মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬

সম্পাদকীয়






“কাল রাত্রে ঘুমোবার আগে কার কবিতা পড়েছো তোমরা”; প্রশ্ন করেছিলেন মার্কীণ কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতার কবিমহলের এক ঘরোয়া বৈঠকে। সে বহু যুগ আগের কথা। শুনিয়েছিলেন সেই গল্প কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে। তার পর একমেরু বিশ্বে বদলে গিয়েছে দৈনন্দিন জীবনের চালচিত্রের ধরণ ও ধারণ। রাত্রে ঘুমোবার আগে কবিতা পড়ার প্রশ্ন করে কেউ কাউকে  আর লজ্জায় ফেলে না। ঘুমোবার আগের সময়টুকু এখন ফেসবুকের দখলে। সেখানে লাইক আছে সেলফী আছে, কমেন্টস আছে। আর আছে চ্যাটবক্স! অনেকেই বলবেন কেন কবিতাও তো আছে। ফেসবুক জুড়ে কবিতার সুনামী দেখে যান নি অ্যালেন গিন্সবার্গ। কিন্তু কবিতার সেই সুনামী দেখে আমরা যারা যারপর নাই আহ্লাদিত, তাদের জন্যে খুব দামী কয়েকটি কথা বলে রেখে ছিলেন ধীমান কবি শঙ্খ ঘোষ, তাঁর সেই নাতিদীর্ঘ  “আমাদের কবিতাপড়া” নিবন্ধে।

বঙ্গসংস্কৃতির এক অব্যর্থ ময়নাতদন্তের প্রতিভাসে শঙ্খ ঘোষ আমাদের সামনে তুলে নিয়ে এসেছিলেন আমাদেরই কাব্যবোধের অনালোকিত দিগন্তের নিদারুণ বাস্তবতাকে। কবি খুব সুস্পষ্ট করেই দেখিয়ে ছিলেন বাঙালির কাব্যবোধ আজও কিভাবে পড়ে রয়েছে তার শৈশবের গণ্ডীতেই। কিভাবে আমরা হামাগুড়ি দিতে থাকি আমাদের ‘কবি কবিতা ও সাহিত্য’ সম্পর্কিত ধ্যানধারণা নিয়ে এক অগভীর জীবন বোধের সংকীর্ণ গণ্ডীতেই। দুঃখের বিষয় আজ থেকে ঠিক তিন দশক আগে লেখা তাঁর সেই অমূল্য পথনির্দেশিকা থেকে আমরা আজও যে বিশেষ কোন শিক্ষা নিতে পারি নি তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আমরাই রেখে চলেছি আমাদের দৈনন্দিন চালচিত্রে।

ঠিক কি বলেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ? প্রথমেই দ্যর্থহীন ভাষায় দেখিয়ে ছিলেন কিভাবে ও কতটা কবিতাবিমূখ জাতি আমরা। শুনতে অবাক লাগলেও সে কথা যে কতটা সত্যি সে কথা জানেন একমাত্র সত্যিকার অর্থের কবিরাই। সাহিত্যের বাজারে গল্প উপন্যাসের তবু যেটুকু কাটতি আছে, কাব্যসাহিত্যের যে তা নেই সেকথা কি আমাদের অজানা? সত্যিই কি আমরা কবিতা পড়তে চাই? কিংবা জানি কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়? এই সত্যটুকুই তুলে ধরে বলেছিলেন বাংলা সাহিত্যের শেষ প্রফেট শঙ্খ ঘোষ; “আমাদের কবিতাবিমুখতা অল্পস্বল্প কেটে যায় কেবল তখন, যখন আমরা হাতের সামনে পাই কোন ছন্দোবদ্ধ কাহিনী বা ছন্দোবদ্ধ বর্ণনা বা ছন্দোবদ্ধ ঘোষণা”।

ফেসবুক বা অন্তর্জাল দিগন্তের অকবিতার সুনামীর মধ্যেও আমাদের কাব্যপ্রেম ঠিক ঐটুকু সংকীর্ণ সীমায়িত দিগন্তেই নাচামাচি করতে থাকে পরম আহ্লাদে। আর বঙ্গভারতীর সাহিত্যের দিগন্তে আমাদের দশাও রাজা নাটকের সুদর্শনার মতো। কার কটি আনন্দ পুরস্কার কি আকাদেমী শিরোপা জুটলো তাই দিয়েই আমরা চিনে নিতে চাই আমাদের প্রিয় কবিদের। যে কবির প্রচার যত বেশি তিনিই আমাদের চোখে তত বড়ো কবি। তার কবিতার দুএকটি লাইন মুখস্থ রেখে দেওয়ার জন্যেও কবিতা পড়তে হয় আমাদের মাঝে মধ্যেই। কিন্তু তার বাইরে? তার বাইরে পা রাখতে মাথা গলাতে চাই কি আমরারা আদৌ? চেয়েছি কি কোনদিন? কেন আমাদের চাহিদা এত অল্পেতেই সন্তুষ্ট রয়ে যায় কবিতার কথা উঠলেই? সেই সত্যই তুলে ধরে বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, “বোধের যে তন্ত্রে আঘাত করবে কবিতা, তাকে আমরা এতই অসাড় করে রাখি, অধিকাংশ সময়ে আমাদের প্রশ্ন, আমাদের উৎসুকতা, আমাদের আকাঙ্খা আর কল্পনা এতই ক্ষীণ হয়ে থাকে যে, শিল্পের জগৎ থেকে প্রায়ই যেন  আমরা যক্ষের মতো নির্বাসিত”। 

কিন্তু কেন এই নির্বাসন? কেন এইভাবে যক্ষের মতো নির্বাসিত হয়ে থাকতে হয় আপামর বাঙালিকে? কেন আমরা আমাদের বোধের সজীব তন্ত্রেগুলিকে এইভাবে অসাড় করে রাখি পরম নিশ্চিন্তে? সেই সত্যের দিকেই আমাদের সচকিত করার চেষ্টা করেছিলেন কবি, দেখিয়ে ছিলেন কিভাবে আমরা অধিকাংশ মানুষ কেবল উপরিতলের ভাসমান একটি জীবনকে ছুঁয়ে থেকে দৈন্দিন খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার বাইরে আর পা রাখতে চাই না। মাথা গলাতে চাই না। আর চাই না বলেই জীবননের মূলগত প্রশ্নগুলি, সমাজের অন্তর্নিহিত ব্যাধিগুলি, জগত ও জীবনের মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের সারবত্তা ও তার তাৎপর্য সম্বন্ধে আমরা এতটাই উদাসীন থাকতে পারি অক্লেশে। আর থাকতে পরি বলেই যথার্থ কবিতা থেকে বেশির ভাগ সময়েই আমরা থাকি মুখ ফিরিয়ে। কেননা যাথার্থ কবিতা হল তাই, যা আমদেরকে অনাদী অনন্তের সাথে সংযুক্ত করতে পারে, যা আমাদের অস্তিত্বের প্রাত্যহিকতাকে বিশ্বসত্ত্বার নিত্যতার মধ্যে সার্থক করে তোলে। যা আমাদের অস্তিত্বের একান্তকতাকে আবিশ্ব জীবনপ্রবাহের মধ্যে সার্বিক করে তোলে। আর তখনই আমরা সত্যিকার অর্থেই খুঁজে পেতে পারি আমাদেরই নিজস্ব দিগন্তের শাশ্বত সত্যকে।

আমাদের নিজস্ব দিগন্তের এই শাশ্বত সত্যকে আবিষ্কার করার অন্যতম রাজপথই হলো কবিতা। যথার্থ কবিতা। আমরা আপামর বাঙালিরা যে রাজপথে পা রাখি নি আজও। না কবিতাউৎসব সেই রাজপথের ঘোড়সওয়ার নয়, কবিতাউৎসব সেই রাজপথের অভিমুখে অনেককে উদ্বুদ্ধ করার একটি ঐকান্তিক প্রয়াস মাত্র। একথা সত্য যে জেগে ঘুমায় তাকে জাগানো যায় না। সেই স্পর্ধাও নাই আমাদের। কিন্তু যে না জেগেই ঘুমিয়ে আছে, আমাদের প্রয়াস তাকে নিয়ে। সেই প্রয়াসেরই আষাঢ়স্য সংকলন নিয়ে প্রতিমাসের মতোই উপস্থিত কবিতাউৎসব আবারও। গত সংখ্যার বিপুল সাড়ায় আমরা অভিভুত ও কৃতজ্ঞ, সেই সাথে আরও বেশি করে দায়িত্বসচেতন। আষারস্য এই সংকলনের প্রধান আকর্ষণ দুই বাংলার অন্তর্জাল জগতের অন্যতম জনপ্রিয় কবি শাকিলা তুবার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সাহিত্যের নানান দিগন্তে কবির চিন্তা চেতনার অভিমুখটিকেই আমরা ধরার প্রয়াসী প্রধানত। পাঠক তাই তুবার কবি জীবনের ক্যানভাসেই সেই চেতনার নানারঙের বর্ণবিচ্ছুরণ প্রত্যক্ষ করতে পারবেন বলেই আমরা আশাবাদী।

কবিতাউৎসবের আগামী শ্রাবণ সংখ্যাটির বিশেষ আকর্ষণ এইটি একটি বিশেষ সংখ্যা হিসাবেই প্রকাশিত হবে। বিষয়, “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঝরঝর শ্রাবণ সন্ধ্যায়” লিখতে হবে পাঁচটি কবিতা শুধুমাত্র অভ্র বাংলায় এমএস-ওয়ার্ড ফাইলে, পাঠাতে হবে একটি প্রোফাইল ছবি সহ কবিতাউৎসবের ঠিকানায়: amaderkobitautsov@gmail.com আগামী ১লা শ্রাবণের আগেই। কবি অকবি পাঠক না পাঠক সকলকেই আষাঢ় সংখ্যায় স্বাগত।