রবিবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

মৌ দাশগুপ্তা




(প্রাইমারী যে স্কুলে আমার পড়াশুনোর  শুরু, এ সেই বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ, ঠিকানা নতুন রোড, ঘোলাপাড়া, বেলঘড়িয়া, কলকাতা ৮৩জীবনের অনেক স্মৃতির মাঝেও যে স্মৃতি শুধুই নির্ভেজাল হাসি আর আনন্দ বয়ে আনে তা আমার এই স্কুল। বড়দিমনি শেফালিদি, বকুলদি, পারুলদি, ছায়াদি, অনিমা দি, মাষ্টারনশাই, আমাদের আয়াদিদি রেখাদি । অনেকেই আজ নেই, আমি তো আছি। এ কবিতা আমার সেই স্মৃতিকে ফিরে দেখা। আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।)

বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ
মৌ দাশগুপ্তা

সাতসকালেই মাঠের ধুলোয় ঘূর্ণিপাক
ফড়িংপায়ে ছুটে যাচ্ছে অবোধ শিশু,
বর্ণ পরিচয়, সহজপাঠ,কিশলয়,গণিত বই,
পিকক রিডার,পিঠে ঝুলন্ত ব্যাগ,বইয়ের স্তুপ,
বঙ্গলিপি, মায়ের হাতে সেলাই করা রুলটানা কাগজ।
নটরাজ পেন্সিল।মোম পেন্সিল,কপিং পেন্সিল।
কালির ফোঁটা চুঁইয়ে পড়া পুরানো ফাউন্টেন,
কোন স্কুল গো?
হুই যে, ঘোলা রোড,বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ।


ঘন্টা বাজল।
সিঁড়ি বেয়ে খোলা চাতালে উঠে আসছে
ধুলোমাখা পায়ের সারি,
ধূলিধুসরিত পায়ে বিদ্যাদেবীর সব হাঁসেরা আসছে,
প্রভাতবেলার গান,রবিঠাকুরের গান ছুঁয়ে প্রার্থনা।
আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে
ছেমেয়েগুলোকে টেনেটেনে এনে পাশপাশি দুটো লাইনে দাঁড় করা্চ্ছে
চিকচিকে মুখচোখ,ভীষণ,রোগা আয়াদিদি, রেখাদি,
সামনে সার বাঁধা মুখগুলো এখনো চোখের সামনে-
ছাপা সিল্ক শাড়ি, রাশভারি মুখ,বড়দিমণি,
কলকল কথা, হাসিমুখ,ছটফটে বকুলদি,
খাটোঝুল সাদা পাজামা পাঞ্জাবি,ঝকঝকে চোখ,মাষ্টামশাই,
জর্দার মিষ্টি গন্ধ,খোঁপাবাঁধা কালোচুল ছায়া দিদিমনি,
মা মা ভাব,লাল পাড় সাদা শাড়ী, পারুলদি,
ছো্টাটো শ্যমলা রঙা,শান্ত,কমকথার অনিমা দি,
রেডি সেডি অনিমা গো
উড়ানপথে স্বপ্নচোখে পাখিরা আসছে 
মেঘজলগায়ে সব মানুষগড়ার কারিগররা আসছে
দিদিমণি,ও দিদিমণি ... মাষ্টামশাই, ও মাষ্টামশাই!!


খেলার মাঠ,পুকুরপাড়, ক্লাস শুরু। ক্লাস ছুটি।
লাল টালি দেওয়া পুরানো ক্লাসঘর, মায়ের গন্ধমাখা টিফিন,
অবাধ্য দস্যি,পড়ুয়া, মারকুটে,শান্ত, ঝগড়ুটে,কাঁদুনে, নালশে
একদঙ্গল ছেলেমেয়ে, সাদা সবুজ পোশাক,
তিন সবুজ পাতাওয়ালা ব্যাজ,সাদা জুতো মোজা।
সকাল দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকালের রোদ
বাঁকা হয়ে আসে, ফিকে হয়,
ক্ষণিক স্পর্শজলের সুখ চোখে হারায়,
চলে যেতে যেতে ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি একটু দাঁড়ায়,
বয়সটা কেন যে যায়!! সময় কেন যে হারায়!!







মানচিত্র
মৌ দাশগুপ্তা

ভারতবর্ষের মানচিত্র এঁকেছিলাম ক্লাশ টেনে,স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে,
সাদা খড়িতে যত্ন করে লিখেছিলাম,
উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর,
মাঝে আসমুদ্র হিমাচল আমার ভারত, আমার দেশ।

তারপর অনেকদিন মানচিত্র আঁকা হয়নি আর 
যদিও তার কোন যুৎসই ব্যখ্যা কিন্তু আজও আমার কাছে নেই ,
তবুও ! চোখের আন্দাজে পার হয়েছি কাঞ্চনজঙ্ঘা, নন্দাদেবী,বিন্ধ্যাচল,
কম্পাসকাঁটা ঘুরেছে পশ্চিম থেকে দক্ষিণ,পূব থেকে উত্তর,
আমিও লঙ্গিচিউড ল্যাটিচিউড খুঁজে চিনে নিয়েছি,
রাজস্থানের বালুময় উষর প্রান্তর থেকে কেরালার সবুজ নারকেলি বন,
চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিস্নাত উপত্যকা ঘুরে মাউন্ট আবু,
পাহাড় আর অরণ্য ডিঙ্গিয়ে গেছি ত্লীক্ষ্নমুখ ছড়ির ডগায়,
কাগজের ওপর দাগ কেটে বনিয়েছি নতুন রাজ্য ছত্তিশগড়,ঝাড়খন্ড,
বদলে যাচ্ছে মানচিত্রের চেনা বিভাজিকা,নদীমুখ, দিগদর্শন।
আমিও লোকের অবুঝ চাহিদায়, রাজনীতির স্বার্থপর দাবার চালে
অনায়াসে  পাল্টে যেতে পারতাম ,ভুলে যেতে পারতাম ,
ছোটবেলায় বই পড়ে শেখা সেই শব্দটা 
আসমুদ্র হিমাচল ...কিন্তু যাইনি !

বরঞ্চ আবার হাতে নিয়েছি চকখড়ি,
আকাশ ছুঁতে চাওয়া তেরঙ্গার ছায়ায় বসে
একমনে আঁকছি সার্বভৌম প্রজাতান্ত্রিক ভারতের অটুট মানচিত্র।
রাজ্যের সীমানা বদলাচ্ছে,
দেশের মানচিত্রের সাথে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে
রাজ্যের মানচিত্র  সামান্য বিভেদ ছাড়াই,
তাই বলে
আমার দেশের সীমানায় যেন ভুলবশত কালির আঁচড়টাও না পড়ে।







ভালবাসার গল্প
মৌ দাশগুপ্তা

আসলে আমাদের ভালবাসার গল্পটা
অনেকটা সেই নদীটার মত,
বুকভরা ছলাত্ছল যৌবনের দিনে আমাদের সেই
গরবিনী নদী সমুদ্রকেই নিজের ভেবেছিল।
আকাশের সূর্যকেও ঝলমলে প্রতিবিম্ব ভেবে ঠিকরে দিয়েছিল।
কোন বাঁধা না মেনেই সমুদ্রকে ভালবেসে
নিরলস অভিসারে চলেছিল দিনের পর দিন,
রাতের পর রাত,
গাছ, মাটি,পাহাড়,টিলা কত বারন করেছিল,
চাঁদ-তারা, জলছাপ বালুচর, কত বুঝিয়েছিল তাকে,
আকাশ বৃষ্টিকে পাঠিয়ে কানেকানে বলেছিল
মেঘেদের জন্মকাহিনী,
বাতাস বলেছিল বদ্বীপ আর জলকন্যার অকরুন চুপকথা।
কারো কথাই শোনেনি নদী,
জোয়ার ভাঁটার টানে বয়ে গেছিল আপনমনে।
শেষে,মোহনাকে বান্ধবী করে
একদিন পেয়ে গেলোও তার অভীষ্টকে। 
দয়িতের সাথে পরম আবেগে
প্রেম চুম্বন,আদর-সোহাগ,রতিমিলন,মৈথুন।
নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচয়, নতুন সংসার,
নদীর কোন আলাদা অস্তিত্বই রইলো না তারপর।
নিজের মিঠাজল ঢেলে ঢেলে নিঃস্ব হয়েও
সমুদ্রের লবনস্বাদ তো মোছাতে পারলোই না.
নদীটাই অকালে হারিয়ে গেল।
সমুদ্র কিন্তু আজও উদ্ভিন্নযৌবনা নদী দেখলেই
নিজের বুকে জড়িয়ে নিচ্ছে তার অমোঘ আকর্ষনে..
তারপর? সব নদীরই সেই একই গল্প,
একই ছিন্ন রূপকথা।






 ভাসান
মৌ দাশগুপ্তা

বিকেলের আকাশ একটু একটু করে ভরে উঠছে
রঙিন সিঁদুরে আলোয়,
বরনের উপাচারহাতে মহিলারা সব মা মাসাজে মাতৃসকাশে,
উলুধ্বনি,শঙ্খ,কাঁসর ঢাকের আওয়াজে সরগরম
দশমীর শেষ বিকালে খোলা প্যান্ডেলের এককোনে
সিদুঁরের লাল আভায়
মায়ের গর্জনতেল মাখা চকচকে মুখখানির দিকে তাকিয়ে,
জলছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আরেক উমা,
যে কোনদিন মাকে দেখেইনি।

আকাশে দশমীর চাঁদের ম্লান রাত জাগানিয়া আলো,
আধভাঙা চাঁদের রূপোরঙা অহঙ্কার,
কাঁধে কাঁধে বাঁশের চৌদোলায় মা চলেছেন কৈলাসে,
দল বেঁধে সঙ্গে চলেছে পাড়ার মেয়েবুড়ো বাচ্চা জোয়ান,
ঢাকীরা উন্মত্তের মত ঘুরেঘুরে দোল খেয়ে
পাড়ায় পাড়ায় ঢাকের বোলে বার্তা ছড়াচ্ছে,
ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন
একা বালিকা অকালমৃতা মায়ের মুখ খোঁজে
ভাসানের প্রতিমায়।

যত দূর দেখা যায় ঐ নদীর এপারে থমকে রয়েছে ভিড়।
উদ্দাম ঢাকের বাদ্যি, শঙ্খধ্বনি আর জয়ধ্বনির মধ্যে
নদীর উঁচু পাড় থেকে দড়ির বাঁধন খুলে
প্রতিমাকে ছুঁড়ে ফেলা ওই ঘোলা নদীজলে,
ধীরে ধীরে ডুবে যায় পা, নিতম্ব,কোমর, বুক, হাত, সিঁদুরলেপা মুখ,
তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে নদী গ্রাস করে মায়ের শেষচিহ্নটুকু,
বালিকার চোখে নদী বয় মা’ –এর শেষ জলছবিটুকু নিয়ে। 


ঘোলা জলে শোলার গয়না ভাসে,শুকনো ফুলের মালা,
মায়ের শরীর থেকে ভিজে মাটি সরে যায়,
খড়ের কাঠামো ছিঁড়ে ছিড়ে যায়,
জলের গভীরে খোলা কালো চুলের মত জলজ আগাছায়
ছেয়ে যায় অন্ধকার।
পাটের চুল রঙীন শাড়ী বিভ্রম জাগিয়ে ভেসে ওঠে ঘাটে,
চোখভরা কান্না নিয়ে পুজো কাটানো উমা
নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মায়ের ছোঁয়া খোঁজে অভিমানহীন জলে।







ক্ল্যামফোজ (camouflage )
মৌ দাশগুপ্তা

আজকাল বিবেককে নিয়ে ভারী দুঃশ্চিন্তায় আছি।
এমনিতে বরাবরই ও মূক ও বধিরের অভিনয়ে কুশলী
তবুও কেন কে জানে আজকাল মাঝে মধ্যেই
অভিনয় ভুলে গিয়ে নিজের মনের কথা বলে ফেলে,
তাও কিনা নিখাদ সত্যি কথা, কি স্পর্ধা ভাবো,
শোধরাতে গেলেই স্নায়ূ টান করে দাঁড়িয়ে থাকে
কংক্রীট রাস্তায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সবুজের মত।
তাকিয়ে থাকে ল্যাম্পপোষ্ট এর নষ্ট বাতির মত মৃত,ঘষা চোখে,
ভয়ে থাকি কি জানি কি বলে ফেলে সত্যের খাতিরে,
যদি দুখবিলাসী অভিমানের আড়ালে তার কৌলীন্য নষ্ট হয়?
যদি ভয়ের বজ্র আঁটুনীর গিঁট খুলে সেই অবোধ শিশুটির মত
উলঙ্গ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল তোলে?
ঠিক তেমনি ভাবেই, আমিও সমর্পিত প্রাণ,আমিও দ্বিধায়,
আমারও সংকটের অস্তিত্ব দু নৌকায় পা রেখে টলমল করে,
তাই শেখাই গান্ধারীর মত অন্ধ সেজে স্বেচ্ছাচারকে মেনে নিতে,
কেননা দশচক্রে পড়ে আমিও যে ক্ল্যামফোজ শিখে ফেলেছি এ্যাদ্দিনে।
https://ssl.gstatic.com/ui/v1/icons/mail/images/cleardot.gif