রিয়া চক্রবর্তী
ইচ্ছেঘুড়ি
আজকাল ইচ্ছেরা আর আকাশে ওড়ে
না
ঘরের এক কোনায় চুপ করে বসে
থাকে।
অথচ একদিন ছিল এই ইচ্ছেরা ওই
দূরে
ওজোনস্তর ভেদ করে সোজা
সূর্যের সামনে চলে যেত,
হাসত, গাইতো, খেলত আবার
ফিরে আসত নিজের ঘরে।
একদিন ইচ্ছেরা আকাশে উড়ছে …
এক ভয়ংকর টর্নেডো এসে দাঁড়ালো
তাদের সামনে,
ছিন্ন ভিন্ন করে দিল তাদের , রক্তাক্ত হল
তারা।
এক এক করে মাটিতে আছড়ে পড়তে
লাগলো
অনেকেই, কবরে
শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।
আর যারা ডানা ভেঙে পরে রইল
আজও নতুন ডানা গজায় নি, আর ওড়া হল
না তাদের।
ওই নীল আকাশটাকে আজ বড় ভয়,
তারা একেবারে চুপ করে থাকে
ঘরের কোনে।
কোন শিকল বা বেড়ি ছাড়াই
তারা পোশ মেনে গেছে এমনিই।
তাদের আজ আর কোন চাওয়া নেই, খিদে নেই, তেষ্টাও নেই,
তারা আজ জীবন্ত লাশ, অপেক্ষা
শুধু কবরস্থ হওয়ার…
রিয়া চক্রবর্তী
শব্দ সন্যাস
একদিন সব শেষ হয়ে যায়
সম্পর্ক শব্দের, কবিতার।
সেই শব্দগাছ আর নেই
যেখান থেকে টুপটাপ
ঝরে পড়তো শব্দেরা
মনের অলিন্দে।
সেখানে এখন শুধু নীরবতার নদী
বয়ে চলেছে পলিময় মন্থর
গতিপথে।
মাঝে মাঝে ভয়ংকর দাবানল
শুকনো গাছগুলোকে জ্বালিয়ে
নিজের আত্মাকে সতেজ করে
নিচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ক্রমশ বড় হয়
নীলরঙা কষ্টগুলো জাগিয়ে
রাখে, রাতচরা
পাখিদের মতো।
করাতের মতো তীক্ষ্ণভাবে কেটে
স্মৃতিগুলোকে মসৃন করে,
নিজের কোল পেতে নিজেকেই ঘুম
পাড়াই।
শব্দের ঝরে যাওয়া একটা
অমানবিক স্তন্যবঞ্চনার ব্যাথা,
এক বন্দীদশা, যা নীরবতায়
বুকের ওপর ভেঙে পড়া আকাশ।
তবুও কিছু অখন্ড থাকে।
জল,গাছ, পাখি, আলো, বাতাস।
একটি ক্রাচহীন, শব্দের,
সুরের ঠাসবুনোটে পশমী কবিতা
উঁকি
দেয় মাঝে মাঝে মনের শার্সিতে।
ঝলমলে সাতটা রঙের রেণুর মতো
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে।
রাত্রির শিরায় শিরায় আঘাত করে,
হারিয়ে যাওয়া শব্দদের তন্ন
তন্ন করে
খুঁজে, সকালে আলোর
দিকে ফেরা।
এভাবেই চলুক আত্মাকে জ্বালিয়ে
অন্তহীন নির্বাসিত সন্ন্যাস।
অহংকারী হুকগুলোয় ঝুলে থাকুক
রক্তাক্ত মাংস, মজ্জা, বুদ্বুদের
জীবন।
শব্দেরা যতই নিষ্ঠুর হোক, ভার্টিগোর
দুর্দান্ত শক্তিতে দূরে
হারাতে যাক;
অস্ফুট, অস্বচ্ছ, তুলতুলে, সদ্যোজাত
শিশুর মতো কবিতার আশ্রমের
খোঁজে
অনন্ত নক্ষত্র সাক্ষী থাকুক
প্রারব্ধ কর্মের।
রিয়া চক্রবর্তী
বহুগামিনী
শব্দের সৃজনে, ছন্দে, অভিমানে, অভিশাপের
অলঙ্কারে ক্ষত বিক্ষত
হতে হতে, পূর্বরাগের
খড়-কুটো
দিয়ে
সাজিয়ে নিচ্ছি আমার চিতা।
হাজারো শরের বহুগামী শয্যায়
দগদগে হয়ে ওঠে গোপন ক্ষত।
সাধ হয় আবারও ইচ্ছে ডানায়
ভর করে উড়ে যেতে সেই স্বপ্নের
পাহাড়ী গ্রামে। সেই স্বপ্নের
কুঁড়ে ঘরে।
শেষবারের মতো আগুনের আলিঙ্গনে
পুড়ে যাক যত স্বপ্ন, অভিশাপ, অপবাদ।
চিতার আগুনে শেষ মুছে যাক
কলঙ্কের দাগ। আগুন তার লেলিহান শিখায় লিখে দিক আকাশে, বাতাসে ..স্বহা ..
জ্বলে যেতে যেতে তবু তোমাকেই
খুঁজবো, তোমারই হাতে
তুলে দিতে
চাইবো আমার শেষ শয্যার
ছাইটুকু।
জেনে রেখো বহুগামী শয্যায় শেষ
প্রেমিকের নাম ছিলো আগুন।
রিয়া চক্রবর্তী
কথারা
ভেঙে যাওয়া, পচে যাওয়া, পঙ্গু হয়ে
যাওয়া ইচ্ছে, স্বপ্নগুলোকে
আজ টুকরো করবো।
.. তারপর কি করবে ওগুলো দিয়ে?
…..একটু ভাবি, ভেবে বলছি।
…..আচ্ছা বেশ ভাবো।
…. ভেবেছি ভেবেছি, ওই টুকরো
টুকরো ইচ্ছে, স্বপ্নগুলোকে
রঙের বিন্যাসে ভাগ করবো।
….তারপর।
… তারপর আমার মনের বিভিন্ন কুলুঙ্গীতে
সাজিয়ে রাখবো তাদের।
… তারপর!
…তারপর যে রং টা আমার সবথেকে প্রিয়, সেই রঙের
স্বপ্নটাকে উড়িয়ে দেবো নীল আকাশে।
তাকে কিছুতেই পঙ্গু হতে দেবো
না।
… হলো না একেবারে মিলল না কিছু
… নাইবা মিলল। আচ্ছা সব প্রেমেরই কি
মিলন হয়?
সব পরকিয়াই কি প্রেম হয়?
… বুঝেছি তারপর বল
.. তারপর স্কেল, কম্পাস, দিয়ে মেপে
আমার একটা কবর বানাবো।
যেখানে আমার আমি কে শান্তিতে
ঘুম পারিয়ে রাখবো।
রিয়া চক্রবর্তী
বসন্তের তারাখসা
এমন একটা সময়ে তুমি এসেছিলে
যখন একটা কালো অন্ধকারের মেঘ
থামিয়ে দিয়েছিলো আমার
ট্রেন।
মৃত্যুকে পিছিয়ে দিয়ে উঠে
এসেছিলাম,
বিশল্যকরণীর মতো তোমার
স্পর্শে।
তোমার জন্যই বসন্ত এসেছিলো
শুকিয়ে যাওয়া হলুদ ঘাসে।
তোমার জন্যই শিমূল, পলাশে
খেলেছিলো হাসির ঝিলিক।
রাতজাগা ক্লান্ত পাখিটা গেয়ে
উঠেছিল
সারি, ভাটিয়ালী
সুরে জীবনের গান।
ফাগুনের ফাগ লেগেছিলো
কৃষ্ণচূড়ার
কোলে, বাতাসে
মাখানো ছিলো পরাগ
মাখা স্নেহের প্রাণেরস্পন্দন।
পৃথিবীর মাতাল গন্ধে গুমোট
মেঘেও
খেলেছিলো পালতোলা পানসি।
তোমার চোখের থেকে স্বপ্ন আবীর
মেখেছিলো আমার ধুসর মন।
সাতটি রংয়ের রামধনু রং সেজে
উঠেছিল আমার চোখের আকাশে।
বারবার শত শব্দের কাঁটায়
বিদ্ধ হয়েও, ও কিছু নয়
বলে
চুপ থেকেছি, ভেঙেছি ভীষণ
ভয়ের ভঙ্গিল
ভাঙা ভাঁজ। অথচ তোমাকেই
দিয়েছিলাম এক সাগর ভালোবাসা
কবোষ্ণ বুকের তরলের মতো।
ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জীবনের টুকরো
গুলো
গোছাতে গোছাতে ভীষণ ক্লান্ত।
একদিন নিঝুম বাসন্তি রাতের
ধূমকেতুর মতো
নয়তো রাতজাগা কোনো রাতের
তারাখসার মতো,
কিংবা দাবানলে ঝলসে যাওয়া
কোনো
শুকনো পাতার মতোই ঝরে যাবো।
কোনো ডাকেই আর ফেরাতে পারবে
না।
আমার মৃত্যুর চূড়ান্ত আনন্দে, নয়তো
পৃথিবীর উতলা আবেগে জীবনের
নৌকা
ভাসাবে অচেনা কোনো নতুন
ঠিকানায়।
জানি শুধু পড়ে থাকবে অন্য
গ্রহের লাল সমুদ্রে
আমার পুরনো পৃথিবী ক্ষত
বিক্ষত, রক্তাক্ত।
ইতিহাসের পটে আঁকা বিবর্ণ
জলছবি মতোই।