সুকন্যা
বন্দ্যোপাধ্যায়
পিছুডাক
********
পদাতিক দুঃখ-রা
মৌনমিছিলে হাঁটে,
রাক্ষসী বেলা--
কর্কটকাল নামে, হার আর জিতে চলে
লুকোচুরি খেলা।
আকাশে দু'হাত ছুঁড়ে, মাতৃস্তন্য খোঁজে
একাকী গাছেরা,
শিকড়ে শিকড়ে আছে
পরিচয় লেখা,
তবু হয়নি তো
ফেরা।
পৃথিবীর
নাভিমূলে, অতীত প্রহরী নেই-
কবে মুছে গেছে।
ঘাসের আয়ুষ্কাল
বুকে ধরে রেখে, প্রেম
আজো জেগে আছে।
জাতিস্মর
জন্মদাগ স্বাক্ষর রেখে
যায়, হিমকুয়াশায়---
পাশাখেলা শেষ
হলো। গুহামানবী মা
ডাকে--''আয়, আয়, আয়--
জরায়ুর ঋণ যত,
নিয়তির বিধি মত
শুধে যাবি--বসে
আছি সেই দুরাশায়-''
গুহামানবী মা
ডাকে-''আয়, আয়, আয়''!
কিন্নর-কথা
**********
প্রান্তিক
নিসর্গছায়া ঘন হয়ে জমে আছে
কামরাঙা গাছের
তলায়--
গমরঙা রোদ একা
খেলা করে
বুনোকুল ঝোপের
পাতায়--
সেইখানে, সরীসৃপ কামনা-রা
বুকে হাঁটে
জানান না দিয়ে!!
তবু,
তোমার নিবিড়
চোখে শুভ দৃষ্টিপাত করি,
কাজলের দাগটি
লুকিয়ে।
তোমার নিশ্বাসে
পাকা ধানের সুবাস,
আমার চুম্বনে
তাই প্রকৃতির ওম লেগে থাকে-
মিনার্ভার
বীজমন্ত্র, সরস্বতী ছন্দে আজ বেঁধেছে যে তোমাকে-আমাকে।
মহাজাগতিক
************
ছাইরঙা ভোর, চায়ের কাপে,
ঝাপসা কাঁচে, জলকবিতা--
তুমি তো খুব
দূরের মানুষ,
মেঘের সঙ্গে কুটুম্বিতা।
কাটছিল বেশ, একলা বিকেল,
কুড়িয়ে নুড়ি, জীবনপথের--
মনখারাপের
চরকাবুড়ি,
ওড়না বোনে নষ্ট চাঁদের।
শ্রাবণললিত
ছন্দে নেচে,
ঠিকরোলো রোদ নাকছাবিতে,
বাঁধভাঙা সাধ
ভাসিয়ে এলে,
আবাদ করতে মনের ভিটে।
তোমার সুরের
আকাশ-জোড়া
মূর্ছনাতে, বাখ-বিটোফেন,
আমার ঘরে তাঁতের
মাকু,
সাঁঝ-সকালের টানা-পোড়েন।
বইছে হাওয়া
শনশনিয়ে,
নদীর ঘাটে চকোর মিথুন,
রোদের গায়ে ছাপ
রেখে যায়
জলের ছায়া-- দুপুর নিঝুম।
এমনি করেই
সাবধানী সুখ,
রাখছে খবর দীর্ঘশ্বাসের,
শান্ত মাটির
ইচ্ছে জলে,
অকিঞ্চিতের নৌকো ভাসে।
জীর্ণ
ছড়া
********
ভীরু বল্মীক,
ডাকে তক্ষক।
ভাঙা কার্নিশ-
একা দাঁড়কাক।
ছেঁড়া গালচে-য়
শুয়ে বুড়ো দিন,
ফাটা মেঝেময়,
সময়ের ঋণ।
চটা আলসেতে,
অশথের গাছ-
ছানিপড়া চোখে
অতীতের নাচ।
উই লাগা খাটে
ঘুণধরা হাড়,
পুরোনো ডায়েরি,
স্মৃতি---
কবেকার!
সন্ধে নামলে
ঝুপসি আঁধার--
শাঁখ বাজে না তো,
দম নেই আর।
দালানের কোণে,
ছায়া জমে যেই,
কারা যেন বলে--
''মন ভাল নেই,
বড় মায়া, তবু,
যেতে তো হবেই,
মন ভাল নেই
মন ভাল নেই''!
অজয়মেরু
*********
চিশতির কবরে
মানতের লালসুতো বেঁধে ফেরে সে,
তার চোখের পাতায়
বসত করে বিবর্ণ
একফালি আজকালপরশুর গল্প--
তার রুখু চুল
নিয়ে খেলা করে
আনাসাগরের জল
ছুঁয়ে আসা হাওয়া----
তার কাঁচামাটির
অন্তরে
গভীর রেখা কেটে
চলে প্লাস্টিকের জীবনযাপন,
বড় কষ্ট হয় তার।
তারাগড় দুর্গের
প্রাকারসীমার
ওপার থেকে,
শুদ্ধসত্ত্বা
হাত বাড়িয়ে ডাকে--
''মুক্তি নিবি? আয়, আয়, আয় না রে---''
সে পারে না।
সাবিত্রী
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
বাঙ্ময় কাকচক্ষু
হ্রদ--
যেন মানবপিতার
অশ্রু জমেছে এসে,
কি অপার শান্তি!
হাত বাড়ায়
পশ্চিমা পুরোহিতের দল--
তর্পণ করাবে
বলে--
সোনালি অতীতের
ভারে
নত হয় মাথা,
অঞ্জলিবদ্ধ জল
দুর্বল মুঠিকে দেয় ফাঁকি--
শুধোয় ঋত্বিক, --''নাম?''
মেরুদন্ডের
পাকদন্ডী বেয়ে,
একটি স্বাধীন
স্বেদবিন্দু নামে-
শূন্য করপুটে
পড়ে একফোঁটা আত্মাভিমান---
একবার, শুধু একবার,
অমোঘ উচ্চারণে
বলে সে--
''পৃথ্বীরাজ চৌহান।''