সম্পাদকের
কলমে
সত্যি কথা বলতে গেলে মন বিষন্ন হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে
গেলে বন্ধু বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবু কথাটা সত্যি। বলি বা না বলি সত্য
সত্যই থাকে। যদি না আমরাই ঘটাতে পারি কোন ব্যাপক পরিবর্তন। বলছিলাম বাংলা সাহিত্যে
কবিতার পাঠক যত কম অকবিতার পাঠক তত বেশি। আচমকা কথাটা শুনলে অনেকেরই পিত্ত গরম হয়ে
ওঠার সম্ভাবনা রয়ে যেতে পারে। অনেকেই বক্তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে রসিকতা করতে
পারেন। অনেকেই আবার বিষয়টি প্রাত্যহিক জীবনে অপ্রাসঙ্গিক মনে করে ঝেড়ে ফেলতে
পারেন। তবু হয়তো কেউ কেউ ভাবতেও পারেন বিষয়টি ভেবে দেখার মতো কিনা! বস্তুত তাদের
জন্যেই সত্যি কথাটা বলা। কথাটি আদৌ সত্য
কিনা কিংবা সত্য হলেও সেটা কতটা দুশ্চিন্তার বিষয় সেটা বুঝতে গেলে আমাদের
একটু বাস্তবের জমিতে পা রাখতে হবে। কবিতার পাঠক যে কম সেটা ভুক্তভুগী মাত্রেই টের
পান। বছর গড়িয়ে যায় কিন্তু প্রকাশকের স্টক গড়ায় না। না প্রকাশকের টাকা যে জলে যায়
তাও নয়। কারণ আজকাল প্রকাশক আর টাকাই ঢালেন না কবিতার প্রকাশনায়। কবিকেই নিজের
টাকায় নিজের বই প্রকাশের বন্দোবস্ত করতে হয়। আর বাঙালির কবিতা প্রীতির কথা জানা
থাকায় কোন প্রকাশকই আর খুব বিখ্যাত কবি ছাড়া কাব্য সংকলনে অর্থ লগ্নী করেন না। তাই
যার কবিতা তাকেই জমানো টাকা খসিয়ে ছাপাতে হয় নিজেরই কবিতার বই। আর প্রকাশ হলে সেই
আনন্দে আত্মীয় বন্ধু পরিজনকে উপহার দিয়ে জানান দিতে হয় নিজ কবি প্রতিভার কথা।
শুধুমাত্র কবিতা লিখে গ্রাসাচ্ছাদনের বম্দোবস্ত করেছেন এমন কবির কথাও শোনা যায় না
আর। এমনই আমাদের কবিতা প্রেমের নমুনা। তাই কবিতার পাঠক যে কম সে কথা বলাই বাহুল্য।
কবিতার পাঠক বেশি হলে কবিদের সত্যই হিল্লে হয়ে যেত। অন্তত বছরে একটি বেনীমাধব শীল
বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তের মতোও যদি কবিতার বই বিক্রূী হতো কবিরা নিশ্চয় আহ্লাদে
আটখানা হতেন সন্দেহ নাই। কিন্তু না বাস্তব চিত্র খুবই দুঃখজনক তো বটেই হতাশজনকও।
পরিচিত অপরিচিত কাউকেই কখনো এ কথা বলতে শোনা যায় না যে তিনি কবিতা লেখেন। অর্থাৎ
পেশা বা কর্ম হিসেবে কবিতা লেখার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারি না আমরা। তাই কাউকে
লজ্জায় বলতেও পারা যায় না যে আমি কবিতা লিখি। বাংলা সাহিত্যে এই হলো কবিতার হালহকিকত।
আর সেই অবস্থায় দেখা দিল প্রযুক্তিগত এক বৈপ্লবিক যুগান্তর।
মানুষের হাতের নাগালে চলে এল এক অলীক জগৎ তার নিজস্ব প্রকরণ নিয়ে। যার অনুষঙ্গে
বাংলা কবিতারও যেন এক জন্মাম্তর ঘটে চলেছে। হ্যাঁ এই অন্তর্জালিক যোগাযোগ মাধ্যমকে
নির্ভর করে এখন সবাই কবি। ফেসবুক থেকে ব্লগ- কবিতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে মিনিটে মিনিটে।
যার বন্ধুবৃত্ত যত বড়ো সেই তত বড়ো কবি। আর কবিতার থেকে অকবিতার সংখ্যা যত বেশি
লাইক ও প্রশংসার ঢক্কা নিনাদও তত বেশি। এমনিতেই বাংলায় কবিতার পাঠক ছিল হাতে গোনা।
সেখানে এই অন্তর্জালিক যুগান্তরের হাত ধরে বাংলা কাব্যের সাম্প্রতিক জন্মান্তরে
অকবিতার বিস্ফোরক সংখ্যাধিক্যে, কবিতার পাঠক যত কম, অকবিতার পাঠক ততই বেশি হয়ে
উঠেছে আজ। এই সত্যেকে আমরা অস্বীকার করতে পারি। উদাসীন হয়ে এড়িয়ে যেতে পারি।
অবজ্ঞা করে তাচ্ছিল্য করতে পারি। কিন্তু ভুল প্রমাণ করতে পারবো না। কষ্ট ও সমস্যা
ঠিক এইখানেই। এই যে অকবিতার মোহে দিকভ্রান্ত পাঠক, সাহিত্যের থেকে দূরবর্তী থেকে
আত্মপ্রবঞ্চনার আবর্তে নিজেকেই আবদ্ধ করে রাখছে, যে কোন সমাজের সুস্থতার পক্ষে সে
বড়োই বিপজ্জনক। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, হোক না অকবিতা, তাই নিয়ে যদি অধিকাংশ
মানুষ ভুলে থাকে, ক্ষতি কি? পরনিন্দা পরচর্চা করার থেকে তো অনেক ভালো। না। এইখানেই
আমাদের ভুল হয়ে যায় সবচাইতে বেশি। সুস্থ সাহিত্যচর্চা একটি সমাজকে সমৃদ্ধশালী করে
তোলে। যে সমৃদ্ধির সুফল সমাজদেহের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। আর সেইখানেই যদি
অসুস্থতার কালো ছায়পাত ঘটতে থাকে, তবে তার সমাজিক কুপ্রভাব অনেক সুদূরপ্রাসারী
ক্ষতিসাধন করতে পারে। ভয়টা সেখানেই।
কিন্তু কি করতে পারি আমরা? অকবিতার বিপ্রতীপে কবিতার চর্চায়
আরও বেশি করে জোর দেওয়া? অকবি ও অকবিতাকে চিহ্নিত করে পাঠককে সচেতন করা? কিন্তু সে
কি ঠগ বাছতে গাঁ উজার হয়ে যাওয়ার মতো হবে না? না কি আরও ধৈর্য্য ধরে নিজেদের
সচেতনতাকে সজাগ করে অপেক্ষা করা? প্রাথমিক এই হুজুক থিতিয়ে যাওয়ার মতো সময় দেওয়া?
বস্তুত বাংলা সাহিত্যের সুবিশাল প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলির সম্বন্ধেও আলোচনা করতেই
কবিতাউৎসবের পক্ষ থেকে আমরা দারস্থ হয়েছিলাম বর্ষীয়ান সাহিত্যকর্মী ও নাট্যব্যক্তিত্ব
সকলের বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ও প্রিয়বান্ধব শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের। শ্রী
মুখোপাধ্যায়ের বিস্তৃত জীবন অভিজ্ঞতার সারবত্তায় আমরা ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলাম বাংলা
সাহিত্যেরই বর্তমান অবস্থার একটি বিশ্বস্ত বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন। আমাদের
প্রত্যাশাকে ছাপিয়েই শ্রী মুখোপাধ্যায় তাঁর দূর্বার ও তীক্ষ্ণধী পর্যালোচনায়
উপস্থিত করলেন বাংলাসাহিত্যের সমস্যা ও সম্ভাবনার ঐকান্তিক দিগন্তকে। বাংলা
সাহিত্য প্রেমী সকলকেই আমরা অনুরোধ করবো শ্রী মুখোপাধ্যায়ের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের
পরিসরে অর্জিত অভিজ্ঞতালব্ধ অন্তর্দীপ্ত আলোর উদ্ভাসনে এই সাক্ষাৎকারটির সাথে
সরাসরি সাক্ষাৎ করে যেতে। আমাদের বিশ্বাস আগামীতে তাঁর এই মূল্যায়ন অনেকেরই কাজে
লাগবে।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকারের
সাথেই এই শ্রাবণের বিশেষ আয়োজন, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। মেঘ বৃষ্টি টাপুর টুপুর
বিরহ মিলনের এই ভরা শ্রাবণে দুই বাংলার কবিদের বর্ষা ও প্রেমের উদযাপনে কবিতা উৎসব
শ্রাবণ সংখ্যা একটু বিশেষত্বের দাবি করতে পারে বই কি। তাই কবিতা ও
বাংলাসাহিত্যপ্রেমী সকলকে কবিতাউৎসব শ্রাবণের টাপুর টুপুর আমন্ত্রণ।
সম্পাদক