কবিতাউৎসবের অথিতি
আলাপচারিতায় কবি শাকিলা তুবা
কবিতাউৎসব: রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে বলা যায় সাহিত্য অর্থে সহিত, সাথে;
অর্থাৎ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা তাই সাহিত্য।
এই যে জীবনের সাথে সংলগ্নতা, যা সাহিত্যের মূলগত রূপ বলে বিশ্বকবি নির্দেশ
করে গেলেন, আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়
নিজের সাহিত্যচর্চা সম্বন্ধে এই বিষয়ে আপনার অভিমত কি, কতদূর সত্য কবির এই ধারণা?
শাকিলা তুবা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা বলেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নিজের
সাহিত্য চর্চায়ও আমি এই মতের ছোঁয়াই পাই। কোনো সাহিত্যই আসলে জীবনের বাইরের কিছু
নয়। আমি লেখালেখি করতে গিয়ে ধ্যানে জ্ঞানে যা পেয়েছি তাও ওই জীবনের সম্পৃক্ততাই।
এর ঊর্ধে উঠে গেলে আর যা-ই হোক হবে কিন্তু সেটা সাহিত্য হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
কবিতাউৎসব: বাংলাসাহিত্যের সাথে প্রথম প্রেম
ও আপনার লেখালেখির সূত্রপাত সম্বন্ধে যদি
আলোকপাত করেন। সময়ের পরিধিতে এবং পরিবেশের প্রেক্ষাপটে। এবং তুবা আপনি
মুক্তিযুদ্ধের লগ্নে জন্ম নেওয়া প্রজন্মের একজন। আপনার পিতা মুক্তিযুদ্ধের শহীদ।
সেই হিসেবে আপনার কাব্যসাহিত্যচর্চা ও
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস; এই দুয়ের মধ্যে সমান্তরাল সম্পর্ক সূত্রটি ঠিক কি বলে
মনে হয় আপনার?
শাকিলা তুবা: বাংলা সাহিত্যের সাথে আমার প্রেম কবে থেকে শুরু এটার
উত্তর আমি সত্যিই দিতে পারব না। কেননা মা’র কাছে শুনেছি আমি যখন প্রথম কথা বলি তখন
থেকেই ছড়া কেটে কেটে কথা বলবার চেষ্টা করতাম। পাঁচ/ছয় বছর বয়সে আমি নিজেই লক্ষ্য
করি বিষয়টা। কেননা ঐ সময়ে তখনো আমি ভাল করে লিখতে পারি না তখন আমার এক ভাই মুখে
মুখে আমার একটা ছড়া শুনে সেই সময়কার শিশুতোষ পত্রিকা ‘শিশু’ তে ছড়াটি লিখে
পাঠিয়েছিলেন, ওটা ছাপাও হয়েছিল। ছড়াটা ছিল এমন,
“এক যে
ছিল হাতী
তার ছিল
এক নাতি
সেই যে
হাতির নাতি
উলটে
ফেলে বাতি।“
এবার
আসি বাবা’র প্রসঙ্গে। আমার বাবা’মা দু’জনেই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। মা তো গল্প
কবিতাই লিখতেন। বাবা নাকি পড়তেন প্রচুর। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পর আমাদের
স্বাধীনতার এই যুদ্ধই মূলতঃ বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে দিয়েছিল এই দেশের জন্যে। বাবা
হারিয়েছি এই যুদ্ধেই তারপরও আমি গর্বিত তার সন্তান হিসেবে। আরো গর্ব হয় যখন আমি দু
চার লাইন লিখি বাংলায়। বাংলাদেশ স্বাধীন বলেই আমি বাংলায় লিখতে পারছি। স্বাধীন
বাংলাদেশের সাথে আমার কাব্যসাহিত্যচর্চার এটাই এক দারুন যোগসূত্র বলে আমি মনে করি।
কবিতাউৎসব: আমাদের সাহিত্যসাধনায় সাধারণ ভাবে পূর্ববর্তী
লেখকদের প্রভাব বেশি পরে। আবার সমসাময়িকদের লেখকদের প্রভাবও কি পরে না? এই দুই প্রভাব আপনার কাব্যচর্চার ভুবনে
কি ভাবে ও কতটা আলোড়ণ ফেলেছে বলে আপনার ধারণা ? এবং এই সব প্রভাব কাটিয়ে উঠে কবি
তুবার একান্ত নিজস্ব যে একটি অনুপম ও অনন্য ভুবন আপনি তৈরী করে চলেছেন
বঙ্গসাহিত্যের অঙ্গনে, সেই বিষয়ে আপনার সচেতন প্রয়াস ও যত্ন কতখানি। নাকি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত এই উত্তরণ?
শাকিলা তুবা: চাইলেও কোনো কবি বা লেখক তার লেখায় পূর্ববর্তী বা
সমসাময়িক লেখকদের প্রভাবকে উড়িয়ে দিতে পারেন না। আমার লেখালেখিতেই হয়তো কারো লেখার
ছাপ পড়তেই পারে আমার অজান্তে। তবে আমি যা কিছু লিখি একেবারেই নিজের মতো করে লিখবার
চেষ্টা করি এবং সেটা অবশ্যই স্বতঃস্ফুর্ত। তারপরও যদি কোনোভাবে প্রভাবিত হই তখন
নিজেকে শুধরাবার কোনো চেষ্টাই আমি করি না। এটাই আমার নিজস্বতা বলে ধরে নিই।
কবিতাউৎসব: বাংলাসাহিত্যের ওপর বিশ্বসাহিত্যের
প্রভাব অপরিসীম । আপনার নিজের লেখালিখির মধ্যে এই প্রেরণার রূপ ও তার বিকাশের
স্বরূপ সম্বন্ধে যদি আমাদের পাঠকদের অবহিত করেন । এই প্রসঙ্গেই জানতে ইচ্ছে করে
আপনি এত সমৃদ্ধ ইংরেজী কবিতা লিখতে পারেন, তবু এই দিকটি নিয়ে আপনি একেবারেই আর
এগোলেন না কেন? অথচ দেখুন, আজ ইনটারনেট বিপ্লবে সারা পৃথিবীর কবি সাহিত্যিক
পাঠকদের সাহচর্য কত সহজ হয়ে উঠেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আপনি এই ক্ষেত্রটিকে
ব্যবহার করলে এতদিনে আপনার একটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি গড়ে উঠতো। বিশ্ববাসীও বাংলার কবির কাব্যসুধার স্বাদ থেকে
বঞ্চিত হতো না।
শাকিলা তুবা: ইন্টারনেটের বদৌলতে নানাদেশের অনেক লেখকের লেখা পড়বার
সৌভাগ্য আমার হয়েছে এবং অবশ্যই আমার কাব্যচর্চায় এইসব লেখা থেকেই আরো লিখবার
অণুপ্রেরনাও পেয়েছি। ইংরেজী কবিতাও আমি লিখেছি দু’একটা। কিন্তু সত্যি বলতে কি খুব
একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। অন্যভাষায় লিখতে গেলে কিছু প্রতিবন্ধকতা থেকেই যায়
সেখানে আমি নিজের ভাষা মানে বাংলায় যখন লিখি তখন আমাকে গ্রামার বা টেন্স নিয়ে
ভাবতে হয় না। ওটা এমনিতেই চলে আসে। তাই ইংরেজীতে আর এগুইনি। আবার আমি একটু
প্রচারবিমুখ মানুষও বটে। তবে হ্যাঁ এখন আপনার কথায় দারুন অণুপ্রেরনা পেলাম। আশা
করি সামনেই আমি ইংরেজীতে আরো কিছু লেখা আমার পাঠকের জন্যে লিখবার চেষ্টা করব।
যেহেতু আমি আগে কখনো ভাবিনি বিশ্ববাসীর কাছে এদেশের সাহিত্য তুলে ধরবার কথা। এখন
আপনার এবং আমার শুভাকাঙ্খীদের অনুপ্রেরনায় ভবিষ্যতে আমার চেষ্টা থাকবে আন্তর্জাতিক
অঙ্গনে বাংলা কবিতার একটা ক্ষেত্র গড়ে তুলবার।
কবিতাউৎসব: বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের
গুরুত্বের কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু আপনার জীবনে সাহিত্যসাধনার যাত্রাপথে
বিশ্বকবির ভূমিকা ঠিক কিরকম ?
শাকিলা তুবা: এই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো ভাষা আমার নেই। আমি মিউজিকের
উপর পড়াশোনা করেছি। বিশ্বকবির লেখা গান গেয়ে গেয়েই পাড়ি দিয়েছি কত পথ। ছেলেবেলা
থেকেই তার লেখা পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। বাঙালীর জীবনে কোথায় তিনি নেই? কাব্যে, কথায়, যাপিত
জীবনে সর্বত্রই তিনি আছেন। রবিঠাকুরকে বাদ দিলে আমার সাহিত্যচর্চার কোনো স্বত্তাই
থাকে না।
কবিতাউৎসব: রবীন্দ্রনাথের যুগের পর আমরা বহুদূর
এগিয়ে এসেছি! জীবন ও সাহিত্যের ভিতর ও বাইরে ঘটে গিয়েছে বিপুল পরিবর্ত্তন! আজকের
দিনে সাহিত্যে আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতা
বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে কোথাও কি একটা আবর্তের মধ্যে
ঘুরপাক খাচ্ছে বলে মনে করেন আপনি? নাকি বাংলাসাহিত্য আরও বেগবান হয়ে আধুনিকাতার
পরিসরটিরই আরও বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে বলে মনে হয় আপনার?
শাকিলা তুবা: আমার কিন্তু মনে হয় না বাংলা ভাষার সাহিত্যচর্চা কোথাও
আটকে গেছে। আধুনিক বলুন অথবা উওর আধুনিকই বলুন সবই অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষার মধ্য
দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে এটা ঠিক। তবে এভাবে সাহিত্যের বিস্তারও ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
সাহিত্য আরো আধুনিক হয়েছে, আরো শক্তিশালী হয়েছে এবং অবশ্যই সেটা নতুন প্রজন্মের
হাত ধরে বিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছে।
কবিতাউৎসব: সাহিত্যের আঁতুড় ঘর লিটল ম্যাগাজিনের
বর্তমান পরিসর কতটা আশাবাঞ্জক আপনার কাছে ? আজকের সোশ্যাল সাইটের বিপ্লবের সাথে
এইযে ওয়েব পত্রিকার বিপুল জোয়ার এসেছে এতে করে বিশুদ্ধ কাব্যসাহিত্যের সাথে
অকবিতার বেনোজল কি ঢুকে যাচ্ছে না ? আপনি কি আশঙ্কিত এই বিষয়ে? প্রসঙ্গটিকে আরও
একটু বিস্তৃত করে নিয়ে জানতে চাইব বাঙালির জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা
প্রাসঙ্গিক কতটা আবেগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে করেন?
শাকিলা তুবা: সোশ্যাল সাইটের লেখালখির চর্চা যেমন এক রকম মানে রাখে
তেমনি লিটল ম্যাগাজিনের প্রয়োজনও এখনো রয়ে গেছে। আমি মানছি সোশ্যাল সাইটে অনেক
অকবিতার জন্মও হচ্ছে প্রতিদিন। তবে কি, বাঙালী আবেগপ্রবন হলেও লেখালেখির বাছ
বিচারে বাংলার পাঠকেরা অনেক বেশী সচেতন। তাই অকবিতা বলে যেসবের চর্চা এখন চলছে
সেগুলোও অচিরেই ঝরে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সে ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগ এর প্রয়োজন
এখনো তাই রয়েই গেছে।
কবিতাউৎসব:
সাহিত্যসাধনা
বা কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ
পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। টি এস এলিয়ট
জোর দিয়েছিলেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ের উপর।
অর্থাৎ কবিতা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত আবেগেরই উদ্গিরণ নয়। আবেগ ও বাস্তবতা, ঐতিহ্য
ও আধুনিকতা, ইতিহাস ও বর্তমান সমষ্টি ও ব্যষ্টি এই সবেরই একটি অন্তর্লীন সমন্বয় ও
সামঞ্জস্যের শৈল্পিক উদ্ভাসনই কবিতা। আর সেইখানেই তো তার সর্বজনীনতা। যেখানে কবিতা
দেশজ হয়েও আন্তর্জাতিক। সমকালীন হয়েও চিরকালীন।
কবি তুবার কবিতার মননশীল নিবিষ্ট পাঠকমাত্রেই এমনই এক অভিজ্ঞতার প্রতিভাসে ঋদ্ধ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই বিষয়ে কবি হিসেবে তুবা নিজে কতটা
সচেতন। কিভাবে সম্পম্ন হয় এই সমন্বয় ও
সামঞ্জস্যের অন্তর্দীপ্ত প্রক্রিয়াটুকু।?
শাকিলা তুবা: এই প্রশ্নের উত্তর আমি কিভাবে দেব সত্যিই জানিনা। কেননা
আমি লিখি স্থান, কাল, পাত্র ভুলেই। এখন কিভাবে, কতটুকু পেরেছি বা পারছি তা নির্ভর
করে আমার পাঠকের উপর। আমি কোনো কিছু না ভেবেই লিখে যাচ্ছি, লিখবও। কবি জীবনানন্দ
যেমন পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান ও সুস্পষ্ট ইতিহাসচেতনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন আবার টি
এস এলিয়ট জোর দিয়েছিলেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ের উপর তেমনি আমিও যখন লিখি আমার
লেখার বিষয়বস্তু ও আবেগগুলো কবিতা ভেদে ঘটায়। এভাবেই আমার আবেগগুলো প্রতিদিনই
নতুনত্বের ছোঁয়া পায়।
কবিতাউৎসব: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
কিছুটা জানার ইচ্ছে অনেকটাই অভিযোগ কথাসাহিত্যিক শাকিলা তুবার কাছে। আপনার যে কয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত এযাবৎ, সবকয়টিই
কাব্যসংকলন। কিন্তু একটিও ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়নি আজও। সাহিত্যের পাঠকের কাছে এ এক অপূরণীয়
ক্ষতি। যাঁরাই আপনার ছোটগল্প পাঠের
অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছে, তাঁরাই জানেন কি বিপুল শক্তির অনন্য সম্ভাবনাময় আপনার
গদ্যশৈলীর নিজস্ব দিগন্ত। ছোটগল্পের
পরিসরে মানবিক মনবিকলনের পরাবাস্তবতার অনুপম চিত্ররূপময়তায় আপনার গল্পগুলি সত্যই
আন্তর্জাতিক মানের ও আধুনিকযুগ লক্ষণ্মযুক্ত।
কিন্তু সেইখানেও আপনি যেন খুবই উদাসীন। অনেকটাই যেন “ছিন্নপাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা”
কেন তুবা এভাবে নিজের সম্পূর্ণ উদ্বোধন থেকে দূরে থাকা? বাংলাসাহিত্যই যে বঞ্চিত
হলো এতে? আমারা আপনার গল্প লেখা ও না লেখার নেপথ্যের গল্পই শুনতে চাই, যদি আপত্তি
না থাকে।
শাকিলা তুবা: প্রথমতঃ আমি প্রায়শঃই খুব অসুস্থ থাকি, দ্বিতীয়তঃ আমার পারিবারিক জীবনের
দায়িত্ব, সব মিলিয়ে আমার সব সময়ই ব্যাস্ততা। সেকারনেই কবিতা লেখা আমার জন্যে যেমন
সহজ গদ্য লেখা ঠিক তেমনি কঠিন। গদ্য লিখতে হলে প্রচুর সময়ের দরকার, সুস্থতা দরকার।
এই দুটোই আমার এত অপ্রতুল যে আমি ঠিক পেরে উঠিনা। যেহেতু গদ্য লেখবার জন্যে যথেষ্ট
স্থিরতা দরকার। আমার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার
কারনে গদ্য এবং উপন্যাস লেখাটা তেমন আশানুরূপ ভাবে বেগবান হচ্ছে না, আমি বুঝতে
পারি। তবে আমারও ইচ্ছে আছে এই সীমাবদ্ধতার ভেতরেও গদ্য এবং উপন্যাস রচনায় যত্নশীল
ভাবে যথেষ্ট সময় দেয়ার। জানিনা পেরে উঠব কিনা। পাঠকের শুভকামনা থাকলে হয়তো আরো
কিছু ছোটগল্প এবং কিছু উপন্যাস আমার জীবদ্দশাতেই লিখে ফেলতে পারব।
কবিতাউৎসব: সাহিত্য বলতে আপনি কি শিল্পের জন্যেই
সাহিত্যে বিশ্বাসী? না কি মনে করেন সাহিত্যের একটা সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? এই
সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে, একজন সাহিত্যেকের সমাজসচেতনতা স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়গুলি কতটা জরুরী বলে
মনে হয় আপনার? আর ঠিক এই প্রসঙ্গেই জানতে ইচ্ছে করছে, বিশেষত একজন লেখিকার
দৃষ্টিকোণ থেকে; আমাদের পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ সভ্যতায় একজন লেখিকার ভূমিকা কতটা
গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার মনে হয়? আপনার নিজের লেখালেখির সূত্র ধরেই যদি বলেন!
শাকিলা তুবা: সাহিত্য মানেই শিল্প কিন্তু সাহিত্যের একটা সামাজিক
দায়বদ্ধতাও অবশ্যই আছে। একজন সাহিত্যিকের অবশ্য কর্তব্য হলো দেশ, জাতি, সমাজ
সবকিছুর উপরই আলোকপাত করা। কেননা যুগ যুগ ধরে সাহিত্যের বিচারেই সমাজের বিশাল
বিপ্লবগুলো ঘটেছে। তাই একজন সাহিত্যেককে যেমন সমাজসচেতন হতে হবে তেমনি স্বদেশপ্রেমিকও হতে হবে। আমাদের সমাজব্যাবস্থায়
লেখক হিসেবে পুরুষদের সুযোগ একটু বেশীই। একজন নারীকে তার সংসার-সন্তান সব দিক
বিবেচনা করতে হয়। এই সব পাড়ি দিয়েও একজন নারী যখন লেখেন মানতে হবে তাকে অনেকটা
বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই আসতে হচ্ছে। আবার একজন পুরুষ লেখকের লেখা যত গ্রহন যোগ্য হয়
সমাজে নারী লেখককে একটা বৃত্তে বাঁধা বলেই ধরে নেয়া হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে সেই
দিনগুলো এখন নারীরা জয় করেই নিচ্ছে তাদের লেখনীর জোরে। সেইদিন আর বেশীদূরে নয়
যেদিন সাহিত্য আর নারী পুরুষ বিচারে
সমাদৃত হবে না। যে যার কর্ম বিচারেই প্রতিফল লাভ করবে।
কবিতাউৎসব:
সাহিত্যিকের
প্রত্যয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখাটা কতটা জরুরী? আর বিশ্বাসভঙ্গেরর দহন তার
প্রতিভাকে কি কোনভাবে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে? না কি সেই দহনেই দাঁড়ি পড়ে যেতে পারে
কোন অনন্য সম্ভাবনার?
শাকিলা তুবা: মানুষের উপর বিশ্বাস না থাকলে একজন লেখক লিখবেই বা কিভাবে?
হ্যাঁ বিশ্বাসভঙ্গ সেই অতীত যুগ থেকে এই যুগেও হয়েই আসছে। তার মানে এই নয় যে
ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। ঘুরে দাঁড়ানোটাই একজন যোগ্য সাহিত্যিকের প্রতিভা বলে
আমি মনে করি। তবে সাহিত্যিকরা একটু আবেগপ্রবন বেশী বলেই অনেকে আহত হলে আর ফিরতে
চাননা পুরনো পরিসরে। সে ক্ষেত্রে সাহিত্যের আকাশ থেকে একটা মোতি ঝরেই যায়, সে
জন্যে আফসোস করা ছাড়া আর কি-ই বা করার থাকে বলুন! তবে ঐ যে বললেন দহন এই দহনকে
পুঁজি করে লিখতে পারলে সেই সাহিত্য অবশ্যই অনন্য হয়ে উঠবে।
কবিতাউৎসব: কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আপনাকে অফুরান
ভালোবাসা ও নিরন্তর শুভেচ্ছে। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমরা এই আলাপচারিতা শেষ
করবো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে।
বুকের মাঝে কাঁটাতার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই যে বাংলা, যার দুই প্রান্তের
জনজীবন ও সহিত্যচর্চার মধ্যে সর্বদাই যে
একটি অদৃশ্য দেওয়াল রয়ে যায়, যে দেওয়ালে
এসে ঠেকে যেতে থাকে স্বতঃস্ফূর্ত আত্মিক যোগের
আর্তিটুকু; সেইখানে দাঁড়িয়ে আপনি কতটা আশাবাদী বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত নিয়ে? দেশভাগের মতো
আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি কবিতারভুবনও কি বিভক্তই রয়ে যাবে? পারস্পরিক দূরত্ব বজায়
রেখে খণ্ডিত আকাশের সীমানায় সমান্তরাল ভাবে
এগিয়ে যাবে আলাদা আলাদা? না কি এই নেটবিপ্লবের হাত ধরে পরস্পরের সাথে
একাত্ম হয়ে ওঠার পথে এগোবে আমাদের সাহিত্যের ভূবন?
শাকিলা তুবা: বাংলা সাহিত্যচর্চার ঐতিহ্য শত শত বছরের। এই ঐতিহ্যের হাত
ধরে আমাদের দুই বাংলার রয়েছে অভিন্ন আবেগ যা কোনো দেয়ালকে বা অস্ত্রকে বাঁধা
হিসেবে দাঁড়াতে দেয়নি। দুই বাংলার এই শত বছরের সৌহার্দ্য আমাদেরকে প্রতিনিয়তই কাছ
টানছে। সোশ্যাল সাইটের কল্যাণে এখন কিন্তু আমরা অনেকটাই একাত্ম হয়ে উঠেছি পরস্পরের
সাথে। ধর্মনীতি এবং রাজনৈতিক মতভেদের কারঙে দেশ বিভাজন এবং সমাজ বিভাজন হতেই পারে
কিন্তু সামাজিক ঐতিহ্য কখনোই কোনো সীমানা মানে না। আমি খুবই আশাবাদী বাংলা
সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে এই দুই বাংলার নিবেদিতপ্রাণ কবি এবং লেখকদের একাগ্র চেতনার
প্রতিফলনে যেভাবে সাহিত্য বিকশিত হচ্ছে সেইসব সাহিত্য দিনে দিনে অমূল্য হয়ে উঠছে
দুই বাংলাতেই। এঁদের সাথে এক সারিতে দাঁড়াবার যোগ্যতা আমার এখনো হয়েছে কিনা আমি
জানিনা তবে শেষ অবধি আমার নিরন্তর প্রচেষ্টা অবশ্যই থাকবে।
পরিশেষ
কবিতাউৎসব কেও আমার পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অফুরন্ত ভালোবাসা ও নিরন্তর শুভেচ্ছা। আমি
কবিতাউৎসবের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করছি।