মৌ
দাশগুপ্ত
পাগলের
ইতিকথা
পাগল
-১
মোড়ের মাথার
শনিমন্দিরের চাতালে শোয়াবসা যে ভবঘুরে পাগলটার,
তার একটাই
চাহিদা ,
‘আমার নামটা, আমার নামটা ফেরত দাও না আমায়, ।‘
হাতে শতচ্ছিন্ন
একটুকরো কাপড়, নোংরা,তেল চিটচিটে,
পেট ভরা আর মন
ভালো থাকলে
সেটারই
আনাচকানাচ তন্নতন্ন করে খোঁজে সারাদিন।
যদিও আমার
আজন্ম-অচেনা ঐ মানুষটার পুরোনো ছেঁড়া রুমালে
কারো কোনো
স্মৃতিই আর নেই,
নেই কোনো রঙিন
সুতোয় বোনা চেনা অক্ষর ।
তবু তাতেই
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে ভুলে যাওয়া নামের ধ্বংসাবশেষ।
ঠাম্মার ঘরটা আজ
তিন বছরের ওপর খালি।
ছুটির সকালে সাফসুতরো
করতে করতে অবাক হচ্ছি,
কত যে জঞ্জাল
বুড়ি তোরঙ্গে, পোঁটলায় জমিয়ে রেখে গেছে!
দাদুর চশমা, পিসিঠাম্মার ছেঁড়া মহাভারত, আমার ভাঙা খেলনা,
বাবার স্কুলের
বইখাতা,পিসির ফ্রকজামা,
পুরানো এর-তার
লেখা হলদে চিঠির গোছা,
ভরাট স্টীচে
এমব্রয়েডারী করা সবুজ টিয়ার নীচে লেখা
‘সুখ নামের শুকপাখী’,বোধহয় ঠাম্মার হাতের সুতোর কাজ,
এও দেখি আরেক
ধরনের পাগলামো।
সন্ধ্যাবেলা
পার্ক থেকে ফেরার সময় দেখি,
ঠাম্মার সেই
ফেলে দেওয়া সুতোর কাজ পাগলটার হাতে,
মন দিয়ে নখে
খুঁটে খুঁটে সুতো তুলছে।
আমায় দেখে একগাল
হেসে বলল,
‘দ্যাখো কেমন নামটা ফেরত পেয়ে
গেছি,আর চিন্তা নেই,’
দেখি, সুতো তুলতে তুলতে ‘টিয়াপাখী’, ‘শুকপাখী’, ‘নাম’শুদ্ধ উধাও,
ছেঁড়া কাপড়ের
এককোনে একা ‘সুখ’ পড়ে আছে।
পাগল-২
পাড়ার মধ্যিখানে
বারোয়ারী পুকুর, বাড়িঘরে ঘেরা।
উল্টোদিকে
তাপসীকাকীমাদের একটেরে ছড়ানো টালির ঘর।
বাইরের
পুকুরমুখী ঘরটায় বাইরে থেকে শিকল তোলা, তালা দেওয়া।
কখনো সখনো
খাবারের থালা হাতে কাকীমা তালা খুলে ঘরে ঢোকে।
লম্বা লম্বা
গারদ লাগানো জানলাটা কখনো বন্ধ হয়না।
গরাদের ফাঁকে
উঁকি মারে গোঁফদাড়িভরা খেপাটে একটা মুখ।
হাতছানি দিয়ে
ডাকে পথচলতি লোক, স্কুলপড়ুয়া কিশোর,খেলুড়ে শিশুদের…
জনে জনে ডেকে
মিনতি করে দরজাটা খুলে দিতে,কখনো কাঁদে,
কখনো দাঁত
কিড়মিড় করে রাগে, কখনো অভিশাপ দেয়।
গরাদ ভাঙার
চেষ্টায় হলুদ দাঁতের ফাঁকে কষ বেয়ে গড়ায় সাদা ফেনা।
বদ্ধপাগল কিনা,ওর অর্থহীন প্রলাপ আমাদের কথাবার্তা কি হল্লায় মিশে
পথের ধুলো ও
দিনের আলোয় লীন হয়ে থাকে।
পাগল-৩
একদম একা একটা
মানুষ আর তার চার দেওয়ালের খাঁচাবদ্ধ পাগলাটে জীবন।
সারাদিন ঘরে
থাকে,একা-একা ,নিজের মত; যেন অনন্ত প্রবাস!
এই ঘরে পথের
শব্দ ভেসে আসে ,প্রতিবিম্বিত ছায়া দেয় পুকুরের জল,
পানকৌড়ি ঘাই
মারে, জলের ছলাৎ শব্দ বুক ভেঙে উঠে আসে;
দেওয়ালে
ঝিলিমিলি আলো ছায়া রোদ্দুর বনের ছায়াভ্রম ঘটায়,
পাখীরা সেই
একসুরে গান গায়, নীড়ে ফেরে ডানা ঝাপটে,
উড়ন্ত পাখীর
দিকে চেয়ে হয়ত বা মনে পড়ে পাহাড়তলীর ছায়া,চিত্রিত পাথর …
ঘরের বাইরে সবুজ
ঘাস,একবার এসে দাঁড়ালে এ ঘাসে - মনে হয় অরণ্য
অতীত ঢেউ থেকে
ভেসে আসে সাঁওতাল যুবতীর অর্থহীন গানের সুর,
পাশের বাড়ীর
রেডিওর চাপা আওয়াজে মিলেমিশে এক হয়ে যায়,
পাগল চোখ বুজে
গান গায় দুখীস্বরে। পথ খোঁজে,
আহা, এতো তার নিজের ঘর,তবু এই ঘরে সে তো বন্দী! পথিক নয়!
পাগল-৪
আকাশে চাঁদ
উঠলেই দারুণ বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে …
লোকের ভীড়ে,নির্জনে,রাস্তায়,লোকালয়ে, শ্মশানে,
আবর্জনার পচা
গন্ধে, মাটির ভেজা গন্ধে,ভাটিখানার সুবাসে,
পাঁচফোড়নের
ঘরোয়া গন্ধে,ব্লিচিংপাউডার বিলাসে.
ফুলের সুবাসে,ঘাসের সবুজ গন্ধে,আশেপাশের বোঁটকা দুর্গন্ধে.
একমুঠো ভাত,একটুকরো খাবারের গন্ধে,আঃ গন্ধ,আরও গন্ধ…
ভীষণ বেঁচে
থাকতে ইচ্ছা করে…
খুব বেঁচে থাকতে
ইচ্ছা করে ফুটপাতে বাদশাহী চালে শুয়ে
লোকের পায়ে
ঠোক্কর খেতে খেতে.
ছোঁড়া ঢিলের
জবাবে পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে,
সুবেশা মহিলাদের
ভয় দেখিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে,
হাসপাতাল অথবা
বাসস্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে চক্কর কাটতে কাটতে।
খুব বেঁচে থাকতে
ইচ্ছা করে,,,
সুস্থ হয়ে
যাওয়ার চেয়ে পাগলামোর শক্তি ঢের বেশী,
যেমন জীবনের
চেয়ে যন্ত্রণার ,মরার থেকে বেঁচে থাকার,
কিন্তু বিশ্বাস
করো ,তোমরা পাগল বলে দুচ্ছাই না করলেই
আমার মরে যেতে
ইচ্ছা করে।
পাগল-৫
যাতায়াতের পথে
রোজই নজরে পড়ে,
মোড়ের মাথায়
শ্যামাদার চায়ের দোকানের সামনে
এঁটো চায়ের কাপ
হাতে চা চাইছে এক পাগল।
পরনে জামা নেই, জটাধারী চুল, গায়ে বিনা স্নানের দুর্গন্ধ,
দোকানের সামনে
রাস্তা, আর সেই
রাস্তা পেরিয়েই
ঝুপসি গুলমোহরের তলায়
ভবঘুরে পাগলের
এঁটো চায়ের কাপ জমানো আস্তানা।
মেজাজ ভালো
থাকলে তারস্বরে গান,
যেন পূর্বজন্মের
শাহেনশাহ।
আর মেজাজ
বিগরালেই তারস্বরে গালি।
ক্রুদ্ধ পাগলের মুখে দেখি
একালের ভ্রান্ত পরাজয় ।