কবির সাথে কথকতা জৈষ্ঠ্য ১৪২৩
দেবাশীষ মজুমদারের মুখোমুখি কবিতাউৎসব
কবিতা উৎসব: কবিতা উৎসবের
পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত। ‘কবিতা আর বাঙালি: বাঙালি আর উৎসব’ এ যেন এতটাই স্বত:সিদ্ধ যে, এই
নিয়ে কোন সংশয়ের অবকাশই থাকে না। আমরা কবিতা লিখতে ভালোবাসি। কবিতা পড়তে ভালোবাসি।
কবিতায় থাকতে ভালোবাসি। আর কবিতা নিয়ে উৎসব তো আমাদের বারোমাস্যা। তাই কবিতা নিয়ে
বাঙালির এই উৎসবকেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ মাসিক কবিতা উৎসব, শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিক পত্র। বাংলার জনজীবনে কবিতার
এই যে একটা বিপুল প্রভাব এই বিষয়টি আপনাকে
কি ভাবে প্রভাবিত করে। এবং আপনার কবিসত্ত্বার গড়ে ওঠার পেছনে এই প্রভাব কতটা
ক্রিয়াশীল ছিল বলে মনে করেন আপনি?
দেবাশীষ: ধন্যবাদ
শূভ্র’দা, প্রথমে এটা
বলে নেয়া দরকার যে আমি কিন্তু এই সাক্ষাৎকার দিতে মোটেই আগ্রহী ছিলাম না, কারন
বিভিন্ন, তবু
আপনি জোর করলেন, আর
আপনার কথা যে এড়াতে পারি না, সে আর নতুন কি। আচ্ছা, এখন যে প্রশ্নটা করলেন সেটায় যাই, বাংলার
জনজীবনে কবিতার প্রভাব এই টাইপ কথাগুলো
বলে আমার মনে হয় আমরা বাঙ্গালিকে একটু উঁচু জাতে তুলতে চাই, এইটা আমার
কাছে অহেতুক বলে মনে হয়। মানে বাঙ্গালি বলেই আমরা খুব কবি স্বভাবের, আমাদের আকাশ
বাতাস খাল নদী জল আমাদের কবি করে দিচ্ছে ব্যাপার কিন্তু এমন না বলে আমার মনে হয়।
তাহলেতো সবাই কবি হত,
যে জল আমায় স্পর্শ করছে, আমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে গড়িয়ে নামছে আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে সেই জল আমার আশপাশের
সবাইকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে,
এই জলকেই যে কবি সে প্রাণের অতলে নিয়ে যাচ্ছে, আমার মত করেই হয়তো বলছে, এই যে আমায়
ছুঁয়ে গড়িয়ে গেলে তুমি,
কি রেখে গেলে! কিছুটা
ছায়া রাখা যেতো, খানিক
লালিত প্লাবন, এই
নাও একমুঠো মল্লার, আঁকো
ধীরে ধীরে, আরেকটা
শ্রাবণ। চারিদিকে অপেক্ষা পতনের, বিরুদ্ধ
বাতাস। ফিরে এসো মায়া –
শোণিত জলের চেয়ে গাঢ়,
এইবার মোকাবিলা হোক। তো এটা আমার ভাবনা হতে পারে, কি জানি
আমার কেন যেন মনে হয় মূলত এইভাবে আমরা কবিতাকেই ব্র্যাকেটবন্দি করে ফেলছি। সে যাই
হোক, আমি
আসলে এখনো আপনার জানতে চাওয়া ওই ক্রিয়াশীলতার ব্যাপারটা নিশ্চিত নই।
কবিতা উৎসব: কিন্তু বাঙালির প্রতিদিনের
জীবনে কাব্যসাহিত্যের ঐতিহ্য কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা হুজুগ সর্বস্ব বলে আপনি মনে
করেন? অর্থাৎ জানতে চাইছি জাতি হিসেবে
সাহিত্যের সাথে আমাদের আত্মিক যোগ কতটা গভীর। নাকি আসলেই এটি একটি সামাজিক হুজুগ,
সামাজিক পরিচিতি লাভের সহজ একটি উপায় হিসাবে।
দেবাশীষ:
হাহাহা কঠিন প্রশ্ন,
আর আমি মনে করি আমি এই উত্তর দেবার মতন কেউ না, তবুও কাঠগড়ায় যখন দাড় করিয়েছেন নিজের
বয়ানটা দেই – দেখেন
কবিতাতো শুধু শব্দের মালা না, কবিতার সঠিক সংজ্ঞা
আমি জানি না। আমি ভাবি কবিতার বিষয়বস্তু
শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে গড়াবে, সেটা আগে থেকে ভাবা সম্ভব না, আবার এমন কিছু যদি হয় যে পাঠক পড়ে কিছুই বুঝল না, সে দায়টা
আমার মতে পাঠকের না,
কবির ব্যর্থতা। আবার মনে করেন কবি ঝকমারি কিছু শব্দের গাঁথুনি দিয়ে কবিতাকে
সাজিয়ে তুলছে বা সাজাতে চাচ্ছেন, যেটা পাঠকের আবার পড়তে ভালও লাগছে, কিন্তু শেষ-মেশ অর্থবহ
কিছু দাঁড়াচ্ছে না, পাঠকের
অনুভূতিতে কোন দাগ কাটেনি,
তাঁকে ভাবাচ্ছে না,
সেটা কবিতা হয়ে উঠতে পারেনি বলেই আমার মনে হয়। এই যে আপনি যেটাকে হুজুগ বললেন
এটা আমার কিন্তু খুব ভাল লাগল, এটা যদি হুজুগও হয় তো মন্দ কি, ভাল হুজুগ
তো!
কবিতা উৎসব: কাব্যচর্চা বলতে আপনি কি শিল্পসাহিত্যের জন্যেই
কাব্যচর্চায় বিশ্বাসী? না কি মনে করেন কবিতার ও একটা
সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে? বাংলাদেশের কাব্যচর্চার
প্রেক্ষিতে যদি বিষয়টি একটু আলোচনা করেন। সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে,
একজন কবির
সমাজসচেতনতা কতটা জরুরী বলে মনে হয় আপনার?
দেবাশীষ: যে কোন কবিতার
প্রথম পাঠক কে? কবি নিজেইতো
তাই না! তো
কথা হল সেই কবি যখন কবিতাটা লিখছেন তখন
শিল্পসাহিত্যের এতে কি ফায়দা হল এইসব কিন্তু ভাবেন না, আবার সে
প্রথম পাঠক হিসেবে যখন পড়ছে তখন তাঁর যে
অনুভূতি হচ্ছে সেটার সাথে লেখক হিসেবে তাঁর অনুভূতির গরমিল হতেই পারে। আবারও বলছি
বাংলাদেশের কাব্যচর্চার বিষয় নিয়ে আলোচনার আমি সঠিক মানুষ না। আমি জানি কম। আমি
কেবল আমার নিজস্ব ভাবনাটাই শেয়ার করতে পারি। সমাজসচেতনতা, দায়বদ্ধতা – এই সমস্ত বড়
বড় কথা কেন কবি সাহিত্যিকদের বেলাতেই কেবল আসবে, যে ডাক্তার, যে
ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী, পুলিশ, রাজনীতিক, আম-জনতা
দায়বদ্ধতাতো সবারই আছে। সেই হিসেবে কবিও একজন সামাজিক জীব, সমাজের নানা
কথা, বিবরণ, তাতপর্য এই
তিনের মিশেলে কবিতা হতে পারে। আবার কবি ফ্যান্টাসিওতো করতে পারে। এখন কোন কবি যদি
কেবলই প্রেমের কবিতা লিখে গেল এবং তাঁর সেই প্রেমের কবিতা পাঠকের খুব ভালও লেগে গেল, অথচ সেই কবি একটাও দ্রোহের কবিতা লিখলেন না,
এখন তাঁকে কি আপনি অকবি বলবেন? নাকি সে
সামাজিকভাবে সচেতন না বলবেন। আমি আমার নিজের কথা বলি, আমি আমার মা’কে অন্য
সবাই যেমন তেমনই প্রচণ্ড ভালবাসি, কিন্তু মা’কে নিয়ে আমি একটাও কবিতা
লিখতে পারি নাই সেইভাবে,
এইটা আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হয়তো, কিন্তু কবিতাতো আর জবরদস্তি লেখা যায়
না। আবার কেউ ধরেন খুব ভাল দ্রোহের কবিতা লিখতে পারেন, কিন্তু
প্রেমের কবিতা লিখতে পারেন না, প্রকৃতির কবিতা লিখতে পারেন না, তাকে কি
আপনি ব্যর্থ বলবেন? এই
যে ফের চলে এল ব্র্যাকেটের কথা, ব্যাপারটাকে
ছেড়ে দিন না, ঘুরে
ফিরে হাওয়া বাতাস খাক।
কবিতা উৎসব: এখন এই সমাজসচেতনতার প্রসঙ্গে একজন কবির দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ
কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আবার এই প্রসঙ্গে কি এইকথাও মনে
হয় না, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ একজন কবির কাব্যভুবনকে বৈচিত্রহীন করে তুলতে
পারে? এমনকি হারিয়ে যেতে পারে সাহিত্যিক উৎকর্ষতাও?
দেবাশীষ: উফ
শূভ্র’দা, আপনি কি সব
জটিল প্রশ্ন করছেন, আমি
এতো ভারী ভারী কথা ভাবতে পারি না। আচ্ছা আমি যখন কবি, তখন কিন্তু
আমি জাদুকর, আবার
সে-ই
আমিই নৌকার মাঝি, কোন
দেশের কিংবা এই মহাজগতের রাজা, সাধারন পথিক, কখনও একটা পাখি মাত্র, তো এই যখন
আমার এতো ক্ষমতা নিজেরে বহুমাত্রিকভাবে ভাববার তখন ব্যক্তি আমি কোন দল পছন্দ করি
কি করি না আমার কাছে এইটা মূল্যহীন। কিন্তু কথা হল, মানুষ যা ভাবে, চিন্তা করে, উপলব্ধি করে
তার পুরোটা কি সব সময় বলে?
আমার মনে হয় বলে না,
তো এখন কথা হল কবিওতো মানুষ, কিন্তু এই মানুষটাকে আবার কবিতাই গোপনে বলে দেয় – তুমি কিন্তু
প্রতি মুহুর্তে কবি। এইখানে জীবনানন্দ থেকে একটা উক্তি দেই, উনি
বলেছিলেন – কবিতা
আর জীবন একই জিনিসের দুই রকমের উৎসারণ। কবি কবিতা লেখেন, পাঠকের কাছে
তাঁর সৃষ্টিটা মেলে ধরেন, পাঠক সেই
সৃষ্টি দেখে আবেগাপ্লুত হতে পারে, অথবা ওয়াক
থু বলে ফেলে দিতে পারে,
পুরোটা স্বাধীনতা পাঠকের। কবি আবাহনী না কি মোহামেডান এর সাপোর্টার সেইটা তাঁর
একান্ত ব্যাপার।
কবিতা উৎসব: আবার এই সমাজসচেতনতার ভিত্তি সুদৃঢ় ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে
কতটা জরুরী বলে মনে করেন আপনি,
এবং কেন? কবি জীবনানন্দ যেমন জোর দিয়েছিলেন সুস্পষ্ট কালচেতনার উপর।
দেবাশীষ: “পৃথিবীর
সমস্ত ধূসরপ্রিয় মৃতদের মুখ নক্ষত্রের রাত দেখতে পারে” (জীবনানন্দ
দাশ/হাওয়ার
রাত) কিংবা
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে (জীবনানন্দ
দাশ / সন্ধ্যা
হয় চারদিকে) দেখেন
এই দুই জায়গায় কবির ভাবনা কিন্তু দুই রকম, একটায় উনি ফ্যান্টাসীর জগতে আছেন
আরেকটায় অতি বাস্তব ভাবনা। তাই বলে কবি
যখন ফ্যান্টাসীর জগতে আছেন সেই সময়টা কিন্তু তাঁর কবিতা ভাবনার, শুধুই তাঁর কবিতা ভাবনার। তাই বলে
কবিতো ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারেন না, আবার কিন্তু
পারে্নও, সেই ক্ষমতা তাঁর আছে। এই যে দ্বৈত অবস্থান এইটা সব কবিরই আছে বলে
আমি মনে করি, এইটা
না থাকলে কবিতা হইতো না।
কবিতা উৎসব:: এই যে স্বদেশপ্রেম, নিজের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতি দায়বদ্ধতা- এগুলি
একজন কবিকে আন্তর্জাতিকতার প্রেক্ষিতে
কতটা সীমাবদ্ধ করে তোলে বলে মনে করেন আপনি? অর্থাৎ আপনার কবিতা তো প্রাথমিক
ভাবে এই বাংলার সুর তাল লয়ের মন্থনই। কিন্তু সেই কাব্যসুধায় কি একজন বিদেশীও
তৃপ্তি পেতে পারেন যদি আপনার কাব্য আপনার স্বদেশপ্রেম আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের
উর্ধে না ওঠে? বিষয়টিকে আরও একটু অন্যরকম করে মেলে ধরলে বলা যায়, কালোত্তীর্ণ
সাহিত্যের আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছাতে গেলে যে বিশ্ববোধ জরুরী, দেশপ্রেম স্বাজাত্যপ্রীতি কি সেই পথে প্রতিবন্ধকতাঁর সৃষ্টি করে না?
দেবাশীষ: তাহলেতো আগে
ইংরেজী ভাষা শিখতে হবে তার পর কবিতা লিখতে হবে, এভাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মেলানো
যাবে, দুঃখিত
আমি এভাবে ভাবি না, আমি
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কবির কোন দায়বদ্ধতা নাই। মার্কেজরে পড়তে আমার স্প্যানিশ ভাষা
শিখতে হয় নাই, বাংলাতেই
তাঁর লেখা পড়বার সুযোগ আমার হয়েছে এবং খুব
ভালও লেগেছে, এখন এর মানে
কি এরকম দাঁড়ায় যে মার্কেজের দেশ প্রেমের অভাব ছিল, তিনি দেশ নিয়ে না ভেবে বিশ্ব নিয়ে
ভাবতেন, তাতো
না। দেখেন কালোত্তীর্ন সাহিত্য এখন হচ্ছে কি হচ্ছে না সেইটা নিয়ে কিন্তু এখন কিছুই
বলা সম্ভব না, অনেকেই
মনে করেন হুমায়ুন আহমেদের বেশীরভাগ লেখাই কেউ মনে রাখবে না, আবার এর
বিপরীত ভাবনার মানুষও আছে,
এইটা বিচার করবে কে?
কাল – সুতরাং
এইসব নিয়ে এখন না ভাবলেও চলবে। আর জীবনানন্দ দাশ-রে যে গোটা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই
চেনে না তাতে আমাদের কার কি এসে গেল, জীবন বাবুতো আমাদের বুকে সব সময়
আছেন। আরেকটা ব্যাপার বলি, আমার কিন্তু বহুবার এমন হয়েছে,
দেখা গেল এই মুহুর্তে একটা কবিতা পড়লাম, কেবল পড়েই গেলাম, কোন অনুভূতি হয়নি।
যথারীতি ভুলেই গেলাম সেই কবিতার কথা। অন্য কোন এক সময়ে আমি ওই কবিতাটাই আবার হয়তো
পড়লাম, আর পড়ে চমকে গেলাম, আমাকে প্রচন্ড নাড়িয়ে দিল লেখাটা, মনে হল – আহা এমন
লেখাইতো আসলে কবিতা। তাহলে কি দাঁড়াল? এর ব্যাখ্যা কি? আমি নিজে নিজেই এর একটা
ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছি, সেটা হল ওই নির্দিষ্ট কবিতাটা আমি যখন প্রথমবার পড়ি তখন
আমার মন সেই কবিতাটাকে উপলব্ধি করবার জন্য তৈরী ছিল না, কিন্তু পরেরবার যখন পড়লাম
তখন সেই লেখাটাই আমার মনে আলোড়ন তুলতে পেরেছে, আর তাই মনে হয় কবিতা পাঠের সময়
স্ট্যাট অফ মাইন্ড এর একটা ব্যাপক ভূমিকা আছে।
কবিতা উৎসব: সাম্প্রতিক
অন্তর্জাল বিপ্লবে বাংলা সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যের ভুবন কি বিপুল
পরিমাণে বিস্তৃত হয়ে গিয়েছে সেটা আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটেছে ও ঘটছে। আগে
লিটল ম্যাগাজিনের পরিসরের বাইরে অনেকটাই ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকতো, যেখানে অনেকেই কবিতা লিখলেও তা চার দেওয়ালের বাইরে আলো
দেখতে পেত না। আজ কিন্তু যে কেউই তাঁর কবিতটিকে বিশ্বের দরবারে হাজির করতে পারছে। এই
বিষয়টাকে আপনি ঠিক কি ভাবে দেখেন? অনেকেই যদিও বলছেন, এতে কবিতার জাত
গিয়েছে চলে। এত বিপুল পরিমাণে অকবিতার স্তুপ জমে উঠছে, যে
তাঁর তলায় চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃত কবিতা।
এই প্রবণতা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে আদৌ কি আশাব্যঞ্জক বলে মনে করেন আপনি? না কি এটি আসলেই অশনি সংকেত?
দেবাশীষ: জাত চলে
গেলে তো সমস্যা নাই, জাত কোথাও যাচ্ছে মানে যাত্রার উপর আছে, স্থবির হয়ে
যে যায় নাই এইটাই আশার কথা। হ্যাঁ অন্তর্জাল, স্পেসিফিক্যালী ফেসবুকের কারনে কবিতা
লিখবার একটা প্লাটফর্ম তৈরী হয়েছে, যেখানে অটোম্যাটিক কিছু পাঠকের কাছে
সরাসরি পৌছান যাচ্ছে। আমার কাছে এটা খুবই পজিটিভ একটা দিক মনে হয়, যার ইচ্ছে
লিখছে, ভাল
হচ্ছে না মন্দ হচ্ছে সেটা আমি-আপনি ডিসাইড করবার কে, অন্য কারও যদি ভাল লেগে যায় আমিতো
জোর করে সেখানে বাঁধা দিয়ে বলতে পারি না – ‘আরে ধুর এইটা
কবিতা হয় নাই, অযথাই
আপনার এটা ভাল লাগছে, এইটা ভাল লাগবার কোন মানেই হয় না’। এটা
মানুষের খুব নিজস্ব ব্যাপার। কবি কি আদতে
নিজেই জানে তাঁর একটা কবিতা ঠিক কতজন
পাঠকের পড়া দরকার? এইসব
আপেক্ষিক। তবে আমি আসলে লিটল ম্যাগের খুব ভক্ত, এখনো কাগজে ছাপার অক্ষরে আমি কবিতা
পড়ে বেশী আরাম পাই। অন্তর্জাল লিটল ম্যাগের চলার পথে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমিতো
চিরকাল তুমুল আশাবাদী মানুষ, তাই আমার কেন যেন মনে হয় এই বাধা কেটে
যাবে।
কবিতা উৎসব: সমাজজীবনে
অস্থিরতা কাব্যচর্চার পক্ষে কতটা প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন? না কি যে কোন সামাজিক
পরিস্থিতিই একজন প্রকৃত কবির কাছে কবিতা লেখার কার্যকারি উপাদান হয়ে উঠতে পারে।
যেমন ধরা যাক বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার কাব্যচর্চার
ভুবনটাকে তো বাড়িয়েই দিয়ে গিয়েছে বলা যেতে পারে। তাহলে সাম্প্রতিক মৌলবাদের উত্থান
লেখক বুদ্ধিজীবী ধরে ধরে হত্যা, নানান রকম ধর্মীয় ফতোয়া, সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা। রাজনীতি ও মৌলবাদের পারস্পরিক
আঁতাত এই বিষয়গুলি অতি সাম্প্রতিক কাব্যচর্চার পরিসরকে নতুন দিগন্তে পৌঁছিয়ে দিতে
পারে বলে ধরা যায়। কিন্তু সেটা কি বর্তমানে আদৌ হচ্ছে বলে মনে করনে আপনি?
দেবাশীষ: দেখেন
আপনি যে অস্থিরতার কথা বললেন আমি সেখানে
নতুন কিছু দেখতে পাচ্ছি না,
যুগ যুগ ধরে এমন হয়েছে,
আমি এগুলোকে দেখি সমস্যা হিসেবে, আর সমস্যা যেহেতু তার সমাধানও আছে, যুগে যুগে সমাধান হয়ে এসেছে। ভাষা
আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের সাথে এগুলোকে মিলিয়ে ফেললে অনেক বড় বোকামি হবে, ভাষা
আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ অনেক বড় ব্যাপার। কবি এবং কবিতা কোন কালেই কিছুর সাথে
আপোষ করেনি, কখনও
করবেও না। জীবনের কিছু স্মৃতি, কিছু মুখ, মুখোশ, ছুঁয়ে যাওয়া কিংবা না ছুঁতে পারা কোন হাওয়া, কথা, নীরবতা, ইশারা, দ্বন্দ, আহবান এ
সমস্ত কিছু মিলিয়েই কবিতা –
সুতরাং কবিতা আজকের বা গত দিনের না, কবিতা সময়ের, একে কোন
কিছুতেই থামিয়ে দেয়া যাবে না।
কবিতা উৎসব: আবার ধরা যাক এই
সব নানান জটিলতা থেকে মুক্তি পেতেই একজন কবি বিশুদ্ধ কবিতার কাছে আশ্রয় পেতে ছুটলেন। যেখানে রাজনীতি নেই,
সামাজিক অস্থিরতার দহন নেই, আছে শুধু
ছন্দসুরের অনুপম যুগলবন্দী। জীবনের জটিল প্রশ্নগুলি এড়িয়ে গিয়ে, কল্পনার ডানায় ভর দিয়ে ছোটালেন তাঁর বিশ্বস্ত
কলম। কবিতা তো মূলত কল্পনারই ভাষিক উদ্ভাসন। কিন্তু সেই পলায়নবাদী কবির কাছে
পাঠকের আশ্রয় কি জুটবে? কবির কলম পাঠকের কাছে কতটা বিশ্বস্ত থাকবে সেক্ষেত্রে বলে
মনে করেন?
দেবাশীষ:
এখানে প্রিয় ক্ষণজন্মা কবি শামীম কবিরের জাল কবিতার কয়েকটা লাইন বলছি –
“একদিন
জাল ফেলতে যাবো / জাল
ফেলার খুব আনন্দ / জাল
ফেলা বিষয়ে আমার পরিচিত এক জেলে আছে / সে বলে জাল তুলে কতো কিছুইতো ধরা
পড়তে / দ্যাখা
যায় কিন্তু জালের আসল কাজ হল মাছ ধরা / আমি মাছ খাই না / একদিন জাল
ফেলতে যাবো / অবশ্য
আমার মাছ না উঠলেও চলবে”
আপনার ওই প্রশ্নের উত্তর আমি শামীম কবিরের এই লাইনগুলোতে
দেখতে পাচ্ছি, এই
বিষয়ে আর কিছু বলব না।
কবিতা উৎসব: আপনার নিজের কবিতার
বিষয়ে যদি জানতে চাই, আপনার পাঠকের কাছে
ঠিক কি ভাবে পৌঁছাতে প্রয়াসী আপনি? ‘ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড’ না জীবনের এই
প্রবল ঘূ্র্ণীর মধ্যেই আপনি আপনার কবিতায় আশ্রয় দিতে চান সচেতন পাঠককে, যে- না আশা
আছে। পথ আছে। যে পথে ক্রমমুক্তি হবে মানুষের।
দেবাশীষ: আমার কবিতার প্রথম
পাঠক এবং প্রথম সমালোচক আমি নিজেই। আবারও জীবন বাবুর
কথায় আসি, আমি
তাঁকে পড়ি, আনন্দ পাই, সেই
চোখ দিয়েই প্রকৃতিকে দেখতে পাই উনার লেখার মাধ্যমে। তাঁর প্রতিটা লাইন পড়ে আমাকে একবার থামতে হয়, ভাবতে হয়।
এই যে তাঁর প্রতি এমন ভালবাসা সেটা কি তিনি কখনও ভেবেছিলেন, উনার
প্রয়াণের ৬২ বছর পরে কোথাকার কোন দেবাশীষ সেই কবিতা পড়ে বুঁদ হয়ে আছে! আমি আগেই
বলেছি আমার কোন দায়বদ্ধতা আছে কবি হিশেবে এটা আমি মানি না। আমি লিখি, আমার লিখতে
ভাল লাগে, আমি
বাদে পৃথিবীর আর একজন মানুষেরও যদি সেই লেখা পড়ে সামান্যও ভাল লাগে এটাই আমার কাছে
বিরাট পাওয়া। মানুষকে মুক্তি দেবার আমি কেউ না।
কবিতা উৎসব: ঢাকা কেন্দ্রিক
কাব্যচর্চা আর চট্রগ্রামের কাব্যচর্চার প্রকৃতিগত কোন তফাৎ কি আপনার চোখে পড়ে?
পড়লে আর স্বরূপটিই বা কি রকম? চট্টগ্রামে
বর্তমান সাহিত্যচর্চার পরিসরটি কতটা আশাব্যঞ্জক? একজন কবি কতটা স্বাধীনভাবে তাঁর
কাব্যচর্চার প্রক্রিয়াটিকে সচল রাখতে পারেন সেখানে?
দেবাশীষ: কোন তফাৎ নাই। পরাধীনভাবে কেউ কবিতা লিখছে বলে আমার জানা
নাই এখানে। অনেকেই লিখছে দেখছি, কেমন লিখছে, ভাল না মন্দ, সেটা বিচার
করবার কাজ পাঠকের, আমিতো
ওই লেখকদের সাথেই জার্নি করছি, তাঁদের
সহযাত্রী,
এখানে আমার কাজ লেখা,
এটাই চলুক।
কবিতা উৎসব: কবিতা উৎসবের
পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমাদের নিরন্তর শুভেচ্ছা আপনার প্রতি। আলোচনার
শেষে জানতে ইচ্ছে হয় যে, নিজের কবি মানসে আপনার চট্টগ্রাম কতখানি জায়গা জুড়ে থাকে?
এই যে জন্মভূমি বা বাসভূমি যাই বলি না কেন, একজন কবিকে কতটা প্রেরণা দিতে পারে বলে
মনে হয়, না কি বিশেষত এই বিশ্বায়নের যুগে গোটা বিশ্বই যখন হাতের মুঠোয়, তখন কবির
কাছেও তাঁর আপন জায়গার বিশেষ কোন তাৎপর্য থাকে না আর!
দেবাশীষ: জীবনের বেশীরভাগ সময়তো এই শহরেই কাটিয়ে দিলাম, তারুন্যের
কিছু উত্তাল সময় ছাড়া। চট্টগ্রাম তাই প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে। কবির দেশ আছে, কবিতার কোন দেশ হয় না। আমার দেশ বাংলাদেশ। আমার কবিতা
এই পৃথিবীর যে কারও হতে পারে। যা দেখে ফেললাম, স্পর্শ করে ফেললাম, ডুবে গেলাম
আপাদমস্তক, এই
নিয়ে যেমন কবিতা লিখি,
আবার যা এখনও দেখতে পাইনি, উপলব্ধি করিনি, ভাবিনি, স্মৃতির
সাঁকো ধরে হেটে আসেনি কিম্বা চলেও যায়নি এইসবই কবিতা ভাবনা হতে পারে, সেখানে কোন
সীমানার কাঁটাতাঁর নেই।