বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

লিপিকা বিশ্বাস সাহা




লিপিকা বিশ্বাস সাহা
উদাস পবন ও সেগুনফুলের ঝুমকো

এক বুনো মেয়ে
সেগুনফুলের ঝুমকো কানে
শুধায় তারে -
ওরে ও উদাস পবন
এই গাছ তার পাশের গাছ
এই জুড়ে এক দীর্ঘ পথ
তারপর মাঠ
মাঠের পরে ঘাট
ঘাট পেরিয়ে ওই যে বুড়ো বট
সেথায় যে বাস রাস্তা
তার পাশে কি তোর ঘর?

না 'রে মেয়ে সেথায় নয়
ট্রেনগাড়িতে দিয়ে পাড়ি
লাইন শেষে আমার বাড়ি।

ওমা ওমা সে তো
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
শ্রাবণ শেষে  ভাদর মাসে
যখন ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে
আসিস কেন এ পরবাসে?

এ সময়ে সেগুনফুলের
বাসর সাজে গহীন বনে।
রুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নাচে
খিলখিলিয়ে রোদ্দুর হাসে
তোর ঠোঁটে যে , জানিসনে তা?
দুদিন পরে -
শরতের মেঘ ভাসে
নীল আকাশে।
যেই না বলা
ওমনি মেয়ের মুখ গোমড়া।

এসময়ে মহাজনের পানসি আসে
যুবতী গাছের কাছে।
সেগুনফুলের মধু শুষে
কাঠ করে দেয়
করাত কলের তলায় পিষে।
হড়পা বানের টানে
কে কোথায় হারিয়ে যে যায়
সব যুবতী।

এই না বলেই
বৃষ্টির জলে বুক ভিজিয়ে
দৌড় লাগালো।
কোথায় যেন মিলিয়ে গেল
ঘাট পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে
গহীন বনে অবুঝ মেয়ে
সেগুনফুলের ঝুমকো ফেলে।

কবি সেটি কুড়িয়ে নিয়ে
 রেখে দিলো বুক পকেটে
যত্ন করে।

সেই থেকে কবিকে
আর কেউ দেখেনি
কংক্রিটের বনে।
ঘোরে সে পথে পথে
সেগুনফুলের ঝুমকো সাথে
সাজাবে তারে আপন হাতে,
বুনো মেয়ে যদি ফেরে ভাদুর গানে
যখন শ্রাবণ শেষে ভাদর মাসে
ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে।

****একবিংশের কবিতা সংকলন
প্রকাশক -যুগ সাগ্নিক কলকাতা বইমেলা ২০১৬







লিপিকা বিশ্বাস সাহা
লগ্নভ্রষ্ট ..
--------------

আজ রোববারের ছুটির দিনে
আনন্দে দোদুল দোলা মন।
এক পুরুষ তার লাভা ঠোঁটে
বজ্রকঠিন শিকল হাতে
লোমশ বুকের অগ্নি তাপে
আমায় ভালোবেসেছে।
বলতে বলতে যখন ছুটছি আর ছুটছি
আমার ঘর আর ছাদ বাগানের দিকে
শুনে হেসে উঠলো রাস্তায় অপেক্ষারত এক নারী।
পথের ধারের কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো
লজ্জায় লাল হলো আরও।
ফেরিঘাট পারাপারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা
মানুষ জনকে কলকল করে বলেদিলো সব।
বট অমনি পাকুড়ের বাহুবন্ধন ছেড়ে
বলে উঠলো -'এ হবার নয়। '
রাধাচূড়া তখন কয়েকটি হলুদ ফুল
বিষণ্ণ বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে
অস্ফুটে উচ্চারণ করলো -'হায়!'
চিতাল লাজুক বুকে বাড়ছে যতই ধুকপুকানি
কানের মাঝে ততই হাজার ঢাকে
কাঠি পড়ার শব্দ শুনি -
এক পুরুষ তার শরীরের গরম ভাপে
প্রবল চাপে আমায় ভালোবেসেছে।
দে ছুট দে ছুট
আমার ঘরের দিকে ছাদ বাগানে
সিঁড়ি পেড়িয়ে ছাদের ঘরে
যেথা আছে শ্যামের সাথে রাইবিনোদিনী
শুনে তপ্ত বুকের হাপর ধ্বনি
আকাশে বাজিয়ে দিলো
সাবধানী বাঁশির বাণী।
আর তক্ষুনি সদ্য ফোটা গোলাপ রানী শুকিয়ে ঝরে গেলো
কংক্রিট ছাদবুকের মধ্যেখানে।
অখুশির মেঘের বানে
নতুন সাজানো ঘরের কোণে
বসে যখন অশনিসংকেত গুণি
কানে আসে -'ওমা খোকা সুলগ্না কি লগ্নভ্রষ্ট হবে?'

কাব্যগ্রন্থ - লগ্নভ্রষ্ট
প্রকাশক - চয়নিকা কলকাতা বইমেলা ২০১৬




লিপিকা বিশ্বাস সাহা
অনিচ্ছা

আমি সেই মেয়ে
যে রাতের স্ট্রেশনে
শ্যামের 'বসবে নাকি ' ইশারা
আগুন দৃষ্টিতে পুড়িয়ে
জেলারেল কম্পার্টমেন্টের গাদাগাদিতে
কনুইয়ের গুতো প্রতিহত করতে করতে
উচুনিচু জমি আগলাতে আগলাতে
'ঈশ্বর তুমি করুণাময়
মা একশো একুশ কোটি সন্তানেরে
স্তন্য দিয়ে ধারণ করেছো বটে' - বলতে বলতে
রোজ শিয়ালদা থেকে অশান্ত ভীড় ঠেলতে ঠেকাতে
শেষ শান্তিপুর লোকালটা ধরি।

আমি সেই মেয়ে
মেনি বিড়ালের মতো
পিটপিটে হাসি হাসি দৃষ্টিতে
'লেডিসে যান দিদি ' চোখ অবজ্ঞা করে
ট্রাউজারের নিচে  স্পর্শ সুখে
জেগে ওঠা পিষ্টনটাকে
দুমড়ে দিতে পারি প্রবল আক্রোশে
পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া হাতে।

আমি সেই মেয়ে
যাকে প্রথম বোর্ড পরীক্ষায়
অজানা  স্কুলের অচেনা ম্যাডাম
খাতা সই করতে এসে বলেছিলেন -
'কিরে তোরা কি অনেকগুলো বোন?
বুঝেছি। নামের বানান মেলাতে গিয়ে। '

আমি সেই মেয়ে
ছেলে ছেলে করে
বাবা মায়ের ইচ্ছের সহবাসে জন্মানো
'অনিচ্ছা ফসল ' পঞ্চম সন্তান মেয়ে।
ধরিত্রীর ভার আরো বেশি  করেছি
বাংলায় এম .এ করে।

আমি সেই মেয়ে
সাপের মতো বেণী
যার পিঠের 'পরে দোলে।
কালো চোখের তারায়
বজ্রপাতের আভাস পায়
ট্রেনের দরজায় ঝুলতে থাকা
আর্ট কলেজের ছেলে।

আমি সেই মেয়ে
বেডসোর হওয়া বাতিল বুড়োটাকে
ঘুমেরে ঔষুধ দিয়ে
যখন বাড়ি ফিরি মাঝরাতেতে
খড়ি হওয়া পা হিঁচড়ে হিঁচড়ে
প্রতীক্ষার প্রহর গোনে ল্যাম্পপোষ্টের তলায় ,
মানিক। আমার একমাত্র পৃথিবী
আমার ভাই।বাবা মায়ের শেষ সন্তান ছেলে।

*একবিংশের কবিতা সংকলন  (দ্বিতীয় খন্ড )
প্রকাশক-যুগ সাগ্নিক ,কলিকাতা বইমেলা ২০১৬






লিপিকা বিশ্বাস সাহা
ছিটমহল..!!!
=============
আজকাল বড় বেশী  দুঃখবিলাসী
তার সাথে আক্রোশের বীণ বাজে
 আরো  বেশী বেশী।
ছাইচাপা আগুন বুকে
নিজভূমে পরবাসী।

ইতিহাসের পাতায় পাতায়
ধূলো জমে বছর বছরক।
সুদূরে থাকা অধীশ্বরের দূরবীন চোখে
আরো মোটা হয় ছানির পরত।

তবু দিনের নিয়মে দিন যায়
বছরের নিয়মে বছর।
প্রতি ভরা শ্রাবণে মাথাভাঙ্গা হয় ঋতুমতী
তার সাথে খড়ি হওয়া গতরে
নারীর সাথে বতর ভরে গাভী।

এরপরে বসন্তে ভাটফুলগুলো
যখন হয় বাসি
মাঝরাতে ধুপধাপ বুটের হাসি
'বহুত রাত আভিভি বাকি।'
কাঁটাতারে আটকে তখন নারী আর গাভী।
কসাই এখন পোয়াতির মাসিপিসি।

সাত সকালে মাটির দাওয়ায়
শিশু রোদের হাসাহাসি।
নিকানো উঠোন জুড়ে
বাছুরের লাফালাফি।

মাথার উপর দিয়ে মেমের মতো মেঘ উড়ে যায়
রাতের সব দায় নিয়ে বাদুড়গুলো
মুখ নীচু করে ঝুলে থাকে ডালে,
নিন্দুকেরা অবশ্য অন্য কথা বলে।

স্বস্তির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বয়সী বট
ঝুরিগুলো নামিয়ে দেয় অভিজ্ঞতার জমিতে।
ন্যাংটো খোকারা চাকা চালিয়ে
ধেয়ে আসে ভেঁপুর আওয়াজে।

আর একটি কুমারী দিন আবার বয়স্ক
হতে থাকে বটের ছায়ায়।
বাকহীন অন্য পৃথিবী চলে যায়
পাশ কাটিয়ে দূরে আরো দূরে!
তবে কিছু শকুনি মাঝে মাঝে চক্কর দিয়ে যায়
কাঁটাতারের এপারের ভাগাড়ে
চামড়ায় মোড়া জীবন্ত কঙ্কালগুলোর উপরে।

কাব্যগ্রন্থ -লগ্নভ্রষ্ট ,প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০১৬






লিপিকা বিশ্বাস সাহা
ব্রেকিং নিউজ ও তুমি মানুষ
*************************

সভা সমিতিতে জ্বালাধরা বক্তৃতা শেষে

বাড়ি ফিরে দামি সাবানের নরম ফেনায়

ধুয়ে নাও সব ঘাম।

মুখোশটা ঠিকঠাক দেখে নাও

স্নানঘরের সুদৃশ্য আয়নায়।

 বিপ্নবের বীজ পোতা ক্লান্ত শরীর,

 স্নিগ্ধ সুগন্ধি নাতিশীতোষ্ণ বাতাসের আরামে

বিছিয়ে দাও সোফার তুলতুলে পেলব আবেশে।

সুবিশাল বসার ঘরের বিয়াল্লিশ ইঞ্চিতে ফুটে ওঠে,

সেই সবে সন্ধ্যা হওয়া রাতে

প্রকৃতির হাতে মাত খাওয়া

সীতার সতীত্ব ছেঁড়ে রাবণের হাতে,

একলা ফিরতে গিয়ে বাসে।

মুহূর্তে তৈরী হয় ব্রেকিং নিউজের

আগুন প্লট তোমারই মুখে।

ছুটির দিনে রসিয়ে কষিয়ে

মাংসের ঝোলে রুটিতে, বন্ধু মহলে

উচিত অনুচিতের চুলচেরা বিচারে,

চাষির রুক্ষ জমিতে প্রতিশ্রুতি- বৃষ্টি নিয়ে

যখন তুমি,

কাছাকাছি থাকা কতগুলো মানুষ

ঝলসে কষা মাংস হয়

ধর্ম -ধর্ম যুদ্ধে শত্রু -শত্রু খেলা খেলে।

আর তখন নরমপানীয়ের গরম ঢেকুরে

মানবতা মিলিয়ে যায় গলার গহ্বরে।

কিছু বেওয়ারিশ, কিছু বেজন্মা শিশু

যারা তোমার কাছে আজকের যিশু

স্থান পায় তোমারই রাষ্ট্রের অনাথ আশ্রমে।

পিঠ চাপড়ে নিজেকে বাহবা দাও

'মানুষ তুমি পারো বটে

ব্রেকিং নিউজ তোমারই হাতে।

*একবিংশের কবিতা সংকলন (দ্বিতীয় খণ্ড )
প্রকাশক -যুগ সাগ্নিক কলকাতা বইমেলা ২০১৬