শনিবার, ২১ মে, ২০১৬

সম্পাদকের কলমে




শৌখীন মজদুরী


হয়তো পৃথিবীর সব দেশেই এবং সব কালেই কবিতাতেই হাতেখড়ি হয় সাহিত্যচর্চার। আমাদের দুই বাংলার জনজীবনেও সেই ধারাটিই বহমান আজও। এবং এও দেখা যায় সারাজীবন সাহিত্যের আর কোন ধারাতেই সাহিত্যচর্চার পরিসরটিকে বিস্তৃত না করে শুধুমাত্র কবিতার ভূবনেই আজীবন পরিভ্রমণ করে গেলেন বেশিরভাগ সাহিত্যসেবী। আমাদের বাংলার পরিসংখ্যানও হয়তো সেই সত্যই তুলে ধরবে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে। এই যে সারাজীবন কেবলমাত্র কাব্যচর্চার পরিসরে ঘোরা ফেরা করার প্রবণতা; একজন কবির পক্ষে সেটি শ্লাঘার বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে সমগ্র জীবনের পরিধিকে শুধু কাব্যচর্চার গণ্ডীতেই কি ধরা সম্ভব? ধরতে পারেন একজন কবি? আমাদের বিশ্বকবি থেকে বিদ্রোহীকবি, বাংলার কিংবদন্তীতুল্য কবিমনীষী জীবনানন্দ দাশ কেউই কিন্তু হাঁটেননি সেই পথে। কাব্যচর্চার সাথে তুমুল উদ্যোমেই গদ্যচর্চা ভূবনে তাঁরা পথ কেটে গিয়েছে এক একটি নতুন দিগন্তের। তখনই মনে হতে থাকে আমাদেরও, সত্যই-কি সম্ভব কবিতার আলপনায় সমগ্র জীবনকে ধারণ করা? অনেকেই হয়তো বলবেন যাঁদের নাম করা হল, বাংলা সাহিত্যের সেই তিন মহর্ষী যদি কেবলই কবিতাই লিখতেন, তহলেও তাঁরা জীবনের সমগ্রতাকে এইভাবেই ধারণ করে যেতে পারতেন। সেখানেই তাঁদের প্রতিভার ঐশ্বর্য্য। ঠিকই, তবুও তারপরেও একটি প্রশ্ন রয়েই যায় আমাদের মনে, তাঁদের মনে কোথাও কি কোন অপূর্ণতার ছায়পাত ঘটেনি কখনো? যেখান থেকে তাঁদের মনে জেগেছে সাহিত্যের অন্যান্য ধারাতেও নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার এক অদম্য তাগিদ? সেই ভাবেই হয়তো ছুঁতে চেয়েছেন তাঁরা মানব জীবনের সমগ্রতাকে সাহিত্যচর্চার পূ্র্ণ পরিধিতে?

কথাগুলি হঠাৎ মনে হওয়ার কারণ আমাদের এই অন্তর্জালব্যপি সাহিত্যচর্চা ও পরিচর্চার বিস্তৃত ভুবনে যত কবি আছেন, তাঁদের বেশিরভাগই কিন্তু কাব্যচর্চার বাইরে সাহিত্যচর্চার অন্যান্য দিগন্ত স্বাক্ষর রাখতে আগ্রহী নন সেভাবে। আর তখনই মনে হয় তাঁরা কি তবে কাব্যচর্চার পরিসরেই জীবনবাস্তবতার সমগ্রতাকে ধরতে আগ্রহী? প্রশ্নটা ওঠার কারণ এই যে, এই অন্তর্জালমুখী কাব্যচর্চার দিগন্তটি যদিও এখনও তার শৈশবে, তবুও এখন অব্দি কাব্যচর্চার এই আন্তর্জালিক দিগন্তে জীবনের সমগ্রতাকে জীবনানন্দের পরিভাষায় ‘ছুঁয়ে ছেঁনে দেখতে’ খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে কি আজকের কবি প্রতিভার প্রতিভাসে আমরা সমগ্র জীবনের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবো না? কিংবা, যিনি মূলত কবিতাই লেখেন তিনিও কি চাইছেন না আরও বৃহত্তর পরিসরে মানব জীবন ও বিশ্বজগতের ছন্দকে প্রতিধ্বনিত করতে? মনে হয় যেন আমাদের আন্তর্জালিক কাব্যসাহিত্যচর্চার বৃত্তটি কেবলই কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথামতো ‘শৌখীন মজদূরীর’র নবতর একটি পরিসর। এবং খুবই সংক্রমকও বটে। অন্তর্জালকে কেন্দ্র করে কবিতা চর্চার যে বিপুল উদ্যোমের সৃষ্টি হয়েছে, তা  প্রাথমিকভাবে যতই আশাব্যঞ্জক মনে হোক না কেন, বেশ একটু নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেই ধরা পরে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই অমোঘ বাণীটির সত্য বাস্তবতা। আজকের বাংলা কাব্যচর্চার দিগন্তে পা রাখলেই মনে হয় বড় সুখে আছে দুই বাংলা। সবাই বেশ খেয়ে পড়ে করে কম্মে দিন কাটাচ্ছে। এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, মনে হয় না যে এই যুগের সামনে আজ আর কোন জীবনপ্রশ্ন নিরুত্তর রয়ে গিয়েছে। কবি বলেছিলেন, ‘শেষ কথা নেই, শেষ কথা কে বলবে’। কিন্তু আমাদের কাব্যচর্চার দৈনন্দিন এই পরিসরে একটু হাঁটলেই মনে হবে বাঙালি কবি যেন শেষ প্রশ্নের সব উত্তরই আজ পেয়ে গিয়েছে। আজ আর কোন প্রশ্ন নেই কবিমানসে। নেই কোনো সংশয়, নেই কোন বিভ্রান্তির ভ্রূকুটি! কবি অনুরোধ করেছিলেন, ‘এখনই অন্ধ বন্ধ কোরো না পাখা’, কিন্তু পাখা বন্ধ করার মতো সামূহিক বিপর্যয় বা বিপর্যয়ের অশনি সংকেতের কোন সংশয়ও নেই যেন আজ আর দুই বাংলার কবিদের চেতনার গহন গভীরে। তাহলে তো ধরে নিতেই হয়, বেশ স্বচ্ছন্দে আছে দুই বাংলা। কিম্তু প্রাত্যহিক সংবাদ প্রবাহে প্রতিনিয়তই যে ছন্দপতনের অবিরাম মিছিল, তা কি আর আমাদের বিচলিত করে না? এই যুগ আর যুগ সংকট থেকেই বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপবাসী কি আমরা; যারা নিয়মিত কবিতার সাথে সহবাসে ব্যপৃত?

এই যে কবিতার সাথে সহবাস, সে যদি নিতান্তই প্রেমন্দ্র মিত্রের উৎকন্ঠার মতো ‘শৌখীন মজদুরী’ই হয় তবে তো খুবই চিন্তার কথা। কেননা এই বিপুল কবিকীর্তি তখন নেহাৎই ‘শব্দের কংকাল’ হয়ে বেআব্রু হবেই একদিন, যেমনটি আশঙ্কা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। আর এইখানেই আমরা সত্যই উৎকন্ঠিত। উৎকন্ঠিত এই কারণেই যে আজকাল কাব্যচর্চা অনেকটাই সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে কারুকাজ করার মতোই নেহাৎই আলঙ্কারিক। যে অলঙ্করণের ক্যানভাসে ধরা পড়ে না বৃহত্তর জীবনের বর্ণ ও বর্ণহীনতার টানাপোড়েনজাত দ্বন্দ্ব ও সংশয়ের সাহিত্যিক উদ্ভাসন। ধরা পড়ে না যুগসংকটের কোন শৈল্পিক প্রতিভাস। ধরা পড়ে না কবি মনের নিরন্তর পথ খোঁজার কোন প্রত্যয়ী চলন। কিংবা পথ হারানোর সাময়িক বেদনার মর্মান্তিক হাহাকার। এই সবই অনুপস্থিত এ যুগের কাব্যচর্চার আন্তর্জালিক পরিসরে। ভয় হয় বড়ো ভয় হয় তাই, এ বড়ো ‘সুখের সময় নয়’ অনুভবে।

সেই অনুভবের পরতেই পথচলা শুরু কবিতা উৎসবের। সেই অনুভবের উৎকন্ঠাতেই দুই বাংলার কবিমানসের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান, নতুন করে ভেবে দেখার, জীবন ও কবিতার মাঝে ঝুলতে থাকা সাঁকোটা কতটা মজবুত আছে এখনো। এবং এই লক্ষ্যেই কবিতা উৎসবে শুরু হয়েছে নতুন বিভাগ ‘কবির সাথে কথকতা’। গত সংখ্যায় কবি রত্নদীপার পর এই সংখ্যায় বাংলার আর এক তরুণ তুর্কি দেবাশীষ মজুমদারের মুখোমুখি কবিতা উৎসব। না কোন ‘শৌখীন মজদুরী’র গল্প নয়, আমরা চেষ্টা করেছি এই সময়ের তরুণ সমাজের কাব্যভাবনার দিগন্তে কবিতা উৎসবের পাঠকদের পৌঁছিয়ে দিতে। আর এই প্রয়াস আমাদের জারি থাকবে বলেই কথা দিতে পারি।  

সম্পাদক: কবিতা উৎসব