সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭

শৌনক দত্ত



কবিতাউৎসব সাক্ষাৎকার  ১৪২৪

কবিতাউৎসব: কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসবএ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে,  এই নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি কবিতা পড়তে ভালোবাসি কবিতায় থাকতে ভালোবাসি আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা তাই কবিতা নিয়ে বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব,  শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র বাংলার জনজীবনে কবিতার এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে কি ভাবে প্রভাবিত করে এবং আপনার লেখকসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?

শৌনক দত্ত: আপনার এবং কবিতা উৎসবের প্রতি অসংখ্য কৃতজ্ঞতাবাঙালি জনজীবনে যে কবিতা প্রেমের দেখা মেলে তা অন্য কোথাও এত দেখা পাওয়া যায় না বলেই আমার মনে হয়আমার বেড়ে ওঠাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নিজন্মের পরে যখন বুঝতে শিখছি, দেখেছি বাড়ীতে আলমারি ভর্তি বইঠাকুরদা রোজ ভোরে মন্ত্র পড়ে জাগিয়ে তুলছেন বাড়ী, সুর করে বৈষ্ণব পদাবলী শুনছেন কালীবাড়ীর কর্তার মুখেমহালয়ার দিন ভোরে সবাই একসাথে বসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র শুনছে বাবু(বাবা) নিয়ম করে বই পড়ছেনকাকুরা, পিসিরা পড়ছেনছুটির দিনগুলোতে বাড়ীতে আসর বসছেদিদিভাই, কাকুরা, পিসিরা গান করছে, কবিতা আবৃত্তি হচ্ছেআমি তখন খুব ছোট শুনিছি, আড্ডা প্রিয় একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে উঠছিএকদিন পারিবারিক আড্ডাতেই শুনছি বাবু জীবনানন্দ দাশের কবিতার বইটি সংগ্রহ করতে কলকাতায় ছুটে গিয়েছিলেনজীবনানন্দ দাশ কে? শিশুমনের হয়ত কৌতুহলের জন্ম হয়েছিলো যে পিতা কলকাতায় যেতেই চান না তিনি কবিতার টানে কলকাতা ছুটে গেলেন এক কাপড়ে! বাবুর আলমারিতে সাজানো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, মধুসূদন নয় সুধীন্দ্র নাথ দত্ত কিংবা সমসাময়িক অন্য কেউ না ভাঙ্গা ভাঙা উচ্চারণে বর্ণের পিঠে বর্ণ জুড়ে জীবনানন্দ দাশ খুঁজে বের করলামআমি তখন পাঁচসেদিন কি বুঝেছিলাম আজ তার কিছুই মনে নেই, তবে সেইদিনই বোধ করি একজন পাঠক শৌনকের চোখ জুড়ে বসলেন কবিতালেখকসত্বা আছে কিনা তা বলবে মহাকাল তবে পাঠক শৌনককে তৈরীতে ক্রিয়াশীল ছিলো কবিতা তার প্রভাব আজো তারিয়ে বেড়ায় বলতে পারি দ্বিধাহীন উচ্চারণে 


কবিতাউৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন?  অর্থাৎ জানতে চাইছি জাতি হিসেবে সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক হুজুগ,  সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে

শৌনক দত্ত:  যদি আপনার প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেই তবে উচ্চারণ করতে চাই-

ধুলার এ পথ যাই ভিজায়ে,
শ্যামল আসন যাই বিছায়ে,
অমল করে যাই রেখে যাই
ক্ষাণিক কাঁদা হাসা

কুমুদরঞ্জন মল্লিকের এই কয়টি পংক্তিই হতে পারে তার উত্তর বাঙালির প্রতিদিনের জীবনে কাব্যসাহিত্য তার যাপনে মিশে, কিছু যুগ আগেও বাঙালির প্রতিটি শৈশব বেড়ে উঠেছে পাঁচালির কথায় ও ছন্দেঅলস দুপুরে ঠাকুরমার গলায় রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণ র্কীতন, বৈষ্ণব পদাবলী শুনে শুনেআর তাই বাঙালির জীবনে কাব্য এক আত্মযাপনের নামমজার বিষয় খেয়াল করি কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮২-১৯৭০) কবিতার পাঠক মহলে কিংবা কবি মহলেও বহুল পঠিত ননএতগুলো কাব্যগ্রন্থ এই কবির সেভাবে আজকাল সেগুলো পাওয়াও যায় নাকবি দাদ আলী, গোবিন্দচন্দ্র দাস, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এমন অসংখ্য নাম করা যাবে যাদের কবিতা তো বটেই নামও আমরা ভুলতে বসেছিতাদের সাহিত্যের সাথে আত্মিক যোগ ছিলো বলেই তারা সামাজিক পরিচিতি নয় বরং ভালবাসার টানেই লিখে গেছেনে, এখনো এমন অনেকেই আছেন যারা অন্তরালে আত্মিক টানেই লেখছেন রোজ


কবিতাউৎসব:  কাব্যচর্চা বা সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যচর্চা বলতে আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই সাহিত্যচর্চায় বিশ্বাসী?  না কি মনে করেন কবিতা বা সাহিত্যেরও একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে?  আপনার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার জীবনের প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেনসামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে,  একজন সাহিত্যিকের সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?  যেমন ধরা যাক একুশের চেতনা বাংলা ভাষার স্বাধিকার বোধ এইসব বিষয়গুলিমুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ লক্ষ্যগুলি 

শৌনক দত্ত:- আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি সাহিত্যচর্চা একটি সাধনাযা চর্চাকারীকে করে গভীর ও ধীরসাধনার পর্যায় যত বাড়ে মানুষ ততই অবলুপ্ত করতে থাকে কুসংস্কার, সংর্কীণতা, দীনতানিজের মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই পরিক্রমায় সে প্রকৃতির নিয়মেই তার সমাজ, দেশ এবং বিশ্বের সাথে মিশে যেতে থাকে, আর তখনই তৈরি হয় দায় সেই মানুষটি ততদিনে আমি শব্দটি অবলুপ্ত করে ফেলেছেন নিজের কাছে, তখন তার কাছে দায় কিন্তু বদ্ধতা নয়, দায়মুক্তি হয়ে ওঠেছে এবং সে মনে করবে সমাজ, দেশ ও বিশ্ব ভাল থাকলেই আমরা ভাল থাকবো

একুশের চেতনা, বাংলা ভাষার স্বাধিকার বোধ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণ লক্ষ্যগুলি বলতে আপনি তিনটি বিষয়কে এক করে ফেলছেন, তিনটি বিষয় আলাদাদুটিরসময়, প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন আলাদা আলাদাআর ভাষার স্বাধিকার বোধ নিয়ে সতের দশকে কবি আবদুল হাকিমের কয়টি পংক্তি আজো সমসাময়িক বলে মনে করি-

যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়াএ
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে  ন যাএ। ।


কবিতাউৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে একজন সাহিত্যিকের দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?  আবার এই প্রসঙ্গে এইকথাও মনে হয় না কি,  নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে পারে?  এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?

শৌনক দত্ত:- প্রবাদ বাক্য শুনি শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়নিরপেক্ষ শব্দটি কখন উচ্চারণ হচ্ছে যখন দুটি পক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনি কোন পক্ষের মতামত বা আদর্শকে সমর্থন করছেন না, আবার নিজের মতকেও প্রাধান্য দিচ্ছেন নাশিশু ব্যাতিত এটি সম্ভব নয় তাই সাহিত্যিকও নিরপেক্ষ ননকিন্তু সাহিত্যিক একটি আয়না,  আগেই বলছিলাম সাধনার কথা, সাহিত্যের সাধক জানবেন, বুঝবেন, দেখবেন কিন্তু নিজের আমিত্বকে লোপ করলে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ একটাই সকলের হিতের, শুভ ও সুন্দরেরনিদিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ সাহিত্যিকের সাহিত্যভুবন কে বৈচিত্রহীন নয় কেবল স্হবিরও করে দেয় এবং সেই আয়নাটিতে তখন আর পারদ থাকেনা সে কেবল কাঁচ মাত্র


কবিতাউৎসব:  আবার এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি,  এবং কেন?  কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর  

শৌনক দত্ত:- সমাজচেতনার ভিত্তি সুদৃঢ় হবে কখন যখন ইতিহাসটা জানবো, ইতিহাস পাঠ এবং চর্চা এক জাতীয় গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজ সেভাবে দেখলে ইতিহাস বিজ্ঞানেরই অনুবর্তী যা অজ্ঞাত তার অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান ইতিহাস বিজ্ঞানের স্বগোত্র শুধু তা সন্ধিৎসার ক্ষেত্রে ভিন্ন অতীতের সংঘটিত মানবিক কর্মকাণ্ড ও তৎসংশ্লিষ্ট জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর খুঁজে বের করাই ইতিহাসের বিবেচনাধীন ইতিহাস এ দায়িত্ব পালন করে তথ্য,  প্রমাণ,  ব্যাখ্যা ও মীমাংসার মধ্য দিয়েএকজন কবি তিনি,  যিনি  সময়ের মাপকাঠিতে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন  তাঁর কাব্য ইতিহাস নির্ভর কী না তার চেয়ে বড় কথা হলো ইতিহাস সম্পর্কে তিনি কতটা সজাগ-সচেতনজীবনানন্দের ভাষায় বললে- একজন কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার,  কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান


কবিতাউৎসব:  এই যে স্বদেশপ্রেম,  নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি একজন সাহিত্যিককে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি?  অর্থাৎ আপনার সাহিত্য তো প্রাথমিক ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই কিন্তু সেই সাহিত্যের পরিমণ্ডলেও কি একজন বিদেশী তৃপ্তি পেতে পারেন যদি না আপনার লেখা আপনার স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উর্ধে উঠতে পারে?  বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়,  কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না?

শৌনক দত্ত:- প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে মনে করি নাকেন মনে করি না বলছি, সাহিত্যিক যখন সাধনা লব্ধ গভীরতায় মগ্ন তখন সে সত্য, সুন্দরের আয়নাসাহিত্য কেবল নয় সকল শৈল্পিকতার একটাই ভাষা হৃদয়কে ছোঁয়াসৃষ্টি তখনই বিশ্বের হৃদয়ে দাগ ফেলবে যখন আমিত্বকে অবলুপ্ত করে বিশ্বকে ইতিহাস চেতনায় সময়ের সাথে লালন করা যাবে    


কবিতাউৎসব: সাম্প্রতিক অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছেআগে লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো,  যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো দেখতে পেত না আজ কিন্তু যে কেউই তার কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে এই বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন,  এতে কবিতার জাত গিয়েছে চলে এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে,  যে তার তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি?  না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?

শৌনক দত্ত:- পাঠককে বোকা ভাবার অবকাশ কোন কালেই ছিলো না, এখনো নেইঅকবিতা বলে কিছু নেইকবিতা বলতে বুঝি    দ্রষ্টার অনন্য মননদৃষ্টি ও শূদ্ধতম হৃদয়বৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম নান্দনিক শব্দসৌধ সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের না পারাদের মুক্তিআমার কবিতা কারো মনে হতেই পারে সেটা অকবিতা, তার দিক থেকে সে ঠিক কেননা সে হয় আমাকে রিলেট করতে পারেনি কিংবা আমি সময়ের ধারায় নিজের শব্দকে গোছাতে পারিনিকবির যেমন জাত নেই কবিতারও জাত হতে পারে নাতাই জাত গেলো রবও অর্থহীন

আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ তাই আমি প্রতিদিন অনেকটা সময় খুঁজে খুঁজে পড়ি এবং বেশ ভাল ভাল লেখাও পেয়ে যাইতারচেয়েও বড় ব্যাপার পর্যবেক্ষণ করা যায় সমসাময়িক ভাবনার কবিতাটির সাথে নিজের অবস্থানতারচেয়েও মূল্যবান কথা হলো মহাকাল বড় নির্ণায়ক, হাজার ফুলের ভিড়ে পূজার ফুলটি তিনি ঠিক বেচে নিয়ে পাঠকের সাজিতে সাজিয়েই দেন


কবিতাউৎসব: সমাজজীবনে অস্থিরতা সাহিত্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন?  না কি যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের কাছে তার লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে যেমন ধরা যাক ওপার বাংলায় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন,  এপারের সত্তরের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দশক; বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার সাহিত্যচর্চার ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা,   রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক আঁতাত; নিরন্তর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকার বাসনায় বুদ্ধিজীবীদের   ক্রমাগত ভোলবদল- এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে দিতে পারে কি?  বা পারলে সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?

শৌনক দত্ত:- আমি তখন ১৩ বসুমতিতে আমার বেশকিছু লেখা ছাপা হয়ে গেছে স্কুলে, শহরেও অনেকে ইয়ারকি করে কবি ডাকে আমার প্রথম সমুদ্রযাত্রা দক্ষিণভারতে আমার কাকা নিহারেন্দু দত্ত যাকে আমি বাবা ডাকিতিনিই মুলত আমার সাহিত্য করতে আসার গুরু ও পথপ্রদর্শকসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে বললেন দেখো সমুদ্রের ঢেউগুলো আসছে, ফিরে যাচ্ছেআমি দেখলাম তাই তো অস্থির ঢেউগুলো একরাশ ঝিনুক, কড়ি, নুড়ি বালু নিয়ে আছড়ে পড়ছে, আবার ঝিনুক, কড়ি, নুড়ি বালু নিয়ে ঢেউ ফিরে যাচ্ছেঅনেক ক্ষণ দেখলাম,  তিনি হাসলেন কিন্তু কিছুই বললেন নাপরের দিন আমরা নীলগিরি গেছিপাহাড়ে দাঁড়িয়ে তিনি আবার বললেন চিৎকার করে নিজেকে ডাকোঅবাক হয়ে দেখলাম নিজের নাম প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে বারবারতিনি হেসে বললেন সাহিত্য যদি করতেই চাও নিজের ভেতর একটা সাগর, একটা পাহাড় তৈরি করার সাধনা করসেদিন কথাটা বুঝিনিঅনেক পরে বুঝেছিলাম

সমাজজীবনের অস্থিরতাকে প্রতিবন্ধকতা মনে করি নাবরং অস্থিরতার ঢেউকে অবলোকন করতে জানতে হয়সাহিত্যিকের বুকে একটা সাগর আর পাহাড় থাকলে যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিই তার লেখার উপাদান হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহেবাহান্নের ভাষা আন্দোলন, উনিশে মে, সত্তরের ছাত্র আন্দোলনের দশক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেআমি আশাবাদী বর্তমান সময়ও ধরা পড়বে সাহিত্যের ভুবনেবর্তমান নিয়ে বাংলাদেশে বা আমাদের এই বাংলাতে ত্রিপুরায়ও কিছু কিছু কাজ হচ্ছে, তবে আমার একান্ত মত আরো কিছুটা পর্যবেক্ষণ ও সময় দাবী করে ঘটনাগুলো কলমে ঝরতে


কবিতাউৎসব: আবার ধরা যাক এই সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন সাহিত্যিক বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন যেখানে রাজনীতি নেই,  সামাজিক অস্থিরতার দহন নেই,  আছে শুধু ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে,   কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত কলম কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে?  কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে মনে করেন?  

শৌনক দত্ত:- সমসাময়িক সময়ের কবিতা পড়লেই বোঝা যায়কবিরা পালাচ্ছেন নাবরং তারা বাস্তবজীবনের অস্থির যাপনকে তুলে ধরছেন তাদের লেখায়পলায়নবাদী কবিতা, ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্ধী হয়ত কাব্য হবে কিন্তু বিশ্বস্ত হবে বলে মনে হয় না 


কবিতাউৎসব:  সাহিত্যে শ্লীলতা ও অশ্লীলতার তর্ক বহুদিনের আজও সে বিতর্কের অবসান হয় নি বলা যায় নিজের লেখা সম্পর্কে অনেক সাহিত্যিককেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে তার সময়ে বিভিন্ন সমালোচকের কাছেআপনার সাহিত্যচর্চার জীবনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে এই বিষয়ে আপনার অভিমতে যদি সমৃদ্ধ করেন কবিতাউৎসবের পাঠকবৃন্দকে

শৌনক দত্ত:- শব্দের শ্লীল অশ্লীল নিয়ে জ্ঞানীদের মাঝে অনেক মত বিরোধআমার মনে হয় শব্দ একটি নদী তার শ্লীল অশ্লীল বলে কিছু নেই সব দৃষ্টি ভঙ্গির ব্যাপারমজার ব্যাপার হচ্ছে অশ্লীলতার মাপকাঠি যেন শুধু নারীর শরীর  পুরুষের শরীর নিয়ে তেমন অশ্লীলতা শোনা দূর্লভ আমরা বরাবরই প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী  এই তত্ত্বে বিশ্বাসী তাছাড়া আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমরা কাজের চেয়ে সমালোচনা করতেই বেশী সময় নষ্ট করি


কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডীত বাংলায় কলকাতা কেন্দ্রিক ও ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার দুটি ভিন্ন স্রোতের মধ্যে কি ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করবেন বাংলাসাহিত্যের একজন পাঠক?  ৪৭এর দেশভাগ বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে কতটা প্রসারিত করেছে বলে আপনার ধারণা এই যে কাঁটাতারের দুইপারে ধুটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্ত দাঁড়িয়ে গেল; এইটি আপনি কি ভাবে দেখতে চান?  

শৌনক দত্ত:- প্রথমে বলি বাংলা সাহিত্য কিন্তু দ্বিখন্ডীত নয় এই ভুলটা আমরা প্রায় সবাই করিবাংলা সাহিত্য চারখন্ডিতকলকাতা আর ঢাকা সব সময় আলোচিত, কিন্তু ঢাকার মতো আসামের কাছাড়ও বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, সেখানেও সাহিত্য হয়, ত্রিপুরা তো বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্রও দিয়েছে কই তাদের নিয়ে আলোচনা নেই কোথাও, তাই পাঠক শৌনক যখন চারটি ভিন্ন স্রোতের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়েছি দেখেছি চারটি ধারার সমন্বয় করতে না পারাটা বাংলাসাহিত্যের ভীষন ক্ষতি করেছে যতটা তারচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে রাজধানীকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চাকে কুক্ষিগত করা৪৭ এর আগে বাংলাসাহিত্য মানেই কলকাতা, তারপর দেশভাগের পর বাংলাসাহিত্য আরেকটি রাজধানী পেলো ঢাকাকিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য একই দেশে থাকার পরও আসামের কাছাড় এবং ত্রিপুরাকে আমরা সঙ্গে নিলাম নাআজো আমরা সেই দূর্ভাগ্য থেকে বের হতে পারিনিবাংলাসাহিত্যের যেকোন আলোচনা হলেই কথা হয় দুই বাংলা নিয়েসাহিত্যের রাজনীতি থেকে এবার বের হবার সময় এসেছে, বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয় তাই সাহিত্যকে দুটি রাজধানী কেন্দ্রিক করে রাখার সময় ফুরিয়েছে বুঝতে হবে

কাঁটাতারের দুইপারে চারটি ভিন্ন ঘরানার বাংলাসাহিত্যের দিগন্তকে একসরল রেখায় সামগ্রিকভাবে দেখতে চাইবোযেন বাংলায় লেখা যেকোন সাহিত্যের নাম বাংলাসাহিত্যই হয়আগামী প্রজন্ম যেন আমাদের মত না বলে কাছাড় সাহিত্য, ত্রিপুরার কবিতা, বাংলাদেশের গল্প, কলকাতার কবি


কবিতাউৎসব: আমাদের এই দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্ত্বায় সাম্প্রদায়িকতার যে চোরাস্রোত নিরন্তর বহমান, যাকে পুঁজি করে ইঙ্গমার্কীণ মহাশক্তি ও তাদের বঙ্গজ সহসাথীরা ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতিতে সদাসক্রিয় থাকে; নেট বিপ্লবের দৌলতে সুদূর ভবিষ্যতে সেই সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত থেকে কি গোটা জাতিকে মুক্ত করতে পারবো আমরা?  আপনার অভিমত!  আর সেই কাজে সাহিত্যের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে আপনি মনে করেন!
       
শৌনক দত্ত: সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস থেকে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর আশু মুক্তি নেইঅন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং শিক্ষা আমাদের প্রতিটি মানুষের যেদিন নিশ্চিত হবে সেদিন ধর্মব্যবসায়ীদের ভুল ব্যাখ্যায় আমরা প্রতিবাদী হবো তার আগে আমাদের দিয়ে তারা ফায়দা লুটবেই

পাশ্চাত্য বিশ্বের তৈরী ধর্মনিরপেক্ষ সাম্প্রদায়িকতা সমগ্র বিশ্বের সমাজ জীবনে যে অস্থিরতা সৃস্টি করে চলছে ভোগবাদী চিন্তাধারার মানুষ আজ নিজের স্বার্থে পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলতের দ্বিধা করছেনামুক্ত চিন্তার অন্তরালে সত্য বিদূরিত হচ্ছে হাওয়ার বেগে তবুও সত্য সন্ধানী একদল মানুষ ও সাহিত্যিকদের জন্যই পৃথিবী এত সুন্দর তারা আর বিশ্বায়নবাদীদের ফাঁকাবুলীতে বিশ্বাস করেনাআবার উগ্র-জাতীয়তাবাদের নগ্নরুপ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) দেখে এর উপরেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেমানুষ এখন এমন একটি বিশ্বব্যবস্থার দিকে পঙ্গপালের ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে,  যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের স্বতন্ত্রতা নিয়েও অন্যের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারবে পারস্পরিক সম্পর্কের মূলভিত্তি হবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস,  স্বার্থ নয় আর সেই বিশ্বব্যাবস্থার স্বপ্নকে নিশ্চয়তা দিতে পারে কেবল সাহিত্য সত্যি কথা বলতে সাহিত্যের একটাই কাজ ভ্রান্ত  মানসের ব্যধির সংকট কাটিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা তৈরীর জন্য কাজ করা  


কবিতাউৎসব: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অভিমুখে এসে আপনার নিজের লেখালেখির বিষয়ে যদি জানতে চাই,  আপনার পাঠকের কাছে ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি?  

শৌনক দত্ত:- পাঠকের সব না পারাগুলোর মুক্তি হয়ে তার তাবত যাপনে হৃদয় ছুঁয়ে থাকতে চাই ঠিক তার স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নগুলোর পাশেই......


কবিতাউৎসব: আপনার সাহিত্যচর্চার আজীবন সাধনার বিভিন্ন পর্ব পেড়িয়ে এসে এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা তৃপ্ত আপনি?  আর কতটা আক্ষেপ রয়ে গেল?  ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আপনার মনে কি স্পষ্ট কোন ছায়পাত পড়ে?  

শৌনক দত্ত:- ত্রিশ বছরের এই ধ্যানযোগে আমি আজো সাগর কিংবা পাহাড় হতে পারলাম নাকত কিছু পড়া হলো না, কতকোটি কবিতা, গল্প লেখা হবে পড়া হবে না কিছুই। আক্ষেপ নেই কোন, প্রার্থনা আছে শুধু- আগামী,  আমায় ক্ষমা করো একটিও শব্দ রেখে যেতে পারলাম না কেবল বিন্দুকণা পাঠ নিয়ে ফিরে যেতে হলো চিতার পাশে থমকে থাকা গঙ্গায়। ভবিষ্যতের বাংলা সাহিত্য উজ্জ্বল নক্ষত্রের আকাশ.......

আপনাকে নমস্কার, কবিতা উৎসবের সকল পাঠকের জন্য রইলো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, সবাই নিরন্তর ভাল থাকুন


শৌনক দত্ত: ১৯৮০এর ৭ আগষ্ট জন্ম গ্রহন করেন ৬বছর বয়সে ছড়া দিয়ে সাহিত্যের হাতেখড়িতারপর নিয়মিত লিখছেন সাহিত্যের সব বিভাগেপ্রচার বিমুখ স্বল্পভাষী মানুষটি, বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে,  লেখালেখির সাথে ভালবাসেন পড়তে,  রাঁধতে, গান শুনতেভ্রমণ তার প্রিয় শখসম্পাদনা করেন অন্যদেশ নামে একটি ই-ম্যাগ ও ম্যাগাজিনএখন পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৩টি, গল্পসংকলন ১টি ২০১৮ বইমেলা তে নতুন ২টি বই প্রকাশিত হতে পারে