বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

সংযুক্তা মজুমদার




সংযুক্তা মজুমদার
শূন্য খেয়া

মিলির সাথে দেখা অনেকদিন পরে,
এখনো মিলি কোনরকমে আঁকড়ে আছে
কবেই ভেসে যাওয়া সেই অনাদি ঘর।
কেমন আছিস? বর, ঘর, সংসার, মেয়ে,
আর সেই যে, ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্তে বাঁচিয়েছিলো যে,
সবাই ভালো আছে তো?’
হাসলো মিলি, কান ছুঁয়ে যাওয়া হাসি,
তবে চোখের শূন্যতা তবু দেখা গেলো,
বললো, ‘‘সারাজীবন চলেও এক পা চলেনি আমার সাথে,
পাশাপাশি ঘুমিয়েও, একসাথে ঘুমায়নি কোন রাতে,
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, একবারও মাথায় রাখেনি স্নেহের হাত,
তবু, তারই ঘর সামলাই দিনরাত।
এক বন্ধু ছিলো বটে, উপকার না অপকার করেছিলো জানিনা,
মন দিয়ে ছুঁতে চেয়েছিলো সবার অলক্ষ্যে আমার হৃদয়,
শূন্য মরুভূমির মাঝে একফোঁটা মরুদ্যান বুঝি,
মরীচিকা নয়, মনে হলো, এইতো সে, একেই আমি খুঁজি?
নীরবে আদরে রেখেছিলাম তাকে,
নীরবেই সে থাকতো অপেক্ষায়, আমার পথের বাঁকে,
প্রশ্ন করলো হঠাৎ, তোমার এই শূন্যতা না থাকলে
বাসতে ভালো আমায় এমন করে?’
অবাক হলাম, উত্তর ছিলোনা, উঁকি দিলাম কেবল মনের ঘরে,
পূর্ণতা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রয়াশ, কিছুই ছিলোনা,
তবু তুমি উল্কার মত এসে ছড়িয়ে গেছিলে,
আগুন জ্বালোনি, ফুল ফুটিয়েছিলে,
তাই লিখেছিলাম তোমায়,
তুমি আমার শূন্যস্থান পূরণ নও,
তুমি আমার ঈশ্বরের দান,
তুমি আমার অগতির গতি নও,
তুমি আমার চিরসখা।
নিজেই এসেছিলে, করিনি সন্ধান।
সেই শেষ, আমার হৃদয়, নীরবতার মুখরতায় পূর্ণ,
সব আছে, যেমনটি থাকবে,
কেবল সেই স্থানটি আজ শূন্য’’
মিলি, এই শূন্য খেয়ার পালে
আবার হাওয়া লাগবে,
আমি জানি...কিছুই শেষ হয়না।
………………………………………………………………………………



সংযুক্তা মজুমদার
গুরুচরণের দরজা

আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে গুরুচরণ...
‘‘আমারে একটু যাইতে দাও!’’
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রক্ষক... ‘‘যাবে? কোথায় যাবে?
অত সোজা নাকি? এই দরজা পেরোলেই হবে?
আরও কত দরজা আছে জানো? আরও কত
কঠোর, কঠিন পাহারা!
সে সব ভেদ করে যাবার তোমার সাধ্য কই?
তুমি বরং এইখানেই বসো, সময় হলে ডাকবো।’’
দিন, মাস,বছর কাটলো,
কত বসন্ত এলো গেলো,
রক্ষকও ঠায় দাঁড়িয়ে, আর গুরুচরণ...
বদলানো চেহারা, আর রুক্ষ, সাদা, বেড়ে ওঠা
অবাধ্য চুলে হাত বুলিয়ে চলে
এই এত্ত বছরে, গুরুচরণ বাকি রক্ষকদের কথা ভুলেই গেলো।
কেবল এই চোখের সামনের রক্ষককেই একমাত্র বাধা মনে হতে লাগলো।
নিজেকে কত দোষারোপ করতে থাকে গুরুচরণ,
যখন জোয়ান সিলাম, ক্যান জোর কইরা যাই নাই!”
এতদিনে গুরুচরণ দ্বাররক্ষীর জামাকাপড়ে ঘুরে বেড়ানো
অদৃশ্য পোকা গুলোকেও চিনে ফেলেছে।
আস্তে আস্তে চোখের তেজ কমছে
অন্ধকারে আজকাল খালি একফোঁটা আলোর রেখাই দেখতে পায় সে।
আর বেশি উঠে বসবারও ক্ষমতা পায়না
তবুও ক্ষীণ শরীর ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যায়,
বলে, ‘‘ রক্ষীমশাই, এই শেষবারের মত শোনো আমার কথা,
একটা শেষ প্রশ্ন...’’
কিসের আকুতি ছিল সেই ডাকে, রক্ষী বুঝি বুঝলো, সময় হয়েছে, সময় শেষ,
তবুও বিরক্ত হয়ে বলল, “উফ, বড্ড লোভী তুমি, বলো কি জানতে চাও?”
‘‘আস্সা, হক্কলের আইনের কাছে আসতে লাগে, ন্যায় বিসারের লগে,
তা এই এত্তগুলি বসরে আমি আর কারে এই দরজার সামনে আইতে দ্যাখলাম না?
কিকইরা সম্ভব?’’
কানের কাছে মুখ নিয়ে রক্ষক চিৎকার করে বললো,
‘‘
আর কারো আসার উপায় নেই এখানে,
দরজা যে খালি তোমার বিচারের জন্য,
তুমি যাবে, আমিও এই দরজা বন্ধ করে দেবো।’’
………………………………………………………………………….


সংযুক্তা মজুমদার
চুমুক
যেদিন তুই প্রথম আমার সামনে ওর গ্লাসে চুমুক দিলি,
সেদিনই বুঝেছিলাম -
আমার আর কিছু নেই,
কিন্তু বলতে পারিনি তোকে
বাইরের ঠুনকো সাজুগুজুর দেওয়ালটা
পাছে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়
তাই যে জলস্রোত
বুকের ভেতর থেকে অকস্মাৎ
লাফিয়ে উঠলো চোখের কার্ণিশে
মাঝপথে সন্তর্পনে খুব গোপনে
চুমুক দিয়ে গিলে নিয়েছি বারবার  

আমার পরম অভিমানেরা নিত্য উধাও হয়ে যেতো
তোর মিষ্টিকথার অনায়াস চুমুকে  
কিন্তু আবার তারা ভিড় করে আসতো
আমার একলা সময়ে
জ্বালাতে
একলা সময় ছিলোই বা কতটুকু?
তবুও তার মধ্যে কেমন গোঁয়ারগোবিন্দ আগাছার মতন
দুঃখ ঢুকে পড়তো
আর জল হয়ে উথলে উঠতো

প্রতিদিন বুঝতাম - তোকে হারাচ্ছি
কিন্তু কি দিয়ে বাঁধবো - জানতাম না
আজও কি জানি ছাই?
কেবল যতবার গ্লাসে জল খেতে যাই,
তাতে জল থাকে না

উপচে থাকিস তুই

তাই গ্লাসে আর চুমুক দিই না
তেষ্টা মেটে না..
.........................................................



সংযুক্তা মজুমদার
ফানুশ
পুড়ছে টাকা উড়ছে ফানুশ
এই না হলে আমরা মানুষ?
কেউ যদি হয় ব্যাতিক্রমী
পায়ের তলায় পায় না জমি
তবু ভাবি এমনি চলুক
হোক পৃথিবী মগের মুলুক
হেসে খেলে যাক কেটে দিন
বিবেক খোঁচা দিন দিন ক্ষীণ
পুড়ছে পুড়ুক যাক জ্বলে যাক
বাঁচার তাগিদ পাক লোপ পাক
আপোষ করে কাটাই কিছু
স্বপ্নে দেখি নেয় সে পিছু
ভোরের সাথে সব মুছে যায়
দিন কেটে যায় উত্তেজনায়
কৃত্রিমতা তোমায় সেলাম
এই না হলে মানুষ হলাম?
....................................



সংযুক্তা মজুমদার
ভণ্ড
শব্দে এবার মর্চে ধরা,
দেখ পৃথিবী গড়ছে কারা,
যে টুকু তোর রইলো মাটি,
পাত সেখানেই শীতল পাটি,
ঘুমিয়ে পড় কাঁদিস না তুই,
আর আমাকে বাঁধিস না তুই,
মেজাজ মুখোশ ভণ্ড সকল,
তাই আবার পাশ ফিরে শুই,
আর আমাকে জাগাস না তুই।

...................................................

সংযুক্তা মজুমদার
পারের কড়ি
আজ রাজুবালার ‘শবকথা মনে পড়লো
মেয়ে রাজুবালামা রাজুবালা,
দিদিবউসব ছাপিয়ে গ্রামের মানুষের কাছে 
ইসসস...ম্যাগোওই তোডোমবালা যায়
রোজ না জানি কত মড়া পোড়ায়!
কতদিন দেখেছি,
কি পরম মমতায়রাজুদি ঘি মাখাতো সব শবেতে,
যেন সকলেরই পারের কড়ি তার হাতে।
রাজুদি রান্না করছেশ্মশানের পাশেতার কুঁড়েঘরে,
হরিধ্বনি শুনেই সব থেমে যেতো তার,
‘‘কি জানি আবার কে মরলো!’’
ছুটে চলে যেতোপড়ে থাকতো ঘরকন্না,
তখন কেবল কলরোল আর কান্না।
অপঘাতে কাটাছেঁড়া শবের প্রতি বড়
মায়া ছিলো তার।
বলতো, ‘‘আহারে, সাবধানে ঘি লাগাইআর যেন না ব্যথা লাগে!’’
পল্টুর মা একদিন বলেছিলো রাজুর স্বামী ভোম্বলকে,
‘‘আচ্ছা ওর হাতের রান্না খাও কিকরে?’’
ভোম্বল হেসে বলেছিল, ‘‘ওর হাতের ওই ঘিয়ের গন্ধ সবকিছুতে ছড়িয়ে থাকে গো,
একদিন খেয়ে দেখোঅমৃত লাগবে।’’
গ্রামের সবাই রাজুকে একটু ঘৃণাই করতো
একে মেয়ে তায় আবার ডোম,
নির্দ্বিধায় নিত্যদিন নরদেহকে মুক্তি দেয়,
তার কি আর মুক্তি আছে?
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘তোমার ভয় করেনা?’’
রাজুদি হেসে বলেছিলো, ‘‘ভয় তো জ্যান্ত লোকেদের রে,
মরা মানুষ কি করব?
আর এইখানে আমাদের হক্কলেরই আইতে হইবো,
তো ভয় ক্যান?
এই একটাই কথা জীবনের জানি হইবই হইব,
বাদ বাকি যা হইবার হোক না ক্যান।’’
পরে জেনেছিলামরাজুবালার হইবই হইব হয়েছে,
তার পারের কড়ি কে দিলো তা আর জানা হয়নি।


…………………………………………………………………………………..