বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

সম্পাদকের কলমে


“বাহিরের জগত আমাদের মনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, আর একটা জগৎ হইয়া উঠিতেছে। তাহাতে যে কেবল বাহিরের জগতের রঙ আকৃতি ধ্বনি প্রভৃতি আছে তাহা নহে; তাহার সঙ্গে আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, আমাদের ভয় বিস্ময়, আমাদের সুখ- দুঃখ জড়িত- তাহা আমাদের হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র রসে নানা ভাবে আভাসিত হইয়া উঠিতেছে” কথাগুলি স্বয়ং বিশ্বকবির। আর এই যে হৃদয়বৃত্তির রসে জাড়িত হয়ে ওঠা, সেইটিই সাহিত্যের আঁতুড়ঘর। তখনই ভাষা এসে ভাবের মুক্তি ঘটায় কোন না কোন মাধ্যমে। তখনই সাহিত্যের সৃষ্টি। তাই সাহিত্যের সাথে তার স্রষ্টার ব্যক্তিগত একাত্মতার একটি চিরকালীন সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু সেই চিরকালীন সম্পর্ক বিশ্বজনীন না হলে তা কখনোই কালোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে না। বস্তুত সাহিত্যের ইতিহাস আমাদেরকে সেই কথাই বলে। এই কারণেই দেখা যায় আজ যা সাহিত্যের সামগ্রী বলে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কালকেই হয়তো তার সাহিত্যমূল্য যাবে হারিয়ে। কিন্তু যে সাহিত্য বিশ্বজনীন হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে, সে কিন্তু আজকের সময়ের বলয়ের বাইরেও পরবর্তী বহু যুগের বাণীকে ধারণ করতে পারে, আর পারে বলেই তা যুগের অন্তেই শেষ হয়ে যায় না। তাকেই আমরা সাহিত্যের শাশ্বত ধারা বলে জানি।

কথাগুলি বলার কারণ, নেট বিপ্লবের পথরেখা ধরে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণে সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তার মধ্যে সাহিত্যমূল্য কতটুকু বিদ্যমান, সেই আশঙ্কাটা কিন্তু থেকেই যায়। উৎকৃষ্ট সাহিত্য হঠাৎই এত সহজলোভ্য হয়ে উঠেছে, এমনটা ভাবার মধ্যে হয়তো একটা হঠকারিতাই রয়ে যাবে। এই যে প্রতিদিন এত কিছু লেখা আপলোড হচ্ছে তার কত শতাংশ সাহিত্যের সামগ্রী আর কত শতাংশ নয়, সে কথা আমরা হয়তো সঠিক করে কেউই বলতে পারবো না। কিন্তু যে কাজটা আমরা করতে পারি, যে লেখাগুলি আমাদের চেতনায় আলো ফেলছে, যে লেখাগুলি আমাদেরকে ভাবাচ্ছে, যে লেখাগুলিকে আমরা কোন ভাবেই এড়িয়ে যেতে পারছি না, পারছি না উদাসীন থাকতে, সেই লেখাগুলি নিয়ে সাহিত্যচর্চার পরিসরটিকে সদা সজীব করে রাখার চেষ্টাটুকু তো আমরা করতে পারি। করতে পারি যে যার সক্ষমতায়! কবিতা উৎসব সেই প্রয়াসটিকেই জারি রাখতে চায়। সেই কারণেই আমরা; এখন যাঁরা নিয়মিত ভাবে ভালো লিখছেন, তাঁদের নিজস্ব প্রিয় লেখাগুলিকে নতুন করে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর নাগালে নিয়ে আসতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এবং সেই সাথে যাঁরা সাহিত্যকে মাধ্যম করে নিরন্তর আমাদের চেতনায় ঢেউ তুলে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে সরাসরি পাঠকের সাথে মুখোমুখি করার বিষয়টিকেও কবিতা উৎসব খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাইছে। আর সেই উদ্দেশ্যেই এই বৈশাখ সংখ্যা থেকে কবিতা উৎসবে সংযোজিত হল কবির সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার বিভাগের। এই বিভাগে এইসময়ের আলোচিত কবিদের সাথে একান্ত আলাপচারিতা জারি রাখবে কবিতা উৎসব। আমাদের আশা পাঠককুল তাঁদের প্রিয় কবির অনেক কথা জানতে পারবেন, ধরতে পারবেন কবির মানসলোকের চাবিটি, খুলতে থাকবে এক একটি আশ্চর্য্য রঙমহলের দরজা।

এই সংখ্যায় আমাদের অতিথি এই সময়ের অত্যন্ত বলিষ্ কলম ও আলোচিত কবিব্যক্তিত্ব কবি রত্নদীপা। বিগত অর্ধদশক ব্যাপি সময় সীমায় দুই বাংলাতেই সমান ভাবে জনপ্রিয় এই কবি। ইতিমধ্যেই তাঁর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ যথেষ্ঠ সমাদর লাভ করেছে কাব্যপ্রেমীদের জগতে। আবার সেই সাথে অতি সম্প্রতি তাঁর সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাঁটাতারের দুই পারেই জমে উঠেছে বিতর্ক। বিষয়, সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতা ও কবির স্বাধীনতা। কবিতা উৎসব কবি রত্নদীপার কাব্য ভুবনকেই ছুঁয়ে দেখতে প্রয়াসী হয়েছিল এই একান্ত আলাপচারিতায়। মননশীল পাঠক এই সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে বর্তমান বাংলাসাহিত্য জগতেরও একটা আভাস পাবেন বলেই আমাদের আশা। এই প্রসঙ্গেই একটি কথা বলা যেতে পারে, সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতার বিতর্ক নতুন কোন ঘটনা নয়। সাহিত্যের ইতিহাসই তার বড়ো প্রমাণ। কিন্তু একথাও ঠিক, আজ পর্য্যন্ত বিশ্বের কোন প্রান্তেই কোন অশ্লীল সাহিত্য টেকে নি। কালের কষ্ঠীপাথরেই তার শ্লীলতা অশ্লীলতার পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। তাই যে সাহিত্য সত্যই সাহিত্যমূল্যহীন কিংবা অশ্লীল, তা কালের নিয়মেই হাওয়া হয়ে যাবে একদিনতবু আমাদের ভালো লাগা মন্দলাগা নিয়ে, আমাদের পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আমরা বিতর্ক করবো, আর সেটাই স্বাস্থের লক্ষণ। কিন্তু সেই সাথে আমরা যেন এইটিও দেখতে না ভুলে যাই, সেই বিতর্ক যেন বিষয় ছাড়িয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে। তাহলে বিতর্কের উদ্দেশ্যই মাটি। হয়তো সেখানেই অশ্লীলতায় জয়! আমাদেরকে সচেতন ভাবে সেই দুর্বিপাক এড়িয়ে চলতেই হবে।

এই বৈশাখে আমরা বেশকিছু নতুন কবিকে পেয়েছি আমাদের মধ্যে, তাঁদের সকলকে কবিতা উৎসবের তরফ থেকে আন্তরিক ভালোবাসা জানাই। সঙ্গে আমাদের নিয়মিত সাথীদের সকলকেই নববর্ষের উষ্ণ অভ্যর্থনা। কবিতা উৎসবের পথচলায় আপনাদের সাহচর্য্য আমাদের পাথেয়। ভালো থাকুন সকলে, ভালো কাটুক নতুন বছর, কবিতার সহবাসে।