বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়



সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

পিছুডাক
********
পদাতিক দুঃখ-রা মৌনমিছিলে হাঁটে,
রাক্ষসী বেলা--
কর্কটকাল নামে, হার আর জিতে চলে
লুকোচুরি খেলা।

আকাশে দু'হাত ছুঁড়ে, মাতৃস্তন্য খোঁজে
একাকী গাছেরা,
শিকড়ে শিকড়ে আছে পরিচয় লেখা,
তবু হয়নি তো ফেরা।

পৃথিবীর নাভিমূলে, অতীত প্রহরী নেই-
কবে মুছে গেছে।
ঘাসের আয়ুষ্কাল বুকে ধরে রেখে, প্রেম
আজো জেগে আছে।

জাতিস্মর জন্মদাগ স্বাক্ষর রেখে
যায়, হিমকুয়াশায়---
পাশাখেলা শেষ হলো। গুহামানবী মা
ডাকে--''আয়, আয়, আয়--
জরায়ুর ঋণ যত,
নিয়তির বিধি মত
শুধে যাবি--বসে আছি সেই দুরাশায়-''
গুহামানবী মা ডাকে-''আয়, আয়, আয়''!



কিন্নর-কথা
**********
প্রান্তিক নিসর্গছায়া ঘন হয়ে জমে আছে
কামরাঙা গাছের তলায়--
গমরঙা রোদ একা খেলা করে
বুনোকুল ঝোপের পাতায়--
সেইখানে, সরীসৃপ কামনা-রা
বুকে হাঁটে জানান না দিয়ে!!
তবু,
তোমার নিবিড় চোখে শুভ দৃষ্টিপাত করি,
কাজলের দাগটি লুকিয়ে।
তোমার নিশ্বাসে পাকা ধানের সুবাস,
আমার চুম্বনে তাই প্রকৃতির ওম লেগে থাকে-
মিনার্ভার বীজমন্ত্র, সরস্বতী ছন্দে আজ বেঁধেছে যে তোমাকে-আমাকে।



মহাজাগতিক
************
ছাইরঙা ভোর, চায়ের কাপে,
  ঝাপসা কাঁচে, জলকবিতা--
তুমি তো খুব দূরের মানুষ,
  মেঘের সঙ্গে কুটুম্বিতা।

কাটছিল বেশ, একলা বিকেল,
  কুড়িয়ে নুড়ি, জীবনপথের--
মনখারাপের চরকাবুড়ি,
  ওড়না বোনে নষ্ট চাঁদের।

শ্রাবণললিত ছন্দে নেচে,
  ঠিকরোলো রোদ নাকছাবিতে,
বাঁধভাঙা সাধ ভাসিয়ে এলে,
  আবাদ করতে মনের ভিটে।

তোমার সুরের আকাশ-জোড়া
  মূর্ছনাতে, বাখ-বিটোফেন,
আমার ঘরে তাঁতের মাকু,
  সাঁঝ-সকালের টানা-পোড়েন।

বইছে হাওয়া শনশনিয়ে,
  নদীর ঘাটে চকোর মিথুন,
রোদের গায়ে ছাপ রেখে যায়
  জলের ছায়া-- দুপুর নিঝুম।

এমনি করেই সাবধানী সুখ,
  রাখছে খবর দীর্ঘশ্বাসের,
শান্ত মাটির ইচ্ছে জলে,
  অকিঞ্চিতের নৌকো ভাসে।



জীর্ণ ছড়া
********
ভীরু বল্মীক,
ডাকে তক্ষক।
ভাঙা কার্নিশ-
একা দাঁড়কাক।
ছেঁড়া গালচে-য়
শুয়ে বুড়ো দিন,
ফাটা মেঝেময়,
সময়ের ঋণ।

চটা আলসেতে,
অশথের গাছ-
ছানিপড়া চোখে
অতীতের নাচ।
উই লাগা খাটে
ঘুণধরা হাড়,
পুরোনো ডায়েরি,
স্মৃতি--- কবেকার!

সন্ধে নামলে
ঝুপসি আঁধার--
শাঁখ বাজে না তো,
দম নেই আর।
দালানের কোণে,
ছায়া জমে যেই,
কারা যেন বলে--
''মন ভাল নেই,
বড় মায়া, তবু,
যেতে তো হবেই,
মন ভাল নেই
মন ভাল নেই''!



অজয়মেরু
*********
চিশতির কবরে মানতের লালসুতো বেঁধে ফেরে সে,
তার চোখের পাতায়
বসত করে বিবর্ণ একফালি আজকালপরশুর গল্প--
তার রুখু চুল নিয়ে খেলা করে
আনাসাগরের জল ছুঁয়ে আসা হাওয়া----
তার কাঁচামাটির অন্তরে
গভীর রেখা কেটে চলে প্লাস্টিকের জীবনযাপন,
বড় কষ্ট হয় তার।

তারাগড় দুর্গের প্রাকারসীমার
ওপার থেকে,
শুদ্ধসত্ত্বা হাত বাড়িয়ে ডাকে--
''মুক্তি নিবি? আয়, আয়, আয় না রে---''
সে পারে না।

সাবিত্রী পাহাড়ের কোল ঘেঁষে
বাঙ্ময় কাকচক্ষু হ্রদ--
যেন মানবপিতার অশ্রু জমেছে এসে,
কি অপার শান্তি!
হাত বাড়ায় পশ্চিমা পুরোহিতের দল--
তর্পণ করাবে বলে--
সোনালি অতীতের ভারে
নত হয় মাথা,
অঞ্জলিবদ্ধ জল দুর্বল মুঠিকে দেয় ফাঁকি--
শুধোয় ঋত্বিক, --''নাম?''

মেরুদন্ডের পাকদন্ডী বেয়ে,
একটি স্বাধীন স্বেদবিন্দু নামে-
শূন্য করপুটে পড়ে একফোঁটা আত্মাভিমান---
একবার, শুধু একবার,
অমোঘ উচ্চারণে বলে সে--
''পৃথ্বীরাজ চৌহান।''