কবিতাউৎসব: বাংলাসাহিত্যের
উদ্ভব ও বিকাশের ধারায় ৪৭ –এর দেশভাগ বাংলাদেশের
সাহিত্যের অগ্রগতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়? অনেকেই বলে থাকেন অখণ্ড বাংলার হিন্দুসমাজের নিরঙ্কুশ
প্রভাব থেকে মুক্তি দিয়ে দেশভাগ বাংলাদেশের সাহিত্যে আশীর্বাদস্বরূপ এক যুগান্তর
এনে দিয়েছে! এই বিষয়ে একটু বিস্তারিত ভাবেই আপনার কাছ থেকে জনতে চাইছি!
মৌ মধুবন্তী: স্বাভাবিক কারণে নয় বরং সাহিত্যের চলন ধারার বিশেষ
প্রয়োজনে এটা বিশেষভাবে গুরুত্বপুর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি ধর্মকে টানতে চাইনা,তবে না চাইলেও পাঠকের পাঠরুচি,মনোস্তত্ব ও ধারা পরিবর্রতনের ক্ষেত্রে এটার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রয়োজন
ছিল এটা বলছিনা তবে প্রকৃতির নিয়ম মেপে যে বন্ধনহীন সীমারেখার সুতো অতিক্রম করে
বাংলাদেশের সাহিত্য দ্রুত গতিতে নিজস্বতা লাভ করেছে তা অবশ্যই প্রমাণ করে ৪৭-এর
দেশ ভাগ বাংলাদেশের সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে আশির্বাদ হয়ে বৃষ্টি ঝরিয়েছে।
কলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আর ঢাকা কেন্দ্রিক পুর্ব
পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাহিত্য।
নীচের তালিকায় কবিদের নাম দেখলেই সুস্পষ্টভাবে দুটো
ধারা দেখা যায়,
ঢাকার কবিরা এতো সুস্পষট হতো বলে মনে হয় না,ছত্রছায়ায়
বেড়ে উঠতে হতো। তবে ধারা দুটো বলেই সাহিত্যে সমৃদ্ধি এসেছে, আবার
ভাব-সমাদার –সম্প্রীতিও গড়ে উঠেছে।
কোলকাতা কেন্দ্রিক ঢাকা
কেন্দ্রিক
অক্ষরকুমার বড়াল আবদুল
মান্নান সৈয়দ
কামিনী রায় কাজী
নজরুল ইসলাম
গগন হরকরা গোলাম মোস্তাফা
জগদীশ গুপ্ত জসীম
উদ্দীন
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দৌলত
কাজী
প্রেমেন্দ্র মিত্র শামসুর
রহমান
সুনীল গাঙ্গুলি নির্মলেন্দু
গুণ
গল্প, উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই রকম
উদাহরণ দিতে পারি।
কবিতাউৎসব: ইতিহাসের
কালপরিক্রমণের ধারায় বার বার বিদেশী শক্তির পদানত হওয়ার প্রভাবেই আধুনিক
বাংলাসাহিত্য অধিকতর পুষ্ট হয়ে উঠেছে বলেই অনেকে মনে করেন। এই বিষয়টি সম্বন্ধে
আপনার অভিমত জানতে চাই! যেভাবে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্য আরব ও পরে ইংরেজী সাহিত্যের
প্রভাব পড়েছে আমাদের বাংলাসাহিত্যে।
মৌ মধুবন্তী: আপনি কি সেটা মনে করেন না? এটা
ঘটেছে,তাই
মনে করাটা গুরুত্বপুর্ণ নয়। ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব কেবল রাজনৈতিক,প্রশাসনিক
কিংবা জনগণের আচরনের উপরেই প্রভাব বিস্তার করে না, বরং সাহিত্যের ধারায়
তার প্রভাব সবার আগে পড়ে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের
গণমানুষের সাহিত্য,সংগীত,নৃত্য,ভোজনরীতি, পোষাক, উৎসব
ইত্যাদির মিথষ্ক্রীয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এই সংস্কৃতি ভারতীয়
সংস্কৃতির থেকে ধার করা কিংবা প্রভাবান্বিত। তবু বাংলাদেশের স্বকীয় কিছু
বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করার প্রয়াস পাওয়া যায়।
বাংলায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ইতিহাসের
সূচনালগ্ন থেকেই ইরান ও বাংলা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। ভারতের নৌবন্দরসমূহ,যেমন:
দেবল, নিরুন, সুপারাকা, বাড়িগাজা, টাগারা,মুজিরিস,নেলকিনডা,আরিয়েক,তাম্রলিপ্তি,গাঙ্গে,সাপ্তগ্রামা(সাতগাঁও/সপ্তগ্রাম), সরন্দিপ
ইত্যাদি থেকে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরণের নৌযান পারস্য উপসাগরের উবুলা, ওমানা, ইউডেইমন,সিরফ,কাইস,হরমুজ,সকোট্রা
এবং গেড্রসিয়া উপকূল অতিক্রম করত। বাংলার প্রাচীন নৌবন্দরসমূহ,যেমন:
তাম্রলিপ্তি, গাঙ্গে এবং সাপ্তগ্রামা তৎকালীন বাংলার
নৌব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এসব বন্দর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
উভয় দেশসমূহের ব্যবসায়ী ও নাবিকদের আকৃষ্ট করত। বাংলার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও
গ্রেকো-রোমান বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে খ্রিস্টীয় অব্দের শুরু
থেকেই তাম্রলিপ্তির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ফলে বাংলার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও ইরানের
কেবল বাণিজ্যিক সম্পর্কই নয়, সাংস্কৃতিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে।
ইরানি বণিক ও বাণিজ্যপণ্যের সঙ্গে সৈন্যবাহিনী,প্রকৌশলী,কারিগর,সুফি,দরবেশ
এবং শিল্পীদেরও আগমন ঘটে বাংলায়। এ ধরনের সম্পর্ক পর্যায়ক্রমে রাজদরবার,সমাজ
ও শিল্পসাহিত্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব থেকেই
ফারসি ভাষার চর্চা ও ইসলাম প্রচার শুরু
হয়। ইরান থেকে আগত সুফি-দরবেশগণ সৈনিক,ব্যবসায়ী ও রাজপুত্রদের কাফেলার
সঙ্গে অগ্রসর হয়ে জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ
ইসলাম গ্রহণ করে এবং কুরআন ও সুন্নাহ
সম্পর্কে জানতে গিয়ে আরবি ও ফারসি ভাষার চর্চা করে। সুফিরা ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক
বিষয়াদি সম্পর্কে অসংখ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন,যা এতদঞ্চলে ফারসি ভাষার উন্নয়ন ও
বিস্তারকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
ব্রিটিশরা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং
ভাষাগতভাবে বাঙলাসহ অন্যান্য স্থানে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদের দেয়াল
নির্মাণ করতে থাকে।
ব্রিটিশ শাসনের একেবারে শুরুর দিকেই বাঙলার মুসলিম
অভিজাত শ্রেণী ক্ষমতা হারায় এবং হিন্দু অভিজাত শ্রেণী শাসকদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এই
পরিবর্তন মুসলিম অভিজাত শ্রেণী ও হিন্দু অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
বাড়াতে থাকে,যা শেষপর্যন্ত বাঙলার সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানদের
মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
অন্যদিকে,ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে
বাড়তে থাকা দ্বন্দ্বে শুধু সুচিন্তিতভাবে উস্কানিই দেয়নি, বরং
মুসলিমদের বঞ্চিত করে হিন্দুদেরকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা
দেয়ার মাধ্যমে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের রেখা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর করে
তুলে।
আবার মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যচর্চা মুসলমানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে
আসে সুলতানি আমলে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাদের বড় অবদান কাহিনীকাব্য বা
রোম্যান্টিক কাব্যধারার প্রবর্তন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বৌদ্ধ-হিন্দু রচিত বাংলা
সাহিত্যে যেখানে দেবদেবীরা প্রধান এবং মানুষ অপ্রধান সেখানে মুসলমান রচিত সাহিত্যে
মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। মুসলমান কবিরা কাহিনীকাব্য ও ধর্মীয় সাহিত্যের পাশাপাশি
হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়মূলক সাহিত্যও রচনা করেছেন
উপর্যুক্ত সংঘটনগুলির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা
যাবে যে, ১৭৫৭
সালে বঙ্গদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ইংরেজদের হস্তগত হলেও সাংস্কৃতিক জীবনে উনিশ শতকের
পূর্বে ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য প্রভাব
অনুভূত হয়নি। প্রধানত ইংরেজদের শিক্ষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটার মধ্য দিয়েই
আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ইউরোপীয় সংস্কৃতির
নিকটবর্তী হয়। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ঘটে, তাকে
ঐতিহাসিকগণ ‘নবজাগৃতি’ বা ‘রেনেসাঁ’ নামে
আখ্যায়িত করেন। এর ফলস্বরূপ উনিশ শতকের সাহিত্যে মানব-প্রাধান্য,গদ্য-সাহিত্যের
উদ্ভব,সাময়িক
পত্রের আবির্ভাব ইত্যাদি বৈচিত্র্যের সূত্রপাত হয়। এ সময় উপন্যাস, ছোটগল্প,প্রবন্ধ
প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের গদ্য-সাহিত্য এবং ইংরেজির আদর্শে নাটক ও কাব্যসাহিত্য
(মহাকাব্য-আখ্যায়িকা,সনেট, গীতিকবিতা) রচিত হতে থাকে;এমনকি
ইউরোপীয় ধাঁচে নতুন রঙ্গমঞ্চও নির্মিত হতে থাকে।
গদ্যরচনার যুগ
উনিশ শতকের পূর্বে বাংলায় যেসব গদ্য রচিত হয়েছিল তা সাহিত্যপদবাচ্য নয়।
সতেরো শতকের শেষভাগে দোম আন্তোনিও ছিলেন
প্রথম বাঙালি লেখক এবং তাঁর রচিত ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ প্রথম মুদ্রিত
বাংলা গ্রন্থ। পরে পর্তুগিজ পাদ্রি মানোএল-দ্য আস্সুম্পসাঁও সংকলিত কৃপার
শাস্ত্রের অর্থভেদ এবং বাঙ্গলা ব্যাকরণ ও
বাঙ্গলা-পর্তুগীজ শব্দকোষ ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে রোমান
অক্ষরে মুদ্রিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা লাভের পর ইংরেজ শাসকবর্গ দেশীয় ভাষা রপ্তকরণের
আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন। ইতোমধ্যে এদেশে মুদ্রণব্যবস্থা প্রচলিত হলে ইংরেজদের বাংলা
শেখাবার উদ্দেশ্যে নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন A Grammar of the Bengal Language। গ্রন্থটি
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় এবং এতে দৃষ্টান্তস্বরূপ উদাহরণ ও
উদ্ধৃতিতে বাংলা হরফ ব্যবহূত হয়। এর কাছাকাছি সময়ে খ্রিস্টান পাদ্রিগণ বাংলা
গদ্যে আরও কিছু পুস্তক রচনা করেন,যার সবগুলিরই উদ্দেশ্য ছিল
ধর্মপ্রচার। এক কথায় বলা যায় যে,শাসনকার্য পরিচালনা ও ধর্মপ্রচারের
প্রয়োজনেই আঠারো শতকে বাংলা গদ্যচর্চার প্রসার ঘটে;তাই তাতে সাহিত্য
সৃষ্টি হয়নি। রাজকার্য পরিচালনায় আইনগ্রন্থের বাংলা অনুবাদই প্রথম প্রয়োজন হয়, তাই
এ সময়ে কিছু আইন গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এ ক্ষেত্রে ১৭৭৮ থেকে ১৮০০
খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হ্যালহেডের পরে উল্লেখযোগ্য হলেন ফরস্টার। তিনি কর্নওয়ালীসী
কোড (১৭৯৩) ও শব্দকোষ (১৭৯৯) বাংলায় অনুবাদ করেন। এ দুটি মৌলিক রচনা না হলেও এ
থেকে বাংলা গদ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা জন্মে। উনিশ শতকে এই গদ্য-প্রচেষ্টা আরও
বেগবান ও সমৃদ্ধ হতে থাকে।
বাংলা গদ্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন উইলিয়ম কেরী (১৭৬১-১৮৩৪) নামে একজন ইংরেজ কর্মকর্তা।
তিনি বাংলা গদ্যচর্চাকে ধর্মপ্রচারের অনুরূপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ
করেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাইবেলের বঙ্গানুবাদ মথী রচিত মঙ্গল
সমাচার প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। পরে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে
গিয়ে গদ্যে পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশের কাজ আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নেতৃত্বে একদল
বাঙালি পন্ডিত বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজ শুরু করেন। এভাবে
কেরী এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার একটা পরিকল্পিত ধারার
প্রবর্তন ঘটে। কলেজের বাংলা বিভাগের পন্ডিত
রামরাম বসু (১৭৫৭-১৮১৩) ও
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার (১৭৬২-১৮১৯) সর্বপ্রথম বাংলায় যথাক্রমে ফারসি ও
সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কেরীর অবদানই বেশি। বাংলা ভাষার
উৎকর্ষ সাধনে কেরী যে অবদান রাখেন,তার জন্য তিনি বঙ্গদেশ ও বাংলা
ভাষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
কবিতাউৎসব: সাহিত্য মূলত
দেশজ সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও জলবায়ু সম্ভূত স্বাভাবিক আত্মপ্রকাশ। কিন্তু বিদেশী ভাষা
সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রভাবে যে নাগরিক মনন ও চিন্তা চেতনার বয়ন গড়ে ওঠে, তার সাথে দেশজ শিকড়ের টানা পোড়েন কিভাবে একজন সাহিত্যিককে
পুষ্ট করে?
মৌ মধুবন্তী: সাহিত্যের
কোন ভৌগলিক সীমারেখা দেয়াল দিয়ে গড়া নেই। নিত্য প্রবহমান। তাই দেশজ আর বিদেশী ভাষা এর মধ্যে কোন সীমারেখা টানা আমি কোনক্রমেই
বিবেচ্য বলে মনে করি না। ভাষা প্রবহমান বলেই যে যখন যে ভাষার সংস্পর্শে আসবে,সে
সে ভাষার রস আস্বাদন করতে পারাই একজনের মেধার পরিচয় বহন করে,নাগরিক
ও দেশজ,আবহাওয়া
সংস্কৃতি একেবারে ভিন্ন, তাই চিন্তা চেতনায় ও তারা ভিন্ন,আর
জিহবায় যে সকল শব্দ গড়্গড় করে রেলগাড়ির মত
সারি বেঁধে চলে,তার থেকে বেরিয়ে অন্য শব্দে লেখা চেতনা থেকে বিচ্যুত
হওয়া কেবল। টানাপোড়েন ছিন্ন করেই অধিকাংশ কবি আধুনিকতার হাল ধরেছেন,তাই
এখানে বিরোধ নেই। কবি ও সাহিত্যিক অনেকেই দেশ –গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন রাজাধানী বা
বড় শহরে,নাগরিক
জীবনকে গ্রহণ করে তার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন,টানা পোড়েন এখানে উপযুক্ত টার্ম নয়
কবিতাউৎসব: এখন এই যে দেশজ সাহিত্যসংস্কৃতির প্রবাহমান ধারা, তার সাথে নাগরিক সাহিত্যধারার কোনো বিরোধাভাস কি আপনার
দৃষ্টিগোচর হয়? হলে তার রূপ ও বিকাশ সম্বন্ধে
যদি আলোকপাত করেন!
মৌ মধুবন্তী: কি করে
বিরোধ বলি? বিরোধের চেয়ে সখ্যতাই দেখি বেশী। আমি তো টেলিভিশান, রেডিওতে
দেখছি মিশেল,প্রচুর মিশেল বাক্য,ইংরেজীর সাথে বাংলা,শুদ্ধ
বাংলার সাথে দেশজ শব্দের বিয়ে,হিন্দি –উর্দু-বাংলার
বিশেষ আত্মীয়তা,
আমরা আমেরিকা, কানাডায় যারা থাকি, তারা
প্রতিনিয়ত এই সব শব্দের মিশ্রণ শুনতে পাই, “বিগ বিগ বাইট দিয়ে খেয়ে ফেলো“,“হাম
দোনো বাংলা-ইংরেজী দুই ভাষায় কথা বলতে
জানি। আমি এখন ভাত খাইয়িং,এই রকম অন্য ভাষার শব্দ আজকাল
সাধারন বাংলায় চলে আসছে, সাহিত্যের ক্ষেত্রো তার চেয়েও বড় ভূমিকা রাখে, যা
পায় তাকেই সযত্নে নিজের করে যথাস্থানে বসিয়ে রাখে। ফিলিপিনো বন্ধুদের সাথে কাজ করি
বলে,সকালে
কাজের জায়গায় গিয়ে বলি, মাগান ডাং ওমাগা- শুভ সকাল,গুড
মর্নিং আর বলছিনা। আমি বলি,এখন বরং উদারতা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়েছে,মিডিয়ার
প্রভাবে,মিডিয়ার
কাটতির জন্য নতুন কিছু আনতেই দেশজ সাহিত্যের প্রতি উদোক্তাগণ বেশী মনোযোগী হচ্ছেন,এটা
বিরোধ নয়,সখ্যতা।
রূপ ও বিকাশ বলতে উল্লেখ করা যায়, গান
কবিতা সব কিছুতেই মিশ্রণ প্রয়োগ করবার প্রকোপ দিনে দিনে বাড়ছে। তাতে অরিজিনাল
চেতনার বিলুপ্তি ঘটছে। কয়েক দশক পরে
বিশুদ্ধ সাহিত্য পাওয়া দুস্কর হবে। আমি আশাহত নই, সেটাই
নতুন প্যারাডাইম তৈরী করছে, প্রিয়
কবি ও আমার যাবজ্জীবনের প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ এর গানের সুরে কি মিশ্রন, রিমিক্স
এসেছে কপিরাইট উঠে যাবার পরে। ভালো হয়েছে রবীন্দ্র সঙ্গীত নতুন প্রজন্মে সুরে না
হোক শব্দে আশ্রয় পাচ্ছে, জায়গা পাচ্ছে, বেঁচে থাকবার জন্য দারুণ ভালো
হচ্ছে। সুর আর্কাইভে যাবেই।
কবিতাউৎসব: বাংলাদেশের
সাহিত্যের আলোচনায় অতি অবশ্যই ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কথা চলে আসবে। ৪৭
পরবর্তী বাংলাদেশে এই দুইটি ঘটনার অভিঘাত নিয়ে যদি একটু বিস্তারিত আলোচনা করেন
আপনার অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসবোধের আলোতে!
মৌ মধুবন্তী: আজকের এই সমৃদ্ধ বাংলা লিখতে পারার অভিজ্ঞতাই আমার
অভিজ্ঞতা। বাংলা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা।সে কেবল বাংলাদেশ ভাষা নিয়ে আন্দোলন ও
যুদ্ধ করেছে বলেই সম্ভব হয়েছে। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে
(বর্তমান বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার
রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানের
অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণ দাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২
সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ বপিত হয়েছিল
বহু আগে, অন্যদিকে
এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত
ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি
অংশ - পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক
ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার
ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ
ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে
গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান
অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং
মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব
পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে
ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি বে-আইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ
অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক
কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ
১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন
রফিক[১], সালাম, বরকত-সহ[২][৩]
আরও অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র
পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয়
সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের
মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯
সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের
প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা
করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে
উদযাপন করা হয়।
বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি
পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতকের
মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও
ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব
ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী
এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায়
উন্নীত হয়। উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর
সদস্য। এ ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি
অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক
অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবিএবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে[ দিল্লি সুলতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে
দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়। এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয়
মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে
হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।
উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে
জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি
প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল।
বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয়
ইন্দো-আর্য ভাষা, যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে।
উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার
বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর
বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার
সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি
প্রত্যাখ্যান করেন।
কবিতাউৎসব: পাকিস্তানী
কর্তৃপক্ষ ও রাজাকার আলবদরদের মিলিত ষড়যন্ত্রে বুদ্ধিজীবী নিধনের প্রভাবে
বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির ভূবনে হঠাৎ
যে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল,
আজকের বাংলাদেশ
কি সেই অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পেরেছে বলে
আপনার ধারণা! স্বাধীনতার পরবর্তী বিগত চার দশকের আলোতে যদি বলেন!
মৌ মধুবন্তী: কঠিন প্রশ্ন, সাহিত্যে ব্যাপক বিচরণ থাকলে এর
উপর দীর্ঘ রচনা লিখেও শেষ করা যাবে না। ৪৭
–এর
ভাগের পরে মানুষের জীবনে যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে তার প্রথম সংকট হলো, বাংলাদেশের
মানুষ ভিটে-মাটি ছেড়ে, পশ্চিম বাংলায় গিয়ে ঠাঁই করেছে, আর
তেমনি পশ্চিম বাংলার লোক দেশ ছেড়ে, সমাজ ছেড়ে নতুন মাটিতে পা
রেখেছে বাংলাদেশে। চেনা বৃত্ত থেকে
বেরিয়ে এসে বেদনা সংকুল অভিজ্ঞতা, চেতনা
ও সব হারাবার মানসিক প্রবল কষ্টের সাথে তো এই ভিন্ন গোত্রের সাহিত্যের সাথে খাপ
খাইয়ে নিতে পারাও বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। অভিঘাত তখন আর থাকেনা, যখন
বিষয়টি আত্মোপলব্ধিতে তুলে নেবার একটা প্রবল চাপ থাকে। মানুষ ক্রমে সেটা মেনেও
নেয়। তাই অভিঘাত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু ‘৪৭ থেকে ‘৭১ আর ‘৭১
থেকে আজ অবধি দুটো পরিবর্তন একেবারে দিনের আলোর মত দেখা যায়।
ইংরেজদের প্রতাপ মুক্ত দেশে সাহিত্যের নতুন সুর্য
ঝিলিক দিয়ে ওঠে। তাদের নিয়ে যা রচনা তা দুঃখের, সাহিত্য কেবল দুঃখ নয়। তাই
নির্মমতার থেকে মুক্ত হয়ে চেতনার পাখী স্বাধীন স্বাধীন বলে নবোউদ্যমে শুরু করে
সাহিত্য যাত্রা।
বুদ্ধিজীবি হত্যার কারণে যে শুন্যতা সৃষ্টির কথা আপনি বলেছেন, আমি
তা মনে করিনা। বাতাস হাল্কা হলে ভারী বাতাস এসে শুন্যস্থান দখল করে। বাংলাদেশে
অনেক বুদ্ধিজীবি আবারো তৈরী হয়েছে আর আছে এবং এখনো হচ্ছে।
বরং পাঠকের সংখ্যা বাড়াতে সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবি দের
ভেতর চেতনার প্রখরতা আরো বেড়েছে। সব কিছুর পরে আছে মিডিয়া ও সোসাল মিডিরার প্রভাব।
এতে আমি মনে করি প্রমাণিত বুদ্ধিজীবির সংখ্যা বেড়েছে।
কবিতাউৎসব: আমরা জানি
বাংলাদেশে এপাড় বাংলার সাহিত্য বিপুল জনপ্রিয়, কিন্তু দুঃখের বিষয়,
এপাড় বাংলায়
ওপাড় বাংলার সাহিত্য সম্বন্ধে উদাসীনতার ইতিহাসটি দীর্ঘকালের! এর মূল কারণ ঠিক কি
বলে আপনার মনে হয়? নেট বিপ্লবের হাত ধরে সোশাল
মিডিয়ার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতির কোনো দিকচিহ্ন কি আপনার নজরে পড়ছে
সম্প্রতি!
মৌ মধুবন্তী: এই
প্রশ্নের উত্তরে আমি যেটা বলতে চাই, তা হলো প্রথম যে প্রশ্ন করেছেন,সেই প্রশ্নটাই এই প্রশ্নের স্পস্ট জবাব। এই যে দাবিয়ে রাখার ধারা,’৪৭
এর দেশ ভাগ সত্যি বাংলাদেশের সাহিত্যের ভান্ডারে পরম আশীর্বাদ দিয়েছে। আমি মনে করি
বাংলাদেশের সাহিত্যে নিরপেক্ষ অনেক চিন্তা চেতনার প্রকাশ দেখা যায়। আজো এপাড় বলতে
কোলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যে আজো,ধর্মের বাতাবরনে ঢাকা। সোসাল
মিডিয়াতে মাঝে মাঝে আমি কমেন্ট দেই,এতো অত্যাধুনিক কবিতায় স্বরসতীর
বন্দনা কেন রে। কবিতাকে স্বরসতী, দুর্গা
আর ধর্মের বেড়াজাল থেকে আলাদা করা দরকার।
ঢাকার সাহিত্যে নামাজ রোজা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি থাকেনা,নায়ক
নায়িকা নির্বাচনে, নামগুলোতে হিন্দু মুসলমান সবই থাকে,কোলকাতার
লেখায় এই বেড়াজাল ভাংগতে পারেনি এখনো।
বাক্যে না হোক শব্দে হলেও এসেই যায় তাদের। তাই তারা সাহিত্যে ব্রাহ্মণ ভাব দেখালেও
আমি মনে করি সোসাল মিডিয়ার কারণে পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা বেড়েছে।
কোলকাতার বই মেলায় বাংলাদেশের বই নিয়ে প্রকাশকরা আসছেন। এইতো পরিবর্তন শুরু হয়েছে, সামনে
আরো এগুবে এক ধাপ বা কয়েকধাপ করে।
আর এই যে ফাল্গুনী দা,শুভ্র,তোমরা
যে যৌথ প্রথা চালু করেছ ব্লগে লিখার মাধ্যমে, তাতে দূরত্ব ঘুছতে শুরু করেছে।
আরো বেশী মেলামেশা হবো আশা রাখছি।
কবিতাউৎসব: আমাদের এই
দ্বিখণ্ডীত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান, যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ
সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি
গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা?
আপনার অভিমত! আর
সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!
মৌ মধুবন্তী: সমাজ পরিবর্তনে সাহিত্যের ভূমিকা বিরাট রকমের এই কথা
আমরা সবাই জানি। আর আজকের স্যোসাল মিডিয়ার আরো ব্যাপক ভূমিকা আছে। সোসাল মিডিয়াতে
লুকোচুরির বেশী সুযোগ নেই, আগামীতে আরো থাকবে না। একই
স্যোসাল মিডিয়াতে আমরা সবাই এক পাতে খাচ্ছি, সেখানে তো ধর্মের কচকচানী নেই, আর
যেটূকু আছে তাদের সাথে আমাদের যোজন যোজন দূরত্ব। এই দূরত্ব অতিক্রম করে অসাম্প্রদায়িকতা
ব্যাপক কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সবাই তো দিনে আলোর মত সবকিছু অবলোকন করেছে তাই
চোরাস্রোত একদিন থেমে যাবে, অন্য রূপ নেবে। প্রকৃতি প্রতিনিয়ত বদলায়। সাহিত্যের
ধারা সে বদলের সাথে বদলায়। বাংলাদেশে প্রচুর নিরীক্ষা ধর্মী লেখা হচ্ছে। হুমায়ুন
আহমদের কথা আনতে না চাইলেও তার অবদান বাংলাদেশের পাঠক গঠনে আমার অস্বীকার করবার
কোন উপায় নাই। আমি তো সোসাল মিডিয়াতে বাংলাদেশের কিছু হলে ফেসবুক বন্ধু হিসাবে
সবাই উদ্ববিগ্ন হয়, সহানুভূতি দেখায়, আবার প্রতিযোগীতার জায়গায় ঠিক চোরা
সুড়ঙ্গ পথ ও কাটে। এটা প্রকৃতি
আর এই সব সাম্প্রদায়িকতা দেখানো এখন তো একটা সুবিধা ভোগের বিষয় হয়ে
উঠেছে। এটা বহির্শক্তির ইঙ্গিতে যা ঘটবে তা দেশের শক্তির চেয়ে বেশীগুণ বলেই তারা
উদাসীন থাকতে পারে। সচেতন মানুষ অসাম্প্রদায়িক
বাংলাদেশিরা একটু আগে চলে আসলে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কমে আসবে আশা রাখি
কবিতাউৎসব: এবার একটু
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি বরং,
আপনার গড়ে ওঠার
পিছনে কোন কোন সৃষ্টিশীল সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের প্রভাব বিশেষ ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল
জানতে ইচ্ছে করছে! এবং আপনার নিজের সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিশীলতার অন্তরালে আর্থ-সামাজিক-রাজনীতির প্রভাব কিভাবে ক্রিয়াশীল
যদি একটু বিস্তারিত ভাবেই বলেন!
মৌ মধুবন্তী: আমার বাপি
একজন প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন আবার ধর্ম সচেতন ও ছিলেন। আমার পরিবারে যা সাম্যতা
দেখতাম, চারিপার্শে
ভিন্ন চিত্র দেখে দেখে আমি ক্ষুব্ধ হতাম। এই একটি বিষয় হলো নারী পুরুষের ভেতর বৈষম্য। নারীর জঠর থেকে
যে সন্তানের জন্ম সে পুরুষ কি করে নারীকে নির্যাতন করে, এই
প্রশ্ন আমাকে ছোটবেলা থেকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আমি গার্লস কলেজে পড়তে চাইনি, কিন্তু
ঢাকায় তখন নামকরা কলেজের মধ্যে ছিল ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজ আর বদরুন্নেসা গার্লস
কলেজ। আমাকে পড়তে হয়েছে ইডেন কলেজে গার্লস
কলেজে। প্রথম দিনের ধাক্কা ছিল, হোস্টেল সুপার এর অশ্রাব্য কথা, ওড়না
কেন পরিনি মেয়ে মানুষ হয়ে। কলেজের ড্রেসের জন্য ওড়না পড়তে বাধ্য ছিলাম। এই নিয়ম
আমি মেনে নিতে পারিনি। সুপারের কথার উত্তরে বলেছিলাম, এটা
আমার বাপী জানে। আমি হস্টেলের ভেতরে ওড়না পরার কোন কারণ দেখিনা, বাইরেই
তো পরিনা। মেয়েদের যেইভাবে খাঁচায় পুরে রাখা হতো, ঐ নিয়ম আমার পছন্দের
ছিল না। তখনি লেখা শুরু করি জোরদার। দেয়াল পত্রিকা ছাড়া আর কোথাও লেখা দেবার কথা
ভাবতাম না। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে যখন বিআইডিএস এ চাকুরি নেই, তখন
নারী নির্যাতনের উপর ও দরিদ্রতা দূরীকরনের উপর প্রজেক্টে কাজ করি। এই আমার ভেতর
আগুন জ্বলা শুরু। কিন্তু নর্থ আমেরিকান জীবন এ নারী নির্যাতন, নারী
পুরুষ বৈষম্য এতো প্রখরভাবে আমাকে নাড়া দিয়েছে যে আমি সকল কাজ ফেলে কেবল এইসবে
নিমগ্ন হবার কথাই ভাবতাম। কিন্তু আমার বাপী সব ছেড়ে চলে গেলেন অজানা গ্রহে। আমি
পুরো পরিবারে বাপী হয়ে উঠলাম। বিবাহিত জীবনে সনাতনী স্ত্রীর মত আচরণ পেতে থাকি।
যদিও অতি আধুনিক মানসিকতার একজনের সাথে জীবন সঙ্গী হয়েছি। আধুনিকতা ছিল কেবল
মুখোশ। এই সময়ে পত্রিকায় কবিতা ছাপাতে উৎসাহিত করেন কৌশিক আহমেদ –বাংলা
পত্রিকাআর সম্পাদক,নিউ ইয়র্ক। কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন আজকের ঢাকার
উপস্থাপক, আমাদের
সকলের প্রিয় নায়ক। কৃতজ্ঞতা তার কাছে। চলতে চলতে
সময় চারিদিকে মেয়েদের হাহাকার দেখেশুনে নিজের জীবন ভূলে গেলাম। দেখা হলো
ভোয়ার একজন প্রতিনিধি যাকিয়া সুলতানার সাথে। প্রথম ইন্টারভিউ নিলেন তিনি টেলিফোনে
ভোয়ায় প্রচারের জন্য। সাহস পেলাম এগিয়ে যাবার। লিখতে থাকি। পড়তে থাকি, খুঁজতে
থাকি কোথায় সেই সেফ হোম। আসলে আজো কোথাও মেয়েদের জন্য সেফ হোম নেই। একমাত্র উপায়
নারীদের সন্তান ধারণে প্রতিবাদ মিছিল বানাতে হবে। রাজনীতি আমার একেবারেই ধর্তব্যের
ভেতর নেই। তবু রাজনৈতিক খেল আর মানুষ হত্যার এই প্রক্রিয়া আমাকে ক্রমাগত পোড়াতে
থাকে। আমি চাই একটি শান্তিময় পৃথিবী।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যিক
প্রেমেন্দ্র মিত্র সাহিত্যচর্চায় যে শৌখিন মজদূরী সম্বন্ধে আমাদের সচকিত করে
দিয়েছিলেন, আজকের অন্তর্জাল সাহিত্যের
হাটে সে কথা যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে বলে মনে করেন অনেকেই। বাড়িতে
আনলিমিটেড নেট, হাতে স্মার্টফোন বা কোলে
ল্যাপটপ, হঠাৎ অবসর, ধরা যাক দু একটি শব্দ এবার। এই যদি সাহিত্যচর্চার সমকালীন
প্রকরণ হয়ে দাঁড়ায় তবে তো সত্যই চিন্তার বিষয়। আপনার অভিমত।
মৌ মধুবন্তী: তিরিশের
কল্লোল যুগে সাহিত্যে যে কয়জন ডিঙ্গা ভাসিয়েছিলেন তার মধ্যে একজন হলে প্রমেন্দ্র
মিত্র। প্রশ্ন হলো সেই সময় প্রসার হবার সুযোগ ছিল সীমিত। পাঠক ছিল সীমিত। এই
সীমিতের সাথে বিস্তারের তুলনা করলে কি চলে? আজকের নেট যুগে মানুষ ক্রমাগত পড়বার সুযোগ পাচ্ছে, যত
পাঠ, তত
উদ্ভাস। নয় কি? আবার এও তো ঠিক কেউ স্রোতে বেশী দিন টিকে থাকছে না।
যত উৎপাদন হচ্ছে তত ঝরে যাচ্ছে। এর কারণ, জীবন যাপন প্রণালী, চাহিদা, টেকনোলজির
প্রভাব, এক
সময় কেবল ফেসবুকে সীমাবদ্ধ ছিলাম, এখন টুইউটার, লিঙ্কেদিন, ফিউচারনেট, ইন্সট্রাগ্রাম, ভিদীও, ইউটিউব, গুগল
প্লাস, ক্রমাগত
নতুন নতুন আবিস্কার। তাই জন্যে সৃষ্টিতে ও
লেখায় অনেক ধারা একই সময়ে চলছে। এখানে উল্লেখ করতে পারি, নাগরিক
শব্দ আর দেশজ শব্দের সংবেনশীল মিশ্রনে নতুন নতুন লেখার যে নির্মান কৌশল আমি সোসাল
মিডিয়াতে দেখি, তা আমাকে উজ্জীবিত করে।
আশাবাদী করে। দু কলম চলে যাবে, দু
চার শব্দ ঝরে যাবে। কিন্তু পাঠ অভ্যাস বাড়ছে। কেউ কেউ হল্লা করে, বই পড়ে না কেন
কেউ। সারা দিন অনলাইনে পড়তেই থাকে। পড়া
নিয়ে কথা। তাই
বই প্রকাশ একসময় বন্ধ হয়ে যাবে।
সেটা হয়ত চিন্তার বিষয় হতে পারে।
সার্বিকভাবে সাহিত্যের দিগন্তে নতুন আঙ্গিক ও প্যারাডাইম তৈরি হচ্ছে।
এতে কোন সন্দেহ নেই
কবিতাউৎসব: এই প্রসঙ্গে
জানতে চাইবো জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে প্রগাঢ় সমবেদনা সাহিত্যের ও অন্যান্য যে কোন
সৃজনশীল সৃষ্টিশীল মাধ্যমের সূত্রপাতের মূল উৎস, বর্তমানের ভোগবাদী দুনিয়ার এই উর্দ্ধশ্বাস ইঁদুর দৌড়ে সেই
অনুভব আর কি আমাদের মধ্যে জায়মান আছে?
আমাদের
সাহিত্যবোধ ও সংস্কৃতিবোধও কি অনেকটাই মোড়ক সর্বস্ব বস্তুবাদী হয়ে ওঠেনি? অনেকটাই বাজারদর ভিত্তিক? কি মনে হয় আপনার?
মৌ মধুবন্তী: পৃথিবীর
সৃষ্টি ভোগের জন্য। তাই বাকী যা কিছু আর যা কিছু হচ্ছে তা ভোগের জন্য। এর সাথে
সম্পৃক্ত সব কিছুর উপর এই ভোগের প্রভাব পড়বে। স্বাভাবিক বিবেচনায় আজকের ফেসবুকিস
কমুনিকেসান বন্ধুত্ব, মাটির পৃথিবীর অনেক সম্পর্কের চেয়ে গভীর, সমব্যাথি, তবু
এক দল লোকের কাছে হাহাকার ও আর্তনাদ শুনতে পাই। আমি এর থেকে ভিন্নভাবে ভাবি। যা
কিছু নতুন আসছে বাজারে তার উপর ভিত্তি কিরে মানবিকতার প্রকাশ ও পরিধি নির্বাচিত
হবে। এখন আমরা গ্লোবাল সিটিজেন। এই সময়ে বাড়ি বসে মাথায় বুলিয়ে মানবিকতা দেখবার সুযোগ
কম। কিন্তু আমি বলব এই টেকনোলজির উন্নয়নের কারণে মানুষ অনেক বেশী মানবিক। যোগাযোগ
অনেক বেশী সহজিয়া করেছে যাপনকারী জীবনকে। দূরত্ব ঘুচে গেছে মায়ায়, ভালোবাসায়
ও মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধে। সেটা লেখায়, কবিতায়, সাহিত্যের
সব মাধ্যমে প্রকাশ পায়, প্রচার পায়। স্বাভাবিক।
কবিতাউৎসব: আমাদের নাগরিক
জীবনের অন্তঃসার শূন্যতা এবং দেশজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে শিকড়হীন
সম্পর্ক বর্তমানের এই অন্তর্জাল সাহিত্যজগতে কতটা ও কিরকম প্রভাব ফেলেছে বলে মনে
করেন আপনি।
মৌ মধুবন্তী: প্রথমতঃ নগর
জীবন অন্তসারশুন্য একথা আমি সমর্থন করিনা। নানা রকমের বিনোদনের মাঝে সাহিত্য একটি
মাধ্যম। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের ব্যাপক বিস্তৃতির মাঝে এখনও নতুন প্রজন্ম দূরন্ত ধারনা নিয়ে কবিতা লেখা ও পড়া
করছে। সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে চর্চ্চা করছে। অফলইনেই নয় অনলাইনেও ব্যাপক চর্চ্চা
চলছে, তাতে
নতুন আইডিয়ার সমাবেশ ঘটছে। তবে এতো দ্রুত সব প্রোগ্রাম আসছে যে দ্রুতগামী এই
ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে পাঠক মেধা অথবা ব্যবহারকারীর মেধা কতটা সামাল দিতে পারবে?
এক সময় হারমোনিয়াম, তবলা এতো কষ্ট করে বহন
করে নিয়ে গিয়ে গান গাইতে হতো, এখন তা করতে হয় না।
আই ফোনে সব ইন্সট্রুম্যান্ট আছে এইভাবে বাজাতে পারলে কোন অসুবিধা নেই। সহজিয়া।
অগ্রগতির কোন কিছু সমাজে ফিট না হলে ক্রমেই পিছিয়ে
পড়ে। মানুষ ধরে রাখেনা সেইরকম কিছুকে যা তার নিজস্ব ইচ্ছা বা আগ্রহকে সাপোর্ট না
করে। আমি বলি এইসব সাহিত্যে বিরাট
পজিটিভ সাপর্ট ফেলছে। আগের মত মুরুব্বি হবার মানসিকতার জন্য খারাপ যদিও। সাহিত্যে
এই মুরুব্বিয়ানা দরকার হয় না, আজকের সময়ে।
যেমন আমি কোন কাউকেই মুরুব্বি মানি নাই কবিতার ক্ষেত্রে। তাতে কেউ কেউ খুন্ন হয়েছে, ব্যাপক
লোকে জানে আমি লিখি, আমার লেখার গতি ও ছন্দ আছে। এইভাবে নিজেই ধরে রাখা
যায়। কবিতা আগে লোকে বুঝতা না। এখন
ইউটিউবের বদৌলতে অনেকেই কবিতা শুনতে পারছে, আর পারছে বলেই শুনছে।
আবার সেখানে মিউজিক,ছবি ইত্যাদি দিয়ে আরো আলোকিত করা হয়েছে,নব্য পাঠকের কাছে রসালো করে তুলছে
কবিতাউৎসব: অন্তর্জাল বিপ্লব
বাংলা সাহিত্যের গণ্ডীটিকে হঠাৎই যেন অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কাকদ্বীপ থেকে কানাডা
বা সিলেট থেকে সিয়াটোল,
যেখানেই হোক না
কেন আজকের সাহিত্য আলোর গতিতে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আর এক
প্রান্তে। এর সবচেয়ে জরুরী সুফলটি আমরা দেখতে পাই, দ্বিখণ্ডীত বাংলার উভয় পারের সাহিত্যচর্চার মধ্যে পারস্পরিক সাহচর্য ও
আদানপ্রদানের পরিসরটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে দিনেদিনে ও দ্রুতগতিতে। যেটি আগে
প্রায় অসম্ভবই ছিল। এই পরিসরটিকে আরও ফলপ্রসূ ও শক্তিশালী করে তোলার বিষয়ে কোন কোন
বিষয়গুলির উপর জোর দিতে চান আপনি?
কি কি বিষয়ে
আমাদের আরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ বলে মনে হয় আপনার?
মৌ মধুবন্তী: দুই বাংলার কথা বললে,প্রথমেই আমি বলব গন্ডি
ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার কথা। বাংলাদেশ স্বয়ং সম্পুর্ণ সাহিত্যের উন্নয়ন ও প্রসারে, চিন্তায়
ও চেতনায়। এখণ কোলকাতার সাহিত্যের কাছে ঢাকার সাহিত্য ছায়াবৃত নয়।
তাই সখ্যতার যে মাত্রা দেখছি, তা
ধরে রাখা বা আগে বাংলাদেশের মানুষ কোলকাতায় যেত, এখন
বাংলাদেশের লোক কোলকাতা থেকে শিল্পী দেশে এনে গান শোনে।
কবিতা শোনে। এইসব সোসাল মিডিয়ার প্রভাব ও
ফলাফল। যে বিষয়টা আমি নজর দিতে বলি, তা লেখা যেন সম্পুর্ণ নিজস্ব
চেতনার হয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, লেখা ইংরেজী বা অন্য ভাষায় লেখার
ছায়ায় ঘেরা। সেটার দিকে নজর দিতে হবে। ধর্মবিত্তিক লেখা থেকে ভিন্ন লেখার প্রতি
মনোযোগ আকর্শণ করছি।
হিন্দুরা যেখানে দেব্দেবী নিয়ে লেখে সেখানে মুসলমানেরা সাধারন মানুষ নিয়ে লেখে। পাঠক এর অভিমত কি তার জন্য জরীপ করা দরকার /
আমরা আন্তরিক হচ্ছি, একত্রিত হচ্ছি সেটাই আনন্দের।
কবিতাউৎসব: অন্তর্জাল
সাহিত্যচর্চা যেন অনেকটাই চিত্ররূপময় কবি জীবনানন্দের সেই অমোঘ বাণীটিরই
প্রতিস্পর্ধী! অন্তর্জাল যুগে সকলেই যেন কবি। কেউ কেউ কবি নয়! মাত্র একটি ইমেল
পরিচিতি তৈরী করে নিতে পারলেই সোশ্যালসাইটের দিগন্তে পা রাখতে না রাখতে যে কেউ
নিজেকে কবি বানিয়ে নিতে পারে এখন। যার যত বড়ো বন্ধুবৃত্ত,তার কবিখ্যাতি তত বেশি। যে কোন ভাষার সাহিত্যের পক্ষেই এ যে
বড়ো সুখের সময় নয়- সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অন্তর্জাল সাহিত্য দিগন্তের এইটাই
কি স্বাভাবিক পরিণতি নয়? কি ভাবে তৈরী হতে পারে প্রকৃত
সাহিত্যের রক্ষাকবচ?
মৌ মধুবন্তী: এইটাই তো
পাবলিক প্ল্যাটফর্মের সুবিধা। মানুষ সহজেই নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে।
গুণগত দিক বিচার করলে কেবল গুণিরাই টিকে থাকবে, বন্ধু সংখ্যা একটি পরিমাপকাঠি। এখন
আর সিনিয়রদের কাছে ধর্ণা দিতে হবে না। দারুণ
বেদনাদায়ক মুরুব্বিদের জন্য। যেমন বই প্রকাশ করতে হলে প্রকাশকেরা পয়সা দাবী করে
একজন লেখক বা কবির কাছে। এই
সুন্দর প্ল্যাটফরম আছে, ই বুক পাব্লিশিং আছে। পাব্লিশারের কাছ থেকে বই বের না
করলে সে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ই বুক বের করেই পাঠক তৈরী করছে।
অসুবিধা কোথায়?
কবিতাউৎসব: এত স্বল্প পরিসরে
কতকথাই অনালোচিত রয়ে গেল,
ভবিষ্যতে
সেগুলির জন্যে আপনাকে আগাম আমন্ত্রণ কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে। তবে আজকের আলোচনা শেষ
করতে চাই আপনারই লেখা কোনো একটি কবিতা দিয়ে। যদি অনুগ্রহ করে আপনার স্বরচিত কোনো
একটি প্রিয় কবিতার উল্লেখ করেন,
ভালো লাগবে
আমাদের!
মৌ মধুবন্তী: আমি ক্লাস ফোরে পড়াকালীন সময়ে বাপী আমাকে সোভিয়েত
নারী ও উদয়ন এই দু’টি ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রাইবার করে দিয়েছিলেন। সেটা
তখন বুঝিনি এখন বুঝি। পড়বার অভ্যেস প্রবল থাকায় ম্যাগাজিন দুটো হয়ে ওঠে আমার নিত্য
সঙ্গী। আমি একটি কন্যা মানুষের মা, সাহিত্যের পাতায় চোখ রাখি ক্লাস
ফোরের থেকে। বাবা মায়ের কোন উতসাহ ছিল কিনা জানতেই চাইনি, স্বাধীনচেতা মানুষ আমি ছোটবেলা থেকে। সে স্বাধীনচেতা মনের
কারণেই আমি গার্লস ইডেন কলেজের দু’বছর সময় একদম পছন্দ করিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলের ছাত্রী থাকাকালীন মুক্তকঠে আবৃত্তি প্রশিক্ষণ নিতে
যাই।একটি ভূল সিদ্ধান্ত পথ থেকে অনেক দূর
সরিয়ে নিয়ে যায়, আমারো তাই হয়েছে-এই মুক্তকন্ঠে। প্রেম হয় এইখানে। এর
পরের জীবন শুরু হয় নর্থ আমেরিকাতে ১৯৯০ সাল থেকে। দীর্ঘ ৮ বছর বইয়ের সাথে আমার
বন্ধুত্ব ছিলনা,লেখালেখি চলছিলো খুড়িয়ে খুড়িয়ে মত।
কোনকালে লেখা পত্রিকায় যাবে এমন ভাবিনি। কিন্তু কি করে কেউ যেন কবিতা পত্রিকায়
পাঠিয়েছে তা আজো জানিনা,তবে ছাপা হয়েছিল একটি ছোটাখাট পত্রিকায়। নাম মনে নেই।
আমি এসবে গুছানো নই একদম। বরাবর অন্যায়,অত্যাচার আমাকে নাড়া দিত।আর আমার
লেখায় তা প্রকাশ পায়। আমি এখনো কবিই হয়ে উঠিনি সাহিত্যিক তো এখন অনেক দূরের পথ। লিখতে
ভালোবাসি। আবৃত্তি মাধ্যম আমার খুব পছন্দের। সিমন দা বিভউর আমার আদর্শ। বেগম
রোকেয়া আমার আলোকশিখা। ফেসবুকে আড্ডাবাজী দারুন ভালো লাগে। খাবারের দিক থেকে আমি
মাছে ভাতে বাঙালী হই মাঝে মাঝে। কবিতাই
আমার একমাত্র ধ্যান। সামাজিক ও কম্যুনিটির উন্ননে অনেক সংগঠনের সাথে জড়িত। অনলাইন,নেটয়ার্ক
বিজিনেস আমার কর্মক্ষেত্র।
জঙ্গিরা খুন করিস নে
মৌ মধুবন্তী
আমাদের সন্তান থাক দুধে ভাতে
জঙ্গিরা আসিস না তাদের কাছে
তোরাও জন্মেছিলি মানুষ হয়ে
কখন এমন হিংস্র হলি? কোন
দাবানলে পুড়ে। আমরা সবাই
এক সমান, সাদা,কালো কিংবা
তামাটে। খুন করিস না বাংলাদেশে
এ আমার সোনার দেশ পেয়েছিরে
অনেক রক্তের বদলে। থাকতে দে
মা কে নি
রা প দে –শান্তিতে।