সোমবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৬

সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়



সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়
লাস্ট ট্রেন
*********

জানলার ফাটা কাঁচে
  ঘুম লেগে আছে,
বাতিরাও ঝিমিয়ে পড়েছে---
  ইতস্তত ছড়ানো ছিটোনো
কিছু হেরো অবয়ব ঘিরে
  রাতের বাতাস শুধু কানাকানি করে।
 
ঘামের গন্ধের সাথে মিশে থাকে
আপসের ঘ্রাণ,
কখনো সঙ্গে মেশে আচারের তেলের সুবাস--
অনাগরিক কৌতূহলে উঁকি দিই পাশের টিফিন বাটিতে--
তেলমাখা মিয়োনো মুড়ির সাথে লঙ্কার দারুণ সঙ্গত--

অন্ধকার ছুঁয়ে একা জেগে থাকে সিগন্যাল শুধু--
আর নিরুত্তর প্রশ্নরা জেগে থাকে আমার দু'চোখে--
কামরার এককোণে বেমানান নিশাচরী
কে ও?
বসন্ত ছুটি নিয়ে চলে গেছে শরীরকে ছেড়ে,
ও কি তার খবর রাখে না?
সস্তার প্রসাধনী, মুছে যাওয়া দ্বিধাহীন লিপস্টিকে,
বুঝি ওর ঠিকানা লেখা আছে--
ধ্যাবড়ানো কাজলের চেয়েও সুগভীর কালো
অতলান্ত খাদ ওর চোখের গভীরে---
স্বচ্ছ শাড়ির ভাঁজে
সুনিশ্চিত পরিচয় লেখা আছে ওর--
কিন্তু,
ঘুমঘুমে আলোর নিচে
ওর হাতে ধরা আছে  যেটা,
কি আশ্চর্য!! তার হার্ড কভারের উপর,
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,
POEMS BY MILTON--

চুপ করে থাকা হয় না তো আর--
বলে উঠি--''কোথায়  নামবেন?''
বইয়ের পাতা থেকে চোখ তোলে সে,
অতলান্তিকের বুকে কূল হারানো জাহাজের নাবিকের দৃষ্টি সে চোখে--
খাপছাড়া হেসে বলে,
''নেমে গেছি তো,
অনেক,অনেকদিন আগে--''
আবার চোখ ফিরে যায়
ছেড়ে আসা হলদে হয়ে যাওয়া বইয়ের পাতায়,
একফোঁটা মূল্যহীন বারিবিন্দু ঝরে পড়ে--
ডুমো হয়ে ফুলে ওঠে
হলুদ পাতায় শোয়া
কালো অক্ষরগুলো---
শিয়রে শিরোনাম নিয়ে,
PARADISE LOST...





সামুদ্রিক
********

এখানে সবুজ নেই।
ধূসর দিগন্তে ওড়ে সাগরবলাকা--
ডানা ভারী হয়ে আসে
নোনা বাতাসের আশ্লেষে,
সময়ের পদচিহ্ন মুছে নিয়ে ফিরে যায় ঢেউ,
ফিরে আসে----
মুহূর্তের সাথে তার যুদ্ধ নিরন্তর।

সূর্যসাক্ষী বালিয়াড়ি
আঁশটে গন্ধ মেখে
চুপচাপ পড়ে থাকে---
কোনোদিন, কোনো এক চাঁদজাগানিয়া রাতে,
শঙ্খবালিকারা এসে চুপিচুপি ছুঁয়ে যাবে তাকে--
সঙ্গী হবে বাতিঘর ও জাহাজের জ্যামিতিক প্রেম।

এখানে নৈঃশব্দ্য নেই--
ভাষাহীন, আদিম এক বোবা গর্জন শুধু,
ধরিত্রীর বিমূর্ত প্রসববেদনা যেন--

দিক নেই, কূল নেই,
আদি-অন্ত কিছু নেই--
আছে শুধু পাতালভৈরবের এই উথাল পাথাল,
আর আছে অহঙ্কারী, নিরুদ্দেশ দিকচক্রবাল।

কেন বারবার সমুদ্রের মুখোমুখি ফিরে ফিরে আসা?
আমিও নিষাদ হবো।
মুহূর্ত শিকার করে,
পেরিয়ে যাব জন্ম জন্মান্তর,
স্মৃতিপত্রে নিয়ে যাবো অসীমের অমোঘ স্বাক্ষর,
আমি সমুদ্র হবো--
কোনো এক আশ্রমবন্দরের পায়ে,
তরঙ্গ গচ্ছিত রেখে,
আমিও সমুদ্র হবো একদিন।




আজ কুসুমের বিয়ে
*****************

' মাস ধরেই চলছিল মেয়ে দেখা--
চুল খুলিয়ে,
পথ হাঁটিয়ে,
খুঁজছিল রূপ, চোখ শানিয়ে,
পায়ের মাপে, লক্ষ্মীছাপের চরণচিহ্নরেখা।

হাটের ক্রেতা হয় না রাজি,
চলছিল খুব আয়নাবাজি,
ঘষা মাজা, নকলকারি
বিক্রি হওয়ার দেখনদারি,
রূপের হাটে দাম বাড়াবার হাজারো কারসাজি।


শরীর যখন ধরল মনে,
ভরসা-বসত চোখের কোণে,
এবার তবে কুশন্ডিকা, সিঁদুরদান-ই বাকি,
দূর বোকা মেয়ে--স্বপনচারী,
বুঝলি না তুই দুনিয়াদারি,
পাওনাগন্ডা, হিসেবনিকেশ ছাড়া সব-ই ফাঁকি।

বরপণ আর নমস্কারি,
আসবাব বা গয়না শাড়ি,
শেয়ারবাজার যেন, এমন চলছে হাঁকাহাঁকি!
খরিদ্দারের নজর উঁচু,
এড়িয়ে যেন যায় না কিছু-
''লগ্ন পেরোক, লগ্নি নিয়ে সুরক্ষিত থাকি!''


বইগুলোর আজ বেবাক ছুটি,
শূন্য আকাশ, ধুলোর ঘুঁটি--
সবুজ বনে তারার উঠোন---
সব ফুরোনোর খেলা?
পুকুরঘাটে, শ্রাবণ মাসে,
বইমেলা আর আঁকার ক্লাসে,
যত্নে রাখা কাঁধের ব্যাগে,
একমুঠো মেয়েবেলা!

ভৈরবী রঙ, আলতাপাটি,
ভোরের সানাই, খুব জমাটি--
মায়ের হাতে হলুদ-বাটি,
খিড়কি দুয়ার খুলে--
ছুটল কুসুম রুক্ষপথে,
ছুটল নিজের ছায়ার সাথে,
মুক্ত পাখির ছন্দ ডানায়, মুক্তি এলোচুলে!


হার না মানা মাঠের পারে,
জীবনখুশির গাঙের ধারে,
কালপুরুষকে সাক্ষী রেখে,
বাঁচার শপথ নিয়ে--
অনেক লড়াই, কান্না ঘামের
চিহ্ন মেখে, শান্তি নামে--
শিকল ভাঙা ছুটির সঙ্গে,
আজ কুসুমের বিয়ে।





উত্তরাধিকার
***********

যেদিকেই দাঁড়াতে তুমি,
দাঁড়িপাল্লা ঠিক পড়ত উল্টোদিকে ঝুঁকে--
তুমি স্টেশনে পৌঁছতে পারোনি কখনো সময়ে-
তার আগেই বেজে উঠত ট্রেন ছাড়ার বাঁশি,
যেখানে যাওয়ার ছিল, যাওয়াই হতো না আর--
তবু, ঘেমো রুমালে পথের ক্লান্তি মুছে,
মুখে অনাবিল হাসি মেখে
উঠে পড়তে অন্য কামরায়,
অন্য কোথাও যাত্রাসিদ্ধি, অন্য কোনোখানে-
পৌঁছেছিলে কি?
উত্তর মেলেনি এখনো।

পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে, খুঁজেছিলে শ্রান্তিছায়া,
হেলাবট তার কৃপণ পাতার শীতল হাওয়া নিয়ে,
সরে গিয়েছিল পশ্চিমে,
আরো পশ্চিমে---
অভিমান হলো না তোমার,
তুমি নিজেই নিজের বাতাসদাঁড়ি হলে-
আর স্বেদবিন্দু মুড়ে রাখলে সবুজ আলোকলতায়।
কেজো পৃথিবী তার খবর রাখেনি বুঝি!

আজ কাঁচের ওপর চন্দনের ফোঁটা,
কাঠের ফ্রেমে দুলছে রজনীগন্ধা--
সাদা নয়, অশ্রুরঙের মালা--
যত্নে সাজানো ''ধূসর পান্ডুলিপি''
আর ''সাতটি তারার তিমির'',
তার ফাঁকে, হঠাৎ পাওয়া
তোমার রুমালখানা--
ধুলো আর স্মৃতির গন্ধ ছাপিয়ে,
পেলাম তোমার ঘামের সুবাস।
লড়াইয়ের গন্ধ নয়,
আপসের ঘ্রাণও নয়-
আস্ত একটা জীবন বাঁচার গন্ধ,
তোমার নিজের মত করে---

ভাঁজ খুলতেই দেখি,
তোমার মুড়ে রাখা স্বেদবিন্দু,
মুক্তো হয়ে গেছে!
মুঠো ভরে নিলাম নিজের করে,
আমার জন্যে,
তোমার উত্তরাধিকার।





বোধন
******

ঘাট ছুঁয়ে যাওয়া
    স্রোত চেনো কেউ?
বালিয়াড়ি ছোঁয়া
    সাগরের ঢেউ---
জল ছুঁয়ে আসা
    মাঝিদের কথা,
মন ছুঁয়ে দেয়া
    তোমার কবিতা।
রাত ছুঁয়ে জাগে
     শ্মশানচাঁপা-রা,
কাম ছুঁয়ে থাকা
      দেহের ইশারা--
পথ ছুঁয়ে হাঁটে
       পদাতিক ধুলো,
আকাশ ছুঁয়েছে
        উড়ো মেঘগুলো!
রাঙা পায়ে ছোঁয়া
         আলতার দাগ,
খোঁপায় ছোঁয়ানো
          ফুলের সোহাগ-
ঘুমভাঙা চোখ
          ছোঁয়া অলসতা
হিম ঠোঁট ছোঁয়,
          চায়ের উষ্ণতা।
আমার স্বপ্ন
          কড়ি ও কোমলে
করে যাতায়াত
          হৃদি ছোঁবে বলে।

তোমার জন্য আহির ভৈরোঁ,
তোমার জন্য আগমনী গান,
তোমার জন্য পথ চেয়ে থাকা--
দেবী ছুঁয়ে আজ অকাল বোধন।