সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

সম্পাদকীয়




সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বহু যুগ পূর্বেই বলে গিয়েছিলেন, বঙ্গসন্তান যৌবনে কাব্যচর্চা করবে না, এ হয় না! বঙ্গজীবনে বাঙালির কাব্যচর্চার ধারার বিবর্তন হয়েছে নানান ভাবে, যুগ পরিবর্তনের নানা পর্বে! কিন্তু পরাধীন জাতির- বৃটিশের স্কুলে প্রবেশ করে কাব্যচর্চায় ঘটে গিয়েছিল এক বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী আর কবিকৃতী যেন সমান্তরাল পদধ্বনী করে এগিয়ে চলছিল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে! হয়ত সেই কারণেই কবি জীবনানন্দ দাশকে উচ্চারণ করতে হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক সাবধানবাণী; "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি" কবি যশ প্রার্থী বাঙালি অবশ্য তাতে কান দেবার পাত্র নয়! দেয়ও নি তাই কোনোদিন!

ছাপাখানার চৌহদ্দীর সেই যুগে জীবনানন্দ কল্পনাও করে যেতে পারেন নি- আজকের লগইন অনলাইনের এই যুগের কাব্যসুনামীর প্রলয়ের বর্তমান চিত্রটি! ইনটারনেট পত্তনের আগে, পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষার সেই যুগেই কবি অস্থির হয়েছিলেন অকবির সংখ্যাধিক্যে! আর আজ তিনি জীবিত থাকলে হয়ত দমবন্ধ হয়েই মমি হয়ে যেতেন আমাদের দাপাদাপিতে! কিন্তু আমরা বাঙালিরা কাঁটাতারের কী এপারে, কী ওপারে সেকথা ভেবে দমার পাত্র নই! আমাদের অফুড়ন্ত দম! সেই দমেই দমদমাদম কবিতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে অনলাইনে! কিন্তু কি লিখছি আমরা? কেন কবিতা! কবিতাই তো? কোনটা কবিতা আর কোনটা কবিতা নয়, সেই সীমারেখাটা কি ধুয়ে যায় নি ইনটারনেটের পক্ষ বিস্তারে? কবিতা আর অকবিতার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্যের ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন কবি; ইনটারনেটে কাব্যচর্চার যুগে সে পার্থক্যের বিষয়ে আমরা কজনই বা আর খেয়াল রাখি? জীবনবোধের পরতে পরতে, অভিজ্ঞতা আর সজ্ঞান কালচেতনার যুগলবন্দীতে- সমাজ সভ্যতা ও ইতিহাস জ্ঞানের বিস্তারে; প্রাত্যহিক জীবনের পরিধিতে- শাশ্বত জীবনবোধের সুস্পষ্ট মায়াবী উদ্ভাসনের যে প্রবল সংঘটনের অন্যতম অভিমুখই হলো কবিতা; সে কথা আজকের এই লগইন সভ্যতায় কজনই বা আর অনুভব করি আমরা? কতগুলি মনের ভাবনা বা বক্তব্যের পরিস্ফূটনে আপাত অসংলগ্ন কিছু শব্দ বিন্যাসের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক ছবির উদঘাটনকেই কবিতা বলে ভুল করে বসি অধিকাংশ সময়েই!   জীবনযাপনের চর্চার মধ্যে নান্দনিক প্রত্যয় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার সম্বন্ধে দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতনতা ও দেশ আর জাতীয়তার শিকড়ের সাথে নিবিড় সংযোগ না থাকলে, যে কবিতা লেখা সম্ভব নয়, ভুলে যাই আমরা সেই মূল সত্যটাকেই! অনেক সময়! তাই বর্তমানে কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ করে অনলাইনে- মূলত শব্দ বিন্যাসের কারিকুরিকেই কাব্যচর্চা বলে ভেবে বসি! কারণ জীবনযাপনের পরিসরে আমরা সাধারণত ভাসমান কচুরীপানার মতোই জীবনের উপরিতলে ভেসে বেড়াই! ফলে কোনো গভীর জীবনবোধের সামনাসামনি হতে আগ্রহী হই না আমরা!সেখানেই আমাদের কাব্যচর্চার পরিসর জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে! আর জীবন বিচ্ছিন্ন লেখা কখনোই হয়ে ওঠে না কবিতা!

জীবনবোধের অগভীর তল থেকে এই যে আমাদের প্রাত্যহিকতা, এই কারণেই সমস্ত কিছুর সাথেই আমদের সংলগ্নতা বড়োই আলগা হয়ে পড়ছে ক্রমশ! ক্রমশই আমরা নিজেদের জীবন প্রক্রিয়ার চারপাশে কখনো তৃপ্তি কখনো বা অতৃপ্তির আত্মগত একটি সংকীর্ণ বলয় তৈরী করে ফেলছি! যার মধ্যে থেকে সমগ্র জীবনবোধের গভীরে পৌঁছাতে পারছি না আমরা কিছুতেই! হারিয়ে ফেলছি বৃহৎ মানবজীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিজীবনের মূল প্রেক্ষিতটাকেই! আর ঠিক সেই কারণেই বিস্তৃতভাবে বাংলা কাব্যচর্চা আজ আর ঠিক সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে উঠতে পারছে না! হয়ে উঠতে পারছে না আমাদের জীবনযাপনেরই মূল অনুষঙ্গ! আর ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই কবিতা উৎসবের আত্মপ্রকাশ অন্তর্জালের বিস্তৃত পরিসরে। প্রতিদিনের জীবন যাপনের চৌহদ্দিতেই মহাজীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিজীবনের  উদ্বোধনে কবিতার এই বিশেষ ভুমিকা ও অনন্ত সম্ভাবনাকেই সারথী করে। কবিতা উৎসব শুধুমাত্র কবিতার জন্যে কবিদের মাসিকপত্র। কেবলমাত্র শব্দের কারিকুরি নয়, কেবলমাত্র প্রকরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা নয়, নয় অলস সময়ের ছান্দসিক উদযাপন। কবিতা উৎসব বস্তুত জীবনেরই উদ্বোধন। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও বরেণ্য সাহিত্যকর্মী সর্বজনশ্রদ্ধেয়  শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের অতিথি সম্পাদনায় প্রকাশিত কবিতা উৎসবের  আত্মপ্রকাশ সংখ্যাটির মতোই এই সংখ্যাতেও আমরা প্রত্যেক কবির ন্যূনতম পাঁচটি করে কবিতা পাঠকের দরবারে হাজির করেছি। এর একটিই কারণ, পরপর পাঁচটি কবিতার সম্মিলিত ক্যানভাসে পাঠক তার প্রিয় কবির প্রিয় কবিতায় কবির আত্মগত ভুবনের দিগন্তকে অনুভব করতে পারবেন অনেক সহজে। সাধারণ ভাবে প্রচলিত ধারায় অন্যান্য পত্রপত্রিকায় মাত্র একটি করে কবিতা পাঠে যে কাজ সহজসাধ্য নয়। তাই আমরা একটি সমগ্রতার ছোঁয়া দিতেই অন্তর্জাল ভুবনে এই প্রথমবারের মতো এই ধারাটির প্রচলনে প্রয়াসী হয়েছি। আমাদের আশা দ্রুতই আমাদের এই ধারাটি সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।  কবিতা উৎসবের পক্ষ থেকে সকল কাব্যপ্রেমী বঙ্গজ সুহৃদসুজনকেই শতাধিক কবিতায় মুখরিত উৎসব প্রাঙ্গনে সাদর আমন্ত্রণ!