকের গোড়ায়। পরে সে ধারণা বদলায়। সারা দুনিয়া জুড়েই কবিতা নানা
পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছে। নানা বিভাজন তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক ধারণা বদলেছে। এবং
সর্বোপরি কবিতা চলে এসেছে এক নিবিড় পাঠকের হাতে। সেখানে পুরনো ধরণে একধরণের
রাজনৈতিক চিৎকার কি যুক্তিসঙ্গত হবে? যেখানে পাঠক নিজে জানেন সেইসব তথ্য।
আরেকটা কথা, পাবলো নেরুদা নিরক্ষর খনি শ্রমিকের জন্য
কবিতা লিখেছিলেন। এখন সে কবিতা শুধুই আকাদেমিয়ার গবেষণার বিষয়। এখন কি কোনও কবি
খনি শ্রমিককে কবিতা শোনাতে পারবেন? তাঁর সে সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে অভিজ্ঞতার ধারালো অভিঘাতও তিনি
এড়িয়ে চলতে পারেন না। কবি তাঁর কল্পনা দিয়েই পারেন সেই অভিঘাতের মুখোমুখি দাঁড়াতে।
তাঁর কল্পনার সাহায্যেই পারেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতে, ভাষাকে নতুন রাস্তা দেখাতে। যেমন কোনও খাদ্য পরিপাক হয়ে আমাদের
পুষ্টি দেয়।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা
কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন
বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক? ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে
কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা। এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার
বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: দেশভাগের পর দু দেশের ইতিহাস দুদিকে প্রবাহিত হয়েছে। ফলত
সাহিত্যও বদলে গেছে। যেমন দেখি স্পেনী ভাষার ক্ষেত্রে। লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে।
একজন লেখক যিনি পেরু থেকে লিখছেন তাঁর বাস্তবতা মেহিকোর বাস্তবতা নয়। আবার স্পেন
এর থেকে একেবারেই আলাদা। একজন স্পেনী ভাষার সাহিত্য পাঠক এটাকে মেনে নিয়েছেন।
বিবিধতাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। আমাদেরও মনে হয় সে পথে হাঁটাই উচিত। কোনও
কেন্দ্রীয় অনুশাসন নয়, বরং প্রান্তীয় বিবিধতাকে মান্যতা দেওয়া, এটা একটা পথ। এতে ভাষাচরাচর ব্যাপ্ত হয়।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে
চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান,যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও
তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার
চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা? আপনার অভিমত! আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: সাম্প্রদায়িকতা আমাদের রন্ধ্রে! আমরা এত বেশি ধর্মাচরণ করি যে
অন্য ধর্মের মানুষকে স্বীকৃতি দিতে বাঁধে। এ বিষ অনেক বছরের। অনেক শতাব্দির। মনে
হয় না কোনও সাহিত্য এর থেকে আমাদের বের করতে পারবে। যদি পারত তাহলে বোধহয় রবীন্দ্রনাথের
পর আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হত না। আপনি ভাবুন তো পশ্চিমবঙ্গের অতি উদার ও
শিক্ষিত বামফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় কজন “নিচু জাতের” মন্ত্রী আর কজন অহিন্দু মন্ত্রী ছিলেন? দেখা যাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মন্ত্রীসভায় সবরকম মন্ত্রী
মিলিয়ে সংখ্যাটা ১০ ছাড়াবে না। এই যদি হয় কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা
তাহলে অন্যদের থেকে কী আশা করা যায়? এখনও আমাদের মনে সংরক্ষণ নিয়ে যে দীনতা
তা আমাদের মনীষার দৈন্য। আমরা বাইরে থেকে যতই প্রগতি জুজু দেখাই না কেন ভিতরে
ব্রাহ্মণ্যবাদ ঘুনপোকার মত। আমাদের সাহিত্যের ভাষা আজও তৎসমপ্লাবিত। আমাদের আজও
কোনও সম্পূর্ণ অভিধান নেই। আমরা আজও “বাঁকুড়ার আঞ্চলিক ভাষা” গোছের বই প্রকাশ করি, অথচ পৃথিবীর অনেক ভাষাই এই সমস্ত
প্রবাহকে এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছে। সামান্য জল আর পানি নিয়ে যে জাতির সমস্ত
বিবাদ। যে জাতির হিন্দুরা বেশিরভাগ সময় জানে না সেই একই জাতির মুসলমানরা পিসি মাসি
কে কী বলে ডাকে, সে জাতি সাম্প্রদায়িক। আর এদেরই সুযোগ
নেয় রাজনীতির কারবারিরা। এখানে সাম্প্রদায়কতা চোরাস্রোত নয়, প্রকাশ্য। যেমন যৌনকর্মী প্রকাশ্যে থেকেও নেই, ঠিক তেমন। এর জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের দরকার। প্রতিনিয়ত সচেতনতা
দরকার। নিজেদের ছেলেমেয়েদের শেখানো দরকার। শুধু সাহিত্য দিয়ে হবে না।
কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে অন্তিম
প্রশ্নে জানতে চাইবো ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন
ছায়পাত পড়ে?
শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: খুব জটিল প্রশ্ন। ভারতবর্ষে ইংরেজির কাছে সমস্ত ভারতীয় ভাষা
হেরে যাচ্ছে। আমরা যে হিন্দির আগ্রাসন থেকে বাঁচতে চাইছে, সে ভাষা তার নিজের জায়গাতেই হেরে গেছে। এই অবস্থায় ভবিষ্যত
বিরাট কিছু উজ্জ্বল দেখছি না। ফলত ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য আরও ছোট পরিধির সাহিত্য
হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।