উদয় শংকর দুর্জয়
লিখে রাখি বিশুদ্ধ আত্মার রাত্রিদিন
আমি লিখে রাখি সেই সব রাত্রিদিন, যেখানে প্রকাশ্যে
খুন দিয়ে পবিত্রতা সুরাক্ষা করে কিছু কিছু বিপথগামী ভ্রূণ। শার্লি হেব্দোর কাগজে টেবিলে
জ্বল জ্বল করে ওঠে রক্তিম মানচিত্র। প্যারিসের পথে বিদ্রোহী স্রোতে ভেসে যাওয়া ৩.৭ মিলিয়ন আহত আত্মার শ্লোগান।
আমি লিখে রাখি ঢাকার বিশুদ্ধ আক্সিজেনে এখন পেট্রল পোড়া
বারুদ। ঝলসে যাওয়া জীবন ছবির স্পষ্ট অবয়ব। হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে থাকা চেতনার কঙ্কাল
তবু ওরা বালির ট্রাক আর বুলেটের রাজনীতি তরান্বিত করে অহোরাত্র। লুট হয়ে যায় প্রকাশ্যে
স্ব-ধীনতা।
দগ্ধ তখন লালসার বার্ন ইউনিট, দগ্ধ তখন ঘরে ফেরা যৌবন,
দগ্ধ তখন ভোরের পাখি বৈকাল্যের দুরন্ত ছেলেবেলা, দগ্ধ তখন আমার মায়ের অপেক্ষার সোনা মুখি বদন।
উদয় শংকর দুর্জয়
ব্যর্থতার দলিল মোড়া সময়
আরেটু পর হাফিজের জানাজা। ক্ষুধার্ত নিউমোনিয়ার
হিংস্র দাঁত
যেন বিক্ষত করল শুধু এম এস হলের হাফিজকে নয়
রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকে দলিল লিখে শিকার হয়ে গেল
অবলীলায়।
বাবুল মাতুব্বর! চা বিক্রেতার পোড়া হৃৎপিণ্ড যেন কাঁপিয়ে
দিয়ে গেল
পুরো আকাশ। মাত্র ৫০০ টাকা চাঁদা দেয়ার ব্যর্থতায়
দেশলাই জ্বলে উঠলো একদল রাষ্ট্রীয় পোশাকিদের
ঘৃণ্য কপাট খুলে। সব লেনদেন মুঠো বন্দী করে
বার্ন ইউনিটে খুঁজে নিল অন্তিম আশ্রয়।
বিবৃতি আর সংলাপে ফুলে ফেঁপে উঠবে টক শো
আর ওয়েব শো। পরিযায়ী ফিরে যাবে ঘরে।
হাফিজ ও বাবুলের দাফনের সিক্ত হাওয়া মেখে
একদল স্বজন ঘরে ফিরবে কঠিন পাথর - হৃতভূমে চাপা
রেখে।
চাপা রেখে সব ব্যথার কলহ, নিরন্তর আহত মেঘ
বুকের বন্দরে জমা রেখে হাফিজের বাবা শুকিয়ে নেবে
অশ্রু
অটোরিকশার তৃষ্ণার্ত বিবাগী হাওয়াতে। বাবুলের
সহধর্মিণী
হিসেবের খাতা লিখতে লিখতে চা - পাতার গোপন
সৌরভে
বুকের মধ্যে লালন করে চলবে প্রাণেশ্বরকে।
এর পরও আমরা কিনছি ১ মিলিয়ন ডলারে সামরিক অস্ত্র
২২০ মিলিয়ন ডলারে যুদ্ধ জাহাজ, আর পরিচর্যায় ৫৫৯
মিলিয়ন ডলার।
… তবু, আমরা গড়ছিনা পর্যাপ্ত আবাসিক হল,
ভাবছিনা হাফিজের
কনকনে রাত্রির শীতকনা ঘায়েলের অস্ত্র নিয়ে। দেখছি
না
পানিবন্দী পাঠশালা শূন্য পড়ে থাকা অসহায় সময়গুলো।
মুখ লুকিয়ে নিচ্ছি শাসক আর শোষকের ভুলে ভরা
পাণ্ডুলিপি দেখেও। আমরা একটিবারও ভাবছি না
একটি বটবৃক্ষের কথা, একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের সোনালি পথ।
উদয় শংকর দুর্জয়
পরাগ মাখা শাশ্বত বিকেল
...তবু
শীত ঝরা বিকেল গুলো অন্যরকম ছিল, বসন্ত আগমনী ভাব
ছিল। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ায় পলাশ পরাগ - উড়তে উড়তে
রাজপথ পেরিয়ে যেতে চাইলে - এক ঝাঁক শকুন
শ্যেন দৃষ্টি ছড়ায়। বাতাসের শরীরে আটকে যায় তাপের দগ্ধ ছোঁয়া।
এখন ভোর হলে নিঃসঙ্কোচে বেরিয়ে পড়ে মুঠো ভরা ফুলেল
শৈশব, মায়াবী ঘাসের রং মেখে হেঁটে যায় স্নাত শিশির। প্রভাত ফেরীর সুর গুঞ্জন
আত্মার শ্রান্তি গুলো লিখে রাখে আরেকটি অধ্যায়ের সৃজনলিপি।
অধ্যায় পার হতে হতে পাণ্ডুলিপি খুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে
শাশ্বত ইতিবৃত্ত। মুঠোভরা সূর্যগুড়ো উড়ে যায় শ্রান্তির চূড়োয়। অবনত মনের দেয়াল
সাদা বক ছড়িয়ে দিয়ে যায় শ্রান্তির হিমেল আলোছায়া।
উদয় শংকর দুর্জয়
একটি স্বচ্ছ আকাশ ভাবনা, অতঃপর
এমন মেঘাচ্ছন্ন জ্যোৎস্না আমরা চাই নি।
পণ করেছিলে একটি দেয়ালী চিত্রে থাকবে
সব পাখির পালক ঝরা হাজার আহত ডানার
একটি আকাশ। অমর সঙ্গীতে কোরাস গাইবে
রাই সরষে ক্ষেতের সব প্রকারের প্রজাপতি।
সোনালি প্রান্ত ধরে বালক পতাকা হাতে দৌড়িয়ে
হাপিত্যেস হয়ে উঠোনে দাঁড়ালে মা মুছে দেবে ঘাম।
কীর্ত্তনখোলার মাঠে ভর সন্ধ্যেবেলায়
ভৈরবী গান হবে। গৌরনদী স্নান সেরে মুছে নেবে
লাশের শরীরে আটকে থাকা ঘাতকের চিহ্ন। পৌষের
সূর্য ডুবতেই আজাদ ফিরে যাবে অপেক্ষার গলি ধরে
শেষ বস্তি ভিটেয়। জগৎ জ্যোতি সব খুনের বুলেট চুরি
করে
দপ করে জ্বলে উঠবে দাঁতাল শুয়োরের কর্ণিয়ায়।
রায়ের সবক’টি আত্মারা শোকার্ত ছায়া উপেক্ষা করে
ভিড় করবে রাজপথে। কলাভবনের শরীরে
নীলিমার লিখে রাখা বীরাঙ্গনার ঠিকানা পড়ে
বুনো কবুতর এসে দাঁড়াবে তোমার ৩২ নম্বর ঝুল
বারান্দায়।
চেয়েছিলে দেখা অদেখা সর্বনাশের সব শকুন
ধারাল বন্য নখ গুটিয়ে নেবে। জয়নুলের
দূর্ভিক্ষের চিত্র হয়ে যাবে নিলাম। গুণ লিখবেন
প্রেমাংশুর রক্তের দ্বিতীয় অধ্যায়। অজর কবিতা
অবিনাশী গান গাইতে গাইতে রাহমান বুনবেন
কবিতার শ্রেষ্ঠ মায়াজাল।
উদয় শংকর দুর্জয়
বিশ্বাস পিতায় নয়তো চিতায়
আমরা এখনো দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে আটকে আছি
ঘোষক আর কে পোষক
আমরা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দোদুল্যমান
জাতির পিতায় নয়তো আদিমতায়
এখনো প্রত্যাশার বিজয়ে রহস্যের ঘুণপোকা
তিন না ত্রিশ
বিশ্বাস করি তবু আমরা দাঁত বের করে হাসি
এক না বত্রিশ
আমরা ভাঙি খিল খুন করি দিল
টকশো আর সুশীল শো
সত্যকে চাপা দিই মিথ্যাকে জপি আমরা
সে যে বহুরূপী বেহায়া বিশ্ব
এখন সবাই চেতনায় বেদনায়
ভারি সচেতন
পেট্রোল বারুদ চাপাতি রক্তাক্ত উল্লাস
আমরা আস্তিক অবচেতন
আমরা খুলি ধর্মের ধারাপাত
বাছি জাতপাত
আমরা বুকে রাখি, বিশ্বাস অন্তরে লালা
আমরাই করি প্রার্থনা আবার বলি হালা।
উদয় শংকর দুর্জয়
কলম ও কালের খেয়া
পাল্টে গেছে আমাদের জীবন জলছবি বাতায়ন
ফিকে হয়ে গেছে অর্জনের সবকটি রং ধূসর ছায়ায়।
জাতি পার করছে বিভীষিকাময় ক্রান্তিকাল। এতটি বছর
পরেও হেরে যায় মুক্তি সন্তানেরা, হেরে যায়
রাত-জাগানিয়া পাখি।
মৃত্যুশঙ্কায় সিকদাররা ডায়রির পাতা খুঁড়ে
আবিষ্কার করে কঠিন পারদ খাঁচা।
সিকদাররা হেরেছিল একাত্তরে, হেরে যাচ্ছে
দুই হাজার পনেরতে তবু পঙ্গু স্বপ্ন নিয়ে
যন্ত্রণার আকাশ পাড়ি, মেঘলা নামে ফরিদপুরের
ভূ-ম-লে। বিত্তজনেরা ভেঙে দেয় কালের খেয়া
স্তব্ধ করে দেয় আস্তিনে জমা চৌদ্দটি হৃৎপিণ্ডের
প্রতিবাদী মিছিল।
অধিকার নয় টিকে থাকার প্রত্যয় মুঠোবন্দি করে
পথে নেমেছে সিকদার। একাত্তরের মুখোশধারী
পশুরা পাল্টে নিয়েছে বেশ, মেহেদিকেশে আর
ধর্মের দলিলে লিখিয়েছে নাম। ওরাই ছিল
চাটুকর দালাল লুটকারী, ওরাই ছিল আতঙ্কের
ভয়ার্ত জনপদ। ওরাই নিয়েছে শপথ, যুদ্ধাভরণ
লাগিয়ে সেজেছে, বকধার্মিক। ওরা এখন
সমাজের বেপরোয়া শকুন, ওরা এখন লুকিয়ে নিয়েছে
বিষাক্ত নখ, হিংস্র রক্তচোখ। তবু ওরাই
শাসনের শপথ পাঠক শোষণের দলিল লেখক।